মলয় কুমার দাস

মলয় কুমার দাস

জন্ম ২৬ জুলাই ১৯৭১। বালুরঘাট। দক্ষিণ দিনাজপুর। বি. এ। কর্মসূত্রে বর্তমান বাসস্থান শিলিগুড়ি। পেশায় পুলিশকর্মী—DSP RAF। নয়ের দশকে লেখার শুরু। মূলত কবিতাই লেখেন। লিটল ম্যাগাজিনের কবি। দীর্ঘসময় লেখা থেকে দূরে ছিলেন। কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখে থাকেন। 'সুমন' তাঁর প্রথম অণুগল্প।

সুমন

সুজন মল্লিকের ছবি

এই পাড়াতে আসার পর থেকে রোজ সকালে হাঁটতে যাই। গলির মুখে গাছতলায় রোজ দেখি সুমন ওর ঠেলা সাজায়। সবজি বেচে পাড়ায় পাড়ায়। ভোরে দু-চার কেজি একদম টাটকা শাকসবজি পাইকারি কিনে এই গাছতলায় ঠেলাতে সাজায়। জল ছেটায়। আর সাজানো শেষ হলেই উত্তরবঙ্গ সংবাদে চোখ বোলায়। মরশুমি তাজা এবং অসময়ের অনেক সবজি পাওয়া যায় ওর কাছে। মোচা, থোড়, লাউ, মানকচু সব একদম সরেস। পেপার পড়া সবজি বিক্রেতা আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ও আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে। সকালে হাঁটতে গেলে এটা ওটা কেনা আমার অভ্যাস। ও কখনও স্যার আবার দাদাও বলে মনমর্জি মতো। দেখা হলেই আমেরিকা থেকে ইজরায়েল, আর জি কর, খেলা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে। দেখি বেশ খোঁজ খবর রাখে ও। ওর ব্যবহার খুব মিষ্টি আর দাম খুব ন্যায্য। তারপর ও ঠেলা ঠেলে সবজি ফেরি করতে যায়। ওর গলাটা খুব সুললিত। একটা সুন্দর টানে ‘স ব জি’ বলে ডাক দেয়। ফ্লাটবাড়ির অনেকেই উপর থেকে ব্যাগ নামিয়ে কেনাকাটা করে। ওর বাঁধা খরিদ্দার সব। ও দশটার মধ্যে সবজি বিক্রি শেষ করে ঘরে ফেরে। পরে বেসরকারি স্কুলে গেটম্যানের কাজ করে। সংসার চলে এই করে।
সুজন মল্লিকের ছবিতা আজ সকালে দেখি সুমন বসে। সবজি গোছানো নেই। পেপার নেই হাতে। কী হলো সুমন? খারাপ কিছু? ভাঙা গলায় বললো স্যার…গলা…। বুঝলাম গলা বসে গেছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কীভাবে হলো বলাতে বললো যে, স্কুলে কোন কারণে চেঁচামেচি করে এই অবস্থা। এখন সবজি কীভাবে বিক্রি হবে? সমস্যা গুরুতর। তো আমি একটু দাঁড়িয়ে ভাবছি কী বলি কী করি। একটু মায়াও হলো। সমস্যা সহজে মেটার নয়। ভাঙা গলা সারতে সময় নেবে। কথা কম বলতে হবে। কিন্তু সবজি বিক্রি করতে হাঁক দিতেই হবে, না হলে ফ্ল্যাট বাড়ির কেউ টের পাবে না।
সমস্যার সমাধান আপাতত নেই আমার কাছেও। বললাম যে এখানেই বসে বিক্রি করো। আর কথা কম বলো। ঘরে গিয়ে নুনজলে গার্গেল করো বারবার।
ঘরে ফিরে মেয়েকে কথায় কথায় বললাম। তো ও বললো, বাবা একটা কাজ করো। আমার কাছে একটা ছোট বক্স স্পিকার আছে ব্লুটুথ, পেনড্রাইভ লাগানো যায়। বাবা তুমি সবজি বলে হাঁক দাও। আমি রেকর্ড করে পেনড্রাইভে দিয়ে দিচ্ছি । সুমনদাকে দিয়ে দিয়ো। গলা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত এইটাতে চলে যাবে মনে হয়। কথাটা মনে ধরলো আমার। কিন্তু ও সবজি ডাক কি আর আমি পারি! যাইহোক একরকম হলো। মেয়ে ল্যাপটপে বসে কি সব করে আমাকে রেডি করে দিল।
পরদিন সকালে দেখি সুমন মুখ কালো করে বসে আছে। সামনে ঠেলাতে খুব কম সবজি। ঠিক হয়নি গলা। ভোগাবে।
ওকে স্পিকার আর পেনড্রাইভ দিলাম। ও অবাক। কী হবে ইশারায় জানতে চাইলো। ওকে স্পিকার চালু করে শোনালাম ‘স ব জি’ ডাক। ও হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না! খুশি হয়েছে। একদম ঝলমলে মুখ। ওকে বললাম, আজ থেকেই শুরু করো ফেরি করা। দুপুরে চার্জ দিয়ে নেবে। পরদিন থেকে মেকানিক্যাল গলার সবজি হেঁকে বিক্রি শুরু করে দিলো। আমি নিজের এমন হেঁড়ে গলা শুনে নিজেই চমকে যাচ্ছি। শুনলাম বিক্রি সন্তোষজনক।
দিন সাতেক পর সকালে ডোরবেল। খুলে দেখি সুমন। একগাল হাসি নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো, স্যার আমার গলা ঠিক হয়ে গেছে। এই স্পিকার সব ফেরত দিতে এলাম। খুশি হলাম। যাক এইবার ও ভালোভাবে সবজি বিক্রি করতে পারবে। তারপর দেখি ঝোলা থেকে একটা কচি নধর লাউ, কুমড়োডগা টুক করে পায়ের কাছে রাখলো। দাম? চোখ জলে ভোরে গেছে দেখি। বললো, স্যার আপনি যা করেছেন আমার জন্য তা শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই এই লাউ আর শাকটুকু। আপনি না করবেন না। বলেই চোখ মুছতে মুছতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।…

ছবি: সুজন মল্লিক

আরো পড়ুনসুমন