গৌতম চক্রবর্তী

গৌতম চক্রবর্তী

বিশিষ্ট শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, ভ্রামণিক গৌতম চক্রবর্তীর বাড়ি জলপাইগুড়ি। তাঁর প্যাশন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক সমাজকে বাস্তবের প্রেক্ষাপটে চিত্রায়িত করা। এই লক্ষ্যে চরৈবেতিকে পাথেয় করে ছুটে বেড়ান পাহাড় সহ তরাই ডুয়ার্সের কোনে কোনে কখনও চা বাগান, কখনও পুরাকীর্তিমন্ডিত মন্দির-মসজিদ-গীর্জাতে। আবার কখনো আদিবাসীদের সমাজ সংস্কৃতি সহ উত্তরের লোকসংস্কৃতিকে জানার তাগিদে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেন আদিবাসী মহল্লাতে বা চা বাগিচার কুলি লাইনে।

শীতকাল বদলায়নি, সময় বদলেছে, বদলেছি আমরা

গৌতম চক্রবর্তী দ্বারা প্রদিত
শীতকালে খেঁজুরের রস
শীতকালে খেঁজুরের রস

“পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন, ফিরে আর আসবে কি কখনও”? হয়তো আর ফিরে আসবে না। কারণ শীত হারিয়েছে তার চিরসঙ্গীদের। আজ সে বড় একা। “এক মাঘে শীত যায় না”। তাই পৃথিবীর পাক খাওয়া নিয়মে প্রতি পৌষ-মাঘে সে আবার ফিরে ফিরে আসে। আসলে শীত মানে তো শুধু উত্তাপ কমে যাওয়া নয়, বরং শীত এলে আমাদের আনন্দের উত্তাপটা যেন অনেকটাই বেড়ে যেত। কারণ শীত তার ঝুলিতে উপহার নিয়ে আসত অনেক কিছু। কিন্তু সেই শীত আর আসে কই! শীত বদলে গিয়েছে, নাকি সময়ের সঙ্গে আমরাই বদলে যাচ্ছি? বদলে যাচ্ছে আমাদের বোধ! বদলে যাচ্ছে আমাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা। বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবনশৈলী। হয়তো এই সব কিছু মিলেই বিজ্ঞান-নির্ভর সভ্যতায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। বিজ্ঞান এনে দিচ্ছে অনেক কিছু, কিন্তু হয়তো কেড়ে নিচ্ছে তার চেয়েও বেশি। ফলে অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে আমরা হয়ে পড়ছি নস্টালজিক। এখন শীত এলেই হারানো খতিয়ানের হিসেব কষতে ইচ্ছে করে। কোনও বিশেষ আত্মীয়তা না থাকলেও বিশেষত শীতকালে সন্ধ্যের পর কাঠকুটো বা পাতায় লাগানো আগুন গোল করে ঘিরেই আড্ডা জমে উঠত। সেই আড্ডায় উঠে আসত সেইদিনের শীতের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে সিনেমা, রাজনীতি, রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে সময়ে সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের খবরাখবর। আধো অন্ধকারে শীতকে ঘিরে থাকা অনেকগুলো মুখ মানেই অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক আদর্শ, অনেক স্বপ্ন চারণ, অনেক আশাভঙ্গের গল্পগাথা। তাকে ঘিরে না থাকত কোন উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, না থাকত বয়সের তারতম্য। শীতের আগুণ থাকা মানেই সকলের অবাধ যোগদান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জটলা আজ প্রায় চোখেই পড়ে না। যৌথ পরিবার ভেঙে, ফ্ল্যাটবাড়ি কালচারে আজকের শৈশব অনেকটাই সেই প্রবীণদের সান্নিধ্য হারিয়েছে। হ্যারি পটারের যুগে এসে হারিয়ে গেছে পরী ও দৈত্যেরাও। এখন একলা রাতে নরম কম্বলের ওমে শীতের সেই চেনা গন্ধ আসে কই?

ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালানোর জন্য আমাদের ছোটবেলায় আসতো শীতকাল। আর তখন থেকেই তোড়জোড় শুরু হত শীতকালকে আমন্ত্রণের। সেই তখনকার শীতকালে ত্বকের যত্ন নেওয়া দিনে গ্লিসারিন সাবানের গন্ধে আমাদের বেঁচে থাকার গল্পগুলো আজ রূপকথা। স্নান করতে যাওয়ার আগে নারকেল তেল গলিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা রোদের কাছে, উনুনের পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। এখনকার প্রজন্মের মনে হবে “কি গেঁয়ো ভুত” রে বাবা! প্রতিবার ভাবতাম পুজোর আগে কুল খাবো না। কিন্তু শেষ রক্ষা হত না কিছুতেই। ইট দিয়ে কুল পাড়ার মজা ছাড়া যায়? যায় না বলেই পকেটে পকেটে ভর্তি থাকতো কাঁচা পাকা কুল। এখনকার প্রজন্ম ভাববে “কি রে বাবা, কুল আবার খাওয়ার বিষয় হল”? “তার জন্য এত কিছু”? আচারের শিশির গায়ে রোদ পড়তো আর আমরা ছোটরা, খুড়তুতো, জেঠতুতোরা লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। আর ঠিক এই সময় ধীরে ধীরে বসন্ত পঞ্চমী’ নামটি বুঝিয়ে দিত রং লেগেছে বনে বনে, ঢেউ জেগেছে সমীরণে। একদিকে সার্কাসের ট্র্যাপিজের খেলা দেখতে দেখতে মনে হতো জীবনের আসল রং খুব সম্ভবত অ্যাডভেঞ্চার, আবার স্কুল থেকে সরস্বতী পুজোর স্বেচ্ছাসেবক হবার প্রতিযোগিতাও ছিল জীবনের আর এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার। মেয়েদের স্কুলে কে কে কার্ড দিতে যাবে এই নিয়ে কত রঙ্গরস! কাঁধে ব্যাগ, চুল উড়ছে, হিরো সাইকেলে চড়ে হাতল ছেড়ে হিরো হওয়ার বাসনাতে যেন দিগবিজয় করে ফিরতাম। গার্লস স্কুল থেকেও কেউ কেউ আসত মাঝে মাঝে। বুকের ভেতর কেমন একটা হত যা খালি চোখে দেখা যেত না। একটু উঁকিঝুঁকি, সামান্য চোখাচোখি। ঘুরে ফিরে তাকানোর পঞ্চমী প্রহর। নতুন শাড়ি সামলে নেওয়ার বয়ঃসন্ধি। আসলে প্রত্যেকের জীবনেই কিছু ‘অকথা’ থাকে। বন্ধুরা সে কথা জানবেই। স্কুলের পুজোর দ্বাদশ শ্রেণী। সারস্বত উৎসব। পরিবেশনের দায়িত্ব। সে আসে ঠিক। নিজের হাতে খেতে দিই। স্যার বলেন দেখে দিবি কিন্তু। হ্যাঁ দিই তো। প্রসাদের সঙ্গে সন্দেশ দিই। হাতে একটু ছোঁয়া লাগে। এক পলকে দুজনের দেখা। সে সময়কাল শীতকাল।

অশোকবাবুর কাছে পড়তে যাওয়ার সময় যখন সাইকেলের বেল বাজাতাম তখন সোহারই মোড়ের সেই সাদামাটা মেয়েটা, যার নাম ছিল বীণা, কেন যে ভালো লাগত আমিও জানি না, চোখের সামনে ঝুঁকে থাকা অবাধ্য চুল কানের পাশে তুলে রাখত। সে জেনে যেত এবং বুঝে নিত বেল বাজিয়ে যে আসছে পেছনে না তাকালেও দেখা যায় সেই আসা। আচ্ছা সাইকেলের বেলেরও কি মোবাইলের মত ভিন্নধর্মী রিংটোন ছিল নাকি? কোনদিন শাড়ি পড়তো, আবার কোনদিন সালোয়ার কামিজ। আমার এক বন্ধুর কাছে যখন বলেছিলাম শাড়ি পড়লে মেয়েদের বড় বড় লাগে তখন ‘প্রেমিকার বুকের সেফটিপিন’ কবিতা লিখে ফেলে সেই কবি বন্ধু সাহিত্য মহলে জবরদস্ত মুরগী। শাড়ি আসলে খুবই সংক্রামক। আসলে আমাদের অনেকের জীবনের ভালোবাসার বর্ণমালার প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল এইসব শীত বিকেলে। আমরা মফস্বলের মাঠ জুড়ে স্বপ্ন ফেরি করতাম। হাফ সেঞ্চুরি অতিক্রম করা এই বয়সে ডাকাবুকো প্রেমিকের দলকে কেউ মনে রাখে কিনা এইকথা ভাবতে ভাবতেই ছোটবেলার মুগ্ধতা ভিড় করে আসে চোখের পাতায়। বাণী বন্দনার শীতসকালে অঞ্জলি দিতে গিয়ে হৃদয়ে অবাধ্য ছেলে কার মুখ ভেবেছিল মন কি তা জানে? মনের গতিবিধি বোঝা দায় যে। কত কবি বন্ধু ছিল সেইসময় আমার ক্লাশে তা কি জানতাম? কার মধ্যে কি সুপ্ত প্রতিভা আছে কি করে জানবো? বঙ্কিমচন্দ্রের বাবু পড়াবার সময় নির্মলবাবু মজা করে মদনকে বলেছিলেন ‘বলতো মদন, ‘মদন আগুণ কি’? মদন অবলীলাক্রমে বলেছিল ‘মদন আগুণ’ হল এমন আগুণ যা বালতি বালতি জল ঢাললেও নেভে না’। সেই মদন বাসন্তীকে চিঠি লিখল ‘পলাশ ও শিমূল পাশাপাশি / আঙ্গুলে শাড়ির খুট, লজ্জা…… ভালোবাসাবাসি’। এটা নিয়ে কয়েকদিন বন্ধুমহলের জমজমাট আলোচনা ক্রমে ক্রমে জমে ক্ষীর। মদন-বাসন্তীর এখন এক ছেলে এক মেয়ে।

