[এই আত্মজীবনী শুধুমাত্র লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়; এটি এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। এই সংখ্যায় লেখক বরিশালের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি জমিদারি প্রথার বিবরণ, জমিদারদের শাসন, প্রজাদের প্রতি তাঁদের দায়িত্ববোধ, এবং সামাজিক উন্নয়নে তাঁদের ভূমিকা তুলে ধরেছেন। লেখক তাঁর পারিবারিক জীবন, তাঁদের সংগ্রাম, এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা পাঠকদের জন্য এক সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা হয়ে উঠবে]
বরিশাল: আমার জন্মস্থান ও ঐতিহ্যের শহর
বরিশাল শহরের কাছারি বাড়ি নামক এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়িতে আমার জন্ম হয়েছিল। দিনটি ছিল ১৯৪১ এর ১৫ই ফেব্রুয়ারি (২রা ফাল্গুন, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ), সময় সন্ধ্যা ৭-৩০ মিনিট। বড় হয়ে শুনেছি, আমার জন্মের প্রস্তুতি হিসেবে বরিশাল শহরের ফকির বাড়ি রোডের এই নিজস্ব বাড়িতেই আলাদা করে একটি আঁতুড় ঘর তৈরি করা হয়েছিল। বড় জ্যাঠামশাই সেই ঘরটি নানা গুল্ম ও লতায় ঘিরে ও আবৃত করে রেখেছিলেন যাতে কোনো অপদেবতা বা প্রেতযোনি কাছে ঘেঁষতে না পারে। এটা করার কারণ আমার বড় জ্যাঠামশাইয়ের কোনো সন্তান ছিল না, আর মেজ জ্যাঠাইমার একমাত্র পুত্র খোকামণি মাত্র আট মাস বয়সে মারা যায়। আমার বাবার বড় ভাই, মনি-জ্যাঠার প্রথম সন্তান ছিল একটি কন্যা তপতী (হারু)। তাই, আমাদের বংশে আমিই প্রথম পুত্রসন্তান। আমাদের বাড়িটি ছিল ফকির বাড়ি রোডে, রাখাল বাবুর পুষ্করিণীর বিপরীতে। সুরকি দেওয়া রাস্তা ফকির বাড়ি রোড থেকে আমাদের বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।। বাড়ির প্রবেশপথের ডানদিকে সারস্বত প্রেস, বাঁ দিকে আমাদের প্রজা ও পাইক নিবারণ জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি। সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই প্রথমে কাছারি ঘর—ডান ও বাঁপাশে তক্তপোশ, তার উপর সাদা ধবধবে চাদরে মোড়া তোশক ও তাকিয়া। মাঝখানে কাঠের টেবিল, পাশে কয়েকটি চেয়ার, টেবিলের উপর বাতিদান। কাছারি ঘরের ভেতর থেকে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়েই কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভাঙলেই মূল অন্দরমহল আর অন্দরমহলে ঢুকলেই ছিল মস্ত উঠোন – ডান ও বাঁ পাশে দুটি করে শোবার ঘর, উঠোনের শেষপ্রান্তে ডানদিকে রান্নাঘর আর তার পাশে পাতকুয়া এবং কিছুটা দূরে একটি হাতকল বা টিউবওয়েল, যাদের মেঝে ছিল সিমেন্ট বাঁধানো। মেয়েদের জন্য ছিল আলাদা স্নানঘর, যেখানে বালতিতে জল এনে রাখা হত। উঠোন পেরিয়ে ছিল মস্ত বাগান, যার মাঝখান দিয়ে সুরকি দেওয়া একফালি পথ গিয়ে শেষ হয়েছে পাশাপাশি দাঁড়ানো দুটি পাকা শৌচাগারে। বাগানের পরিচর্যা একাই করতেন বড় জ্যাঠামশাই। পথের দুপাশে ছিল রঙিন কচুপাতার গাছ, সঙ্গে ছিল নানা বাহারি ফুলগাছ ও কলাগাছ।
নদীবেষ্টিত হওয়ার কারণে এই অতিশয় সুন্দর শহর টিকে বলা হত অবিভক্ত ভারতের ভেনিস। সামনে দিয়ে বয়ে চলা নদীর তীরে ছিল ব্যস্ত স্টিমার ঘাট। কীর্তনখোলা, আড়িয়াল খাঁ, কালাবদর এবং মেঘনা নদী এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য জলপথ। কাছাকাছি যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হত শালতি নৌকা। আর ছিল সুসজ্জিত গয়নার নৌকা যার দাঁড় ছিল বেশ বড় এবং যা হাল নামে পরিচিত। আর ছিল পাল সেটি কখনও সাদা, কখনও তার উপর নানা ধরনের নকশা আঁকা থাকত। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ছিল বজরা, আর দূরপাল্লার যাত্রার জন্য ব্যবহৃত হত স্টিমার। ইংরেজ শাসনকালে, ১৭৯৭ সালে বরিশালকে প্রশাসনিক সদর হিসেবে গড়ে তোলা হয়। বরিশাল জেলায় অনেক ছোটো ও বড় মাপের জমিদার ছিলেন। তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই একটি করে কাছারি বাড়ি ছিল এই শহরে। আমাদের বাড়ির কাছেই ছিলেন পি. এল. রায় যিনি ভারতীয় বক্সিং ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সভাপতি ছিলেন। সেই বাড়ির ছেলে জর্ডন রায়ের কন্যা হল সাহিত্যিক ও সমাজসেবী অরুন্ধতী রায়। এছাড়া ছিল বরদা ব্যানার্জীর বাড়ি, লোকে বলত বরদা বাড়ুজ্জ্যের কাছারি বাড়ি। তাঁর ছেলে ডাক্তার দিলীপ ব্যানার্জী ছিলেন প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ। জেলা সদর হিসেবে বরিশালে আদালত, জেলা শাসকের অফিসসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল। দর্শনীয় স্থানের মধ্যে ব্রজমোহন কলেজ, টাউন হল, দীপালি কালী বাড়ি, পল্টন মাঠ, ঘোড়দৌড়ের মাঠ উল্লেখযোগ্য। বরিশাল, খুলনা ও পাবনা—এই তিন জেলার নাম নিয়ে প্রচলিত ছড়াটি ছিল: “বরি আছে খুলনা, খুললে বরি পাবনা“।
উত্তর শাহবাজপুরের জমিদারি: ইতিহাস, উত্তরাধিকার ও শাসন
