অভিজিৎ দাশগুপ্ত

অভিজিৎ দাশগুপ্ত

জন্ম ১৩ই অক্টোবর ১৯৬৮ - কলকাতায় । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা স্নাতক এবং উত্তরবঙ্গ থেকে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন-এ স্নাতকোত্তর । গত বেশ কিছু বছর যাবৎ বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত, প্রকাশিত হয়েছে একাধিক ছোট গল্প । ২০১৬ -তে মিত্র ও ঘোষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ছোট গল্পের সংকলন "গল্প নয়" । যদিও নিজেকে পাঠক ভাবতেই বেশি ভালো লাগে

শুভ্রতা

অভিজ্ঞান দাশগুপ্তের ছবি

অভিজ্ঞান দাশগুপ্তের ছবি ফোনটা যখন এলো তখন সূর্যের আলো কমে এসেছে। যদিও আম্মানের রাস্তার সব দোকানে আলো জ্বলেনি। সেই “কনে দেখা আলো” টাইপের সময়। আগামীকাল সকালে আমার পেট্রা যাওয়ার কথা। সাতটায় বাস। ঘন্টা চারেকের যাত্রা।

তিনদিন হল জর্ডানের রাজধানী আম্মানে এসেছি। ফেব্রুয়ারি মাস। ঠান্ডা বেশ। সাধারণতঃ ইসলামিক দেশ বা শহরের যে ছবিটা আমার মনে ছিল, এ দেশটা একেবারেই সেরকম নয়। দেশটায় বেশ রকম পশ্চিমী ছোঁয়া। রাত বাড়লে ঠান্ডা আরও বাড়ে। আর বাড়ে রোমান্টিক উষ্ণতা।

গল্প লেখার ইচ্ছে বা অভ্যেস কোনটাই আমার নেই, তা সত্ত্বেও লিখতে বসলাম। ডাইরিতে। কারণটা – ঐ যে বললাম “ফোন”। বাসের টিকিট বুক করার সময় সিংগল সিট চেয়েছিলাম। পরে আমাকে ফোন করেছিল – আমি দুজনের পাশাপাশি সিট গুলোতে বসতে রাজি আছি কিনা। এবার এই পুরো যাত্রাপথকে নিজের মতন করে অনুভব করতে, তাই আমি চাইছিলাম আমার পাশে যেন কেউ না থাকে। ট্যুরিজম কোম্পানি থেকে ফোন করে জানালো আমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে ওরা দুজনে পাশাপাশি বসে, সেরকম সিট দেবে। রাজিও হয়ে গেলাম। সহযাত্রীর নামটাও আমাকে জানালো। আফরা। আফরা উইল বি দ্য প্যাসেঞ্জার নেক্সট টু ইউ। ছাতা, বুঝতেই পারলাম না ছেলে না মেয়ে। আমার যদিও কিছুই যায় আসে না। ভাববার চেষ্টা করলাম, আচ্ছা আফরা যদি ছেলে হয় – একটা ঝকঝকে তরুণ, নাম আফরা। বাস্কেটবল খেলে। এক মাথা ঝাঁকরা কালো চুল। ব্লু জিন্স আর স্লিম ফিট সাদা শার্ট। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা আর তার সাথে কথা বলার ভঙ্গি। আর যদি আমারই বয়সী কোন তন্বী, হাতা গোটানো সাদা টপ, সার্প ফিচার, একজোড়া ঘনকালো গভীর চোখ, সাইড থেকে মারিয়া শারাপোভা।

না,ডাইরী লেখাটা বেশ চাপের, মনের সব কথা লেখাটাও যেমন কঠিন না লেখাটা আবার তেমনি কাইন্ড অফ – ইন জাস্টিস।

আম্মানে ভোর বেলায় ঠান্ডাটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। লজ্জার মাথা খেয়ে একটা মাঙ্কি টুপি চাপিয়ে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেছিলাম। বাস ছাড়ার মুহূর্তে ভাবছিলাম যে প্ল্যানটা নিয়ে চলছি, মাঝেমাঝে ডাইরিটা লিখব, সেটা আদৌ কতটা সম্ভব হবে।
জনবসতিকে পিছনে ফেলে বাসটা ছুটে চলেছে। দু’দিকেই ধুধু প্রান্তর, মাঝখানে প্রকৃতির বুক চিড়ে একটা কালো রাস্তা। ঝাঁকুনি বিশেষ নেই বললেই চলে তবুও লেখার ইচ্ছেটা কেন জানি না সেরকম হচ্ছে না, চোখটা লেগে আসছে, থাক আবার পরে লিখবো।

