অঞ্জন সেনগুপ্ত

অঞ্জন সেনগুপ্ত

জন্ম ১৪ মার্চ ১৯৫১। বোলপুর। বীরভূম। ভারত। পৈতৃক ভিটে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার দুলালি গ্রামে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ, বি-এড। দীর্ঘদিন লেখালেখি করেও সেভাবে পরিচিতি ঘটেনি। এখন অবশ্য বিশিষ্ট গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে । বিভিন্ন ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকা, রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, শারদ সানন্দা প্রভৃতি পত্রিকায় গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। আনন্দমেলায় শিশুদের জন্য 'বিড়ালের থাবা'র মতো অসামান্য ভূতের গল্প লিখেছেন। আপাতত গ্রন্থসংখ্যা তিরিশ! ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, নাটক, প্রবন্ধনিবন্ধ, গণসংগীত সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই কলম চালিয়েছেন। ভাঙনের শব্দ, জলপাহাড়, ভূমিতল, গৌড়েশ্বর, সংশোধনাগর থেকে বলছি, বনজোছনায় জারোয়ারা প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কালজয়ী 'টোপ' গল্পের মতো অঞ্জন সেনগুপ্তের টোপ গল্পটিও একটি অসাধারণ গল্প। মিথআশ্রিত 'ধনকুদরা' বাংলা গল্প সাহিত্যের ধারায় এক নতুন সংযোজন। মালদা জেলায় কেটেছে জীবনের সিংহভাগ। রাষ্ট্রীয় সাধারণ বীমাশিল্পে উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। বর্তমানে থিতু হয়েছেন লেকগার্ডেন্স, কলকাতায়

-গাবৌ-গাব

সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবি

-“ভাইয়া,জারা সিধা হোকে খাঁড়া রহিয়ে।“

-“ম্যায় কেয়া করু!”

-“ইয়ে জেনানাকা মামলা হ্যাঁয়।“

-“তো, ম্যায়নে কেয়া করু?”

-“জেনানাকা ইজ্জৎকা সওয়াল হ্যাঁয়। অব সমঝে কেয়া?”

-“আরে বহেনজি, ইজ্জৎ তো মরদকা ভি হ্যাঁয়। আরে হ্যাঁয় কি নহি সবনে বাতাও।”

সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবিএমন কথায় যারা সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়ল তারা সংখ্যায় বেশি। এই ভিড়ে সত্যিই পুরুষদের থেকে মেয়েরা সংখ্যায় কম। এমন নিরুদ্ধেশ যাত্রায় সাধারণত তাদের খুব একটা নেওয়া হয় না। কিছুটা হেয় চোখেই মেয়েদের দেখা হয়ে থাকে! তাদের জায়গা বাড়িতে। সন্তানের জন্ম দেও আর বিগলিত করুণায় শুভ্র ফেননিভ জলরাশির মতো দুগদ্ধ দিয়ে যাও। বৈ্দিক যুগ থেকে বা তারো আগে সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে অথবা বিরাট রাজার বিশাল গোশালার সময় থেকেই তাদের কাজটা একেবারে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। আজো তাই রয়ে গেছে। ন যযৌ ন তস্থৌ!

গাড়িটা যত জোরে ছুটছে ততই গাড়ির ভিতরে একে অপরের সাথে ঠোকাঠুকিটা বেশি হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে না এই অজুহাতে পুরুষেরা ইচ্ছে করে মেয়েদের শরীরে ঢোলে পড়ছে কিনা! আসলে রাস্তাটা এতই খারাপ যে ভদ্রভাবে দাঁড়িয়ে থাকে কার সাধ্য।

সংখ্য্যায় মাত্র তিনটি মেয়ে। মেয়ে না বলে মহিলা বলাই ভাল। বয়সও একেবারে কম নয়! কর্মক্ষমতা যে একেবারে শেষ সীমায় এসে ঠেকেছে তা বলাই বাহুল্য। তবু মেয়ে তো! বয়স যতই হোক সম্ভ্রমটা তো খোয়া যায়নি! কাজেই আজো তারা যতটা পারে পুরুষের ছোঁয়া বাঁচিয়েই চলে। অন্তত যুবতীদের মতো অমন ঢলাঢলি পছন্দ করে না।

গাড়ির চাকাটা হঠাৎ একটা গাড্ডার মধ্যে পড়ায় গাড়ির মধ্যে নারী-পুরুষের ভেদাভেদটা একেবারে তালগোল পাকিয়ে গেল। ঘাড়টায় বেশ লেগেছে। পাশের হুমদো পুরুষটা একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে গায়ের উপর। যেন জীবনে কোনদিন মেয়ে দেখেনি! ঘাড়টাকে একবার দুদিকে ঘুড়িয়ে ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টা করে। পাশে দাঁড়ান একজন মহিলা বলে,”বহত ঝটকা লাগা?”