আমাদের জমিদারি ছিল মেঘনা নদীর কূলে উত্তর শাহবাজপুরে, যার পত্তন বহু পুরোনো। পূর্বসূরিদের বর্ণনা ও লোকমুখে প্রচলিত কথায় জানা যায়, বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ভুঁইয়া ছিলেন চাঁদ রায়, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর সেনাপতি কালীনাথ গুপ্তের বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়ে চাঁদ রায় তাঁকে উত্তর শাহবাজপুর ও ভোলা দ্বীপ ‘জায়গির’ হিসেবে দান করেন। যদিও আমাদের পারিবারিক ইতিহাস কখনও প্রামাণ্যভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি, তবে জানা যায়, কালীনাথই জমিদারির পত্তন করেন, যা পরে কালীনাথ এস্টেট নামে পরিচিত হয়। পরে ব্রিটিশ রাজ থেকে রায়চৌধুরী খেতাব পান করেন এবং পরিচিত হন কালীনাথ রায় চৌধুরী নামে। বরিশাল থেকে উত্তর শাহবাজপুর যাওয়ার পথে একটি বড় পাইকারি বাজার ছিল, যা পরিচিত হয় কালীগঞ্জ নামে। জমিদার বাড়ির কাছই ভীষণ দাপুটে নদী মেঘনা, তিব্বত থেকে সাংপো( চীনা নাম ইয়ারলুং জাংবো) নামে যার শুরু, আসাম প্রদেশে প্রবেশের পরে নাম বদল করে ব্রহ্মপুত্র এবং সেখান থেকে বর্তমান বাংলাদেশে ঢুকে নেয় মেঘনা। এই মারাত্মক পাড় ভাঙা স্বভাবের জমি খেকোর হাত থেকে রেহাই পেত না জমিদার বাড়িও, যার ফলে স্থানান্তরিত হতে হত। সাথে স্থানান্তরিত হত জমিদারদের মত পাইক, লস্কর ও বরকন্দাজ। সে সময় বাংলার কিছু জমিদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তারা ডাকাত দল পরিচালনা করতেন, এমনকি নিজেরাই ডাকাতিতে নেতৃত্ব দিতেন। তবে প্রজা-বৎসল কালীনাথের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ ছিল না, বরঞ্চ জলাশয়, বিদ্যালয় নির্মাণ ও দানধ্যানের মাধ্যমে নিজেকে প্রসিদ্ধ করে তুলেছিলেন। দরিদ্র প্রজাদের কন্যাদায় মোচনে সাহায্য করতেন এবং সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।
এই কালীনাথের কোনো সন্তান ছিল না, তাই জমিদারি রক্ষার্থে এক জ্ঞাতি পুত্র জগন্নাথ-কে তিনি দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এই জগন্নাথের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শ্যামকান্ত জমিদারি গ্রহণ করেন। এই শ্যামকান্তের কনিষ্ঠ পুত্র সারদাকান্ত-ই ছিলেন আমার ঠাকুরদা। তিনি ছিলেন সদাশিব ও ধর্মপরায়ণ, বাসুদেবে নিবেদিতপ্রাণ, জমিদারির বিষয় থেকে একেবারেই নির্লিপ্ত। তাঁর দাদা রাশভারী ও পরাক্রমশালী রাজেন্দ্রনাথ জমিদারি পরিচালনা করতেন। তাঁর কর্মকুশলতার একটি উদাহরণ – মেঘনা নদীর বুকে চর গজিয়ে উঠলেই ইংরেজ সরকার জলকর প্রদান করত। একবার খবর এল, পাশের জমিদার পরদিন লেঠেল বাহিনী নিয়ে চর দখল করবেন। রাজেন্দ্রনাথ সেদিন রাতেই লেঠেল পাইক পাঠিয়ে চরের দখল নিলেন এবং রাতারাতি সেখানে একটি স্কুল ও ছাত্রাবাস নির্মাণ করে ফেললেন। আরেকটি মজার ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। রাজেন্দ্রনাথ জানতে পারেন, রান্নাঘরের ভাঁড়ার থেকে প্রায়শই সরিষার তেল চুরি হচ্ছে, কিন্তু চোর ধরা যাচ্ছে না। তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাবলেন, যেখানে সবাই বিশ্বাসী লোক সেখানে এইরকম ঘটনা কি করে ঘটতে পারে। তারপর সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। একদিন সন্ধ্যায় বারান্দায় পায়চারি করার সময় তিনি দেখলেন, এক রাঁধুনি হাতে একটি ঘটি নিয়ে শৌচালয়ের দিকে যাচ্ছে। তিনি তাকে ডাকলেন এবং দেখলেন, ঘটি সরিষার তেলে পরিপূর্ণ। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “তুমি কি আজকাল জলের বদলে তেল দিয়ে শৌচকার্য সম্পন্ন কর?” আমার বাবার কাছে শোনা, তিনি রাঁধুনি কে কোনো শাস্তি দেননি, কারণ তাঁর শক্তি এতটাই ছিল যে এক চড় খেলে রাঁধুনি কে শ্মশানে নিয়ে যেতে হত! এমনকি তাকে কাজ থেকেও ছাঁটাই করেননি। এরপর থেকে আর কখনও ভাঁড়ার ঘর থেকে কোনো জিনিস চুরি হয়নি।
রাজেন্দ্রনাথের জনহিতকর শাসন ও তাঁর প্রিয় বাঘ
রাজেন্দ্র ছিলেন আমার বাবার সেজ জ্যাঠামশাই। সে সময় বিদ্যালয়ের পাশে ছাত্রাবাস ছিল, যা জমিদার বাড়ির সংলগ্ন অংশে অবস্থিত ছিল। বিদ্যালয়টি ছিল সম্পূর্ণ অবৈতনিক, এবং ছাত্রাবাসে থাকা ও খাওয়ার সমস্ত ব্যয় এস্টেট বহন করত। ছাত্রদের খাবার জমিদার বাড়ির রান্নাঘরের সংলগ্ন হল ঘরে পরিবেশন করা হত, যেখানে প্রধান রাঁধুনির দায়িত্ব ছিল তদারকি করা। একদিন সন্ধ্যায় প্রধান রাঁধুনি রাজেন্দ্রনাথের কাছে এসে জানাল যে গোয়াল থেকে পাওয়া দুধ প্রয়োজনের তুলনায় কম। সে পরামর্শ দিল, ছাত্রদের পাতে দুধ না দিয়ে পুরো দুধ জমিদার বাড়ির লোকজনের জন্য বরাদ্দ করা হোক। রাজেন্দ্রনাথ শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, কত সের দুধ কম পড়েছে। উত্তর শুনে তিনি বললেন, “সেই পরিমাণ পানীয় জল দুধে মিশিয়ে সকলকে দেওয়া হোক, যেন কেউ বঞ্চিত না হয়।” রাঁধুনি হতবাক হয়ে বলল, “তাহলে আপনার দুধটা আলাদা করে রেখে বাকী দুধে জল মেশাই?” রাজেন্দ্রনাথ বললেন, “না, তোমাকে যা বলেছি তাই করো।” তিনি এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যে প্রধান রাঁধুনি পালিয়ে বাঁচার উপায় খুঁজছিল!
আরেকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য—রাজেন্দ্রনাথ সে সময় বাড়িতে একটি বাঘ পুষতেন। একবার শিকারে গিয়ে তিনি একটি অনাথ ব্যাঘ্র শাবক পান। নিঃসন্তান রাজেন্দ্রনাথ সেই শাবকটিকে পুত্র স্নেহে লালন পালন করতে শুরু করেন। ছোটবেলায় বাঘটি সর্বদাই তাঁর ছায়াসঙ্গী হিসেবে থাকত। কিন্তু ধীরে ধীরে বড় হয়ে যখন সে মাংস খেতে শিখল, আশেপাশের লোকজন ভয় পেতে শুরু করায় তিনি বাড়ির ভেতর একটি সুন্দর বড় খাঁচা তৈরি করে, যেখানে বাঘটিকে রাখার বন্দোবস্ত করলেন। প্রতিদিন কাজে বেরোনোর আগে বাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বাঘটির সাথে কথা বলতেন। বাঘ কী উত্তর দিত, তা একমাত্র তিনিই বুঝতেন—আর কেউ বুঝতে পারত না! তবে বাঘ থাকার কারণে আর ডাকাতদের উপদ্রবও কমে গিয়েছিল। বাঘটি তখন যৌবনে উপনীত, মাঝে মাঝে তার গর্জন অনেক দূর থেকেও শোনা যেত।সে সময় এলাকায় যাত্রাপালা, জারিগান, পালাগান, তাজিয়া ও অষ্টপ্রহর হরি সংকীর্তন প্রচলিত ছিল। পৌষের শীত পড়ে যাওয়ায়, স্থানীয় বাজারে সারারাতব্যাপী হরি সংকীর্তন চলছিল। ভোরের আলো ফুটতে তখন কিছু সময় বাকি, মণ্ডপে অগণিত শ্রোতা, যাদের বেশিরভাগই বয়স্ক। ঠিক সেই সময়ে সময় জমিদার বাড়ি থেকে বাঘের গর্জন শোনা গেল। স্থানীয় লোকেরা সেই গর্জন চিনত, তাই কেউ ভ্রূক্ষেপ করল না। কিন্তু কিছু দুষ্ট লোক রটিয়ে দিল যে বাঘ খাঁচা থেকে বেরিয়ে পড়েছে! ব্যস, শ্রোতারা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। সে এক বিশ্রী কাণ্ড, মণ্ডপে হুলস্থূল পড়ে গেল! সবাই তখন প্রাণ বাঁচাতে পালানোর চেষ্টা করছিল। পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরেজমিনে তদন্ত করতে জমিদার বাড়িতে এলেন এবং দেখলেন যে বাঘটি খাঁচার মধ্যে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে! পুলিশ স্থানীয় লোকদের আশ্বস্ত করলেও, আতঙ্কে পালানোর সময় কয়েকজন আহত হয়। সবাই বুঝতে পারল, ঘটনাটি নিছক রটনা এবং কিছু দুষ্ট লোকের কৌশল। কয়েকদিন পর, সাদা চামড়ার জেলা শাসক রাজেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি জানালেন, ইংরেজ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বাঘটিকে চিড়িয়াখানায় দান করতে হবে। রাজেন্দ্রনাথ কয়েকদিন সময় চাইলেন। পরিশেষে, প্রজাবর্গের কল্যাণার্থে, ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে এবং ইংরেজ সরকারের সঙ্গে সংঘাতে না যেতে হয়, সেই কারণে তিনি বাঘটিকে চিড়িয়াখানায় দান করতে মনস্থির করলেন। বাঘটিকে নিয়ে যাওয়ার দিন ঠিক হল। আগের দিন রাজেন্দ্রনাথ তাঁর পুত্রসম বাঘের কাছে এলেন। আদর করলেন, কথা বললেন। বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় এই ইস্পাত-কঠিন মানুষটির চোখে জল এল। তারপর তিনি নিজের শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। সারা রাত কিছুই খেলেন না। পরদিন সকালে সাজসাজ রব পড়ে গেল। বনদপ্তরের কর্তা, পুলিশ কর্তা, লোক-লস্কর ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম সবই প্রস্তুত। কিন্তু খাঁচার চাবি তো রাজেন্দ্রনাথের কাছে! সরকারি আধিকারিক এলেন তাঁর কাছে চাবি চাইতে। রাজেন্দ্রনাথ দরজা খুলে দিলেন, আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন। বালিশের তলা থেকে চাবির গোছা বের করে তাঁর হাতে দিলেন এবং বললেন, “দেখো, ওর যত্নের কোনো ত্রুটি না হয়।” বাঘটিকে অন্য খাঁচায় ঢোকানোর চেষ্টা করা হলে সে যেতে চাইছিল না। বহু কসরত করার পরে তাকে নতুন খাঁচায় ঢোকানো সম্ভব হল। গাড়ি যখন চলতে শুরু করল, বাঘটি তখন সজল নয়নে জমিদার বাড়ির দিকে ঠায় তাকিয়ে রইল। কলকাতার চিড়িয়াখানায় বাঘটি এল, কিন্তু তিন দিন ধরে কিছুই মুখে না তোলার কারণে চতুর্থ দিন, বাঘটি দেহ ত্যাগ করল। বাঘের মৃত্যুর খবর শুনে তৎক্ষণাৎ রাজেন্দ্রনাথ ছুটলেন কলকাতায়। নিজের ব্যয়ভারে মৃত বাঘটিকে স্টাফড করালেন এবং পরে সেটি দান করলেন কলকাতা যাদুঘরে। ছোটবেলায় একবার কলকাতার যাদুঘরে এই স্টাফড বাঘটিকে দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল সামনের দু’পায়ে ভর করে সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগার জীবন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দেখছিলো! তাঁর বাঁ পায়ের থাবার পাশে একটি ফলক – “দাতা: আর. এন. রায় চৌধুরী“.
