বহিরাগত
আমি যে শহরে থাকি
ফেলে আসা গ্রামের সেখানে কোনো চিহ্ন নাই
জনবিচ্ছিন্ন তামাম অ্যাপার্টমেন্টে আমি খুঁজি
খড়ের চাউনি, ছইঞ্চা
শহরের আলপথে অনেকটা হেঁটে গিয়ে
খুঁজে ফিরি চট পেতে অ-আ ভোরের শিউলি
অচেনা মিছিলে সবগুলো মুখই যেন
শ্রাবণমেঘের মতো চেনা—স্বপ্নময়
মনে হয় একটা বটগাছ পেলে চড়ে বসা যেত
দেখা যেত পাতার সড়ক গলে
ঝিকিমিকি রোদেদের ইছামতি
বটের ঝুরিতে মুখোমুখি দোলনার নাগরিক কার্নিভাল
গ্রীষ্মের দীর্ঘতম দিনে
পুকুরের পাশে বসার টঙ খুঁজি পার্কের বেঞ্চিতে
বাতাস খুঁজে ফিরি খিদের বাজারে, ভিস্তায়
কুব-কুব-কুব-কুব পাখির ডাক খুঁজি
সংবিধানে, ছাদের মালঞ্চে
স্পর্শের মতো ফকফকা জ্যোৎস্না খুঁজি হলুদ আলোয়
সাইরেনে খুঁজে ফিরি বাঁকরত রঙিন মোরগ
আকাশ ধরব বলে চুপিচুপি হেঁটে যাই আকণ্ঠ শৈশবে
আকাশ এখনও ঝুঁকে আছে ঐখানে যমুনাদির ঘরে
হারানো বকুল খুঁজি পিৎজায়, সেঙ্গোলে
ফ্লিপকার্টে খুঁজে মরি ব্যালকনি, বাপুজিনগর
ধুলোয় শিশির খুঁজি পাথরে সংহিতা
বুটের ভেতরে খুঁজি শ্রাবণকৃষকের মুঠি
শব্দে নৈশব্দ খুঁজি—চতুর্দিকে জেনোফোবিক
অসহিষ্ণু কসাই
খুঁজে পাওয়া যায় না কিছুই
শহরে সবই হারায়, সবাই হারায়
স্পর্ধার মতো লালনিশান খুঁজি তবু
বাণিজ্যিক উপত্যকায়
ছবি: চিত্রদীপ দাশ
দখল
যে আয়না ফুটিয়ে তুলত
তোমার ভুবন
যে নদীতে শিখেছিলে সাঁতার
যে সমুদ্রে অবগাহন
যে হৃদয়ে খড়কুটো দিয়ে
বুনেছিলে পাতার সংসার
যে মাঠে গন্ধছড়িয়ে খেলা করত
বেগুনবিচি ধান
কার হাতে সেসব এখন
কার হাতে তোমার বাগান
গাছগুলো কাকে দেয় ফল
জামবনে সাঁঝের জোনাকি
পেকে ওঠা জমির ফসল
জ্যোৎস্নার মতো বরফ ভেজানো
পদ্মার দিঘল ইলিশ
থোকা থোকা স্বপ্নগুলি
বেবাক দখল—শান্তগহীন জল
খেলা করে আজনবি ছায়া
ছবি: অদ্রীশ সিংহ
মেঘ
হামেশাই বলতেন : ‘কী হালে যে মৃত্যু হবে’
বাতাসে উড়ত ছাই
হিজাব বা বোরখা কিছুই পরতেন না
আম্মার খোলা চুলে খেলা করতো চৈত্রমাস
আব্বা বলতেন : ‘দোয়া করিস
যেদিকে তাকাই
মাঠভরা চকচক…চকচক…
কেবল চকচকে শ্রাবণ দেখার জন্য
আরও কিছুদিন থেকে যেতে চাই’
ধবধবে সাদা সাজে
আব্বাকে দেখাতো ফেরেশতার মতো
তুমুল ঝড়ে মাটি আলগা হয়
কা কা শব্দে মৃত্যু ওড়ে
কাকপাখির মতো দীর্ঘশ্বাস
চেপে বসে অবলুপ্ত খানকাঘরে
জলের অক্ষরগুলি জমির উপরে ফোটে
বৃষ্টি হয়, বৃষ্টির ভেতরে
শত শত গর্ভবতী মেঘ ঝরে পড়ে
ছবি: চিত্রদীপ দাশ
ঘোড়া
আপনি আমার কেউ নন বাংলাদেশ
হে মহাভারত তুমিও আমার কেউ নও
সাঁইজি তু্ই মেঘ না মরুভূমি
জানা নেই তাই
তু্ইও আমার কেউ হতে পারলি নে
শুনুন মশাই
আমার ঘোড়াই সব থেকে তেজি
আমি স্বধর্ম করি তবে
অন্যের ঘরে আগুন না দিয়ে মজা পাই না
গাছ ফুল পশু পাখি চন্দ্র সূর্য…
কয়লাখাদান বালিয়াড়ি সাদাকাপড়…
গেরুয়াবসন গণভবন…
নদী সমুদ্র সিংহাসন…
চাকরিবাকরি হিংসা ক্রোধ লোভ…
অলি গলি গীতাঞ্জলি…
গোলাবারুদ ঢেঁকি কেউ স্বর্গে যাবে না
আমি ও আমার ঘোড়া অবশ্যই স্বর্গে যাবো
ছবি: অদ্রীশ সিংহ
গন্ধ
কেউ যদি না বোঝে ?
না বুঝুক
একদিন কেউ না কেউ বুঝবে এই আশায়
ঝিনুকের ঘরে আগুনরাঙা স্বপ্নগুলো
রেখে যেতে হবে
শোকের মতো
দীর্ঘতম কোনো রজনীগন্ধা নেই
কী যে বলো যা তা !
কেউ যদি না খোঁজে ?
না খুঁজুক
গন্ধে গন্ধে তবু এই মহাগ্রহে
একদিন কেউ উপশমগুলি খুঁজে পাবে
এই সংকেতে
কমলালেবুর মতো অ্যালিগরি
জমা হতে থাকে উভচর অযোধ্যানগরে
ভালোবাসার মতো
দীর্ঘতম কোনো রাজনীতি নেই
ছবি: চিত্রদীপ দাশ
টব
একমাত্র সমুদ্র—ছেড়ে গেছে সেও
একমাত্র নদী সেও গেছে মায়ের সঙ্গে
আমি একা ফ্ল্যাটবন্দি, ঘেয়ো
আমি গেলে গাছে পানি দেবে কে ?
আমার কোনো জন্মে কেউ ছিল নাকো
আমার বাঁচামরায় শতজন্মের কালো
সম্পর্কের শেষে দেখি ভাঙা এক সাঁকো
হঠাৎ বাঘের মতো সামনে দাঁড়ালো
যা—পাখি হ…স্—যা—পাখি হু…স্—
অলিন্দে জলের বাটি পড়ে আছে অপেক্ষায়
জল-ক্ষেতে আসে না মৌটুস
মাঝে মাঝে ফোন করে জলশূন্য ঢেউ :
—আমি বেঁচে আছি কি না ?
—প্রেসারের ওষুধ খেয়েছি কি না ? স্নান ?
শেকড়গুলি নিজেদেরই পেঁচিয়ে ধরেছে
মৃত্যুগন্ধে ভরে আছে টবের বাগান
ছবি: অদ্রীশ সিংহ