এটা অস্বীকার করা যাবে না আমবাঙালির কাছে শীত বরাবরই এক ‘সুস্বাদু’ মরশুম। তরতাজা সব্জিভরা বাজারে ঢুকলে খরচের হাতটাও যেন বাগে আসতে চাইত না। এই মরশুমে কেনার ক্ষমতা লাগাম ছাড়া হতেই হবে, কেন না শীত এসেছে যে। ফুলকপি কেনার পরে কই মাছ দেখলে গোটা গোটা বড়িসহ ফুলকপি আর আলু দিয়ে কইমাছের ঝোলের কথা ভেবে ঢোক গেলে না এমন নির্লিপ্ত আসক্তিহীন বাঙালি আছে কি

গৌতম চক্রবর্তী দ্বারা প্রদিত
শীতের বাজারে কমলালেবু

ইহজগতে? কিংবা মুলো, বেগুন, আলু, ধনেপাতা দিয়ে মৌরলার চচ্চড়ি যে প্রাণিত বাঙালি খায়নি তার তো বাঙালি জন্মই বৃথা। আবার কালজিরে ও পেঁয়াজ কুচি ফোড়ন দিয়ে ডুমো ডুমো করে কাটা চিকন বেগুন সহযোগে পাবদার ঝোল, নতুবা টাটকা সতেজ পিয়াজকলি দিয়ে ছোট চিংড়ির প্রিপারেশন খেয়ে কত ভিনজাতি পুরুষ যে বাঙালি শ্বশুরবাড়ি পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়েছে, হিসেব নেই। মাছেভাতে বাঙালি অনায়াসে দিনকতক মাছ ভুলে থাকতে পারে। কিন্তু সেও তো হওয়ার নয়। শীতকালের মাছ বাজার রুপোলি শস্যে ভরা। সুন্দরী মৌরলা, আদুরে কাজলি, লাবণ্যময়ী পাবদা, রূপসী বোরোলি, বিদুষী সরপুঁটি, দাপুটে কই, হ্যান্ডসাম কাতলা। শীত এলে ব্যাগে ঝলমল করত রূপসী ফুলকপি, চিরসবুজ তন্বী পেঁয়াজকলি, বার্মিজ রুবির মত গাঢ় লাল চকচকে অপরূপা টমেটো, ঝিনুক থেকে বের করা সবুজ মুক্তোর মত মটরশুটি, সপ্তমীর চাঁদের মত বাঁকা কচি সিম, ব্ল্যাকবিউটি বেগুন, লজ্জায় গোলাপী ফরসা নধর মুলো, পাটভাঙা তসরের মত সজীব পালং, পরতে পরতে রহস্যময়ী বাঁধাকপি। কাকে ছেড়ে কার কথা বলি? আসলে বাঙালির কাছে আমিষ নিরামিষে তফাৎ যে খুব কম এই ঋতু সেটাই প্রমাণ করে দেয়। কিন্তু না, আধুনিক কৃষিব্যবস্থা ফসল ফলাতে এখন আর শীতের তোয়াক্কা করে না। শীতের নিজস্ব ফসল ফলছে সারা বছর, শীতের ফুলকপি এখন সারা বছর ধরে খাচ্ছি আমরা। সেই স্বাদ আর নেই। তাই খেতে বসে অতীত আর আজকের শীত ভিন্নতা লাভ করে আমাদের হৃদয়কে আরো ব্যাথাতুর করে সুদূর অতীতে ফিরিয়ে দেয়। তবুও কিন্তু বাজার ফেরতা কর্তার ঠাসা ব্যাগে উঁকি দিয়ে আহ্লাদিত গিন্নি ঘন দুধে মালাইদার কফি নয়ত আদা দিয়ে কড়া ফ্লেভারের চা বানিয়ে আনে।

কণ্ঠ আর কণ্ঠি। শব্দদু’টো সঙ্গীতকে জড়িয়ে হলেও খানিক আলাদা। হিন্দি ও বাংলা জনপ্রিয় ফিল্মের গান যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করতেন মূলত তারাই বিভিন্ন দিকপাল কণ্ঠশিল্পীদের ‘কপি সিঙ্গার’ বা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন আমাদের ছোটবেলায়। কিশোর কন্ঠ, রফিকন্ঠ, মুকেশ কন্ঠ, লতাকন্ঠি বা আশাকন্ঠি নামে অভিহিত এই কণ্ঠশিল্পীদের শীতের সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিল। বাঁশের মাচা বেঁধে এ পাড়ায় সে পাড়ায় গানের জলসা ছিল শীতের সন্ধ্যেরাতের এক বিশেষ আকর্ষণ। সুপারহিট নানান গানকে কণ্ঠে নিয়ে শীতের এই মাচা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই অনেক কণ্ঠশিল্পীর জন্ম। কোন পাড়ায় কোন অর্কেস্ট্রার প্রোগ্রামের খবর বাতাসের থেকেও ক্ষিপ্র গতিতে আগাম ছড়িয়ে পড়ত। পাড়া কাঁপিয়ে শীতের সন্ধ্যা গড়িয়ে অনেক রাত অবধি চলত শরীর দুলিয়ে সেই গান শোনা। অর্কেস্ট্রা শব্দটির অর্থ ‘সমবেত বাদকদল’। সেই দল থেকেও শীত বিদায় নিয়েছে অনেকদিন। সারা বছর রোজগারের তাগিদে অর্কেস্ট্রার সঙ্গে শীতের সে প্রণয় আর নেই। আজ আর কলকাতা বা বোম্বের আর্টিস্ট দেখতে আলাদা করে শীতের রাত জেগে খেলার মাঠের প্যান্ডেলে ত্রিপলে বা কাঠের চেয়ারে বসে তারকাবহুল স্টার নাইট দেখার ধূম আর নেই। ফলে শীতের কাটে নিঃসঙ্গ রাত। এখন উৎসবের মুহুর্তগুলোতে যখন সেই কন্ঠশিল্পীরাই গানের রিমেক নিয়ে বিভিন্ন পুজোমন্ডপে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেজে সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশন করেন তখন দেখি কেউ সারেগামার অংশগ্রহণকারী, কেই ইন্ডিয়ান আইডলস, কেউ বা আবার ড্যান্স বাংলা ড্যান্স বা মীরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার অভিধাতে অভিহিত। এখন হাতের ইলেকট্রনিক ডিভাইসে কয়েক হাজার গানের সম্ভার শীতের রাতের সেই গানের জলসার আকর্ষণকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। এখন সারা বছরই টিভির পর্দায়, হাতের মোবাইলে ‘তারাদের’ সহজলভ্যতা। তাই আজ আলাদা করে শীতের রাত জেগে খেলার মাঠের প্যান্ডেলে ত্রিপলে বা কাঠের চেয়ারে বসে তারকাবহুল স্টার নাইট দেখার ধূম ধীরে ধীরে হারিয়েই যাচ্ছে। তবুও দুর্গাপুজো কালীপুজোর রাতে ‘ব্র্যান্ডেড’ বা ‘রেস্তোওয়ালা’ বিশিষ্টজনেদের পুজোতে নামীদামীদের দেখতে এখনো ভিড় জমে। সঙ্গীত শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, কৌতুক শিল্পীদের সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে ব্র্যান্ডীয়করণের যুগে আমার হারিয়ে যাওয়া শীতকালের সেই ছোটবেলার অনাবিল মজার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে আর নস্টালজিক হয়ে যাই।