যার লেগেছে তার নাম সুনয়নী। একেবারে পটলচেরা চোখ। আজো তেমনটাই আছে, তবে মুখমন্ডলের চামড়া একেবারেই কুঁচকে গেছে। ঐযে বয়সকালে যা হয় আরকি! তবু আজো পুরুষেরা আড় চোখে মাঝে মাঝেই তাকাতে ভুল করে না। কিন্তু ওদের অমন হ্যাংলাপনা সুনয়নীর একেবারেই পছন্দ নয়। গাড়ির মধ্যে এমন ঝাঁকুনিতে পেছন থেকে কোন এক অচেনা গলা ড্রাইভারের উদ্দেশে একটা চার অক্ষরের খিস্তি ছুঁড়ে দেয়। খিস্তিটা এতটাই কাঁচা ছিল যে ড্রাইভার আর তার রাগ সামলাতে না পেরে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক চেপে ধরে এবং গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। সে রাগে চোখ লাল করে বলে,”কৌন খিস্তি মারা? ঘরমে তেরা মা-বহিন হ্যাঁয় কি নহি? আবে নিকম্মা বয়েল, ইয়ে সড়ক তেরা বাপনে বানায়া হোতা তো আচ্ছা হোতা। লেকিন ইয়ে তো নহি হুয়ি। উসি লিয়ে ইতনে দিক্কত সহন পড়তা।“ ড্রাইভার আরো কিছু মোক্ষম গালাগাল দেবে ভেবেছিল কিন্তু এইসব মাথা মোটাদের সাথে কথা বললে এরা কিছুই বুঝতে পারবে না। আর এটাই হচ্ছে মুশকিল!

।।দুই।।

গাড়ির মধ্যে যারা আছে তারা যে সবাই একে অপরের কথা বুঝতে পারছে, তা নয়! কারণ কেউ এসেছে হরিয়ানা থেকে,আবার কেউ এসেছে রাজস্থানের কোন এক অজ গাঁও থেকে। কেউ আবার পাঞ্জাব বা বিহারের কোন মহাজনের ঘর থেকে। কাজেই ভাষার ইতরবিশেষ তো হবেই। হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকেই কে যেন বলে ওঠে,”মা,আমরা কবে থেকি যেন চলতেছি?”

মেয়ের কথায় মায়ের হুস ফেরে। সে ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েকে দেখে যাত্রার তারিখটা মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কিছুই মনে পড়ে না। বরং সবটাই তালগোল পাকিয়ে যায়। কবে যে ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়েছিল,কোথায় চলেছে, আর কবেই বা পৌছাবে তা সে কিছুই জানে না। এমন নিরুদ্দেশে যাত্রার খবর আগে কেউ তাকে দেয়নি। তবে আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠে ঘুরে বেড়ানোর সময় কানাঘুসায় শুনেছিল দলের অনেকেই নাকি মাঝে মাঝে এভাবেই হারিয়ে যায়! যেহেতু যে যায় সেতো আর ফিরে আসে না! কাজেই বাকিদের এসব ঘটনার পরম্পরার গল্প আর শোনাও হয় না। তাহলে তারাও কি আজ অনেকের মতোই হরিয়ে যাচ্ছে! তারা কি দিকশূন্যপুরের উদ্দেশে চলেছে! মাকে এভাবে অনেক্ষণ ধরে নিরুত্তর থাকতে দেখে মেয়ে আবার বলে,”ও মা,তুমি কইলা নাতো আমরা কনে চলতেছি।“

অনেকেই মেয়েটির মুখের ভাষা শুনে অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে। মা যে ব্যাপারটা বোঝেনি তা নয়! ওরা যে গ্রাম থেকে এসেছে সেখানে প্রায় সবাই হিন্দি বা ভোজপুরি ভাষায় কথা বলে। ঐ ভাষা মা যতটুকু বোঝে মেয়ে তাও বোঝে না। আসলে মালিকেরা সবাই বাড়িতে একেবারে বাঙাল ভাষায় কথা বলে। কারণ তারা এই বাড়িটিকে বাংলা দেশের এক বাঙালের সাথে পাল্টাপাল্টি করে নিয়েছে। আর তাই আজো তারা দেশের ভাষা ছাড়তে পারেনি। মেয়েটাও সব সময় মালিকের ছোট ছেলের সাথে থাকার জন্য ওদের মুখের ভাষাটাই রপ্ত করে নিয়েছে।

