
“পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন, ফিরে আর আসবে কি কখনও”? হয়তো আর ফিরে আসবে না। কারণ শীত হারিয়েছে তার চিরসঙ্গীদের। আজ সে বড় একা। “এক মাঘে শীত যায় না”। তাই পৃথিবীর পাক খাওয়া নিয়মে প্রতি পৌষ-মাঘে সে আবার ফিরে ফিরে আসে। আসলে শীত মানে তো শুধু উত্তাপ কমে যাওয়া নয়, বরং শীত এলে আমাদের আনন্দের উত্তাপটা যেন অনেকটাই বেড়ে যেত। কারণ শীত তার ঝুলিতে উপহার নিয়ে আসত অনেক কিছু। কিন্তু সেই শীত আর আসে কই! শীত বদলে গিয়েছে, নাকি সময়ের সঙ্গে আমরাই বদলে যাচ্ছি? বদলে যাচ্ছে আমাদের বোধ! বদলে যাচ্ছে আমাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা। বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবনশৈলী। হয়তো এই সব কিছু মিলেই বিজ্ঞান-নির্ভর সভ্যতায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। বিজ্ঞান এনে দিচ্ছে অনেক কিছু, কিন্তু হয়তো কেড়ে নিচ্ছে তার চেয়েও বেশি। ফলে অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে আমরা হয়ে পড়ছি নস্টালজিক। এখন শীত এলেই হারানো খতিয়ানের হিসেব কষতে ইচ্ছে করে। কোনও বিশেষ আত্মীয়তা না থাকলেও বিশেষত শীতকালে সন্ধ্যের পর কাঠকুটো বা পাতায় লাগানো আগুন গোল করে ঘিরেই আড্ডা জমে উঠত। সেই আড্ডায় উঠে আসত সেইদিনের শীতের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে সিনেমা, রাজনীতি, রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে সময়ে সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের খবরাখবর। আধো অন্ধকারে শীতকে ঘিরে থাকা অনেকগুলো মুখ মানেই অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক আদর্শ, অনেক স্বপ্ন চারণ, অনেক আশাভঙ্গের গল্পগাথা। তাকে ঘিরে না থাকত কোন উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, না থাকত বয়সের তারতম্য। শীতের আগুণ থাকা মানেই সকলের অবাধ যোগদান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জটলা আজ প্রায় চোখেই পড়ে না। যৌথ পরিবার ভেঙে, ফ্ল্যাটবাড়ি কালচারে আজকের শৈশব অনেকটাই সেই প্রবীণদের সান্নিধ্য হারিয়েছে। হ্যারি পটারের যুগে এসে হারিয়ে গেছে পরী ও দৈত্যেরাও। এখন একলা রাতে নরম কম্বলের ওমে শীতের সেই চেনা গন্ধ আসে কই?
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালানোর জন্য আমাদের ছোটবেলায় আসতো শীতকাল। আর তখন থেকেই তোড়জোড় শুরু হত শীতকালকে আমন্ত্রণের। সেই তখনকার শীতকালে ত্বকের যত্ন নেওয়া দিনে গ্লিসারিন সাবানের গন্ধে আমাদের বেঁচে থাকার গল্পগুলো আজ রূপকথা। স্নান করতে যাওয়ার আগে নারকেল তেল গলিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা রোদের কাছে, উনুনের পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। এখনকার প্রজন্মের মনে হবে “কি গেঁয়ো ভুত” রে বাবা! প্রতিবার ভাবতাম পুজোর আগে কুল খাবো না। কিন্তু শেষ রক্ষা হত না কিছুতেই। ইট দিয়ে কুল পাড়ার মজা ছাড়া যায়? যায় না বলেই পকেটে পকেটে ভর্তি থাকতো কাঁচা পাকা কুল। এখনকার