মিনিট পনেরোর জন্য বাসটা দাঁড়িয়েছে। আমার বাইরে যাবার বিশেষ প্রয়োজন নেই, আর বাইরে যা ঠান্ডা যাওয়ায় ইচ্ছেও নেই। আফরা নেমেছে। ও কফি আনবে। আমার জন্যেও। নামার আগে জিজ্ঞেস করেছে, আমি হ্যাঁ বলেছি। আফরা আমারই মতন একা বসার টিকিট কেটেছিল। ওরও প্ল্যান ছিল রাস্তাটা একা একা অনুভব করতে করতে যাবে। অদ্ভুত ঘটনাচক্রে আমরা পাশাপাশি এসে বসেছি। আফরাও একটা ডাইরি এনেছে। না, ও কিছু লিখছে না। পড়ছে। হাতের লেখা একটা ডাইরি। ওর থেকেই জানলাম লেখাগুলো আরবি ভাষায়।

কফি আনার আগে, “হ্যালো”- “হাই” অবধিই ছিলো। বাস থামার মিনিট পাঁচেক আগে, নীরবতা ভেঙে ওই শুরু করলো। তখনই জানলাম যে ওরও একা বসার টিকিটই ছিল। আর তারপরের গল্পটা, আমার ই মতো। বাস থামার পর স্মার্টলি বল্ল, “কফি ?”, আমিও চটজলদি বল্লেম, “নাথিং লাইক”। ব্যাস অপরিচয়ের আরষ্ঠতা, যাকে বলে, নিমেষেই ফুরুৎ।

আর বড়জোর আধঘন্টা, তারপরই পেট্রা। কথাটা মনে হল আফরা আমার কানের কাছে এসে বলল।

এরপর বেশ মজা হলো, আমরা দুজনে একসাথে, একে অপরকে প্রশ্ন করলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তখন থেকে এত মন দিয়ে কি পড়ছো? আর আফরা জিজ্ঞেস করল, তুমি পেট্রা যাচ্ছ কেন ?

কে আগে উত্তর দেবে এখন সেটাই প্রশ্ন। হেসে উঠলাম একসাথে, দুজনেই।
— বেশ প্রথমে আমি বলছি। পেট্রা ঐতিহাসিক স্থান, চারিদিকে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। শুনেছি হজরত মুহাম্মদের মৃত্যু হয়েছিল এই শহরে।
কথা বলার ফাঁকে, আরও একটু ঘেঁষে বসলাম। আফরা জানতে চাইলো-
— ঐতিহাসিক, ইতিহাস, কাকে বলো তুমি ইতিহাস ?
— ইতিহাস হলো ঘটে যাওয়া ঘটনা,অতীত
— অতীত মানেই কি ইতিহাস ?
— না তা নয়, অতীতের ঘটনা যা কিছু লেখা আছে সেটা ইতিহাস
— ও তুমি বিশ্বাস করো, অতীত এর ঘটনা, কেউ লিখে রাখলেই, তবে তা ইতিহাস; আর লিখে না রাখলে ইতিহাস না
— লিখলেই ইতিহাস হবে, না এমন কথা নয়, তবে যে লেখায়, সময়টাকে ধরা যাবে, সেটা ইতিহাস
— শুধুই কি সময়কে ধরা নাকি অন্য কিছু ?
— শুধু সময় নয় তার সাথে সাথে মানুষ, তাদের ভাবনা, মানসিকতা ?
— আর জীবনের উষ্ণতা ?
— হ্যাঁ, উষ্ণতা না থাকলে আর যাই হোক পড়তে ভালো লাগবে না।