-“কইতে পারুম না কনে চলতেছি! এ চলার তো দ্যাখতেছি কোন বিরাম নাই! আমরা যে সেই কবে চাট্টা খাইছিলাম, তাকি কাউর খেয়াল আছে? লিশ্চয়ই নাই।“ মা তার মাথা নাড়তে থাকে। একটা শব্দ হয়। ওকে ওভাবে মাথা নাড়তে দেখে বাকিরাও একসাথে জোরে জোরে তাদের মাথা নাড়তে থাকে। আর চারদিকে তার বড় কানের ফটফট শব্দটা নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গাড়ি তার আপন মনেই চলতে থাকে। শুধু একবার ব্যাপারটা দেখার জন্য ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়।

গাড়ির মধ্যে যারা আছে তারা একে অপরের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সকলের মুখই রয়েছে রাস্তার দিকে। গাড়ির গতির সাথে আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তরগুলো দ্রূত ছুটে চলেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এদিকে বেশ বর্ষা হয়েছে। চারদিকে হরিতের সমারোহ। এমন দৃশ্য দেখে সকলের মুখের মধ্যেই বর্ষার জলের মতো লালা টলটল করে ওঠে! গলাটাকে একটু উঁচু করে সকলেই একবার করে ঢোক গিলে নেয়। ধীরে ধীরে সন্ধার আস্তরণ গাঢ় হতে থাকলে হরিত ক্ষেতগুলোও ক্রমশই দূরে সরে যেতে যেতে একসময় সবটাই অন্ধকারে ডুবে যায়! অথচ সবার চোখে লেগে থাকে সুস্বাদু খাবারের দৃশ্যপট!

।।তিন।।

সন্ধার পর থেকেই আকাশে হিম জমে। এক সময় ওরা নিজেদের ভার ধরে রাখতে না পেরে টুপ টাপ নিচে খসে পড়ে। আর তাই ভোরের হাল্কা আস্তরণের মধ্যে গাড়িটা যখন একটা বিশাল প্রান্তরে এসে দাঁড়িয়ে যায় তখনও গাড়ির মধ্যে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা সবার চোখেই ঘুম জড়িয়ে রয়েছে। চোখ খুলতেই বাইরের সতেজ হিমেল হাওয়াটা সবার চোখেই মৃদু ঝাপটা মারে। একে একে গাড়ির পেছনে লাগিয়ে দেওয়া একটা পাটাতনের উপরে খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে সবাই নিচে নেমে শরীরের আড়মোড়া ভাঙে। পাগুলোকে ঝেরে নেয়। চারদিকে তাকিয়ে দেখে বিচ্ছিন্নভাবে আরো অনেকেগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আর তার সামনে ওদের মতো অনেকেই জটলা করছে। এই বিস্তৃর্ণ প্রান্তরের পরেই রয়েছে ঘন সবুজ লকলকে সব সুখাদ্যের ক্ষেত। দেখলেই জিভে জল আসে! মেয়ে ভাবে সে একবার মাকে জিজ্ঞাসা করে এক ছুটে যাবে নাকি ঐ পানে। চারদিকে সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবিতেমন কোন লোকজন নেই। কাজেই কেই বা তাদের খেয়াল করবে। মায়ের দিকে এক ঝলক তাকাতেই দেখে মাও তাঁর ডাগর চোখ দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে ওদিকেই তাকিয়ে আছে। এবং অদ্ভুত ভাবে মায়ের মুখের দুই প্রান্ত থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটি তার মায়ের মনের কথা টের পেয়ে নিজের মনের ইচ্ছেটা বলে ফেলে। মাও এক কথাতেই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু যাবে কীভাবে! মায়ের সাথে তো আর এক আন্টি দিব্বি কন্ঠলগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গেলে দু’জনকেই যেতে হবে। তাই মায়ের আর যাওয়া হল না। মা পা ভেঙে বসতে চাইলে আন্টিকেও সাথে সাথে বসতে হল। মেয়েটি চারদিকে তাকিয়ে দেখল শুধু সেই একমাত্র মুক্ত! বাকিরা একে অপরের সাথে বাঁধা। মেয়েটি তার জুলজুল চোখে চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে শরীরে যত শক্তি রয়েছে তা দিয়ে ভীষণ জোরে ছুটতে ছুটতে ঐ হরিত শস্য ক্ষেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সামনে যা পায় তাই গোগ্রাসে গিলতে থাকে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই অনেকে রে-রে করে ছুটে এসে ওকে জাপটে ধরে নিজেদের কোলে তুলে নিয়ে একেবারে মায়ের কন্ঠলগ্ন করে মাটিতে শুইয়ে দেয়। মেয়েটি মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,” মা,কিছুটা খাইতে পারছি। আঃ!কী যে মিঠা সোয়াদ।“

-“বেশি কইরা খাইতে পারলি না?” মা জানতে চাইল।

-“অরা পিছে পিছেই আইতেছিল। তাই কিছুটা খাইতেই আমারে জাপটাইয়া কোলে তুইলা নিছে। অগো সাথে কি আমি পারি! আর কিছুটা সময় পাইলেই আমার পেট ভইরা যাইত। আচ্ছা মা, যারা আমাগো আইনলো তারা খাতি দিবেনা?