প্রজন্ম ভাববে “কি রে বাবা, কুল আবার খাওয়ার বিষয় হল”? “তার জন্য এত কিছু”? আচারের শিশির গায়ে রোদ পড়তো আর আমরা ছোটরা, খুড়তুতো, জেঠতুতোরা লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। আর ঠিক এই সময় ধীরে ধীরে বসন্ত পঞ্চমী’ নামটি বুঝিয়ে দিত রং লেগেছে বনে বনে, ঢেউ জেগেছে সমীরণে। একদিকে সার্কাসের ট্র্যাপিজের খেলা দেখতে দেখতে মনে হতো জীবনের আসল রং খুব সম্ভবত অ্যাডভেঞ্চার, আবার স্কুল থেকে সরস্বতী পুজোর স্বেচ্ছাসেবক হবার প্রতিযোগিতাও ছিল জীবনের আর এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার। মেয়েদের স্কুলে কে কে কার্ড দিতে যাবে এই নিয়ে কত রঙ্গরস! কাঁধে ব্যাগ, চুল উড়ছে, হিরো সাইকেলে চড়ে হাতল ছেড়ে হিরো হওয়ার বাসনাতে যেন দিগবিজয় করে ফিরতাম। গার্লস স্কুল থেকেও কেউ কেউ আসত মাঝে মাঝে। বুকের ভেতর কেমন একটা হত যা খালি চোখে দেখা যেত না। একটু উঁকিঝুঁকি, সামান্য চোখাচোখি। ঘুরে ফিরে তাকানোর পঞ্চমী প্রহর। নতুন শাড়ি সামলে নেওয়ার বয়ঃসন্ধি। আসলে প্রত্যেকের জীবনেই কিছু ‘অকথা’ থাকে। বন্ধুরা সে কথা জানবেই। স্কুলের পুজোর দ্বাদশ শ্রেণী। সারস্বত উৎসব। পরিবেশনের দায়িত্ব। সে আসে ঠিক। নিজের হাতে খেতে দিই। স্যার বলেন দেখে দিবি কিন্তু। হ্যাঁ দিই তো। প্রসাদের সঙ্গে সন্দেশ দিই। হাতে একটু ছোঁয়া লাগে। এক পলকে দুজনের দেখা। সে সময়কাল শীতকাল।
অশোকবাবুর কাছে পড়তে যাওয়ার সময় যখন সাইকেলের বেল বাজাতাম তখন সোহারই মোড়ের সেই সাদামাটা মেয়েটা, যার নাম ছিল বীণা, কেন যে ভালো লাগত আমিও জানি না, চোখের সামনে ঝুঁকে থাকা অবাধ্য চুল কানের পাশে তুলে রাখত। সে জেনে যেত এবং বুঝে নিত বেল বাজিয়ে যে আসছে পেছনে না তাকালেও দেখা যায় সেই আসা। আচ্ছা সাইকেলের বেলেরও কি মোবাইলের মত ভিন্নধর্মী রিংটোন ছিল নাকি? কোনদিন শাড়ি পড়তো, আবার কোনদিন সালোয়ার কামিজ। আমার এক বন্ধুর কাছে যখন বলেছিলাম শাড়ি পড়লে মেয়েদের বড় বড় লাগে তখন ‘প্রেমিকার বুকের সেফটিপিন’ কবিতা লিখে ফেলে সেই কবি বন্ধু সাহিত্য মহলে জবরদস্ত মুরগী। শাড়ি আসলে খুবই সংক্রামক। আসলে আমাদের অনেকের জীবনের ভালোবাসার বর্ণমালার প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল এইসব শীত বিকেলে। আমরা মফস্বলের মাঠ জুড়ে স্বপ্ন ফেরি করতাম। হাফ সেঞ্চুরি অতিক্রম করা এই বয়সে ডাকাবুকো প্রেমিকের দলকে কেউ মনে রাখে কিনা এইকথা ভাবতে ভাবতেই ছোটবেলার মুগ্ধতা ভিড় করে আসে চোখের পাতায়। বাণী বন্দনার শীতসকালে অঞ্জলি দিতে গিয়ে হৃদয়ে অবাধ্য ছেলে কার মুখ ভেবেছিল মন কি তা জানে? মনের গতিবিধি বোঝা দায় যে। কত কবি বন্ধু ছিল সেইসময় আমার ক্লাশে তা কি জানতাম? কার মধ্যে কি সুপ্ত প্রতিভা আছে কি করে জানবো? বঙ্কিমচন্দ্রের বাবু পড়াবার সময় নির্মলবাবু মজা করে মদনকে বলেছিলেন ‘বলতো মদন, ‘মদন আগুণ কি’? মদন অবলীলাক্রমে বলেছিল ‘মদন আগুণ’ হল এমন আগুণ যা বালতি বালতি জল ঢাললেও নেভে না’। সেই মদন বাসন্তীকে চিঠি লিখল ‘পলাশ ও শিমূল পাশাপাশি / আঙ্গুলে শাড়ির খুট, লজ্জা…… ভালোবাসাবাসি’। এটা নিয়ে কয়েকদিন বন্ধুমহলের জমজমাট আলোচনা ক্রমে ক্রমে জমে ক্ষীর। মদন-বাসন্তীর এখন এক ছেলে এক মেয়ে।