বাতাসে শিরশিরে অনুভূতির সঙ্গেই যেন আগাম ভেসে আসত শীতের রসনার সুবাস। মন ভালো হয়ে যেত আগাম কল্পনার রসাস্বাদনে। শৈশবের আচরণে কিছুদিনের জন্য হলেও বড় হওয়ার ভাব এনে দিত এই শীত। শীত এলেই দুই আঙুল মুখের সামনে সিগারেটের মতো ধরে বেশ লম্বা করে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়বার সময়ে বড়দের সামনে বড়গিরির সুযোগটা শীতই এনে দিত। ঘুম থেকে উঠেই কিংবা দিনের অন্যান্য সময়েও মুখের ধোঁয়া বের হতে দেখাটা ছিল আমরা যারা ছোট ছিলাম আমাদের কাছে শীতের এক উপরি আকর্ষণ। পাতা খসানোর সময় শুরুর বার্তা অনেক আগেই পৌঁছে যেত আমলকী গাছের কাছে। আর সেই সময় এক নতুন ঋতুর জন্য আমরা তৈরি হতে থাকতাম। পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে, স্টিলের আলমারির মাথা থেকে নামত লেপ, সোয়েটার, মাফলার, চাদর, শাল, শেয়ালরঙা আলোয়ান। গ্রামগঞ্জ মফস্বল শহরের পুরনো পাড়ার পুরনো বাড়িতে মনে আছে টিভি তখনও শুরু হয়নি। শীত এলেই আমাদের মফস্বলের ছোট মাঠে বা একটু বড় খোলা জায়গায় চারপাশ ঘেরা ছাউনি পড়ত। মাটি থেকে একটু উঁচুতে ছোট্ট মঞ্চ বরাবর মাটিতে ত্রিপল পেতে পুরুষ ও নারীর বসার জায়গা আলাদা করে দেওয়া হত। টিকিটের দাম খুব বেশি না হওয়ায় এবং প্রতিদিন বিভিন্ন কাহিনী পরিবেশিত হওয়ায় প্রায়দিনই এই আসরে ভিড় জমত। স্ট্রিং, রড আর গ্লাভস এই তিন ধরনের পাপেটের মধ্যে স্ট্রিং অর্থাৎ দড়ি দিয়ে উপর থেকে ঝোলানো পুতুল দিয়ে চলত এই পুতুল নাচ। সুরেলা সংলাপ আর কীর্তনের সুরে গান গেয়ে রাজা হরিশচন্দ্র, নিমাই সন্ন্যাস, কালীয় দমন, বেহুলা লক্ষ্মীন্দর, সীতাহরণ, শহিদ ক্ষুদিরাম ইত্যাদি নানান কাহিনীর সঙ্গে শৈশবকে আলাপ করিয়ে দিতে শীতের পুতুল নাচের একটা বড় ভূমিকা ছিল। এখনও চাইলে শীত শৈশবকে সেই সুযোগ দেয়, কিন্তু দেখি শীতকে জড়িয়ে আজকের শৈশবের সেইসব আবেগ, অনুভূতির সময়টাই নেই। ফলে শীত নীরবে আসে, আবার একদিন নীরবে চলেও যায়। এখন সারা বছরব্যাপী টেলিভিশনের অ্যানিমেশন চ্যানেলগুলো শৈশবের দখল নিয়েছে। শীত সেখানে অনাহুত। বদলে যাওয়া জীবন-শৈলীর বিনোদনের পসরা শীতের জন্য আলাদা করে কোনও জায়গা ছেড়ে দেয় না। তাকে ছেড়ে গিয়ে অথচ তাকে মনে রেখেই আজ তার সঙ্গীরা দিয়েছে শীত ঘুম।

গৌতম চক্রবর্তী দ্বারা প্রদিত
শীতের রাতে আলো জ্বেলে ব্যাডমিন্টন খেলা

শীত এলেই সন্ধেবেলায় এলাকার ছোট খালি জমিতে ব্যাডমিন্টন খেলা হত অনেক জায়গাতেই। শীতের শীতলতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই যেন সন্ধেবেলায় এই ঘাম ঝরানোর আয়োজন। আমরাও খেলতে যেতাম। শীতের গোটা সময়টাই সান্ধ্য এই খেলা চলত। শীতের শেষভাগে কোন টুর্নামেন্ট আয়োজন করে খেলার পাট চোকানো হত সে বছরের মতো। নেটের দুই প্রান্তের খুটির মাথায় বোর্ডের বালবগুলো জ্বলে উঠতেই চারপাশ আলো আঁধারির মধ্যে ঝলমল করে উঠত রাতের ব্যাডমিন্টনের কোর্ট। না, এখন আর চিলতে জমি ফাঁকা পড়ে থাকে না, মাটি ফুঁড়ে সেখানে বিল্ডিং গজিয়ে গিয়েছে। হয়তো হাতে নেই খেলার মতো অবসরও। তাই সান্ধ্য এই খেলার উদ্যোগ কমে গিয়েছে অনেকটাই। শীত হারিয়েছে তার এই সান্ধ্য খেলার আসরকে। শীত হারিয়েছে গোলকুন্ডের আগুণে আড্ডাকেও। তীব্র শীতের দিনের যে কোনও সময় বিশেষত সন্ধ্যের পর কাঠকুটো পাতায় লাগানো আগুন গোল করে ঘিরেই বাবা কাকুদের আড্ডা জমে উঠত দেখতাম। মাঝেমাঝে পড়া শেষ হয়ে গেলে নিভন্ত আগুণের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম আমরাও। আধো অন্ধকারে উষ্ণ আগুণ ঘিরে থাকা অনেকগুলো মুখ মানেই অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক আদর্শ, অনেক স্বপ্ন চারণ, অনেক আশাভঙ্গের গল্পগাথা। তাকে ঘিরে না থাকত কোন উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, না থাকত বয়সের তারতম্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জটলা আজ প্রায় চোখেই পড়ে না। তথাকথিত আধুনিকতা আর বৃক্ষ সংরক্ষণ এই দুইয়ে মিলে শীতে আগুন পোহানো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। সমাজের নিম্নবিত্ত লোকজনদের মধ্যে কালেভদ্রে শীতের সন্ধ্যায় কাঠকুটো জড়ো করে আগুণ পোহানোর ছবিও এখন কালেভদ্রে চোখে পড়ে। এখন একলা রাতে নরম কম্বলের ওমে শীতের সেই চেনা গন্ধ আসে কই!

শীতের মাসে লেপকম্বল ছাদে শুকাতে দেওয়া, অথবা রোদে বসে কমলালেবু খেতে খেতে গল্পের বই পড়ার মধ্যে এক রকম যৌথ জীবনযাপন কৌমজীবনের অনুষঙ্গ ছিল। লাঞ্চ শেষে বারান্দায় আরাম কেদারায় গা এলিয়ে কৌণিকভাবে আছড়ে পড়া মিঠে রোদ শরীরে মেখে আলতো হাতে খোসা ছাড়িয়ে কমলা খেতে খেতে ঝিমঝিমে অনুভূতি লা জবাব। গরম চা আর নানারকম পিঠেপুলিতে সেরে নেওয়া হয় পৌষ সংক্রান্তির উৎসব। একইসঙ্গে অগুণতি আমন্ত্রণ, একাধিক আত্মীয়-স্বজন-বান্ধবের শুভ পরিণয়, যেখানে উপস্থিত থাকা ইজ আ মাস্ট, সেগুলোর কথা ভুলি কী করে? ছাদ-পিকনিক কিংবা কাছাকাছি কোনও বাগানবাড়ি ভাড়া করে দলেবলে গিয়ে হইহুল্লোড় ও খানাপিনা করে একটা বেলা কাটিয়ে আসা। শীতের শৈত্যকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতাম আমরা, আর শীতের ওমে তার হাজার মজাকে বুক চিতিয়ে আবাহন করতাম। দিন পাল্টাচ্ছে। গালভরা রাশভারী সাহেবি নাম দিয়ে বাঙালি জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে শতেক লাইফ-স্টাইল ডিজিজ। সুগার, প্রেসার, থাইরয়েড, কোলেস্টেরল, ইউরিক অ্যাসিড, গ্যাস-অম্বল, বদহজম নিয়ে নিত্য বসত করা বহু বাঙালির জীবন থেকে কাটছাট হয়ে গেছে অনেক শখ আহ্লাদ। তবু শীতের ক’টা দিন তারা বেপরোয়া থাকতে চেষ্টা করে। অসুখ তো জীবনভর থাকবে। কিন্তু কড়াইশুটির কচুরি, নলেন গুড়ের সন্দেশ, জয়নগরের মোয়া, ফুলকপির পুরভরা শিঙাড়া, টোপা টুসটুসে কমলালেবু এ সব তো মাত্র ক’দিনের অতিথি। এদের যথাযথ আপ্যায়ন না করলে হয়? আজকের পায়রার খোপের মতো ফ্ল্যাটবাড়ির কালচারে শীত সেভাবে বোঝাই যায় না। তীব্র গরমের দহন থেকে নিস্তার পেতে শীতের উত্তাপটুকুই এখন লোকে চায়।