তান্ত্রিক যজ্ঞ, পুত্রসন্তান ও রাজেন্দ্রনাথের নির্মম পরিণতি
রাজেন্দ্রনাথের মতো একজন সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় মানুষের জীবনে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল, যা তাঁর চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান এবং তাঁর মৃত্যুর পর সম্পত্তির মালিকানা ভাই ও ভাইপোদের হাতে যাওয়ার কথা ছিল। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন তন্ত্র-মন্ত্র, ডাকিনী বিদ্যা, ভূত-প্রেত সম্পর্কে মানুষের গভীর আগ্রহ ও বিশ্বাস ছিল। এক তান্ত্রিক বিধান দিলেন যে নিষ্পাপ ও খুঁতহীন একটি শিশুকে বলি দিয়ে তন্ত্র মতে যজ্ঞ করলে রাজেন্দ্রনাথের পুত্র প্রাপ্তি ঘটবে। রাজেন্দ্রনাথ প্রথমে রাজি ছিলেন না, কিন্তু তাঁর স্ত্রীর নিরন্তর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে অবশেষে রাজি হলেন। সেই অনুযায়ী গুপ্তচরেরা এমন একটি শিশুর সন্ধান শুরু করল। অবশেষে, একদিন একটি শিশুর সন্ধান পাওয়া গেল। সে যখন মায়ের বুকের কাছে মাদুর পাতা বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল, রাতের অন্ধকারে জমিদারের লেঠেলরা শিশুটিকে নিঃশব্দে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মায়ের কাছ থেকে তুলে নিয়ে এল। তান্ত্রিক যজ্ঞ করল এবং শিশুটিকে বলি দিল। কাজ শেষ হলে তান্ত্রিক তার পারিশ্রমিক ও উপঢৌকন নিয়ে চলে গেল।এদিকে সন্তানহারা মা ছেলের খোঁজে হন্যে হয়ে দোরে দোরে ঘুরতে লাগল। সেই দুঃখিনী মা একসময় জানতে পারল, যে জমিদার বাড়িতেই তার সন্তান আছে। সে জমিদার বাড়ির দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে রইল কিন্তু সুবিচার পাওয়ার কোন আশার আলো তখন অবশিষ্টই ছিল না। পক্ষান্তরে, তাকে পাগলিনী আখ্যা দিয়ে দারোয়ান দিয়ে হটিয়ে দেওয়া হল আর সন্তানহারা মায়ের চোখের জলে জমিদার বাড়ির মাটি সিক্ত হয়ে উঠলো। যজ্ঞের পর যথাসময়ে রাজেন্দ্রনাথের একটি পুত্রসন্তান জন্ম নিল। কিন্তু নিয়তি ছিল নির্মম। পুত্রের তখন আঠারো বছর বয়স। একদিন সে স্নান সেরে জানালার ধারে আয়নায় চুল আঁচড়াচ্ছিল।হঠাৎ মেঘের গর্জন এবং সঙ্গে বজ্র নির্ঘোষ! বজ্রপাতের সংস্পর্শে এসে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। সেই পুত্রহীনা হতভাগিনী রমণীর হাহাকার, ক্রন্দন ও বিলাপ হয়তো রায়চৌধুরী পরিবারের ওপর এক অভিশাপ বয়ে এনেছিল, যার প্রভাব থেকে হয়তো আজও মুক্তি মেলেনি। পুত্রের অকালমৃত্যুর পর, রাজেন্দ্রনাথও বেশিদিন বাঁচলেন না।
ঠাকুরদার ধর্মপরায়ণ জীবন ও অলৌকিক বিদায়
আমার আগেই বলা হয়েছে, আমার ঠাকুরদা সারদাকান্ত ছিলেন নির্লোভ, সদাশিব, জমিদারি ব্যাপারে উদাসীন ও সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। আমাদের গৃহদেবতা ছিলেন কষ্টি পাথরের তৈরি বাসুদেবের মূর্তি। অতি প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠে তিনি বাসুদেবের মন্দির ঝাড় দেওয়া, ধোয়া পোঁছা করা, স্নান পর্ব সমাপন করে বাগান থেকে ফুল তোলা, মালা গাঁথা, পূজারি এলে তাকে সাহায্য করা – এসব কাজে নিবেদিত থাকতেন। বাসুদেবই ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। এই বাসুদেবের নাম অনুসারে আমার বাবার নাম রাখা হয় বাসুদেব যা বিষ্ণুর আরেক নাম। আমার ঠাকুমা, অর্থাৎ সারদাকান্তের সহধর্মিনী, ছিলেন নাটোরের রাজকর্মচারীর কন্যা। আমি ঠাকুরদাকে দেখিনি, কারণ আমার জন্মের বহু পূর্বেই তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন তবে ঠাকুমাকে দেখেছি। তিনি ছিলেন ছোটোখাটো চেহারার মানুষ, গায়ের রং ছিল স্বর্ণাভ, এবং ছিলেন অত্যন্ত সচেতন ও বুদ্ধিমতী। বাবার মুখে শুনেছি, রাজেন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় কোনো দুরূহ সমস্যায় পড়লে আমার ঠাকুমার পরামর্শ ও মতামত নিতেন এবং তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতেন। সে যুগে মেয়ে ও বউরা অন্তঃপুরচারিণী ছিলেন। পরপুরুষের মুখ দেখাও পাপ বলে গণ্য হত। তবুও অন্তঃপুরচারিণী হয়েও ঠাকুমা সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর রাখতেন। তিনি জমিদারির গতি-প্রকৃতি, আয়ব্যয়, শরিকি ও অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন। আসলে ঠাকুরদার বিষয়-আশয়ে উদাসীনতা ঠাকুমাকে সংসারের দায়িত্বভার নিতে বাধ্য করেছিল। জমিদারির দেখাশোনার ভার ছিল একজন কমন ম্যানেজারের উপর। প্রথম কমন ম্যানেজার ছিলেন রজমোহন দত্ত যিনি হিসেব-নিকেশ সভায় দাখিল করতেন এবং শরিকদের কার কত প্রাপ্য ভাতা তা নির্ধারণ করতেন। বাবার মুখে শুনেছি, তিনি সৎ ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। যেহেতু ঠাকুরদা এসব থেকে দূরে থাকতেন, তাই কিছু শরিক তাঁকে তাঁর সঠিক