আজ এক আজব সমস্যা নিয়ে একজন রোগী এসেছে ডঃ সেন- এর কাছে। রোগী মানে ঐ ভদ্রলোক- এর বয়স চল্লিশ – বেয়াল্লিশ। ভদ্রলোক এর বক্তব্য, প্রায়শই ওনার বুকের ভেতরটা নাকি ভীষণ খালি খালি লাগে। ডঃ জয়ন্ত সেন এক সম্ভ্রান্ত অঞ্চলের এক অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হার্ট বিশেষজ্ঞ । সকালবেলা উঠে নিয়মমাফিক দুটো নার্সিংহোম এবং একটা হসপিটাল এর ভিজিট সেরে বাড়ি ফিরতে বেলা প্রায় আড়াইটে তিনটে । এরপর বিকেল চারটে থেকে পার্সোনাল চেম্বার। রাত এগারোটা অবধি । বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় বারোটা। দুপুরে বাড়ির টেবিলে বিভিন্ন পোরসেলিন-এর পাত্রে ঢাকা দেওয়া থাকে ওনার জন্য নানান রকমের খাবার । খাবারের ব্যাপারে বিশেষ সচেতন জয়ন্ত বাবু । প্রতিদিন খাবারে পরিমাণ মতো স্যালাড এবং টক দই থাকবেই । জয়ন্ত বাবুর স্ত্রী বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত , আর ওনাদের একমাত্র মেয়ে, মৃত্তিকা – সোসিওলজি নিয়ে মাস্টার্স করছে । যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত । কারোরই সময় নেই দু’দন্ড বসার অথবা নিজেদের মধ্যে গল্প করার । তবে এ নিয়ে কারোর মনে কোন খেদ নেই । ডঃ সেন -এর উপার্জনের জোয়ার ঢেকে দেয় অন্যান্য ছোট বড় পাওয়া – না পাওয়াকে । মিসেস সেন একাধিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থান অলংকৃত করে রেখেছেন । অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা, মানুষকে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভীতকে অনেক জোড়ালো করে ।
সে যাই হোক, ডঃ সেন আর একটু গভীরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন, কবে থেকে এই সমস্যা হচ্ছে ? রাতের ঘুম, বিশেষ কোন পারিবারিক সমস্যা, গ্যাস, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি ইত্যাদি। না, বিশেষ কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না । ডক্টর সেন এর আগে এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি কোনদিনও হননি । কোন কিছু থেকেই বোঝা যাচ্ছে না যে, রোগটা আসলে কি । তাহলে কি এটা হার্ট সংক্রান্ত সমস্যা আদৌ নয় !!
সামান্য সময়ের বিরতি নিয়ে, ডক্টর সেন ভদ্রলোককে বললেন, আচ্ছা আপনি বরং আপনার কথা বলুন, আমি শুনি, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি । ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন, আমি বেশ কিছুদিন হলো লক্ষ্য করছি যে, আমার কোন বন্ধু আমাকে ফোন করে না ; না সে অর্থে আমিও করি না । কিন্তু আমার কাছে প্রতিদিন বেশ কিছু ফোন আসে, সবই আমার অফিসের, কোন না কোন কাজ সংক্রান্ত । এছাড়াও খান কয়েক ফোন আসে, কোনটা বা ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার জন্য বা ক্রেডিট কার্ড অথবা কোন প্রপার্টি কেনার । আগে জানেন, আমরা বন্ধুরা, কারণ ছাড়াই দেখা করতাম, কারণ ছাড়াই হাসতাম । এরপর একটা সময় অব্দি, কোন একটা কারণ খুঁজে বার করতাম, দেখা করার জন্য । কিন্তু আজকাল কেউ আর কারণ খুঁজি না, দেখাও করিনা, ফোনও না । তবে হ্যাঁ আমাদের একটা হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপ আছে । একদিন সকালে আমার এক বন্ধু সুজয় লিখলে, লুকোচুরি খেলতাম সবাই মিলে, কেউ লুকাতো – কেউ খুঁজতো । হঠাৎ একদিন বন্ধুরা লুকিয়ে গেল, আর খুঁজে পেলাম না, বুঝলাম বড় হয়ে গেছি । এরপর থেকেই ক্রমশ অনুভব করতে শুরু করলাম, আমি যেন কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না । তারপর থেকেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগে । স্টেথোস্কোপ হাতে ডক্টর জয়ন্ত সেন অসহায়ের মতন তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোকের দিকে, মুহূর্তে মনে হলো যেন ওনার নিজের বুকটাও যেন কিরকম খালি খালি হয়ে যাচ্ছে।
ছবি :অভিজ্ঞান দাশগুপ্ত