কথার মাঝে এলো হালকা হাসির ছোঁয়া।
— আচ্ছা তুমি কি বিশ্বাস করো ইতিহাস একজন লিখলেই হয় ?
— না, আমার মনে হয় ইতিহাস যদি একাধিক জন মিলিতভাবে বা আলোচনার মাধ্যমে লেখে, তাহলেই সেটা সঠিক ইতিহাস
— বেশ, তাহলে বলি তুমি যে কারণে পেট্রা যাচ্ছ আর আমি যে কারণে ডাইরিটা পড়ছি দুটোর কারণই এক।
এক ভদ্রলোক লিখেছেন, তার কৃতকর্মের ইতিহাস, লিখেছেন কেন তিনি সেসব কাজ করেছেন। কথাগুলো লেখা হয়েছে খুব সামান্য শব্দ ব্যবহার করে, আর প্রত্যেক পাতায় তার স্ত্রী সেই কথাগুলোকে ভিত্তি করে, আরো কিছু বলেছেন। খুব মজার ব্যাপার হলো, ভাবনার দিক থেকে অনেক জায়গাতেই তা পরস্পর বিরোধী কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার সময়টাকে ধরা যাচ্ছে।
— কারা লিখেছে ?
— ওই যে বললাম একজন স্বামী আর তার স্ত্রী। ভদ্রলোক যা লিখেছেন সময়ের দিক থেকে তা সবই আমার জন্মের আগে। ভদ্রমহিলার লেখাগুলো এর কিছুদিন পরের। সময়ের দিক থেকে আমার জন্মের পর, বিভিন্ন সময়ে। পরে সেই ভদ্রমহিলা তার এই ডাইরি এবং ওনার একমাত্র কন্যা সন্তানকে তুলে দিয়েছেন এক ব্রিটিশ দম্পতির কাছে। শর্ত ছিল ব্রিটিশ দম্পতি ওই শিশুটির কুড়ি বছর বয়স হওয়া অব্দি কোন কথাই প্রকাশ করবে না; এবং কুড়ি বছর হওয়ার পর সবকিছুই জানাতে হবে এবং ঐ শিশুটির হাতে তুলে দিতে হবে সেই ডাইরী। কি অদ্ভুত না ?
— ওহ্, এতো বেশ ইন্টারেস্টিং। কি করতেন সেই ভদ্রলোক ? পর্যটক ? ঐতিহাসিক ? সাংবাদিক নাকি সাধারণ একজন মানুষ ?
— না, সাধারণ মানুষ তিনি ছিলেন না, তিনি ছিলেন জিহাদী, মানে তোমাদের ভাষায় তোমরা যাকে বল উগ্রপন্থী, টেররিস্ট
— বাপরে, এক জেহাদি র ডাইরী।
— হ্যাঁ, বলতে পারো এক জেহাদির আত্মকথা। এটা হচ্ছে ইতিহাস। আচ্ছা, একটা কথা বলতো, সীমানা কাকে বলে ?
— সীমানা ? কিসের সীমানা ?
— দেশের সীমানা
— দেশের সীমানা হলো যেখানে একটা দেশ শেষ অথবা আরেকটা দেশের শুরু
— আর দেশ মানে ?
— দেশ মানে যেখানে মানুষ থাকে। যেখানে আমরা থাকি। যেখানে তুমি থাকো
— তাহলে দেশ মানে দাঁড়াচ্ছে মানুষ এবং তার থাকার জায়গা। তবে সীমানার কি প্রয়োজন ?
— সীমানার প্রয়োজন যদি বলো, তাহলে এরকম ভাবে ভাবা যেতে পারে যে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য আমাদের নিজের জায়গাটা অথবা আমাদের স্বাধীন ক্ষেত্র কোনটা, সেটা পরিষ্কার ভাবে চিহ্নিত হওয়া দরকার আর তাই সীমানা
— আমার কি মনে হয় জানো, এই সীমানা গুলো আমাদের উষ্ণতার এক বদ্ধভূমি। যেখানে দুটো দেশ আলাদা হয়ে যায়। যেখানে একই বাড়ির দুই ভাই আলাদা হয়ে যায়। তোমার কি মনে হয় না, এই সীমানা গুলো দেশগুলোকে শেষ করে দিচ্ছে। আমাদের মানবিক সত্ত্বা গুলোকে শেষ করে দিচ্ছে। আমরা হাতিয়ার তুলে নিচ্ছি দেশের নামে।
— সেরকমটা তো ভাবিনি কখনো
— আমিও না
— তাহলে এরকম অদ্ভুত অনুভূতি ?
— অদ্ভুত লাগছে ? পৃথিবীর সব দেশের কবি, দার্শনিক এবং যারা মহান আত্মা তারা সবাই বলে গেছেন, সবার উপর মানুষ সত্য, তা সত্ত্বেও আমাদের শেখানো হচ্ছে “দেশ”। “দেশ “-ই হলো শেষ কথা। দেশমাতৃকাকে বড় করতে করতে,কোথায় যেন “দেশ” বানানটা পাল্টে যাচ্ছে, বানানটা হয়ে যাচ্ছে দ্বেষ। যখন আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছি, দেশের নামে। হত্যা করছি মানুষকে, মানবতাকে। এই হত্যা বন্ধ হোক, বন্ধ হোক জিহাদীদের জন্ম। ভাষাগত কারণে তুমি এই ডাইরি পড়তে পারবে না, তা আমি জানি, কিন্তু আমি যেই জিহাদীর কথা বলছি, তার স্ত্রী শেষে এই কথাই বলে গেছেন প্রতিটি পাতায়।
— তাহলে দেশ শব্দের অর্থ ?
— কেন, সংগীতে যা বলে, “দেশ” একটা রাগের নাম, এই হোক “দেশ” এর ডেফিনেশন।

