শংকর করণ

শংকর করণ

জন্ম পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক শহরে। পরবর্তীতে কলকাতাতে বসবাস। বর্তমানে ভারত সরকারের টেলিকম বিভাগ এ কর্মরত। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট এ গবেষণা করার সময় আমি অধ্যাপক দ্বিজেশ কুমার দত্ত মজুমদার এর সান্নিধ্যে আসি। যিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট এর প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ এর সরাসরি অনুসারী ছিলেন। তিনি আমাকে বাংলা সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রাণিত করেন। ক্ষুদ্র ন্যানো কণা ১-১০০nm, জ্ঞানের একটি প্রাথমিক একক গঠন করে। সাইবারনেটিক্সের তত্ত্ব, যোগাযোগের বিজ্ঞান, গণনা এবং নিয়ন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ন্যানো-মিটার বা আণবিক স্কেলে মেশিনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি পদ্ধতি উপস্থাপন করি। যা দেশ-বিদেশের বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলার প্রতি আমার গভীর অনুরাগ আছে, শুধু ভাষা হিসেবে নয়, প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। তাই লেখার চেষ্টা করি। কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে “তত্ত্বমসি” , ব্যারাকপুর রামকৃষ্ণ মিশন, পত্রিকায়। সাহিত্য জীবন খুবই নগণ্য।

কাপালিকের ধন

সুজন মল্লিকের ছবি কাপালিকের ধন

“এ কি ! কাচের গ্লাস টা ভেঙে দিলে তো। ও মা! তোমার হাতটা ও তো কেটে গেছে দেখছি। বেরোনোর সময় কখনো কেউ তাড়াহুড়ো করে ?“

অনুরাধা। আমার দ্বিতীয় বর্ষের বিবাহিতা স্ত্রী। আদর করে অনু বলে ডাকি। বাসর রাতে খুব শক্ত একটা ধাঁধা সলভ করার পর ওর নাগাল পেয়েছি। ভয়ঙ্কর বুদ্ধিমতী।

“আরে না না কিছু হবে না। আমি সামলে নেব। গদাধর কাকা গাড়িতে লাগেজ গুলো তুলে দাও। বউদিমনির ব্যাগটা সাবধানে তোলো কিন্তু , ওতে অনেক খাওয়ার আছে।“

গদাধর আমাদের বাড়ির তিন দশকের পুরাতন ভৃত্য। সংসারের শুভ অশুভ ওর হাত দিয়েই আসে।

এখন আমাদের গন্তব্য রিং ফরেস্ট। উত্তর কানাডার ফরেস্ট রিং নয়। মেঘালয়ের খাসি হিলস থেকে পূর্ব দিকে নং-খুন-আম নদীর ধারে, রাইমাতাং ফরেস্ট রিসর্ট। জায়গাটা অনেকেরই অজানা। একটু বেশি অ্যাডভেঞ্চার আছে। জনমানব শূন্য ভ্যালি। ঘন জঙ্গল। আর আছে দেন-তাহলেন-ফলস এর হাতছানি। ভীষণ সুন্দর জলপ্রপাত। এলিফ্যান্ট ফলস কে ও হার মানায় শুনেছি। এটা অনুরাধার পছন্দের জায়গা। আসলে ওর রূপের কাছে প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপটাও হার মানে।

আমরা যখন টুরিস্ট বাংলাতে পৌঁছালাম, তখন সূর্য ডুবু ডুবু করছে। কানে বাজলো জলের কল কল শব্দ। সামনের কোন নদী বা ঝরনার হবে! দুজনের দুকাপ চা অর্ডার করে বারান্দার সোফাতে বসতে যাবো, এমন সময় রিসেপশন থেকে ফোন এলো, একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওয়েটিং রুম এ বসে আছেন। গিন্নি স্নানের ঘরে গেছে ফ্রেশ হতে। অগত্যা দরজা ভেজিয়ে নিচে নামলাম।

রিসেপশন লন এ গিয়ে দেখি একজন ভদ্রলোক, ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি,  চোখে চশমা, ম্যাগাজিনে  মুখ ঠুসে বসে আছেন। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,- “ গুড ইভিনিং মিস্টার ব্যানার্জি । আর ইউ ফ্রম পেন?“

ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া। ওয়েস্ট ফিলাদেলফিয়া। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। বড্ড বেশী ঠাটবাট । আমি এবং আমার গিন্নি ওই ইউনিভার্সিটিতেই পড়াই।

আমিও সম্ভাষণের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, -“ ইয়েস, হাউ ইউ নো মি?”