এটা অস্বীকার করা যাবে না আমবাঙালির কাছে শীত বরাবরই এক ‘সুস্বাদু’ মরশুম। তরতাজা সব্জিভরা বাজারে ঢুকলে খরচের হাতটাও যেন বাগে আসতে চাইত না। এই মরশুমে কেনার ক্ষমতা লাগাম ছাড়া হতেই হবে, কেন না শীত এসেছে যে। ফুলকপি কেনার পরে কই মাছ দেখলে গোটা গোটা বড়িসহ ফুলকপি আর আলু দিয়ে কইমাছের ঝোলের কথা ভেবে ঢোক গেলে না এমন নির্লিপ্ত আসক্তিহীন বাঙালি আছে কি

ইহজগতে? কিংবা মুলো, বেগুন, আলু, ধনেপাতা দিয়ে মৌরলার চচ্চড়ি যে প্রাণিত বাঙালি খায়নি তার তো বাঙালি জন্মই বৃথা। আবার কালজিরে ও পেঁয়াজ কুচি ফোড়ন দিয়ে ডুমো ডুমো করে কাটা চিকন বেগুন সহযোগে পাবদার ঝোল, নতুবা টাটকা সতেজ পিয়াজকলি দিয়ে ছোট চিংড়ির প্রিপারেশন খেয়ে কত ভিনজাতি পুরুষ যে বাঙালি শ্বশুরবাড়ি পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়েছে, হিসেব নেই। মাছেভাতে বাঙালি অনায়াসে দিনকতক মাছ ভুলে থাকতে পারে। কিন্তু সেও তো হওয়ার নয়। শীতকালের মাছ বাজার রুপোলি শস্যে ভরা। সুন্দরী মৌরলা, আদুরে কাজলি, লাবণ্যময়ী পাবদা, রূপসী বোরোলি, বিদুষী সরপুঁটি, দাপুটে কই, হ্যান্ডসাম কাতলা। শীত এলে ব্যাগে ঝলমল করত রূপসী ফুলকপি, চিরসবুজ তন্বী পেঁয়াজকলি, বার্মিজ রুবির মত গাঢ় লাল চকচকে অপরূপা টমেটো, ঝিনুক থেকে বের করা সবুজ মুক্তোর মত মটরশুটি, সপ্তমীর চাঁদের মত বাঁকা কচি সিম, ব্ল্যাকবিউটি বেগুন, লজ্জায় গোলাপী ফরসা নধর মুলো, পাটভাঙা তসরের মত সজীব পালং, পরতে পরতে রহস্যময়ী বাঁধাকপি। কাকে ছেড়ে কার কথা বলি? আসলে বাঙালির কাছে আমিষ নিরামিষে তফাৎ যে খুব কম এই ঋতু সেটাই প্রমাণ করে দেয়। কিন্তু না, আধুনিক কৃষিব্যবস্থা ফসল ফলাতে এখন আর শীতের তোয়াক্কা করে না। শীতের নিজস্ব ফসল ফলছে সারা বছর, শীতের ফুলকপি এখন সারা বছর ধরে খাচ্ছি আমরা। সেই স্বাদ আর নেই। তাই খেতে বসে অতীত আর আজকের শীত ভিন্নতা লাভ করে আমাদের হৃদয়কে আরো ব্যাথাতুর করে সুদূর অতীতে ফিরিয়ে দেয়। তবুও কিন্তু বাজার ফেরতা কর্তার ঠাসা ব্যাগে উঁকি দিয়ে আহ্লাদিত গিন্নি ঘন দুধে মালাইদার কফি নয়ত আদা দিয়ে কড়া ফ্লেভারের চা বানিয়ে আনে।
কণ্ঠ আর কণ্ঠি। শব্দদু’টো সঙ্গীতকে জড়িয়ে হলেও খানিক আলাদা। হিন্দি ও বাংলা জনপ্রিয় ফিল্মের গান যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করতেন মূলত তারাই বিভিন্ন দিকপাল কণ্ঠশিল্পীদের ‘কপি সিঙ্গার’ বা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন আমাদের ছোটবেলায়। কিশোর কন্ঠ, রফিকন্ঠ, মুকেশ কন্ঠ, লতাকন্ঠি বা আশাকন্ঠি নামে অভিহিত এই কণ্ঠশিল্পীদের শীতের সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিল। বাঁশের মাচা বেঁধে এ পাড়ায় সে পাড়ায় গানের জলসা ছিল শীতের সন্ধ্যেরাতের এক বিশেষ আকর্ষণ। সুপারহিট নানান গানকে কণ্ঠে নিয়ে শীতের এই মাচা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই অনেক কণ্ঠশিল্পীর জন্ম। কোন পাড়ায় কোন