আমাদের ছোটবেলাতে শীতের পথেঘাটে বাতাসে ভেসে আসত হিন্দি ও ইংরাজিতে অদ্ভুত নরম আওয়াজের ধ্বনি। তার সঙ্গে মাঝে মাঝেই দর্শকের উল্লাসের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত রেডিয়োর মধ্যে দিয়ে। কানে ছোট্ট রেডিয়ো ধরে পথ চলা কারও উদ্দেশে ‘দাদা কত হল? প্রশ্নটা ছিল খুব কমন। কোথাও বা খানিক বড় রেডিও ঘিরে জটলা। রেডিয়োতে ক্রিকেট কমেন্ট্রি ততদিন শুধুই শোনার জিনিস ছিল। যতদিন না সাদাকালো টিভি এসে সেই জায়গার দখল নেয়। এখন সারা বছরের ক্রিকেট তার চরিত্র বদলেছে। শুধুমাত্র শীতের সঙ্গে ক্রিকেটের যে বন্ধুত্ব সেই সম্পর্কে চিড় ধরেছে অনেকদিন। তখন বাংলা ছবির যুগ। আর বাংলা ছবি মানেই বেশিরভাগ সাদাকালো। তাই হিন্দি ছবি দেখার বাড়তি আকর্ষণই ছিল তার রঙিন চেহারা। এই রংয়ের কারণেই হিন্দি সিনেমার টিকিটের দামও ছিল বেশি। খেলার মাঠে অনেকটা জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে তার ভিতরে বাঁশের ফ্রেমে বড় সাদা পর্দা টাঙিয়ে সপ্তাহব্যাপী চলত ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। সন্ধে ও রাতে প্রতিদিন দু’টো করে শো হতো। প্রতি শোয়ের রোজের টিকিট কিংবা সারা সপ্তাহের সিজন টিকিটের ব্যবস্থা থাকত। শো চলাকালীন বেড়ার ফাঁক দিয়ে আমাদের মত ইচড়ে পক্কদের কৌতূহলী চাউনি ছিল রোজের অঙ্গ। এখন ঘরে ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় প্রতি মুহুর্তে নানান সিনেমার সম্ভার। শীত এলে বড় শহরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন হয়। কিন্তু সে এখন মাঠ ছেড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে উঠে এসেছে। বদলে গিয়েছে তার আঙ্গিক ও লক্ষ্য। শীত হারিয়েছে তার মাঠের সঙ্গীকে।

গৌতম চক্রবর্তী দ্বারা প্রদিত
কুয়াশায় ঢাকা বহুদূর

আমাদের সেই স্বার্থপূরণে শীত নীরবে আসে আবার একদিন নীরবে চলেও যায়। এখন শীত মানে শুধুই ঠান্ডা উত্তাপ আর ধোঁয়া মেশা কুয়াশার আভরণ। সেই ধোঁয়াশার আড়ালে যেন ওত পেতে থাকে কোনও বিপদ, কোনও অজানা আতঙ্ক। সকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখেছি গরিব মানুষের কাছে শীতের নির্দয় রূপ। অনেকবার দেখেছি, বিশেষ করে শীতকালেই, নিথর শায়িত শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাজ্ঞ ব্যবস্থাপক টাইপের কিছু মানুষের প্র্যাকটিকাল পরামর্শ। ঝুঁকি না নিয়ে সকাল সাড়ে ছ’টায় শীতবস্ত্রে আপাদমস্তক মুড়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে দেখি জীবনসংগ্রামে জর্জরিত মানুষ ছেঁড়া সস্তার সোয়েটার আর রোঁয়া-ওঠা মাঙ্কি ক্যাপ পরে তাঁদের চ্যালাকাঠ আর জং-ধরা টিনের ডালাগুলি খুলে চায়ের জন্য আদা পিষছেন বা খোসাসুদ্ধ দাগী আলু কাটতে শুরু করছেন তরকারির জন্য। কোথাও বা লিট্টি সেঁকার আগুনেই জমে যাওয়া হাত একটু গরম করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। ফুটপাতে এ সবের মধ্যেই পড়ে থাকে জরাজীর্ণ ভুষোকম্বলে আপাদমস্তক মোড়া আধপাগলা ভবঘুরে যে তার কাঠকুটো আর কার্ডবোর্ডের প্রাত্যহিক বেডরুম ভেঙে উঠে বসে সকালের প্রথম বিড়িটি ধরায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে এক প্রবল শৈত্যপ্রবাহ স্থায়ী হচ্ছে ধীরে ধীরে। শীতকে উপেক্ষা করে আমার দেশের অগণিত সংগ্রামী মানুষ লড়াই করছেন, অবস্থান করছেন, যুঝে চলেছেন অনেক জায়গায় সামান্য চাকরির জন্য। তীব্র শীতকালকে উপেক্ষা করে কত মানুষ এগিয়ে এসে খাবার তুলে দিয়েছেন অগণিত বুভুক্ষু জনতার পাতে, কিন্তু সহযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের উষ্ণতা কি শীতের প্রকোপ কমিয়েছে একটুও? হয়তো একটু হলেও। সঙ্গোপনে হলেও এটুকুই আশা শীতের এই সমবেত লড়াই বিফলে যাবে না।

বি:দ্র: আলোকচিত্র গুলি প্রদান করেছেন লেখক নিজে।

আরো পড়ুনশীতকাল বদলায়নি, সময় বদলেছে, বদলেছি আমরা

রবি স্মৃতির গৌরীপুর হাউস এখনও নস্টালজিক করে

জরাজীর্ণ বিশাল গৌরীপুর হাউস
অনাদৃত রবি স্মৃতির গৌরীপুর হাউস
অনাদৃত রবি স্মৃতির গৌরীপুর হাউস

কালিম্পং শহর থেকে দক্ষিণদিকে রিং কিং পিং রোড ধরে এগোলেই গৌরীপুর হাউস। ভরা পর্যটনের মরসুমেও এখানে ভিড়ভাট্টা নেই। বরং একটা গা ছমছমে ভাব। কালিম্পং শহরে বেড়াতে এসে চিত্রভানুতে অনেকেই যান। কিন্তু রবিস্মৃতি বিজড়িত গৌরীপুর হাউসের খোঁজ অনেকেই রাখেন না। এক গ্রীষ্মের ছুটিতে এরকমই এক রবীন্দ্রপক্ষে কালিম্পংয়ে মেঘ-কুয়াশা বৃষ্টির মধ্যে দূরপিনদাড়ার অদূরে রিং কিং পং রোডে অবস্থিত নিঝুম মরগ্যান হাউস, গলফ মাঠের পাশ দিয়ে হাজির হলাম গৌরীপুর হাউসের উঠানে। ‘চিত্রভানু’ আর গৌরীপুর হাউসে বেশিক্ষণ থাকব শুনে নেপালি ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলে – ‘ক্যায়া হ্যায় ইধার বাবু? কুছ নেহি’। প্রত্যুত্তরে কিছু বলার থাকে না। কারণ বাঙালির রবীন্দ্র-প্রেম এখনও পাহাড়ের উচ্চতায় উঠতে পারেনি। দূরপিনদাঁড়া রোড মঙ্গলধাম পেরিয়ে অবশেষে রাস্তার এক প্রান্তে একটা উতরাই পেরোতেই একটা ঢালের মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল আমাদের বোলেরো। এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা। একটা সরু পায়ে চলা পথ নেমে গেছে ঢাল বেয়ে। গাড়ি থেকে নামলাম। এই সরু এবড়োখেবড়ো রাস্তাটা দিয়ে গাড়ি নামবার কোনও উপায় নেই। অথচ তখন প্রকাণ্ড মোটর নামত দিব্যি। মনে মনে হিসাব করলাম তার মানে এখন যা সরু তার চেয়ে বেশ খানিক চওড়া ছিল তখন। রাস্তার ডানদিকের অংশটা ধ্বসে গেছে বহুদিন। সাবধানে নামছি। দেখতে পাচ্ছি প্রাসাদোপম অট্টালিকাকে। ইতিহাসের ভগ্নস্তূপ। অভিমান আর অহংকার একসাথে প্রতিফলিত হচ্ছে সেখান থেকে। গৌরীপুর লজ। বিশাল এলাকা জুড়ে বাগান এবং তার গাছগাছালির মাঝে অপরূপ বাড়িটিকে দূর থেকে পুরো ভূতের বাড়ির মতো মনে হয়েছিল৷ পিচ বাঁধানো পাকা রাস্তা থেকে গৌরীপুর হাউস পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তাটিও ছিল এবড়োখেবড়ো, রাশি রাশি শুকনো পাতায় ঢাকা৷

এই ভবনে কবিগুরু বাস করতেন
এই ভবনে কবিগুরু বাস করতেন

তখন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। উদোম, অনাদৃত, তাচ্ছিল্যকর ভুতুড়ে পরিবেশ। চতুর্দিকে এমন আগাছা যে দিনের বেলাতেও সে রাস্তায় হাঁটতে গা ছমছম করে৷ আর বাড়ির সামনে পৌঁছে তার চেহারা দেখে চোখে জল আসার উপক্রম হয়েছিল৷ ভেজা জংলা ঘাস, আবর্জনা, বিষ্ঠা, প্লাস্টিক এককথায় চরমতম অবহেলা। পোড়োবাড়ি, ভূতবাংলো বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিতিকিচ্ছিরি বেহাল রবি কবির স্মৃতিবিজড়িত গৌরীপুর হাউসের দেওয়ালে, কার্নিশে, জানালার খাঁজে খাঁজে গাছপালা। আগাপাশতলা শ্যাওলার কালচে আস্তরণে ঢাকা। ইতিহাসের নির্মম রসিকতাই বলতে হবে, গৌরীপুর হাউসের গায়ে এক খণ্ড মর্মর ফলকে লেখা ছিল – ‘‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫ শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে জন্মদিন কবিতা আকাশবাণীরমাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন৷” সদর দরজা বন্ধ ছিল, কিন্তু বাড়ির প্রায় সব জানালা হয় ভাঙা, নয় দু হাট করে খোলা৷ তার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি মেরে দেখলাম একেবারে বেবাক খালি, আসবাবহীন, ধুলোয় ঢাকা ঘর৷ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কোনো সামগ্রী, কোনো আসবাবপত্র সেখানে থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। দেখেছিলাম বাড়ির অনেকাংশই ভেঙে পড়েছে। ঘরের বেশিরভাগ জানলাতেই কাচ নেই। যেগুলোতে ছিল, সেগুলোও দেখেছিলাম ভাঙা। অনায়াসে ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল। দেওয়াল এবং মেঝের কিছু অংশ খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা ছিল। বাড়ির চত্বরেই চলছিল কনস্ট্রাকশনের কাজ। জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম পলিটেকনিক কলেজ স্থাপিত হবে সামনেই। কনস্ট্রাকশনের কাজের কারণেই চারিদিকে আরও বেশি জলকাদা হয়ে জায়গাটা হাঁটার অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল। আসলে ইতিহাসের সমাধি-খনন। কতবছর আর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কে জানে!