-“আরে বাবা যা শুইনলাম তাতে খাতি দেওয়া তো দূরের কথা আমাগো নাকি পগার পার কইরবে। কে যে কুথায় যাবে তার ঠিক নাই! কিন্তু আমার চিন্তা তোরে নিয়া। তুই হলি আমার শেষ নাড়ি ছেঁড়া মাইয়া। তোরে ছাড়া বাঁচি ক্যামনে বল!” চোখের কোণা দিয়ে জল পড়ার মতো জলও আজ মায়ের চোখে অবশিষ্ট নেই!

।।চার।।

দু’দিন পরে এই প্রথম পেটে কিছু খাবার পড়ল। তাও ভাল কিছু নয়। সামান্য কিছু কলা পাতা মাত্র। এখানে তো আর নেই এক বালতি ভাতের ফ্যান,গুড় মাখানো তুষ,বড় বড় লাউয়ের টুকরো,বাহারি সবজির চোকলা বা নিদেনপক্ষে এক জাবনা খড়। তবে যে মালিকই যত খাবারই দিক না কেন লকলকে ঘাসের কাছে সবই তুচ্ছ। হয়তো এসব কথা ভাবতে ভাবতেই সব্বাই কলা গাছের মাথায় ঝুলে থাকা পাতাগুলো গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছে। সবার পেটেই এখন আগুনের মতো খিদা। তাই বাদ বিচারের কোন প্রশ্নই নেই।

পাট গাছের বিশাল পাথার। তার মধ্যেই এতক্ষণ যারা কলাপাতা খাচ্ছিল এবার তাদের এক এক করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মা-মেয়ে দু’জনের চোখেই অপার বিস্ময়! শেষে আর নিজেকে চেপে রাখতে না পেরে ছোট মেয়েটি বলেই ফেলে,”ও মা,এরা যায় কনে? ওদিক পানে কি ভালো খাবার আছে?”

-“জানি নারে মা। আমিও তো এই পত্থম দেখতেছি!”

-“অরা কি আমাগোও নিয়া যাবে মা? নাকি আমরা থাকুম। আন্টিকো তো নিয়া গেল!”

এমন প্রশ্নের কোন উওর নেই মায়ের কাছে। সেও একটু অবাক হয়েই এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। কিন্তু সবাইকে চিনতে পারল না। ওরা সবাই মাথা নিচু করে এখনও পাতা খেতেই ব্যস্ত। মা ভাবল তার গলার সাথে আর একজন যে বাঁধা ছিল তাকে নিয়ে যাওয়ায় সেও এখন একেবারে মুক্ত। তাহলে সেকি তার মেয়েকে নিয়ে উর্ধশ্বাসে যে কোন দিকে ছুটতে শুরু করবে! ছুটতে ছুটতে সামনে যে গ্রাম পাবে সেখানে না হয় কারোর গোয়ালে দিব্বি সিঁধিয়ে যাবে। এতে অবশ্য গোয়ালের মালিকেরই লাভ হবে। সাথে একটা বকনা বাছুর মাগনা পেয়ে যাবে। হঠাৎ দেখে পাশে তার মেয়েটা নেই। আর সাথে সাথে সেই লোকগুলো তার মেয়ে আর তাকে ধরে নিয়ে গেল একেবারে নদীর পাড়ে। এত বড় যে দরিয়া হতে পারে তা এর আগে সে কোনদিন দেখেনি! সাথে সাথে মেয়ে চিৎকার করে বলে,”মা ওই দেখতেছ আন্টি কেমন হেলতেছে। আমারাও কি জলে হেলব মা?”

-“হ। তাইতো দেখতেছি!”

সবার শরীরেই তিন টুকরো কলা গাছ বাঁধা। সামনেরটায় যূপ কাষ্ঠের মতো গলার নিচে দিয়ে রাখতে হয়। আর বাকি টুকরোদুটো শরীরের দু’প্রান্তে বাঁধা। এতে কেউই ডুবে যাবেনা। সাথে নৌকা করে দুটো লোক সবাইকে খেদিয়ে নিয়ে চলেছে ওপারের উদ্দেশে। মা একবার তারস্বরে মেয়েকে ডাকল। একটু দূর থেকে মেয়ে সামান্য সারা দিল। অথচ মা তাকে দেখতে পেলনা!

সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবি এমন বিশাল দরিয়ার বড় বড় ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে সবার মাথায়। প্রয়োজনের থেকেও অধিক জল বাধ্য হয়েই সকলে গিলে নিচ্ছে। ধীরে ধীরে ওপারটা ক্রমশই এগিয়ে আসছে। একসময় মাও পৌছে গেল ওপারে। কিন্তু নাড়ি ছেঁড়া মেয়েটা কৈ! মা যতই তার মেয়েকে খোঁজে ততই লোকে তাকে টানতে থাকে। একে একে সবাই ডাঙায় উঠে দাঁড়ায়। মা তারস্বরে মেয়েকে ডাকে। দূরে দেখে শুধু একটাই ভেলা জলের উপর দোল খাচ্ছে। পাশ থেকে একজন বলে ওঠে,”আহারে! অতটুকু বকনা কি আর পদ্মা হেলতে পারে! তাই তো সে আর–। জিন্দা থাইকলে হামিই অরে পাইলতাম। বড় কইরতাম । মাইয়াটা কবে থেকি একটা বকনা পাইলতে চাইছিল !”

মা বুঝতে পারেনা এই মুহূর্তে তার চোখে পদ্মার জল,নাকি নিজের চোখের জল একাকার হয়ে গিয়েছে!

ছবির সংরচনা ড্যাল-ই-এর মাধ্যমে এবং প্রোক্রিয়েট দিয়ে স্কেচ করেছেন সৌরভ রায়চৌধুরী

আরো পড়ুন-গাবৌ-গাব

একেবারে ফ্রেস স্যার

চিত্রদীপ দাশের ছবি

চিত্রদীপ দাশের ছবি “ স্যার, বিশ্বাস করুন এর কমে দেওয়া যায় না ।“

“ তা বলে পুরো পাঁচ !”

“ স্যার,আমি তো পাঁচ পঁচিশ ছাড়া মাল হাতছাড়া করি না। আপনারা নেহাত ভদ্রলোক তাই-“

“ ঠিক বুঝলাম না ! ভদ্রলোক ছাড়া কেউ আসে নাকি !”

“ কি যে বলেন স্যার,ছয় মাস রেখে গতরে মাংস সমেত হাত ছাড়া করতে পারলেই কমপক্ষে দুই বেশি পাওয়া যাবে । তাছাড়া মালটা একেবারে ফ্রেস স্যার ।কোন প্যাঁন্দা মাল নয়কো ।“

“ ফ্রেস মানে !একি মাছ-মাংস নাকি যে বাসি হবে !”

“ ফ্রেস মানে স্যার কোন গন্ডগোল নেই ।একেবারে সৎ বংশ,বুদ্ধিমানের ঔরসজাত খাঁটি সোনা । আপনি অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন বলেই আমি একেবারে বেছে রেখেছিলাম ।এখনো কতজনই তো ছোঁক-ছোঁক করছে ।আপনারা না বললেই বাকিরা একেবারে শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে ।“

“ কিন্তু একবার না দেখেই বা কীভাবে তোমাকে হ্যাঁ বলি ।তাই বলছিলাম –“

“ আপনি কী এখনই নেবেন ?”

“ এই মুহূর্তে কীভাবে সম্ভব ।আমরা তো প্রিপারেশন নিয়ে আসিনি ।আমাদের অন্তত দুটো দিন সময় দিতে হবে ।“

“ সে না হয় যেদিন নেবেন সেদিনই আগে দেখে নেবেন ।আজ পর্যন্ত কেউ আমার দেওয়া মালকে বাজে বলেনি স্যার ।তবে হ্যাঁ,কমে হয়তো আপনি পাবেন ।তাদের শারীরিক গঠন নিখুঁত নয় ।আর যদি ছেমড়ি নেন তাহলে তিনেও হয়ে যাবে ।তবে রঙের কোন গ্যারান্টি দিতে পারব না ।আর এসব কথা আগেই বলে নেওয়া ভাল ।“

“ কিন্তু তোমাকে কীভাবে জানাব ।তোমার তো আবার ফোন নেই বলেছ ।তাহলে উপায় ।“

“ আমি একটা নম্বর দিচ্ছি ।পরশুদিন ঠিক এই নম্বর থেকে একটা ফোন আসবে ।শুধু’হ্যাঁ’ বা ‘না’ বললেই চলবে ।তবে যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন তখন বলে দেওয়া হবে আপনাদের কোথায় যেতে হবে ।“

দুই 

এসব ফ্যানানোর এখন আর কোন মানেই হয় না ।যা হবার তা তো হয়েই গেছে ।আসলে হঠাৎ করে ঘটনাটা মনে পড়ে গেল বলেই বললাম ।তাছাড়া আপনাদের না বললে আর কাকেই বা বলি ।এমন সাত সকালে শুনবেই বা কে !