অর্কেস্ট্রার প্রোগ্রামের খবর বাতাসের থেকেও ক্ষিপ্র গতিতে আগাম ছড়িয়ে পড়ত। পাড়া কাঁপিয়ে শীতের সন্ধ্যা গড়িয়ে অনেক রাত অবধি চলত শরীর দুলিয়ে সেই গান শোনা। অর্কেস্ট্রা শব্দটির অর্থ ‘সমবেত বাদকদল’। সেই দল থেকেও শীত বিদায় নিয়েছে অনেকদিন। সারা বছর রোজগারের তাগিদে অর্কেস্ট্রার সঙ্গে শীতের সে প্রণয় আর নেই। আজ আর কলকাতা বা বোম্বের আর্টিস্ট দেখতে আলাদা করে শীতের রাত জেগে খেলার মাঠের প্যান্ডেলে ত্রিপলে বা কাঠের চেয়ারে বসে তারকাবহুল স্টার নাইট দেখার ধূম আর নেই। ফলে শীতের কাটে নিঃসঙ্গ রাত। এখন উৎসবের মুহুর্তগুলোতে যখন সেই কন্ঠশিল্পীরাই গানের রিমেক নিয়ে বিভিন্ন পুজোমন্ডপে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেজে সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশন করেন তখন দেখি কেউ সারেগামার অংশগ্রহণকারী, কেই ইন্ডিয়ান আইডলস, কেউ বা আবার ড্যান্স বাংলা ড্যান্স বা মীরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার অভিধাতে অভিহিত। এখন হাতের ইলেকট্রনিক ডিভাইসে কয়েক হাজার গানের সম্ভার শীতের রাতের সেই গানের জলসার আকর্ষণকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। এখন সারা বছরই টিভির পর্দায়, হাতের মোবাইলে ‘তারাদের’ সহজলভ্যতা। তাই আজ আলাদা করে শীতের রাত জেগে খেলার মাঠের প্যান্ডেলে ত্রিপলে বা কাঠের চেয়ারে বসে তারকাবহুল স্টার নাইট দেখার ধূম ধীরে ধীরে হারিয়েই যাচ্ছে। তবুও দুর্গাপুজো কালীপুজোর রাতে ‘ব্র্যান্ডেড’ বা ‘রেস্তোওয়ালা’ বিশিষ্টজনেদের পুজোতে নামীদামীদের দেখতে এখনো ভিড় জমে। সঙ্গীত শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, কৌতুক শিল্পীদের সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে ব্র্যান্ডীয়করণের যুগে আমার হারিয়ে যাওয়া শীতকালের সেই ছোটবেলার অনাবিল মজার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে আর নস্টালজিক হয়ে যাই।
বাতাসে শিরশিরে অনুভূতির সঙ্গেই যেন আগাম ভেসে আসত শীতের রসনার সুবাস। মন ভালো হয়ে যেত আগাম কল্পনার রসাস্বাদনে। শৈশবের আচরণে কিছুদিনের জন্য হলেও বড় হওয়ার ভাব এনে দিত এই শীত। শীত এলেই দুই আঙুল মুখের সামনে সিগারেটের মতো ধরে বেশ লম্বা করে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়বার সময়ে বড়দের সামনে বড়গিরির সুযোগটা শীতই এনে দিত। ঘুম থেকে উঠেই কিংবা দিনের অন্যান্য সময়েও মুখের ধোঁয়া বের হতে দেখাটা ছিল আমরা যারা ছোট ছিলাম আমাদের কাছে শীতের এক উপরি আকর্ষণ। পাতা খসানোর সময় শুরুর বার্তা অনেক আগেই পৌঁছে যেত আমলকী গাছের কাছে। আর সেই সময় এক নতুন ঋতুর জন্য আমরা তৈরি হতে থাকতাম। পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে, স্টিলের আলমারির মাথা থেকে নামত লেপ, সোয়েটার, মাফলার, চাদর, শাল, শেয়ালরঙা আলোয়ান। গ্রামগঞ্জ মফস্বল শহরের পুরনো পাড়ার পুরনো বাড়িতে মনে আছে টিভি তখনও শুরু হয়নি। শীত এলেই আমাদের মফস্বলের ছোট মাঠে বা একটু বড় খোলা জায়গায় চারপাশ ঘেরা ছাউনি