রবীন্দ্র-গবেষক রতন বিশ্বাসের নিবন্ধ থেকে জেনেছিলাম একসময় নীচের দিকে ধাপ কেটে ৬৪টি সিঁড়ি ছিল। সেসবই বা কোথায়? ভেতরে প্রবেশ করে কারা থাকে একটু খোঁজখবর করতে একটা দরজা দেখিয়ে দিল এক নির্মাণকর্মী। দরজাতে কড়া নাড়াতে বেড়িয়ে এলেন এক বৃদ্ধা। হিন্দীতে আসার কারণ জানতে চাইলে জলপাইগুড়ি থেকে এই বাড়িটি নিয়ে লিখব বলে এসেছি শুনে একাধারে বিস্ময় এবং আনন্দের অভিব্যাক্তি ফুটে উঠল তাঁর চোখেমুখে। অত্যন্ত খাতির করে ভেতরের ভাঙাচোরা অথচ পরিপাটি করে গোছানো ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। হিন্দীতে কাকে যেন ডাকলেন। কিছুক্ষণ পড়ে এলেন মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। তিনিই এই বাংলোর কেয়ারটেকার। নাম মাণিক শর্মা। বাংলোর অস্থায়ী কেয়ারটেকার। একতলার যে অংশটা এখন মাটিতে মিশে গিয়েছে, ঠিক তারই ওপরের অংশে একটা ঘর নিয়ে থাকেন তিনি, স্ত্রী সঞ্জিতা শর্মা আর তাঁর তিনটি ফুটফুটে মেয়ে। এছাড়া কতকগুলো মোরগ-মুরগি। মাণিকের মুখে জানলাম সেখানে তাঁরা রয়েছেন চার পুরুষ ধরে। তাঁর মাতামহ এই বাড়ির চৌকিদার ছিলেন।  মানিকের মা কৃষ্ণা শর্মার এখন বয়স প্রায় নব্বই৷ তিনিই আগে বাংলোটা দেখাশোনা করতেন৷ মানিক জানালো ছোটবেলায় আলখাল্লা পরা লম্বা একজন মানুষকে কখনও কখনও বাংলোতে থাকতে দেখতেন৷ ওঁর সামনে যেতে মায়ের ভয় করত৷ তাঁর মা তখন খুব ছোট, সেসময় রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন। ছোট্ট কৃষ্ণা নাকি দাড়িওয়ালা বৃদ্ধকে রীতিমত ভয় পেতেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি এসে হাঁক দিতেন -‘বিটি, মিঠাই লে আ’। পরবর্তীকালে সঞ্জিতার বাবা পদমলালও চৌকিদারি সামলেছেন।

বাংলোর অস্থায়ী কেয়ারটেকার মানিকের সহায়তায় বাড়ির ভেতরে ঢোকার সৌভাগ্য হল। সুন্দর একটি ভারতীয় ও পাশ্চাত্য মিশ্ররীতিতে প্রস্তুত সাদা দোতলা বাংলোবাড়ি। একাধিক ব্যালকনির রেলিঙে পাথরে জাফরির কাজ। অনেকখানি জায়গা নিয়ে, পাহাড় কেটে কেটে, কখনও বড় বড় পাথর সাজিয়ে ধাপ বানানো, আবার নিচের দিকে ৬৪ টি সিঁড়ি ভেঙে প্রশস্ত জায়গাতে। বোঝাই যাচ্ছিল বাড়িটি ছিল অপূর্ব সুন্দর। ঘরে

জানালা দরজার কাঁচ সব ভেঙে পড়েছে
জানালা দরজার কাঁচ সব ভেঙে পড়েছে

ঘরে ছিল প্রচুর আলো। দরজা-জানলাগুলি বড় মাপের। চারদিকে বড় বড় গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, নাথুলা পাহাড় চোখে পড়ে। সামনের নির্জন উপত্যকা ছাড়িয়ে অবাধ শূন্যতা আর পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে অনন্ত আকাশ মুগ্ধ করেছিল কবিকে। এই বাড়িরই একটি ঘরে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। কবি চুপচাপ বসে থাকতেও পারতেন না। তিনি এই পাহাড়ি শহরে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসাও করতেন। দেখলাম গৌরীপুর ভবনের সেই চাকচিক্য আর নেই। বাড়িটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ভুতুড়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছে। দিনের বেলাতেই বাংলোর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গা ছমছম করে৷ ঘরগুলো সব তালাবন্ধ৷ নানা রঙের কাচের শার্সি লাগানো কাঠের দরজার খোপে চোখ রেখে দেখা যায় ময়লা ঘরে ভাঙাচোরা ফায়ার প্লেস৷ আসবাবপত্রের নামগন্ধ নেই৷ কে কবে নিয়ে গিয়েছে কে জানে৷ মানিক জানালো মালিকেরা সব আসবাব নিয়ে গিয়েছেন৷ বাঁধানো ছবিগুলোও৷ দোতলার যে ছোট বারান্দাটায় রবীন্দ্রনাথ বিশ্রামের জন্য এসে বসতেন, একসময় সেখান থেকে দেখা যেত কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নাথুলা। এখন বসতি হয়ে গেছে। দূষণের পর্দা ভেদ করে শুভ্র হিমশিখরের দৃশ্যমানতা আর সম্ভব হয় না। তবে সামনের গাছ দুটি আজও ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকবে, আরও কতদিন। এরকম ইতিহাসের স্মৃতি-বিজড়িত জায়গায় এসে এই গাছেদের দেখে মনে হয়, যদি ওরা কথা বলতে পারত, কোনোভাবে!

জানিনা কখন মন চলে গিয়েছিল সুদূর অতীতে। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ১৯৩৮ সালের ২৫ শে বৈশাখের সেই দিনটি। পরিব্রাজক, সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল ‘দেবতাত্মা হিমালয়ে’ গৌরীপুর হাউসে কবির জন্মদিন পালনের কথা উল্লেখ করেছেন। মংপু থেকে ড: মনমোহন সেন, মৈত্রেয়ীদেবী, চিত্রিতাদেবী এলেন। সেন পরিবার ছাড়াও ২৫শে বৈশাখ উপলক্ষ্যে কবির অতিথি হয়ে এসেছিলেন ‘যুগান্তরে’র সম্পাদক পরিব্রাজক-সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল। কবির জন্য যুগান্তরের ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী সংখ্যা’র বেশ কিছু কপি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘দেবতাত্মা হিমালয়’-এ সেই যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়েছেন প্রবোধকুমার। তাঁর ভাষাতেই, “সেটা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ এবং বাংলা তারিখ ছিল ২৫ বৈশাখ। মহাকবির জন্মদিনে আমরা যাচ্ছিলুম কালিম্পং-এ। রবীন্দ্রনাথ তখন সেখানে”। সময়কাল ১৯৩৮। সেই সময় অশোককুমার সেন ছিলেন আকাশবাণী কলকাতার কেন্দ্র অধিকর্তা। কবিকণ্ঠে জন্মদিন কবিতা সম্প্রচার করার জন্য কালিম্পং ট্রাংক টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়। গৌরীপুর ভবন থেকেই ১৯৩৮ সালের ২৫ বৈশাখ  আকাশবাণীর বেতার-তরঙ্গে কবির বিখ্যাত ’জন্মদিন’ কবিতাটি পাঠ করার উদ্যোগ আয়োজন করা হল। ট্রাঙ্ক টেলিফোনে যোগাযোগ হল কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে কালিম্পঙের। অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা শাখার অধ্যক্ষ কালিম্পং এসে পৌঁছলেন। এসেছিলেন বেতার-বিশেষজ্ঞ নৃপেন্দ্র মজুমদার যিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ভারতীয় অনুষ্ঠানগুলির প্রযোজক ছিলেন। প্রবোধকুমার সান্যাল লিখছেন- “আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ঝড়ও ছিল প্রচন্ড। বৃষ্টি, পাহাড়ের ভাঙন, দূর্যোগের ফলে রাস্তায় কয়েকদিন আগে পোঁতা টেলিফোনের খুঁটিগুলি উপড়ে পড়েছিল। অনুষ্ঠানের সময় এগিয়ে এল। টেলিফোন সংযোগ কয়েকবার পরীক্ষা করা হল। সেদিনই কবির হাতে দূরভাষ কেন্দ্রের উদ্বোধন হবে। ট্রাঙ্ক টেলিফোনে জুড়বে কলকাতা আর কালিম্পং। টেলিফোন পরীক্ষা হল বারবার”।