প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করত এবং কমন ম্যানেজারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাত। প্রতি বছর কালীনাথ রায় এস্টেটের একটি বার্ষিক সভা হত। সেই সভায় কমন ম্যানেজার আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতেন, পরবর্তী আর্থিক বছরের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের রূপরেখা উপস্থাপন করতেন, এবং শরিকদের কার কত বাৎসরিক ভাতা প্রাপ্য তা নির্ধারণ করতেন। এই সভার মাধ্যমে কমন ম্যানেজারও পরিবর্তন করা যেত। যদিও সকল শরিককে সভায় সশরীরে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক ছিল, কিন্তু ঠাকুরদা কখনোই যেতেন না। পরিবর্তে তার খোঁজ পাওয়া যেত বাসুদেবের মন্দিরে। তবে সেই সভায় আমার ঠাকুমা উপস্থিত থাকতেন। চিকের আড়াল থেকেই তিনি ক্ষুরধার যুক্তির বেড়াজালে ষড়যন্ত্রকারীদের পর্যুদস্ত করতেন, ঠাকুরদার স্বার্থ ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতেন। রাজেন্দ্রনাথও ঠাকুমার যুক্তি মানতে বাধ্য হতেন। তিনি ছিলেন সে যুগের স্কুল-কলেজ না পড়া এক অসাধারণ নারী যার ক্ষুরধার বুদ্ধি ও দীপ্তি আজও আমাকে মুগ্ধ করে।
বরিশালের কাছারি বাড়িতে একসময় আমার ঠাকুরদা সপরিবারে বসবাস করতেন। কিন্তু কষ্টিপাথরের বাসুদেব মূর্তি ছিলেন উত্তর শাহবাজপুরের জমিদার বাড়ির মন্দিরে। একদিন অসুস্থ ঠাকুরদা অনুভব করলেন, তাঁর অন্তিম সময় প্রায় আসন্ন। ডাকযোগে তার পাঠানো হল উত্তর শাহবাজপুরের বাড়িতে। রাত হয়ে গেছে, তিনি বিছানায় শুয়ে উচ্চস্বরে বাসুদেবের জপ করতে লাগলেন। ঠাকুরদা বাড়ির সকলকে বললেন, তাঁকে যেন উঠোনে তুলসী মঞ্চের কাছে শায়িত করে রাখা হয়। তাঁর স্তবের ধ্বনি রাত্রির নিঃসঙ্গতা ভেদ করে চারদিকে ধ্বনিত হতে লাগল। সবাই অবাক হয়ে দেখল একজন মৃত্যুপথযাত্রী নিজেই সজ্ঞানে ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করছেন। তারপর একসময় সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল। এই বিশ্বচরাচরের সকল বন্ধন মুক্ত হয়ে তিনি ঈশ্বরের কোলে ফিরে গেলেন। এই মৃত্যুর সঙ্গে এক অলৌকিক ঘটনা জড়িয়ে আছে। উত্তর শাহবাজপুরে বাসুদেবের মন্দিরের পুরোহিত ঠাকুরদার অসুস্থতার সংবাদ পাওয়ার পর থেকে বিগ্রহের কাছে তাঁর রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করছিলেন। সন্ধ্যাবেলায় আরতির সময় তিনি লক্ষ্য করলেন যে বিগ্রহের গাত্র থেকে অবিরত ধারায় ঘাম ঝরছে! এতটাই যে মন্দিরের নালা দিয়ে সেই জল প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি অবাক হয়ে গেলেন। এরপর ডাবের জল দিয়ে বিগ্রহকে স্নান করানো হল, গা মুছিয়ে দেওয়া হল। ঠিক সেই সময় প্রথম বার্তা টি এসে পৌঁছেছিল, কিন্তু ঘাম থামছিল না। মূর্তির গা থেকে অবিরত জল-ধারা নেমে আসছিল। একসময় ঘাম পড়া বন্ধ হল আর তার কিছু পরে জমিদার বাড়িতে বরিশাল থেকে ঠাকুরদার মৃত্যু সংবাদ বহন করে তার এল। মৃত্যু সকল জীবের পরিণতি, আমার ঠাকুরদাও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু পরম ভক্তের অন্তিমকালে তাঁর ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করা, আবার ভক্তের কষ্টে দেবতার ব্যথাতুর ও শোকাতুর হওয়া, এটাই হয়তো ভক্তি প্রকাশের নিদর্শন।
ঠাকুমার সংগ্রামী জীবন, দত্তকপুত্র ফটিক ও তাঁর করুণ পরিণতি
আমার ঠাকুরদার ছিল পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে। ছেলেরা ছিল জীতেন্দ্র নাথ, হেমচন্দ্র, ফটিকচন্দ্র, ননীগোপাল ও বাসুদেব। কন্যারা বড় পিসি, মনি পিসি, রাঙা পিসি ও ছোট পিসি খুকী। আমার বাবা বাসুদেব ছিলেন অষ্টম গর্ভের সন্তান। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর এস্টেট থেকে যে ভাতাটা পেতেন তাই দিয়েই ঠাকুমা বহুকষ্টে সংসার চালাতেন। কুলীন দেখে বড় মেয়ের বিয়ে দিলেন, সেও কিছুদিনের মধ্যে বিধবা হয়ে ঠাকুমার সংসারে। ফিরে এল। একসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। জমিদারির একজন শরিক, যার সম্পত্তির অংশ ও প্রাপ্য ভাতা আমার ঠাকুরদার তুলনায় বেশি ছিল, তিনি দীর্ঘদিন বিবাহিত হলেও নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি আমার ঠাকুমার কাছে তাঁর এক পুত্রকে দত্তক নিতে চান, কিন্তু ঠাকুমা তীব্র আপত্তি জানান। শরিক বোঝাতে থাকেন যে যাকে তিনি দত্তক হিসেবে গ্রহণ করবেন, সেই ভবিষ্যতে উত্তরাধিকারী হবে এবং তাদের মৃত্যুর পর দত্তকপুত্রই সেই ভাতা পাবে, যা ঠাকুরদার তুলনায় বেশি। এই ভাতা ঠাকুমার সংসারে খরচ করা যাবে, যা তাঁর প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট। তখন সংসারে আর্থিক সংকট চলছিল, বাড়িতে অবিবাহিত কন্যারা ছিলেন, ছেলেদেরও রোজগার ছিল না। তাই এই টানাপোড়েনের মধ্যে একদিকে মাতৃ-হৃদয়ের টান, অন্যদিকে আর্থিক