অনেক বাক বিতন্ডা হয়েছিল কেকার সাথে । আসলে টাকাটা তো নেহাত কম ছিল না ।একজন সরকারি অফিসের মাছি মারা কেরানীর সামর্থই বা কতটুকু ।এক লপ্তে অত টাকা পাবই বা কোথায় ।আবার হাতে যে প্রচুর সময় রয়েছে তাও নয় ।তাই নিজের পি এফ ও কো-অপারেটিভ থেকে কর্জ করে এবং এর ওর থেকে ধার নিয়ে ম্যানেজ করেছিলাম ।তবু শেষ মুহূর্তে কেকাকে বলেছিলাম আর একবার ভেবে দেখতে। একেবারে নিঃস্ব হওয়াটা কী ঠিক হচ্ছে ।অথবা কম টাকায় একটা মেয়েতে অসুবিধাই বা কোথায় ।এখন তো ছেলে-মেয়ে সবই সমান ।কিন্তু কেকার সেই একই কথা-আমাদের বৃদ্ধাবস্থায় এই ছেলেই নাকি দেখবে ।তাই নির্দিষ্ট দিনে হ্যাঁ বলে দিলাম ।

স্কেচ অনুযায়ি যখন একটা বিশাল আম বাগান পেরিয়ে একটা কোঠা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম তখন চারদিকের নিস্তদ্ধতায় বুকের মধ্যে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল ।সাথে অত টাকা ছিল ।কেউ কেড়ে নিলেও আমাদের কিছুই করার ছিল না ।একজন এসে আমাদের ঐ কোঠা বাড়িতে নিয়ে গেল ।বাড়ির চৌহদ্দিতে পা দিতেই অনেক শিশুর কান্না আমাদের অভ্যর্থনা জানাল ।আমরা একটি ঘরে বসলাম । একটি লালচে রঙের শিশু আমাদের দেখান হল ।আপাতদৃষ্টিতে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব ঠিকই রয়েছে । কিন্তু আমি জানি লালচে রঙের শিশুরা বড় হয়ে কালো রঙের হয় । সে যাকগে,সোনার আংটির আবার বাঁকায় কি এসে যায় । মানুষের মতো মানুষ হলেই হল ।আমি বললাম।“ এই শিশুর বায়োডাটা দেবেন তো ? আর উনি কোথায় যার সাথে আমি আগে কথা বলেছিলাম ।”

একজন বাঊন্সার গোছের লোক বলল,”আমাদের প্রত্যেকের কাজ ভাগ করা আছে ।সে শুধু প্রাথমিক কথা বলে ।বাকিটা আমাদের দায়িত্ব ।“

আমি কিছুটা বেয়ারা গলায় বললাম,”উনি না এলে তো আমি টাকা দেব না । তাছাড়া আমি তো আপনাদের কাউকেই চিনি না ।আমি তো ওনাকে বেছে নেওয়ার কথা বলেছিলাম ।“

একজন কর্কশ গলায় বলল,”এখানে কেউ একবার ঢুকে পড়লে আর খালি হাতে যায় না ।যা দেওয়া হবে আপনাদের তাই নিতে হবে । কোন বেগরবাই করা চলবে না ।“

শিশুটিকে ভাল করে টাওয়েলে জড়িয়ে যখন রাস্তায় এলাম তখনও শিরদাঁড়া দিয়ে কুলকুল করে ঘাম বয়ে চলেছে ।এদিকে কেকার আদর যত্নে পান্তু যতই বড় হতে লাগল ততই যেন কেকার মুখে একটা প্রগাঢ় প্রশান্তি লক্ষ্য করতে লাগলাম । যা আমাকে ভরসা দিয়েছিল ।

আমি জানি সাত সকালে এমন ভ্যাজর-ভ্যাজর শুনতে কারই বা ভাল লাগে ।কিন্তু আমি আপনাদের ছাড়া আর কাকেই বা বলি বলুন । তখন পান্তু সবে ক্লাস ফোরে পড়ে ।একদিন স্কুল থেকে ফিরে মাকে বলল, ” আজ একটা ছেলেকে হেব্বি পেঁদিয়ে এলাম ।শালা আমাকে বলে কিনা গঙ্গা পার করে দেবে !এবার দেখ তোর মুখটা কেমন গ্যামাকসিন করে দিয়েছি ।“

কেকা ছেলের মুখে অমন অসংলগ্ন ভাষা শুনে কাঁদতে থাকে । বুঝতে পারে না পান্তু কাদের কাছ থেকে অমন ভাষা শিখছে । আমাকে কেকা পান্তুর ব্যাপারে সব জানালে আমি ওর স্কুলে গিয়ে ওর অমন আচরনের কথা জানিয়ে আসি । কর্তৃপক্ষ বলেন এর পরে তারা পান্তুর উপরে নজর রাখবেন ।