ধীরে ধীরে সূর্য ঢলে পড়ল দুরপিন পাহাড়ের অস্তাচলে। সাড়ে সাতটা কী আটটার সময়ে বেল বাজল। কবি গিয়ে বসলেন নির্দিষ্ট আসনে। সকলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। কবি গৌরীপুর ভবনের একটা ঘরে বসে আছেন। দরজা, জানালা বন্ধ। বাইরে থেকে যেন কোনও শব্দ ভিতরে ঢুকতে না পারে। সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করে দেওয়া হল অবাঞ্ছিত শব্দের হাত থেকে মুক্তি পেতে। বাইরে রাখা আছে রেডিও সেট। কবির আবৃত্তি কলকাতা ঘুরে ব্রডকাস্ট হবে সেই যন্ত্রে। সোজা কলকাতা পৌঁছে বেতারে ছড়িয়ে পড়বে দেশ জুড়ে। সকলেই তখন প্রচন্ড কৌতূহলী। সকলের মধ্যে জন গ্রাহামও ছিলেন। বাড়ির চারিদিকে বসানো হয়েছিল টেলিফোনের তার। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, আবেগ, ইতিহাস সব একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সৌজন্যে ওই একটি মানুষ। প্রবোধ সান্যাল লিখছেন- “মহাকবি মাঝে মাঝে একবার ভীষণ শব্দে গলা ঝাড়া দেন, একথা সকলেরই মনে আছে। কিন্তু কাব্য পাঠকালে সেই আওয়াজটির দাপটে সূক্ষ্ম যন্ত্রটা বিদীর্ণ হয়ে যাবে কিনা এই আশঙ্কাটা ছিল রথীন্দ্রনাথ প্রমুখ অনেকের মনে। সেজন্য উদ্বেগও ছিল”। তখন সাড়ে সাতটা থেকে আটটা। গৌরীপুর ভবনের ঘরে বসে কবির কন্ঠ থেকে উচ্চারিত হল ‘‘আজি মম জন্মদিন / সদাই প্রাণের প্রান্তপথে / ডুব দিয়ে উঠেছে সে / বিলুপ্তির অন্ধকার হতে / মরণের ছাড়পত্র নিয়ে।…(জন্মদিন, সেঁজুতি)। টানা পনেরো মিনিটের পাঠ। একটি দীর্ঘ কবিতা। নাম ‘জন্মদিন’। পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল। আবৃত্তি শেষ। সেই পাঠ ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা, সেখান থেকে দিল্লী, বোম্বাই, লখনৌ, পেশোয়ার, লাহোর। একই সময়ে ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত মুখরিত হল বিশ্বকবির উদাত্ত কণ্ঠের মাদকতায়। সেই মায়াবী মুহুর্তের অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন প্রবোধকুমার- “আমাদের পায়ের নীচে কালিম্পং থর থর করতে লাগলো কিনা সেকথা তখন আর কারো মনে রইলো না। জ্যোৎস্না ছিল সেদিন বাইরে। একটা মায়াচ্ছন্ন স্বপ্নলোকের মধ্যে আমরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিলুম। ভুলে গিয়েছিলুম পরস্পরের অস্তিত্ব।” প্রথম লাইভ ব্রডকাস্ট। কালিম্পঙের সাথে কলকাতার দূরভাষ যোগাযোগটিও সেদিনই স্থাপিত হল, যোগ্যতম লোকের হাতেই। ধীরে ধীরে কালিম্পঙের পাহাড়ি নির্জনতাও ফিরে এল।

জরাজীর্ণ  গৌরীপুর হাউস
জরাজীর্ণ গৌরীপুর হাউস

ইহা পর কালা বিল্লি লেকে শ্যুটিং হুয়া থা…!’ এই তথ্য জানান দিল মানিকের শিশুকন্যা সফিয়া। ব্রাউন সাহেবের প্রিয় পোষ্য সাইমন নামের বিড়ালটির প্রেতাত্মা আর্বিভূত হয়েছিল গৌরীপুর হাউসের পোড়ো বাংলোতেই। সেখানেই ‘যেখানে ভূতের ভয়’ ছবির শ্যুটিং করে গিয়েছেন সন্দীপ রায়। কালিম্পংয়ের উতরাইতে দুরপীনদাড়া রোডের গৌরীপুর বাংলোর চৌকিদার মানিকের মেয়ে সফিয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে সেই শুটিং এর কথা জানাল আমাকে। কালিম্পংয়ের এই বাংলোয় বসেই ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘জন্মদিন’৷ পাহাড়ি শহরে টেলিফোন চালু হওয়া উপলক্ষে এ বাড়ি থেকেই কবির স্বকন্ঠে উচ্চারিত কবিতা দেশজুড়ে সম্প্রচার করেছিল আকাশবাণী৷ সেই বাড়িতে কিনা বেড়ালের প্রেতাত্মার আগমন! হজম করতে কষ্ট হয় বৈকি। এক সময় এ বাড়িতে বসেই বিশ্বকবি লিখে গিয়েছেন একটার পর একটা কবিতা৷ সে সময়কার রঙিন কাচের শার্সি লাগানো দরজা, ফায়ারপ্লেস, বড় বড় জানালা – সবই রয়েছে এখনও৷ শুধু মলিন থেকে মলিনতর হয়েছে অবস্থা৷ জীর্ণ হয়েছে দেওয়াল-দরজা-জানালা৷ খসে পড়েছে চাঙড়৷ রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা এতই খারাপ যে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত গৌরীপুর হাউস এখন কিনা এলাকায় পরিচিত ভূত বাংলো বলে! গা ছমছমে ভূতের ছবির শ্যুটিং স্পট হিসাবে হালে বেশ কদর হয়েছে জরাজীর্ণ গৌরীপুর বাংলোটির৷ সন্দীপবাবু গোটা উত্তরবঙ্গ চষে বেরিয়েছিলেন সত্যাজিতের ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’-র জন্য উপযুক্ত পুরনো বাংলোর সন্ধানে৷ শেষপর্যন্ত কালিম্পংয়ের গৌরীপুর হাউসের খোঁজ পান৷ একনজরেই পছন্দ হয়ে যায় তাঁর৷ সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় ফোন করে ইউনিটকে জানিয়ে দেন, ঠিকঠাক বাড়ির সন্ধান মিলেছে৷ পরে গৌরীপুরের বিখ্যাত জমিদার পরিবারের সদস্য সীমা রায়চৌধুরীর সহায়তায় বাড়িটি ব্যবহার করার সুযোগ পান সন্দীপবাবু৷

গৌরীপুর লজের চৌহদ্দিতে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কেন জীবন সায়াহ্নে উপনীত হয়ে চিরনবীন কবি ছুটি কাটাতে মংপু আর কালিম্পং এই দুটি জায়গাতেই কেবল আসতেন পালা করে। অথচ পাহাড় তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল না বলে মৈত্রেয়ী দেবী কিন্তু উল্লেখ করেছেন। কবি নিজেকে বলেছিলেন ‘পৃথিবীর কবি’। দেশ-বিদেশের নানান কোণায় মাটির সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল তাঁর পায়ের ছাপ। তাহলে শেষ বয়সে কিসের টানে বারবার ছুটে এসেছিলেন এই গিরিরাজির কোলে? কেবলই মৈত্রেয়ী দেবীর প্রতি ভালবাসার টানে নাকি বাংলার পাহাড়ের অপার্থিব সৌন্দর্য্যের কাছে ধরা দিতে? গৌরীপুর লজ ‘আসবাবশূন্য নিরলঙ্কার। এখানে কেউ কোনো দিন বাস করেছে বলে মনে হয় না। এখন মানুষ বাস করে। রবীন্দ্রনাথ এখানে এলে বেশ অনেকগুলো ঘর ব্যবহার করতেন। সুবিশাল অট্টালিকায় ঘরের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। কিন্তু কোন ঘরগুলো ব্যবহার করতেন তিনি? প্রতিমা দেবীই বা কোন ঘরে থাকতেন? কবির একটি আলাদা বসবার ঘর ছিল। মৈত্রেয়ী দেবীরা এলে সেই ঘরের পাশের ঘরে থাকতেন। সেগুলোই বা কোনগুলো? সঞ্জিতা দেখাতে পারেননি। এজন্য তাঁকে দোষ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এত খুঁটিনাটি কথা তাঁর জানার কথা নয়। যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়েরই ভেঙে পড়বার উপক্রম, সেখানে একসময়ে রবীন্দ্রনাথ এসে কোন ঘরে থাকতেন এসব জেনে তাঁর লাভ কী! কবির সম্বন্ধে যতটুকু পড়েছি তাতে জেনেছি, তাঁর দৃষ্টি চলে যেত বহুদূর। সুদূরের পিয়াসী মানুষটি যে সুদূরকেও অতিক্রম করে গেছেন। শুধু সাদা চোখের দৃষ্টিতে নয়, অন্তর্দৃষ্টিতেও। সামনের গাছ থেকে শুকনো পাতা ঝরে এসে পড়েছে বারান্দায়। আমার জুতোর চাপে মর্মরধ্বনি উঠছে তাদের। যেন একটা দীর্ঘশ্বাসকে চাপা দিয়ে মারতে চাইছে কেউ। সঞ্জিতার কথা আর কানে ঢুকছে না তখন। আমি যেন ফিরে গিয়েছি সেই অদেখা সময়ে। সময়টা যে বড় প্রিয় আমার।

