অরুণেশ ঘোষ

অরুণেশ ঘোষ

বাংলাসাহিত্যের প্রখ্যাত কবি। গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও অনুবাদক হিসেবেও খ্যাতিমান। জন্ম কোচবিহারের হাওয়ারগাড়ি গ্রামে। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৪১। শৈশবের অনেকটাই কেটেছে টাঙ্গাইলের জাঙ্গালিয়ায়। 'হাংরি' আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। ১৯৬৫-তে আন্দোলনকারী কয়েকজন 'রাজসাক্ষী' হয়ে গেলে আন্দোলনটি ভেঙে যায়। সাতের দশকের মাঝামাঝি 'জিরাফ' পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনকে পুনর্জীবিত করে তোলেন। ১৯৮১ সালে কবি শৈলেশ্বর ঘোষের উদ্যোগে প্রথম কবিতার বই 'শব ও সন্ন্যাসী' প্রকাশিত হয়। অন্যান্য কবিতাগ্রন্থ : 'গুহা মানুষের গান' ১৯৮৫, 'সহজ সন্তান যারা' ১৯৮৯, 'দীর্ঘ নীরবতা' ১৯৯৪, 'বিপথিক' ১৯৯৫, 'মাতাল তরণী' (ৱ্যাঁবোর কবিতার ভাবানুবাদ) ১৯৯৫, 'কাল কবীরের দোঁহা' ২০০০, 'কবিতা সংগ্রহ-১' ২০০৬, 'পশুরাও অন্তর্লীন হাসে' ২০০৭, 'দোঁহাসমগ্র' ২০১২, 'শ্রেষ্ঠকবিতা' ২০১৩। গদ্যগ্রন্থ : 'অপরাধ আত্মার নিষিদ্ধ যাত্রা' ১৯৮৩, 'জীবনানন্দ' ১৯৯৮, 'জীবনের জার্নাল' ২০০২, 'কবিতার অন্ধকার যাত্রা' ২০০৪, 'ৱ্যাঁবো ও রামকৃষ্ণ' ২০১৩, 'আমার কবিতা যাত্রা' ২০১৩।উপন্যাস : 'সন্তদের রাত' ২০০২, 'নগ্ন পরিবার' ২০২২। গল্পগ্রন্থ : 'গল্পসমগ্র-১' ২০১১, 'গল্পসমগ্র-২' ২০১৪। নাটক : 'বর্বরের তীর্থযাত্রা' ১৯৯৮। ২৪ আগস্ট ২০১১, বাড়ির কাছে পুকুরে স্নানরত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ। মৃত্যুর পর পেয়েছেন 'বর্ণপরিচয়' ২০১১ ও 'পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার' ২০১২। অজস্র অপ্রকাশিত রচনা লেখক ও অধ্যাপক রঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় একে একে প্রকাশের অপেক্ষায়।

দুর্গ

দুর্গ

দুর্গসোমবার মাংসের বাজারে কমলাদির সঙ্গে আমার দেখা হয়। অনেকদিন ২৩ কি ২৪ বছর পর সেই প্রথম দেখা। কমলাদি নাকে রুমাল চেপে মাংস কিনছিল। তার চারপাশে ভনভন করে মাছি উড়ছিল। মাংসের কটু পচা গন্ধ। মাচার উপর ছাল ছড়ানো, ঝোলানো পাঁঠার মুখোমুখি বসে দোকানি। দুটো কুকুর কমলাদির পায়ের কাছে একটা হাড় নিয়ে ঝগড়া করছিল। কমলাদি একটু জোরে আওয়াজ করে কুকুরদুটোকে ধমক দিল। খানিকটা দূর থেকে এসব দেখছিলাম আমি। প্রথম নজরেই কমলাদিকে আমি সনাক্ত করতে পারিনি। কমলাদি বুড়িয়ে গেছে। মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। নিষ্প্রভ চোখে চশমা। চুল দু’একগাছি পাকা হয়ে গিয়েছে। মাংস কিনে বাজার থেকে বেরিয়ে এলে তখনই আমার সঙ্গে তার মুখোমুখি দেখা হয়। ভেবেছিলাম আমাকে চিনতে পারবে না কমলাদি। পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। কিন্তু সে আমার মুখের দিকে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থেকে অনুচ্চর স্বরে বললে, ‘তুমি’!
‘আমি অরুণেশ’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ চিনতে পারছি।’ মাথা নাড়ল কমলাদি। কতদিন পর দেখা। ‘কিন্তু তুমি এখানে কেন?’
‘চাকরি বজায় রাখতে।… তোমাকে এদ্দিন পর দেখে অবাক হয়ে গেছি কমলাদি।’
কমলাদি হাসল, ‘ভেবেছিলে আমি মরে গেছি, না?…আর কোনদিন দেখা হবে না।’
‘না না তা নয়’
কমলাদি বলল, ‘এসো – হাঁটি… চলো আমার আস্তানা দেখে আসবে।’ কথাটা বলেই কমলাদি কেমন যেন বিব্রত হলো, অস্বস্তি বোধ করল। ‘ঠিক আছে চলো’ আবার বলল সে। আমি ও কমলাদি বাজারের লোকজন ও দোকানের পসারের মধ্যদিয়ে হেঁটে এসে রাস্তায় উঠলাম। কমলাদি ও আমি উভয়েই নীরব। সন্ধ্যা তখন গাঢ় হয়ে আসছে ক্রমে। আমাদের চোখের সামনেই একেবারে রাস্তার আলো জ্বলে উঠল। কমলাদি মাথা নীচু করে হাঁটতে হাঁটতে কিছু ভাবছিল। ‘বিনোদের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে দেখা হয়।’ আমি বললাম।
‘তাই নাকি?’ কমলাদি মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে।
‘হ্যাঁ – এই সেদিনও ধানবাদে…’
‘আমার সঙ্গে দেখা হয় না, ভয়ে লজ্জায় দেখা করে না আমার সঙ্গে।’
‘বিনোদটা একেবারে নষ্ট…বখে গেছে। দেখলাম ও মেয়ের দালালি করছে আজকাল…’ হা হা করে হাসে কমলাদি। দাঁতগুলো পানের দাগে কালো কুচকুচে। ‘টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না।’
কমলাদি চুপ করে আমার কথাগুলো শুনছিল। শেষে বলল, ‘আমার কথা বলেছে কি?…বিনোদ হয়তো বলেছে, না?’
‘বলেছে।’
‘কী?’
‘তুমি নাকি ইচ্ছে করে খারাপ লাইনে নেমে গেছ, তোমাকে নাকি সে শুধু রাখতে চেয়েছিল… এইসব।’
কমলাদি ভীষণ সাদা ঠোঁটে হাসল। ‘ঠিক ঠিক। সত্যি কথাই বলেছে বিনোদ…।’

আরো পড়ুনদুর্গ