মুক্তির সম্ভাবনা – এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই ফটিকচন্দ্রকে দত্তক দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আইন মোতাবেক সেই শরিক ফটিককে দত্তক নেন, এবং তার নতুন জীবন শুরু হয়। প্রথমদিকে ফটিক খুব রাজার হালেই ছিল। দামি জামা ও জুতো পরে আমার ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করতে আসত। আমার বাবা ও জ্যাঠামশাইরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখত। এরপর ফটিক যখন একটু বড় হল ফটিককে বিয়ে দেওয়া হল। এরপর সেই জ্ঞাতি দম্পত্তির একটি পুত্র সন্তান হল। ঠিক সেই সময় থেকেই ফটিক উপেক্ষিত হতে থাকল। কিন্তু আইন মোতাবেক দত্তক নেওয়ার ফলে ফটিকই জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে স্বীকৃত হল। সেই জ্ঞাতি আদালতে আবেদন জানালেন যে এই দত্তক অবৈধ, কিন্তু আদালত তার দাবি গ্রহণ করল না। আদালতে হেরে গিয়ে জ্ঞাতি এবার অন্য পন্থা নিল। যদি ফটিক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যায় বা তার মৃত্যু ঘটে, তাহলে শরিক দম্পতির সন্তানের উত্তরাধিকার লাভে কোনো বাধা থাকবে না। তবে ফটিককে সরাসরি হত্যা করলে আদালত ও পুলিশ সন্দেহ করতে পারে, তাই তারা সেই ঝুঁকি নেয়নি। পরিকল্পিতভাবে ফটিকের ওপর অত্যাচার শুরু হয়, তার আহারের মধ্যে এমন বিষ মেশানো হয়, যা মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটায় কিন্তু মৃত্যু ঘটায় না। ধীরে ধীরে সুস্থ ফটিককে সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্থ করে দেওয়া হয়, এবং সে তার স্বাভাবিক বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে। এই অবস্থায় ফটিক মাঝে মাঝেই নিজের মা, অর্থাৎ আমার ঠাকুমার কাছে আসত এবং দুটি ভাত খেতে চাইত। সে কাতর স্বরে বলত, “তোমার তো অনেক ছেলে-মেয়ে আছে, তাদের সঙ্গে আমারও কি ভাত জুটত না? তুমি আমাকে পর করে দিলে।” আমার ঠাকুমা ছিলেন অত্যন্ত নরম মনের মানুষ। ফটিকের কথায় তার হৃদয় রক্তক্ষরণ হত।
ঠাকুমার দয়ালু মনোভাবের একটা ঘটনা মনে পরে গেলো। সে সময় যুদ্ধ ও কালোবাজারির কারণে বাংলা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। তবে আমার বাবা ও জ্যাঠামশাই ইংরেজ সরকারের কর্মী ছিলেন, তাই তারা অফিস থেকে রেশন পেতেন। রেশনে চাল, ডাল, কেরোসিন তেল, দেশলাই, চিনি এমনকি গরম কম্বলও থাকত। দুজনের মিলিত রেশন সংসারের জন্য যথেষ্ট ছিল, ফলে পরিবার দুর্ভিক্ষের কোনো আঁচ পায়নি। ঠাকুমার খাবার প্রতিদিন তার ঘরে পৌঁছে দেওয়া হত।একদিন দুপুরে ঠাকুমা খেতে বসেছেন, তখনও মুখে প্রথম গ্রাস তোলেননি। ঠিক সেই সময় সদর দরজায় এক ভিখারিনী দুর্বল কণ্ঠে ডাকতে লাগল “মা, একটু ভাত দেবে? মা, একটু ফ্যান দেবে? দু-দিন কিছু খাওয়া হয়নি।” ঠাকুমা ভিখারিনীর করুণ আর্তি শুনতে পেলেন। তিনি নিজে আসন থেকে উঠে এলেন, এবং ভাতের থালা ও ব্যঞ্জন সহ সেই ভিখারিনীকে দিয়ে দিলেন, নিজে কিছুই খেলেন না। আমার বাবাকে ঠাকুমা অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন। ফিরে আসি ফটিকের কথায়। ফটিককে আমি রাঙা জ্যাঠা বলেই ডাকতাম। রাঙা জ্যাঠার অনেকগুলো সন্তান ছিল তাদের বেশির ভাগই অল্পবয়সে মারা যায়। জীবিত থাকে একমাত্র সূর্য ও টালু। সূর্যকে আমি বড়দা ও টালুকে রাঙাদা বলে ডাকি। সংসারে বাড়ির বৌদের মধ্যে কলহ চলাকালীন বাবা হয়ত তার বৌদিদের কিছু বলতে চাইলে ঠাকুমা বাবাকে থামিয়ে দিতেন এবং বাবাকে বলতেন, তুই ওদের মধ্যে যাস্ না। কিছু বলিস না। পরবর্তীকালে ফটিকের অবস্থা দেখে আমার ঠাকুমারও মস্তিষ্কে একটু অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা হয়। আমার বাবা ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মী, সাব পোষ্টমাস্টার, সে কারণে বদলির চাকরি। কখনও সরুককাঠি, কালোকাটি বা রহমতপুর ইত্যাদি জায়গায়। সরুককাঠি থাকাকালীন হঠাৎই খবর এল ঠাকুমা মৃত্যু শয্যায়। বাবা আমাদের নিয়ে বরিশালের বাড়ীতে এল। বাড়িতে কান্নার রোল। বাবা ঠাকুমার ঘরে ঢুকলো, আমি ছোটো তাই ঢুকতে দেওয়া হল না। আমি বাইরে উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছু পরে বাবা ঠাকুমার ঘর থেকে বেরোল। বাবা ও জ্যাঠামশাইরা খাটে শায়িত ঠাকুমার দেহটি নিয়ে উঠোনে তুলসী মঞ্চের কাছে এনে রাখল। শাস্ত্রমতে কিছু ক্রিয়াকলাপ পালিত হল। বুঝলাম আমাদের জন্যই বাড়ির লোক অপেক্ষা করছিল। একটা নিঃশব্দতা বিরাজ করছিল। থেকে থেকে আত্মীয় বা অনাত্মীয় কেউ এলেই আবার একপ্রস্থ কান্নার রোল উঠত। তারপর বাবা, জ্যাঠারা ও শববাহকেরা ঠাকুমার দেহ বরিশালের শ্মশান কালিবাড়ী সংলগ্ন শ্মশানে দাহ করলেন। ঠাকুমার শ্রাদ্ধের সময় দেখলাম বাবা ও জ্যাঠাদের সকলেই ন্যাড়া, তারা একটা সুদীর্ঘ কাঠ যার মাথার দিকটা একটা বেশ বড় পুতুলের মুখ সেটা নিয়ে বাড়ির সামনে রাখাল বাবুর পুকুরে। কোমরজলে নেমে তা স্থাপন করল। এই দৃশ্য আমার মনে কিছুটা কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল।