পড়ত। মাটি থেকে একটু উঁচুতে ছোট্ট মঞ্চ বরাবর মাটিতে ত্রিপল পেতে পুরুষ ও নারীর বসার জায়গা আলাদা করে দেওয়া হত। টিকিটের দাম খুব বেশি না হওয়ায় এবং প্রতিদিন বিভিন্ন কাহিনী পরিবেশিত হওয়ায় প্রায়দিনই এই আসরে ভিড় জমত। স্ট্রিং, রড আর গ্লাভস এই তিন ধরনের পাপেটের মধ্যে স্ট্রিং অর্থাৎ দড়ি দিয়ে উপর থেকে ঝোলানো পুতুল দিয়ে চলত এই পুতুল নাচ। সুরেলা সংলাপ আর কীর্তনের সুরে গান গেয়ে রাজা হরিশচন্দ্র, নিমাই সন্ন্যাস, কালীয় দমন, বেহুলা লক্ষ্মীন্দর, সীতাহরণ, শহিদ ক্ষুদিরাম ইত্যাদি নানান কাহিনীর সঙ্গে শৈশবকে আলাপ করিয়ে দিতে শীতের পুতুল নাচের একটা বড় ভূমিকা ছিল। এখনও চাইলে শীত শৈশবকে সেই সুযোগ দেয়, কিন্তু দেখি শীতকে জড়িয়ে আজকের শৈশবের সেইসব আবেগ, অনুভূতির সময়টাই নেই। ফলে শীত নীরবে আসে, আবার একদিন নীরবে চলেও যায়। এখন সারা বছরব্যাপী টেলিভিশনের অ্যানিমেশন চ্যানেলগুলো শৈশবের দখল নিয়েছে। শীত সেখানে অনাহুত। বদলে যাওয়া জীবন-শৈলীর বিনোদনের পসরা শীতের জন্য আলাদা করে কোনও জায়গা ছেড়ে দেয় না। তাকে ছেড়ে গিয়ে অথচ তাকে মনে রেখেই আজ তার সঙ্গীরা দিয়েছে শীত ঘুম।

শীত এলেই সন্ধেবেলায় এলাকার ছোট খালি জমিতে ব্যাডমিন্টন খেলা হত অনেক জায়গাতেই। শীতের শীতলতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই যেন সন্ধেবেলায় এই ঘাম ঝরানোর আয়োজন। আমরাও খেলতে যেতাম। শীতের গোটা সময়টাই সান্ধ্য এই খেলা চলত। শীতের শেষভাগে কোন টুর্নামেন্ট আয়োজন করে খেলার পাট চোকানো হত সে বছরের মতো। নেটের দুই প্রান্তের খুটির মাথায় বোর্ডের বালবগুলো জ্বলে উঠতেই চারপাশ আলো আঁধারির মধ্যে ঝলমল করে উঠত রাতের ব্যাডমিন্টনের কোর্ট। না, এখন আর চিলতে জমি ফাঁকা পড়ে থাকে না, মাটি ফুঁড়ে সেখানে বিল্ডিং গজিয়ে গিয়েছে। হয়তো হাতে নেই খেলার মতো অবসরও। তাই সান্ধ্য এই খেলার উদ্যোগ কমে গিয়েছে অনেকটাই। শীত হারিয়েছে তার এই সান্ধ্য খেলার আসরকে। শীত হারিয়েছে গোলকুন্ডের আগুণে আড্ডাকেও। তীব্র শীতের দিনের যে কোনও সময় বিশেষত সন্ধ্যের পর কাঠকুটো পাতায় লাগানো আগুন গোল করে ঘিরেই বাবা কাকুদের আড্ডা জমে উঠত দেখতাম। মাঝেমাঝে পড়া শেষ হয়ে গেলে নিভন্ত আগুণের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম আমরাও। আধো অন্ধকারে উষ্ণ আগুণ ঘিরে থাকা অনেকগুলো মুখ মানেই অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক আদর্শ, অনেক স্বপ্ন চারণ, অনেক আশাভঙ্গের গল্পগাথা। তাকে ঘিরে না থাকত কোন উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, না থাকত বয়সের তারতম্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জটলা আজ প্রায় চোখেই পড়ে না। তথাকথিত আধুনিকতা আর বৃক্ষ সংরক্ষণ এই দুইয়ে মিলে শীতে আগুন পোহানো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। সমাজের নিম্নবিত্ত লোকজনদের মধ্যে কালেভদ্রে শীতের সন্ধ্যায় কাঠকুটো জড়ো করে আগুণ পোহানোর ছবিও এখন কালেভদ্রে চোখে পড়ে। এখন একলা রাতে নরম কম্বলের ওমে শীতের সেই চেনা গন্ধ আসে কই!