মনে হয়, কবিগুরুর ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’-র শিশিরবিন্দুটিকে খুঁজতেই বুঝি এই স্বেচ্ছা-প্রত্যাবর্তন। ছোট পাহাড়ি শহর কালিম্পং। এখানে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। যাতায়াতের পথও ছিল সমস্যাসঙ্কুল। শিলিগুড়ি থেকে দূরত্ব ৫০ মাইল। তিস্তার পাশ দিয়ে রাস্তা, দুই পাহাড়ের মাঝখানে তিস্তা, জঙ্গল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া সে এক অপূর্ব ভয়চকিত আনন্দ। রঙ্গিত ও তিস্তার মিলন আর হিমালয়ের দীর্ঘ বিস্তার। কবিকে এই পরিবেশ খুব কাছে টেনেছিল। রবি ঠাকুর বড্ড ভালোবাসতেন এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরটিকে। তাঁর পাহাড় ভ্রমণ প্রসঙ্গে দুই শৈলশহর কালিম্পং ও মংপুর নাম উঠে আসে। দুটি শহরেই তিনি চারবার করে থেকেছেন। কালিম্পংয়ের প্রতি কবিগুরুর এক বিশেষ টান এবং ভালোবাসা, কালিম্পংয়ের মৌন ধ্বনিহীন প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কবি সেঁজুতি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন কালিম্পংয়ের এই গৌরীপুর হাউসে৷ শুধু কবিতা নয়, চিঠিপত্র, গদ্যরচনা যা অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। কালিম্পংকে ভীষণ ভালোবাসতেন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর সীমান্তে কালিম্পংয়ের কথা উঠলেই অমিয় চক্রবর্তীকে কবির লেখা চিঠিতে কবিতাটির কথা মনে আসে। কবিতার লাইনগুলো- ‘‘পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে, / শূন্যে আর ধরাতলে, মন বাঁধে ছন্দে আর মিলে / বনেরে করায় স্নান শরতের সোনালী / মাঝখানে আমি আছি, চৌদিকে আকাশ তাই / নিঃশব্দে দিতেছে করতালি / আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ, / জানে তাকে এ কালিম্পং।’’ পরিব্রাজক, সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল ‘দেবতাত্মা হিমালয়ে’ গৌরীপুর হাউসে কবির জন্মদিন পালনের কথা উল্লেখ করেছেন “মনে পড়ে সেই ২৫শে বৈশাখের অপরাহ্ন। কবি রয়েছেন গৌরীপুর প্রাসাদে। বৈদান্তিক অ্যাটর্নি হীরেন দত্ত আছেন, আছেন রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, অনিল চন্দ, মৈত্রেয়ী আর চিত্রিতা৷ শ্ৰীযুক্ত অমল হোমের কলম এবং রজনীগন্ধার গুচ্ছ কবির হাতে তুলে দিয়ে প্রণাম করলুম”।

কথা প্রসঙ্গে দেখলাম বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে সঞ্জিতার গলায় যথেষ্ট উৎকণ্ঠা। সন্দীপ রায়ের ‘যেখানে ভূতের ভয়’-এর ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’-র শুটিং এ বাড়িতেই হয়েছিল। সঞ্জিতা তখন সন্দীপকে অনুরোধ করেছিলেন, যদি বাড়িটার কিছু ব্যবস্থা করা যায়। ফল হয়নি। তাই বাড়ির সাথে সাথে সঞ্জিতাও কেবল দিনই গোনেন। এই বুঝি বিপজ্জনক নোটিশ পড়ল বাড়িতে। বেশ কসরত করে নেমে একতলার দিকটায় যেতে হল। সব ঘরে তালা ঝুলছে। একটা ফলক। ‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫ শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে “জন্মদিন” কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন’। কে ফলকটি করিয়েছিলেন সেসব কিছু লেখা নেই। তবে যিনিই করিয়েছিলেন ভারতীয় গণমাধ্যমের ইতিহাসে যে প্রথম লাইভ টেলিকাস্টের ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল এই বাড়ি অন্তত সেই স্বীকৃতিটুকুর লিখিত খোদাইটি করিয়েছিলেন। কালিম্পংয়ে রায়চৌধুরি পরিবারের গ্রীষ্মকালীন আবাস গৌরীপুর হাউস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য৷ অথচ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই স্মৃতি আজ ধূলাচ্ছন্ন৷ আত্মবিস্মৃত বাঙালি নিজের ইতিহাস, নিজের ঐতিহ্য আর গর্বকে যথাযোগ্য মর্যাদায় রক্ষণাবেক্ষণ করতে জানে না৷ নয়ত কালিম্পংয়ের ঐতিহাসিক গৌরীপুর হাউস আজ পোড়ো বাড়ির চেহারা নিত না। সে নিয়ে কারও কোনো দায় নেই, দায়িত্বও নেই৷ গৌরীপুর হাউসের যাঁরা মালিক, কলকাতার সেই রায়চৌধুরী পরিবার কিন্তু বহুবার জানিয়েছিলেন কালিম্পংয়ের মতো জায়গায় প্রায় প্রাসাদতুল্য ওই দোতলা বাংলো বাড়ির সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে তাঁরা অপারগ৷ সরকার যদি চায়, অথবা অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যদি আগ্রহী থাকে গৌরীপুর হাউসকে একটি রবীন্দ্র সংগ্রহশালায় পরিণত করতে তা হলে তাঁরা সাগ্রহে রাজি আছেন৷ অথবা বাড়িটি একটি হেরিটেজ হোটেলেও রূপান্তরিত করা যায়৷ তা হলেও অন্তত রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত ইমারতটি রক্ষা পায়। কিন্তু তখনও পর্যন্ত কিছুই হয়নি৷

কবিগুরু বই পড়ছেন
কবিগুরু বই পড়ছেন

আসলে আমাদের নিত্যদিন, প্রতিমুহূর্তে, অস্থিমজ্জায়, চিন্তায়-মননে যিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন তিনি আর কেউ নন। পরমপ্রিয় অতি আপনজন গর্বের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালিকে দিয়ে গিয়েছেন পরম সম্পদ যা আমরা ফিক্সড ডিপোজিটের মতো ভাঙিয়ে তাঁর নাম জপ করে চলেছি। দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, মংপু, রংপো, রিয়াং, পেদং এগুলো বেশিরভাগই স্থানীয় তিব্বতি বা লেপচা নাম থেকে উদ্ভূত। কিন্তু কালিম্পং এর মত জায়গাতে গৌরীপুর লজ এই নামটা কেন সেই বিষয়ে কৌতূহল ছিল। আসলে কালিম্পং পাহাড়ে এসে চিরসখা রবি ঠাকুরকে নিয়ে ভাবতে গেলে গৌরীপুর হাউস এবং মংপু আমাকে খুব ভাবায়। তাই পাহাড়ি মেঘের মত এই ভাবনাগুলোও উড়ে উড়ে আসে আমার অলস মস্তিস্কে। এরকম বিশুদ্ধ বাংলা নাম তো চট করে এই অঞ্চলের কোনও জায়গার হতে পারে না। জবাবটা পেলাম কালিম্পং এর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মিলনী সঙ্ঘের সভাপতি তথা কর্ণধার দুলাল রায়ের সঙ্গে। দুলালদার কাছ থেকে জানলাম এখানকার জায়গাগুলোর নাম স্থানীয় তিব্বতি বা লেপচা নাম থেকে উদ্ভূত যেখানে ‘ঙ’ বা ং এর উপস্থিতি চোখে পড়ে। আবার নেপাল সীমান্তের কাছাকাছি সুখিয়াপোখরি, জোড়পোখরি, মানেভঞ্জং এই নামগুলো আবার নেপালি। সেক্ষেত্রে গৌরীপুর বলে কালিম্পঙে কোনও জায়গার নামকরণ রীতিমত বেমানান। দুলালদার গ্রন্থসম্ভার থেকে মৈত্রেয়ীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিতে প্রশ্নের উত্তর পেলাম।

“কল্যাণীয়েসু (য়াসু)