কিছুটা দম নিয়ে, আফরা বলতে থাকে, তবে কি এই কথাটা আমার নয়, ঐ জিহাদী র স্ত্রীর কথা।
— শেষ পর্যন্ত কি হলো ওনার স্ত্রী র ?
— সেও এক ইতিহাস, উনি চাইলেন ওনার সন্তানকে এসব থেকে দূরে রাখতে, নাম রাখলেন – কলঙ্কহীন শুভ্রতা, আর দত্ত্বক দিলেন সুদূর ইউ. কে. এর এক ব্রিটিশ দম্পতির কাছে। আর তারপর কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।
— সেই ছোট্ট মেয়েটার কি হলো ?
— বিশেষ কিছুই নয়, ধিরে ধিরে আর দশটা শিশুর মতো বড় হতে লাগলো
— আর, তুমি এই ডাইরিটা পেলে কোথায়, তোমায় কে দিলো
— আমার ব্রিটিশ ড্যাড। তুমি বরং আফরা মানেটা দেখে নিও।
কিছু সময় নিরবতার পর আফরা বল্ল,
— ঐ স্বামী- স্ত্রী, যাদের লেখা এই ডাইরী ওনারা আমার আব্বু আর আম্মী
— কি বলছো, আর ইউ সিরিয়াস ?
— হ্যাঁ আমি এক জিহাদীর সন্তান, যার অফিসিয়াল এভিডেন্স কোথাও নেই। একটা কোন এনকাউন্টারে আব্বুর মৃত্যু হয়। তারপর আব্বুর ডাইরিটা মার হাতে এসে পৌঁছায়। দ্যট টাইম শি ওয়াজ প্রেগনেন্ট। এর কয়েক মাস বাদেই আমার জন্ম।
— তোমার জন্মস্থানে ফিরতে ইচ্ছে হয়নি ?
— আমার মাতৃভূমি আমার আব্বু র অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, আমি তো কোন ছাড়।
— তুমি সত্যি বলছো ?
— ইএস স্যার। তুমি যার পাশে বসে শেষ চার ঘন্টা সফর করলে, সে এক জেহাদির সন্তান। ফলাও করে বলার মতো নয়, তবে আমাদের স্বল্প সময়ের উষ্ণতার কাছে আমি দায়বদ্ধ, তাই এই অকপট। তুমি চাইলে ফেরার সময় সিট চেঞ্জ করতে পারো। চয়েস ইস ইওরস্।

ঝাঁকুনি দিয়ে বাসটা থামলো, পেট্রা….