শীতের মাসে লেপকম্বল ছাদে শুকাতে দেওয়া, অথবা রোদে বসে কমলালেবু খেতে খেতে গল্পের বই পড়ার মধ্যে এক রকম যৌথ জীবনযাপন কৌমজীবনের অনুষঙ্গ ছিল। লাঞ্চ শেষে বারান্দায় আরাম কেদারায় গা এলিয়ে কৌণিকভাবে আছড়ে পড়া মিঠে রোদ শরীরে মেখে আলতো হাতে খোসা ছাড়িয়ে কমলা খেতে খেতে ঝিমঝিমে অনুভূতি লা জবাব। গরম চা আর নানারকম পিঠেপুলিতে সেরে নেওয়া হয় পৌষ সংক্রান্তির উৎসব। একইসঙ্গে অগুণতি আমন্ত্রণ, একাধিক আত্মীয়-স্বজন-বান্ধবের শুভ পরিণয়, যেখানে উপস্থিত থাকা ইজ আ মাস্ট, সেগুলোর কথা ভুলি কী করে? ছাদ-পিকনিক কিংবা কাছাকাছি কোনও বাগানবাড়ি ভাড়া করে দলেবলে গিয়ে হইহুল্লোড় ও খানাপিনা করে একটা বেলা কাটিয়ে আসা। শীতের শৈত্যকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতাম আমরা, আর শীতের ওমে তার হাজার মজাকে বুক চিতিয়ে আবাহন করতাম। দিন পাল্টাচ্ছে। গালভরা রাশভারী সাহেবি নাম দিয়ে বাঙালি জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে শতেক লাইফ-স্টাইল ডিজিজ। সুগার, প্রেসার, থাইরয়েড, কোলেস্টেরল, ইউরিক অ্যাসিড, গ্যাস-অম্বল, বদহজম নিয়ে নিত্য বসত করা বহু বাঙালির জীবন থেকে কাটছাট হয়ে গেছে অনেক শখ আহ্লাদ। তবু শীতের ক’টা দিন তারা বেপরোয়া থাকতে চেষ্টা করে। অসুখ তো জীবনভর থাকবে। কিন্তু কড়াইশুটির কচুরি, নলেন গুড়ের সন্দেশ, জয়নগরের মোয়া, ফুলকপির পুরভরা শিঙাড়া, টোপা টুসটুসে কমলালেবু এ সব তো মাত্র ক’দিনের অতিথি। এদের যথাযথ আপ্যায়ন না করলে হয়? আজকের পায়রার খোপের মতো ফ্ল্যাটবাড়ির কালচারে শীত সেভাবে বোঝাই যায় না। তীব্র গরমের দহন থেকে নিস্তার পেতে শীতের উত্তাপটুকুই এখন লোকে চায়।
আমাদের ছোটবেলাতে শীতের পথেঘাটে বাতাসে ভেসে আসত হিন্দি ও ইংরাজিতে অদ্ভুত নরম আওয়াজের ধ্বনি। তার সঙ্গে মাঝে মাঝেই দর্শকের উল্লাসের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত রেডিয়োর মধ্যে দিয়ে। কানে ছোট্ট রেডিয়ো ধরে পথ চলা কারও উদ্দেশে ‘দাদা কত হল? প্রশ্নটা ছিল খুব কমন। কোথাও বা খানিক বড় রেডিও ঘিরে জটলা। রেডিয়োতে ক্রিকেট কমেন্ট্রি ততদিন শুধুই শোনার জিনিস ছিল। যতদিন না সাদাকালো টিভি এসে সেই জায়গার দখল নেয়। এখন সারা বছরের ক্রিকেট তার চরিত্র বদলেছে। শুধুমাত্র শীতের সঙ্গে ক্রিকেটের যে বন্ধুত্ব সেই সম্পর্কে চিড় ধরেছে অনেকদিন। তখন বাংলা ছবির যুগ। আর বাংলা ছবি মানেই বেশিরভাগ সাদাকালো। তাই হিন্দি ছবি দেখার বাড়তি আকর্ষণই ছিল তার রঙিন চেহারা। এই রংয়ের কারণেই হিন্দি সিনেমার টিকিটের দামও ছিল বেশি। খেলার মাঠে অনেকটা জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে তার ভিতরে বাঁশের ফ্রেমে বড় সাদা পর্দা