যৌথ পরিবার, আত্মীয়দের সম্পর্ক ও পারিবারিক বন্ধন
সে সময় আমরা যৌথ পরিবারের অংশ ছিলাম। কার্যোপলক্ষে বাবা মাঝে মাঝেই বরিশাল জেলার বিভিন্ন পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টারের দায়িত্ব পালন করতেন, ফলে আমরা কিছুদিনের জন্য আলাদা থাকতাম, কিন্তু পরিবার থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হইনি। বরিশালের বাড়িতে সবাই মিলিতভাবে যৌথ পরিবার অটুট রেখেছিল। সুখ-দুঃখ সমানভাবে ভাগ করে নিত, কেউ অপরকে পর ভাবত না। আমার বড় জ্যাঠামশাই জীতেন্দ্র নাথ (জীতেন)-এর স্ত্রী, অর্থাৎ বড় জ্যাঠাইমাকে আমরা “মাগো” বলে ডাকতাম। মেজ জ্যাঠামশাই হেমচন্দ্র (হেম)-এর স্ত্রী হাসিকে “মেজমা“, সেজ জ্যাঠামশাই ননী গোপাল (ননী)-এর স্ত্রী রমাকে “মনিমা” বলে ডাকতাম। আমার রাঙা জ্যাঠা ফটিক চন্দ্র (ফটিক)-এর স্ত্রী, অর্থাৎ রাঙা জ্যাঠাইমা আমার জন্মের অনেক আগে মারা গিয়েছিলেন, তাই তাকে ডাকার সুযোগ হয়নি। সংসারে চার পিসি ছিলেন। বড় পিসিমা ছিলেন বাল্যবিধবা, তাই পিতৃগৃহেই তার আশ্রয় ছিল। এরপর ছিলেন মনি পিসি, যিনি বিবাহিত ছিলেন। তার স্বামী ধনেশ দাশগুপ্ত আসানসোলের হাটন রোডে একটি গৃহ নির্মাণ করেন। তিনি সুপুরুষ ছিলেন, আর মনি পিসির ভালো নাম ছিল স্নেহলতা। স্নেহলতার নামেই বাড়ির নাম রাখা হয় “স্নেহভবন“। মনি পিসির গায়ের রং ছিল শ্যামবর্ণী, দোহরা চেহারা, এবং তিনি অত্যন্ত কর্মঠ ছিলেন। তার ছিল তিন ছেলে – তিনু, লোহা ও সমরেশ, এবং এক কন্যা – দুর্গা।
রাঙা পিসির ছিল দুটি কন্যা, নাম মলিনা ও মীনা। বিধবা হওয়ার পর তিনি দুই মেয়েকে নিয়ে পিতৃগৃহে বসবাস করতে শুরু করেন। রাঙা পিসির গায়ের রং ছিল আমার ঠাকুমার গায়ের রঙের মতো, ঠিক যেন কাঁচা সোনা। পরে তিনি তার বড় মেয়ে মলিনাদির বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় থাকতেন। একটু স্থূলাঙ্গী ছিলেন, এবং যখন আমাদের বাড়িতে কয়েকদিন থাকতেন, সকালবেলায় পূজো-অর্চনায় ব্যস্ত থাকতেন। তিনি দুহাতের বাজুতে চন্দন দিয়ে উল্কি কাটতেন। মলিনাদির স্বামী সুবোধ সেনগুপ্তের খড়গপুর বাজারে একটি সাইকেলের শোরুম ও দোকান ছিল। তার সীরাজ ও চন্দন নামে দুই পুত্র এবং এক কন্যা ছিল। মলিনাদির ছোটবোন মীনাদির যথাসময়ে বিবাহ হয়। আমার মেজ জ্যাঠামশাই বিবাহের শর্ত হিসেবে বিমলকে ডাক বিভাগে একটি চাকরি দেন, এবং পরিবর্তে বিমল মীনাদিকে বিয়ে করেন। কিন্তু কর্মরত অবস্থায় হঠাৎই একদিন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর শোক সামলানোর সময়ও পাননি, এরই মধ্যে তার একমাত্র পুত্র সাইকেল চালিয়ে যাবার সময় খিদিরপুর অঞ্চলে পথ দুর্ঘটনায় মারা যায়। শুনেছিলাম মীনাদি বেহালা অঞ্চলে থাকতেন, কিন্তু আজ তারা কোথায়? মলিনা দি ও সুবোধবাবু বেঁচে আছেন কিনা তও জানি না। মীনাদিও বেঁচে আছেন কিনা জানি না। তবে শৈশবে তাঁদের কাছ থেকে যে স্নেহ ও মমতা পেয়েছি, তা আজও অম্লান। ওদের পরিবারের কারও সঙ্গে এখন আর কোনো যোগাযোগ নেই। আমার বড় পিসি, রাঙা পিসি ও মনি পিসি সবাই আমার বাবার চাইতে বয়সে বড় ছিলেন ছোট পিসিকে আমি শুধুমাত্র “পিসি” বলে ডাকতাম, আর বাবা ডাকতেন “খুকি” বলে। পিসি থাকতেন তাঁর স্বামী সুধীর মজুমদারের সঙ্গে, নিমতলার কাছে দর্মাহাটা বাই লেনে। তাঁর দুই ছেলে – সীপাই ও রাম, এবং দুই মেয়ে – ফুলি ও লিলি। পিসেমশাই রেল কোম্পানিতে চাকরি করতেন, এবং সীপাইদা ও রাম দুজনেই রেলে কর্মরত ছিলেন। আজ পিসি, পিসেমশাই, সীপাইদা ও তাঁর সদাহাস্য স্ত্রী ডলি বৌদি আর ইহজগতে নেই। সীপাইদার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত, এবং মেয়েদের সুবিবাহ হয়েছে। রাম রেল থেকে অবসর নিয়ে উত্তরপাড়ায় বাড়ি করেছেন। তার একমাত্র ছেলে একটি ব্যাংকের কর্মী, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এম.এ. পাশ করেছিলেন। আমার বড় জ্যাঠামশাইয়ের কোনো সন্তান ছিল না। তিনি জমিদারির বিষয়-আশয় ও আইন-আদালতের দিকটি দেখাশোনা করতেন। সন্ন্যাসী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি আর মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেতেন, কখনও কয়েকদিন, কখনও কয়েক মাস। আমার বড় জ্যাঠাইমা “মাগো”-র নয় বছর বয়সে বিয়ে হয়। তিনি সংসারকে পুরোপুরি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারতেন, কখনও তাকে দিনের বেলায় শুয়ে থাকতে দেখিনি। জায়েদের কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবক দিদি, স্নেহ-মমতা দিয়ে জায়েদের মন জয় করেছিলেন। মনে পড়ে, মাগো প্রায়ই বলতেন, “সাগরে যার সজ্জা, শিশিরে তার ভয় কি?”