বীরেন্দ্রকিশোরের কাছ থেকে তাদের কালিম্পঙের বাড়ি চাবা মাত্র তারা উৎসাহপূর্ব্বক দিয়েছে ………. বউমাকে ডাক্তার দীর্ঘকাল পাহাড়ের হাওয়ায় রাখতে চায়, তাঁর সঙ্গে পরিচারিকা ও অনুচরবর্গ থাকে, এই উপলক্ষ্যে আমার ভগ্ন শরীরের ভার তার উপর দিতে চাই- আমার এখন দরকার মাতৃশুশ্রূষার……………

আসলে গৌরীপুরের বাড়ির সঙ্গে জড়িত আছে এক অন্য ইতিহাস। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বড়মাপের পৃষ্ঠপোষক ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরিরা ছিলেন এখনকার বাংলাদেশের অদূরে ময়মনসিংহের গৌরীপুর এস্টেটের জমিদার। তাঁদের সুবিশাল প্রাসাদোপম বাড়িটির নাম ছিল গৌরীপুর হাউস। সেই অনুকরণেই কালিম্পঙের বাড়িটিরও এই নাম। এখানে ব্রজেন্দ্রের পরিবার গ্রীষ্মাবকাশ যাপনে আসতেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯২৬ সালে ময়মনসিংহের মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরির নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে সেখানে গিয়েছিলেন তখন রায়চৌধুরি পরিবারের সাথে তাঁর আত্মীয়তা হয়। তবে কালিম্পঙে রায়চৌধুরিদের বাড়িটি কবে তৈরি হয়েছিল সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। এই পরিবারের স্বদেশী আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক জগতে ব্যাপক অবদান আছে। বীরেন্দ্রকিশোরের বাবা ব্রজেন্দ্রকিশোর ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক। স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসাবে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনের পত্তন যখন হয়, সেই কাজেও অর্থসাহায্য করেছিলেন ব্রজেন্দ্রকিশোর। এই সংস্থাই বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট ও বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে এই দুটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান একত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দিয়েছে। প্রবাদপ্রতিম সেতারবাদক পণ্ডিত বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির হাত ধরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের প্রতিষ্ঠা। দুলালদার সঙ্গে হাটতে হাটতে চলে এলাম গৌরীপুরের ঐতিহাসিক বাড়িটির কাছে। হেরিটেজ কমিশন নিয়ে নিলেও তখনও সেভাবে কাজ শুরু হয়নি। সেই বাড়ির সামনে পলিটেকনিক কলেজের কাজ হচ্ছিল বলে বালি, পাথর এবং নির্মাণের সামগ্রী ফেলে রাখা হয়েছিল ওই বাড়ির সামনে। মিলনী ক্লাব সেখানে কবি প্রণাম আয়োজন করে প্রতিবছর।

দুলালদার সঙ্গেই এলাম এই গৌরীপুর হাউসের কাছেই অতিশা রোডে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত চিত্রভানুতে। কবির খুব ভালো লাগত কালিম্পং। তাই কালিম্পং-এ স্থায়ী একটি আবাস তৈরি করতে চান কবি। সে বাড়িটির জমি কেনা হবে বলে কবিই স্থান নির্বাচন করে দিয়ে যান। ১৯৪১ সালে কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবীর নামে লিজে নেওয়া হয় জমি। সেখানে নির্মাণের সময় রথীন্দ্রনাথ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নির্মাণ করিয়েছিলেন। পরে বিশ্বভারতীর উপাচার্য হিসাবে রথীন্দ্রনাথ কাজে ব্যস্ত থাকলে প্রতিমাদেবী দীর্ঘদিন সেই চিত্রভানুতে ছিলেন। আর তিনি থাকার সময় চিত্রভানুর লনে তিনি কয়েকবার রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালন করেছিলেন। সেই সময় কালিম্পং টাউন হলে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালিত হলে তাতে উপস্থিত ছিলেন প্রতিমা দেবী। চিত্রভানু তৈরি হয়েছিল কবির মৃত্যুর ঠিক দু’বছরের মাথায়। তাঁর প্রয়াণের পর চিত্রভানুর দেওয়ালে

জঙ্গল আর আগাছায় ঢাকা জরাজীর্ণ স্মৃতিবিজড়িত গৌরীপুর হাউস
জঙ্গল আর আগাছায় ঢাকা জরাজীর্ণ স্মৃতিবিজড়িত গৌরীপুর হাউস

মার্বেল পাথরে কবিতার কয়েকটি লাইন খোদাইও করা হয়। কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথের স্টুডিওর নামে এই বাড়ির নামকরণ হয় চিত্রভানু। এখন যেখানে পাইন ভিউ ক্যাকটাস নার্সারি, ঠিক তার পাশেই চিত্রভানুর গেট। এ জায়গাটার নাম ছিবো বস্তি। গেটের দুদিকে লেখা তারিখ। ২২ শ্রাবণ, ১৩৫০। ৮ অগাস্ট, ১৯৪৩। ২০১১ সালের ভূমিকম্পে সেই বাড়ির অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে প্রতিমা দেবীর ব্যবহার করা টেবিল, চেয়ার, খাট সবই আছে। তাছাড়া কবিগুরুর অনেক হাতের কাজ এখানে আছে। শেষজীবনে রথীন্দ্রনাথের সাথে যখন তাঁর চির-দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে সেসময় প্রতিমা দেবী এখানে এসে দিন কাটিয়ে যেতেন। ছবি আঁকতেন। দুই শিল্পীর স্মৃতিতে ভরপুর গৌরীপুর হাউস এবং চিত্রভানু। এখন রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনস্থ নারী শিক্ষা কেন্দ্র এখানে। এখন রাজ্য সরকারের তরফে মহিলাদের হাতের কাজের কিছু প্রশিক্ষণ হয়। পাহাড়ি মহিলারা হাতের কাজ শেখেন। উপযুক্ত পথেই ব্যবহৃত হচ্ছে চিত্রভানু। গৌরীপুর ভবনটাও যদি কোনোভাবে ব্যবহৃত হতো।

আসলে মংপু হয়ে কালিম্পঙে একরাশ অভিমান আর দায়িত্ববোধ নিয়ে ইতিহাসের ভগ্নস্তূপে এসে পৌঁছেছিলাম একটা হেরিটেজ সফর এবং ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। রবীন্দ্র অনুরাগী হিসাবে আমার দুঃখ, অভিমান আর জেদ নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ক্ষেত্রসমীক্ষা করে মংপু, গৌরীপুর হাউসের হতশ্রী অবস্থা সংক্রান্ত আমার লেখাগুলি এবং ভিডিওগ্রাফির ক্লিপিংস রাজ্য হেরিটেজ কমিটি সহ উত্তরবঙ্গের নির্বাচিত মন্ত্রী, সাংসদ এবং বিধায়কদের কাছে পাঠাবো। কারণ আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ যদি সততার সঙ্গে আঁকড়ে থাকা যায় তাহলে অসীর চেয়ে এখনো মসী বড়ো। সেই বছরেই পুজোর সময়ে কালিম্পং এসে মংপু, গৌরীপুর হাউস, গ্রাহামস হোমকে বেছে নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করি প্রচুর মানুষের ইন্টারভিউ নিয়ে। তৎকালীন মাননীয় পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেব সহ হেরিটেজ কমিটিকে ফাইল পাঠাই এবং অবশেষে মংপু বাংলো, গৌরীপুর হাউসের সংস্কারের কাজ শুরু করে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রখ্যাত ভ্রামণিক প্রাবন্ধিক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের প্রাক্তন সদস্য আনন্দগোপাল ঘোষ সহ আরো অনেক রবীন্দ্র অনুরাগীর সাহায্য সহযোগিতাই সরকারের ঘুম ভাঙাতে হয়তো সাহায্য করেছিল। সেই বিশেষ দিনটায় ফিরতে ইচ্ছা করছিল বারবার। মানসচক্ষে ভেসে উঠছিল ছবিটা- অট্টালিকা চত্বর লোকে লোকারণ্য। পাশে রাখা রেডিও সেট। বিশ্বকবির কণ্ঠ বেজে উঠবে তাতে। একখানা যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী থাকা। আসলে ওই মেলাতে না পারা আর মেলাতে যাবার চেষ্টা করার অসহায়ত্ব, এই দুইয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যা ভাবছি, তা যেন সবই গল্পকথা। ইতিহাস নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তোলা বাঙালির বুঝি এতটা ইতিহাস-বিস্মৃত হওয়া সাজে না।

সামনে থেকে গৌরীপুর হাউস
সামনে থেকে গৌরীপুর হাউস

তথ্যসূত্রঃ পাহাড়ে পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ – রতন বিশ্বাস, পেপার কাটিং (আনন্দবাজার, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, বিভিন্ন ব্লগ, গুগল সার্চ, বঙ্গদর্শন ওয়েব, দুলাল রায় – সম্পাদক, মিলনী ক্লাব, কালিম্পং, শিশির রাউত – মংপু, জলপাইগুড়ি জেলা গ্রন্থাগার, পরিব্রাজক, সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল – ‘দেবতাত্মা হিমালয়’,

বি:দ্র: আলোকচিত্র গুলি প্রদান করেছেন লেখক নিজে।

আরো পড়ুনরবি স্মৃতির গৌরীপুর হাউস এখনও নস্টালজিক করে