আরো পড়ুনশুভ্রতা

লুকোচুরির গল্প

অভিজ্ঞান দাশগুপ্তের ছবি

অভিজিৎ দাশগুপ্তের ছবি

আজ এক আজব সমস্যা নিয়ে একজন রোগী এসেছে ডঃ সেন- এর কাছে। রোগী মানে ঐ ভদ্রলোক- এর বয়স চল্লিশ – বেয়াল্লিশ। ভদ্রলোক এর বক্তব্য, প্রায়শই ওনার বুকের ভেতরটা নাকি ভীষণ খালি খালি লাগে। ডঃ জয়ন্ত সেন এক সম্ভ্রান্ত অঞ্চলের এক অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হার্ট বিশেষজ্ঞ । সকালবেলা উঠে নিয়মমাফিক দুটো নার্সিংহোম এবং একটা হসপিটাল এর ভিজিট সেরে বাড়ি ফিরতে বেলা প্রায় আড়াইটে তিনটে । এরপর বিকেল চারটে থেকে পার্সোনাল চেম্বার। রাত এগারোটা অবধি । বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় বারোটা। দুপুরে বাড়ির টেবিলে বিভিন্ন পোরসেলিন-এর পাত্রে ঢাকা দেওয়া থাকে ওনার জন্য নানান রকমের খাবার । খাবারের ব্যাপারে বিশেষ সচেতন জয়ন্ত বাবু । প্রতিদিন খাবারে পরিমাণ মতো স্যালাড এবং টক দই থাকবেই । জয়ন্ত বাবুর স্ত্রী বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত , আর ওনাদের একমাত্র মেয়ে, মৃত্তিকা – সোসিওলজি নিয়ে মাস্টার্স করছে । যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত । কারোরই সময় নেই  দু’দন্ড বসার অথবা নিজেদের মধ্যে গল্প করার । তবে এ নিয়ে কারোর মনে কোন খেদ নেই । ডঃ সেন -এর উপার্জনের জোয়ার ঢেকে দেয় অন্যান্য ছোট বড় পাওয়া – না পাওয়াকে । মিসেস সেন একাধিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থান অলংকৃত করে রেখেছেন । অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা, মানুষকে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভীতকে অনেক জোড়ালো করে ।

সে যাই হোক, ডঃ সেন আর একটু গভীরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন, কবে থেকে এই সমস্যা হচ্ছে ? রাতের ঘুম, বিশেষ কোন পারিবারিক সমস্যা, গ্যাস, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি ইত্যাদি। না, বিশেষ কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না ।  ডক্টর সেন এর আগে এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি কোনদিনও হননি । কোন কিছু থেকেই বোঝা যাচ্ছে না যে, রোগটা আসলে কি । তাহলে কি এটা হার্ট সংক্রান্ত সমস্যা আদৌ নয় !!

সামান্য সময়ের বিরতি নিয়ে, ডক্টর সেন ভদ্রলোককে বললেন, আচ্ছা আপনি বরং আপনার কথা বলুন, আমি শুনি, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি । ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন, আমি বেশ কিছুদিন হলো লক্ষ্য করছি যে, আমার কোন বন্ধু আমাকে ফোন করে না ; না সে অর্থে আমিও করি না । কিন্তু আমার কাছে প্রতিদিন বেশ কিছু ফোন আসে, সবই আমার অফিসের, কোন না কোন কাজ সংক্রান্ত ।  এছাড়াও খান কয়েক ফোন আসে,  কোনটা বা ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার জন্য বা ক্রেডিট কার্ড অথবা কোন প্রপার্টি কেনার । আগে জানেন, আমরা বন্ধুরা, কারণ ছাড়াই দেখা করতাম, কারণ ছাড়াই হাসতাম । এরপর একটা সময় অব্দি, কোন একটা কারণ খুঁজে বার করতাম, দেখা করার জন্য । কিন্তু আজকাল কেউ আর কারণ খুঁজি না, দেখাও করিনা, ফোনও না । তবে হ্যাঁ আমাদের একটা হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপ আছে । একদিন সকালে আমার এক বন্ধু সুজয় লিখলে, লুকোচুরি খেলতাম সবাই মিলে, কেউ লুকাতো – কেউ খুঁজতো । হঠাৎ একদিন বন্ধুরা লুকিয়ে গেল, আর খুঁজে পেলাম না, বুঝলাম বড় হয়ে গেছি  । এরপর থেকেই ক্রমশ অনুভব করতে শুরু করলাম, আমি যেন কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না । তারপর থেকেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগে । স্টেথোস্কোপ হাতে ডক্টর জয়ন্ত সেন অসহায়ের মতন তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোকের দিকে, মুহূর্তে মনে হলো যেন ওনার নিজের বুকটাও যেন কিরকম খালি খালি হয়ে যাচ্ছে।

ছবি :অভিজ্ঞান দাশগুপ্ত

আরো পড়ুনলুকোচুরির গল্প