আমি বুঝতে পারি কেকা রোজ আমার পকেট থেকে বাড়তি টাকা স্কুলে যাবার সময় পান্তুর হাতে গুঁজে দেয় ।এটা যে ঠিক নয় তা কেকাকে বুঝিয়ে বলি ।এতে যে পান্তুর খারাপ বৈ ভাল হচ্ছে না তাও বলি । কেকা আমাকে বোঝাতে চায় যে ওর বন্ধুরা রোজ ওকে ভাল ভাল জিনিস খাওয়ালে ওকেও তো একদিন খাওয়াতে হয় । তাছাড়া সামান্য দশ টাকার বেশি তো আর দেওয়া হয় না ।

তিন 

পান্তু প্রথম বার মাধ্যমিকে ফেল করল। আর পড়বে না বলায় অনেক সাধ্য সাধনা করে ওকে আবার পরীক্ষায় বসালাম। এবার সে মাত্র একটা বিষয়ে ফেল করল। পান্তু যে সব বিষয়ে ফেল করেনি তাতেই ওর মা খুব খুশি। একদিন ভীষণ প্রত্যয় নিয়ে কেকা বলল,” দেখবে আগামী বছর পান্তু খুব ভাল রেজাল্ট করবে।“ সেদিন আমি আর কেকার বিশ্বাসে কোন আঘাত দেইনি।

পান্তু যে আর পড়বে না তা আমিও যেমন বুঝতে পেরেছিলাম, তেমনি কেকারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ইদানীং পান্তুর কানে দুল আর হাতে বালা উঠেছে। আর চুলের নব্য ছাঁটে ওকে দেখতে যে কতটা কুৎসিত লাগছে তা বলায় সেদিন ও এমন সিনক্রিয়েট করল যে ও আমার ছেলে এটা ভাবতেই আমার বেশ ঘেন্না হচ্ছিল। হঠাৎ মনে হল আমি কেন মিছে মরমে মরে যাচ্ছি! এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিল। ওতো আমাদের পালিত সন্তান ।কে ওর আসল বাবা-মা তা আমরা জানতে পারিনি। তবু দিন দিন কেকার অপত্য স্নেহ যেন ঝরে পড়তে লাগল পান্তুর উপর। আমি বুঝতে পারছিলাম পান্তু কেকার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে । রোজ সকালে বাড়ির সামনে একটা বাইক আসে। ও তাতে উঠে কোথায় যেন বেরিয়ে যায়। ও যখন রাতে ফেরে তখন আমি ঘুমিয়ে থাকি। কিন্তু কেকা ঠিক ছেলের জন্য জেগে থাকে। একদিন আমি যতটা যাওয়া যায় ওর পিছু ধাওয়া করেছিলাম। দেখেছি ও এগলি ওগলির অন্ধকারের মধ্যে ক্রমশই ঢুকে যাচ্ছে। আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। মনে হল তাহলে কী পান্তু রোজ রাতে এভাবেই ঘন অন্ধকারে তলিয়ে যায়! কিন্তু কেন যায়! কে বা কারা থাকে ওখানে! ওদের বাবারাও কী আমার মতোই সরকারি অফিসের কনিষ্ঠ কেরানী! বুঝতে পারলাম না। আসলে মাথাটাও আর কাজ করছিল না!

সংসারে ইদানীং বেশ টানাটানি চলছে । অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয় ।মাস মাইনে থেকে নিজের হাত খরচের টাকা রেখে বাকিটা সংসার চালানোর জন্য কেকাকে দিয়ে দেওয়াটা আমার অভ্যেস । কিন্তু ইদানীং কেকা মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মাঝে মাঝেই টাকা চায়। জিজ্ঞাসা করলে যে সব সময় সঠিক উত্তর পাওয়া যায়,তা নয় ।তাহলে কেকা কী আমার কাছে কিছু গোপন করছে !দিন দিন সন্দেহটা আমার মনে প্রকট হতে লাগল । একদিন দুপুরে কেকাকে কথার জালে এমন ভাবে জড়িয়ে ফেললাম যাতে সে যেন কোনমতেই বেরিয়ে যেতে না পারে। আমার সন্দেহের কারণটা ওকে বুঝিয়ে বললাম। একসময় ও ভয় পাওয়া শিশুর মতো হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলল! আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ওর চোখে কত গ্যালন পর্যাপ্ত জল ছিল যা ওর আঁচল ভিজিয়ে দিতে পারে! এ যেন হড়কা বানের মতো মুহূর্তেই কেকাকে ভাসিয়ে দিল! আমার সামনে মুহূর্তের মধ্যে একটানে ব্লাউজ খুলে নিজের উদোম পিঠটা দেখাল। আমি তার চৈত্র মাসের ক্ষত বিক্ষত মাঠের মতো পিঠ দেখে আঁৎকে উঠলাম। একবার খুব যত্নে ঐ এঁবড়ো খেবড়ো পিঠে হাত বুলিয়ে দিলাম । বুঝলাম এ ক্ষত এক দুঃখী মায়ের গভীর লজ্জার উপহার!