টাঙিয়ে সপ্তাহব্যাপী চলত ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। সন্ধে ও রাতে প্রতিদিন দু’টো করে শো হতো। প্রতি শোয়ের রোজের টিকিট কিংবা সারা সপ্তাহের সিজন টিকিটের ব্যবস্থা থাকত। শো চলাকালীন বেড়ার ফাঁক দিয়ে আমাদের মত ইচড়ে পক্কদের কৌতূহলী চাউনি ছিল রোজের অঙ্গ। এখন ঘরে ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় প্রতি মুহুর্তে নানান সিনেমার সম্ভার। শীত এলে বড় শহরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন হয়। কিন্তু সে এখন মাঠ ছেড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে উঠে এসেছে। বদলে গিয়েছে তার আঙ্গিক ও লক্ষ্য। শীত হারিয়েছে তার মাঠের সঙ্গীকে।

আমাদের সেই স্বার্থপূরণে শীত নীরবে আসে আবার একদিন নীরবে চলেও যায়। এখন শীত মানে শুধুই ঠান্ডা উত্তাপ আর ধোঁয়া মেশা কুয়াশার আভরণ। সেই ধোঁয়াশার আড়ালে যেন ওত পেতে থাকে কোনও বিপদ, কোনও অজানা আতঙ্ক। সকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখেছি গরিব মানুষের কাছে শীতের নির্দয় রূপ। অনেকবার দেখেছি, বিশেষ করে শীতকালেই, নিথর শায়িত শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাজ্ঞ ব্যবস্থাপক টাইপের কিছু মানুষের প্র্যাকটিকাল পরামর্শ। ঝুঁকি না নিয়ে সকাল সাড়ে ছ’টায় শীতবস্ত্রে আপাদমস্তক মুড়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে দেখি জীবনসংগ্রামে জর্জরিত মানুষ ছেঁড়া সস্তার সোয়েটার আর রোঁয়া-ওঠা মাঙ্কি ক্যাপ পরে তাঁদের চ্যালাকাঠ আর জং-ধরা টিনের ডালাগুলি খুলে চায়ের জন্য আদা পিষছেন বা খোসাসুদ্ধ দাগী আলু কাটতে শুরু করছেন তরকারির জন্য। কোথাও বা লিট্টি সেঁকার আগুনেই জমে যাওয়া হাত একটু গরম করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। ফুটপাতে এ সবের মধ্যেই পড়ে থাকে জরাজীর্ণ ভুষোকম্বলে আপাদমস্তক মোড়া আধপাগলা ভবঘুরে যে তার কাঠকুটো আর কার্ডবোর্ডের প্রাত্যহিক বেডরুম ভেঙে উঠে বসে সকালের প্রথম বিড়িটি ধরায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে এক প্রবল শৈত্যপ্রবাহ স্থায়ী হচ্ছে ধীরে ধীরে। শীতকে উপেক্ষা করে আমার দেশের অগণিত সংগ্রামী মানুষ লড়াই করছেন, অবস্থান করছেন, যুঝে চলেছেন অনেক জায়গায় সামান্য চাকরির জন্য। তীব্র শীতকালকে উপেক্ষা করে কত মানুষ এগিয়ে এসে খাবার তুলে দিয়েছেন অগণিত বুভুক্ষু জনতার পাতে, কিন্তু সহযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের উষ্ণতা কি শীতের প্রকোপ কমিয়েছে একটুও? হয়তো একটু হলেও। সঙ্গোপনে হলেও এটুকুই আশা শীতের এই সমবেত লড়াই বিফলে যাবে না।
বি:দ্র: আলোকচিত্র গুলি প্রদান করেছেন লেখক নিজে।