মেজ জ্যাঠাইমার সংগ্রামী জীবন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা
আমার মেজ জ্যাঠাইমা হাসির একটি সন্তান হয়েছিল, কিন্তু সে আট মাস বয়সেই মারা যায়। এরপর আর কোনো সন্তান হয়নি। মেজমার বাবা সুরেন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত ছিলেন সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট অফ পোস্ট অফিসেস। ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত তিনি ছিলেন সুপুরুষ, তার ছিল লম্বা-চওড়া ও সাহেবদের মতো গায়ের রঙ। তিনি ইংরেজিতে ধর্মবিষয়ক একটি বই লিখেছিলেন, যা পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছিল। আমার মেজমা ঢাকায় ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। রাজা পঞ্চম জর্জ ঢাকায় মেজমার বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে, তার সম্মানে মেজমা অন্যদের সঙ্গে কোরাসে গান গেয়েছিলেন – “Long live our noble king”। এই গানটি মেজমার মুখে বহুবার শুনেছি। সুরেন্দ্র নাথ সেনগুপ্তের প্রচেষ্টায়, একটি স্থায়ী চাকরির বিনিময়ে আমার মেজ জ্যাঠা মেজমাকে বিয়ে করেন। তখন মেজমার বয়স ছিল মাত্র পনেরো বছর। মেজমা রান্নাঘরের ধারে কাছে যেতেন না। দুপুরে তার খাবার তার ঘরে পৌঁছে দেয়া হত। ছোটবেলায় দেখেছি, প্রত্যেক ঘরে খাটের নিচে একটি করে পিতলের ডাবর থাকত। জল ও জঙ্গলের দেশে বাইরে সাপ-খোপের উপদ্রব থাকায় রাতে কেউ ঘর থেকে বেরোত না। এছাড়া বর্ষার সময় দূরের শৌচাগারে যাওয়া কঠিন ছিল। সকালবেলায় দেখতাম, মেজমা প্রস্রাবে পরিপূর্ণ ডাবরটি যত্ন সহকারে ধরে, টিউবওয়েলের পাশে যে নালা ছিল, সেখানে ফেলে আসতেন।
আমার মেজমা ছোটবেলায় ঢাকায় যে এলাকায় থাকতেন, সেখানে জেলা শাসক, জেলা জজ এই সব আমলাদের বাস ছিল। এদিকে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়তেন বলে সমাজের শীর্ষস্থানীয় ও কৃতী ব্যক্তির কন্যারা বান্ধবী হিসাবে জুটে গিয়েছিল। বিয়ে হয়ে বরিশালে আসার পরও তিনি এলিট সোসাইটিতে মেশা বন্ধ করেননি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরই তিনি বেরিয়ে পড়তেন। তার বান্ধবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, কমিউনিস্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেন এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের সহোদরা লতিকা বোস। একবার আমার মেজভাই মিলন অসুস্থ হলে, ডাক্তার তাকে হরলিক্স খেতে পরামর্শ দেন। সে সময় যুদ্ধ শেষ হয়েছে, বাজারে হরলিক্স নেই, চারদিকে কালোবাজারি চলছে। মিলন মেজমাকে দেখে বলল—”হল্লিমিলি খাব“। মেজমা বাড়ী থেকে খাওয়া দাওয়ার পর যেমন আড্ডা মারতে বের হন তেমনি বের হলেন। আড্ডা শেষ করে মেজ জ্যাঠা ফেরার আগে ফিরে আসতেন, তেমনি ফিরে এলেন। হাতে একটা বড় হরলিক্সের জাব। মা জিজ্ঞেস করলেন—”মেজদি, এটা তুমি কোথায় পেলে?” মেজমা উত্তর দিলেন—”ডাক্তার গিন্নীর কাছ থেকে নিয়ে এলাম“। ডাক্তার গিন্নী ছিলেন মেজমার বান্ধবী । স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বিলেতি কাপড় ও বিদেশি সামগ্রী বর্জনের ডাক এলে, মেজমা তাঁর আলোকপ্রাপ্তা বান্ধবীদের নিয়ে সে কর্মযজ্ঞে সামিল হন এবং নেতৃত্ব দেন। নিজের ও অপরের বিলাতি শাড়ি ও দ্রব্য এনে এক অনুষ্ঠানে স্তূপাকৃত করে আগুন জ্বালিয়ে দেন। আমাদের বাড়ির কর্তারা একটু ইংরেজ ঘেঁষা ছিলেন, তারা এতে কিছুটা ভ্রূ কোঁচকালেন, কিন্তু মেজমা নির্বিকার। যেহেতু পুলিশ মহলে মেজমার বাবা ও আমাদের বাড়ির কর্তাদের প্রভাব ছিল, তাই ব্যাপারটি নিয়ে কোনো নাড়াচাড়া হয়নি। দুর্ভিক্ষের সময় তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহ, ব্যবহৃত কাপড়-জামা সংগ্রহের কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। যদিও ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এই রমণীর কোনো নাম পাওয়া যাবে না তবুও তাঁর মধ্যে যে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ দেখেছি, তাতে আমি আজ গর্ব অনুভব করি। আমার মনি জ্যাঠামশাই ননী গোপাল (ননী)-এর স্ত্রী ছিলেন রমা। তাঁকে আমরা “মনিমা” বলে ডাকতাম। বারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের তিন মেয়ে ও এক ছেলে ছিল – তপতী (হারু), শিবানী (বানী), পুত্র চন্দন ও কন্যা টলটল।আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন অল্প বয়সেই ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হত। পাত্রের রোজগারের দিকটা দেখা হত না, বরং পরিবার ও সম্পত্তির গুরুত্ব বেশি ছিল। আমাদের পরিবারে মেজ জ্যাঠামশাই ও বাবা চাকরি করতেন, তবে পরিবারের আয়ের একটি অংশ জমিদারির ভাতা থেকে আসত। অন্যদিকে, বড় জ্যাঠা, রাঙা জ্যাঠা ও মনি জ্যাঠা আক্ষরিক অর্থে বেকার ছিলেন। মনি জ্যাঠা ছিলেন একজন দক্ষ চিত্রকর, বিশেষ করে পোর্ট্রেট আঁকায় তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। আমি তাঁর আঁকা বহু ছবি দেখেছি – তার মধ্যে যেমন আমার বাবার ছবি যেমন ছিল, তেমনি অনেক মনীষীর ছবি এবং তখনকার যুবসমাজে জনপ্রিয় অভিনেত্রী কাননবালার ছবিও ছিল। তবে প্রকৃতির কোনো ছবি তিনি আঁকতেন না। এছাড়া, তিনি কাপড়ের উপর বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন লিখতেন, কিন্তু এতে তেমন আয় হতো না। অনেক ক্ষেত্রে পাওনা বাকি থেকে যেত, যা আদায় করা সম্ভব হতো না। জমিদারি থেকে যে ভাতা পাওয়া যেত, সেটাও ক্রমশ কমতে থাকায় বাড়ির খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। আসলে, মনি জ্যাঠা ছিলেন অত্যন্ত ভালো মানুষ। কখনো তাঁকে গলা উঁচু করে কথা বলতে দেখিনি, তিনি সবসময় কলহ-বিবাদ এড়িয়ে চলতেন। মনিমার বিয়ে কিছুটা আকস্মিকভাবেই হয়েছিল। তাঁর বাবা ছিলেন ক্যালকাটা ক্লাবের ম্যানেজার। তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ মনিমার মার নাম ছিল ডালিম। তাঁকে আমি দেখেছি। ছোটোখাটো মানুষটি অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন ও ডালিম নামের সার্থকতা বহন করত। তাঁদের বাড়ি ছিল গল্ফ ক্লাব রোডে। মনিমার অগ্রজ দিদিকে যে গানের মাস্টার গান শেখাত, সেই মাস্টারের সঙ্গে তিনি পালিয়ে যান। গানের শিক্ষকের বাড়ি ছিল জলপাইগুড়িতে, সেখানে গিয়ে তাঁরা বিয়ে করেন। দিদি তখন নাবালিকা ছিলেন, কিন্তু লোকনিন্দার ভয়ে থানায় কোনো অভিযোগ করা হয়নি। এই ঘটনার পর মনিমার বাবা আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। ঘটনার সাত দিনের মধ্যেই তিনি মনিজ্যাঠার সঙ্গে মনিমার বিয়ে স্থির করেন।
[ক্রমশঃ]