এরমধ্যে একদিন গভীর রাতে বাইকে করে পান্তু বাড়ি ফিরে এল। সাথে একটি মেয়ে আর তার কোলে একটি কয়েক মাসের শিশু। যারা এসেছিল তারা টলতে টলতে বলে গেল,” মাসিমা একদিন কবজি ডুবিয়ে খাসি খেয়ে যাব । পান্তুর সাথে দুটো জিনিস দিয়ে গেলাম। খুব যত্নে রাখবেন ।“

সেদিন কেকার মনে আদৌ কোন আনন্দ হয়েছিল কিনা জানি না ।তবে আমি মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না ঐ শিশুটি কার !সত্যিই কী পান্তুর! নাকি সকলেরই আনন্দের ফসল !

পান্তুর কয়েকদিন ধরেই জ্বর আর কাশি। চলার শক্তি নেই। আমি ডাক্তার ডেকে আনলাম। ডাক্তার বাবু রক্ত-কাশি পরীক্ষার কথা বলে গেলেন। আমি ইচ্ছে করেই পান্তুর সোয়াব টেস্টের ব্যবস্থা করলাম ।এই ধরনের টেস্ট আবার সব ল্যাবে হয় না। একে বলে ডি এন এ পরীক্ষা ।

পান্তুর হাত থেকে যে কেকা এখনও মুক্তি পায়নি তা ওর ভেজা চোখ দেখলেই বুঝতে পারি ।ইদানীং ওকে আর মিথ্যা সান্ত্বনা দেই না ।বরং বুকের ওমে জড়িয়ে ধরি ।আমি যে ওর সাথে আছি তাই বোঝাই । এতে কেকার মনের গভীর ক্ষতের যন্ত্রণাটা অনেকটা প্রশমিত হয় বুঝতে পারি । একদিন অফিস থেকে কিছু এরিয়ারের টাকা পেয়ে কেকার হাতে দিয়ে আলমারিতে তুলে রাখতে বললাম । ভাবলাম কাল বরং ব্যাঙ্কে রেখে আসব ।

পরের দিন আর ব্যাঙ্কে যাওয়া হল না ।সাত সকালেই ছুটতে হল ডি এন এ-র রিপোর্ট আনতে । ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই লেখা রয়েছে ।পান্তুর শরীরে বইছে একজন খুনির পাপ রক্ত !এটা এখনই কেকাকে বুঝিয়ে বলতে হবে ।বরং নিজেরা অন্য কোথাও বাড়ি বিক্রি করে চলে যাব ।তবু খুনির ছেলের সাথে থাকব না । আমি যত দ্রুত সম্ভব ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম । চিত্রদীপ দাশের ছবি

দূর থেকেই দেখতে পেলাম আমার বাড়ির সামনে অনেক মানুষের জটলা !আমি তাড়াতাড়ি ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাই ।পুলিশের সাহায্যে ঘরে ঢুকে দেখি কেকা এক নদী রক্তের মধ্যে ডুবে রয়েছে !আমি রিপোর্টটা কেকাকে দেখাই ।কেকা পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে !এই প্রথম আমি পান্তুর বউয়ের নাম ধরে ডাকি ।কোন সারা নেই !পুলিশ অফিসার বলেন,” আমরা এসে এ বাড়িতে আর কাউকেই দেখতে পাইনি । দরজা হাট করে খোলা ছিল, সাথে আলমারিটাও। আর আপনার সর্বস্য চুরি হয়ে গেছে।“

কেকা পুড়ে যাচ্ছিল দাউ দাউ করে !তবু আমি ওর সারা শরীরে ছেলের মারা কালশিটে দাগগুলো যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি মেয়ে পছন্দ করতাম। অথচ কেকা চাইত ছেলে। স্বাবলম্বী হবে,বাবা-মাকে দেখবে,ওর এমনই সব কল্পনা ছিল। ও বুঝত না যে হাতের পাঁচটি আঙুল কখনই সমান হয় না। আমি ঐ লেলিহান আগুনের শিখার কাছে গিয়ে পান্তুর ডি-এন-এ রিপোর্টটি কেকাকে দেখালাম।  হঠাৎ দেখলাম ওর আধ পোড়া কালো হাতটি চিতার আগুন থেকে বেরিয়ে এল আর আমি ওর হাতে রিপোর্টটি গুঁজে দিয়ে অনেকটা ভার মুক্ত হলাম। জানি একদিন না একদিন কেকা ঠিক সময় মতো রিপোর্টটি পড়ে নেবে।

ছবি : চিত্রদীপ দাশ

আরো পড়ুনএকেবারে ফ্রেস স্যার