উনি বললেন, আমার রিসেপশনে দেওয়া ভিজিটিং কার্ডটা দেখেছেন। নাম অখিলেশ। অখিলেশ ব্যানার্জি।

-২-

আমার দর্শন, অনুর সাবজেক্ট ক্রিপ্টোগ্রাফি। গরমের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। দক্ষিণ কলকাতার ব্যানার্জি পাড়া লেন। তারপর প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে অনুর বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা।

অগত্যা দুটো বাটার কফি অর্ডার করতে হলো। আমাদের পেনের রেস্তোরাঁর খুব প্রিয় আইটেম। তবে ওখানকার হাউস্টন হল, মার্ক ক্যাফে, আর্ট ক্যাফে, এদের কাছে এখানকার কফি ধারে কাছে ঠেকে না। ওদের প্রিপারেশন টাই আলাদা। এরপর আমরা নিজেরা নিজেদেরকে একটু বেশি বোঝার জন্য মাতলাম পুরোনো দিনের গল্পে।

ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া তৈরি হয়েছিলো বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন এর আমলে। ১৭৪০ হবে। ক্যাম্পাস টা খুবই সুন্দর। প্রায় হাজার একর জায়গা নিয়ে তৈরি। আগে ওখানে কেবল মাত্র লেভী ল্যাঙ্গুয়েজে পড়ানো হতো। এখন অনেক সাবজেক্টে গবেষণা হয়। তবে ওখানকার ফিলোসফি টা একটু আলাদা, নৈতিক মানুষের নৈতিকতা এবং সাহসকে মিলিয়ে। কথায় কথায় জানতে পারলাম অখিলেশ ওখানে কিছুদিন ক্রিপ্টোগ্রাফি নিয়ে পড়াশুনা করেছে।

অখিলেশ বলে, “ ক্রিপ্টোগ্রাফি হল শব্দের ধাঁধা। ধাঁধা সলভ করার মজাই আলাদা, যদি সেই ধাঁধা কোন প্রিয়জনের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।“

আমি বললাম,-“ আজ রাত্রে, ডিনারে আপনাকে একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো। আমার গিন্নি। ওর সাবজেক্ট ক্রিপ্টোগ্রাফি।“

সন্ধ্যের সাইট সিন, ফটোগ্রাফি এ সবে ব্যস্ত থাকায় রাত্রে অখিলেশ আর ডিনারের ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। গিন্নিকে বললাম তুমি ডাইনিং এর দিকে এগোও, আমি আসছি। ডাইনিং হলে পৌঁছে দেখি অখিলেশ আগেভাগেই গিন্নির সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছ। কাছে গিয়ে বসতে, কানে এল অখিলেশ বলছে, “ তারপর আর কি? ওখানে টো টো করে ঘুরতাম, আর প্রেম করে বেড়াতাম। ফ্রাঙ্কলিনের উপদেষ্টাই খেটে গেল-বাই ফেলিং টু প্রিপেয়ার, ইউ আর প্রিপেয়ারিং টু ফেল। পরীক্ষার প্রস্তুতি না নেওয়ার মানেই ফেল করার প্রস্তুতি নেওয়া। কয়েকটা সাবজেক্টে গোল্লা পেয়ে সোজা ইন্ডিয়া। তারপর ঘুরতে ঘুরতে এই রিং ফরেস্ট। একেই ভালোবেসে ফেললাম। “

কথায় কথায় জানতে পারলাম এখানকার সব থেকে বিস্ময়ের জায়গা পঞ্চ-জ্বীহা কালী মন্দির। জঙ্গলের মাঝ বরাবর ঘণ্টাখানেকের হাঁটা পথ। কথিত আছে বহু বছর আগে কোন এক অমাবস্যার রাতে পাঁচজন কাপালিক তাদের নিজেদের জিভ কেটে মাকে উৎসর্গ করেছিলেন। নিজেদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য। এই মন্দিরের বিশেষত্ব হল এখানে কোনো পুরোহিত নেই। নিজেদেরকেই পুজোর উপকরণ সাজিয়ে দেবীর আরাধনা করতে হয়। অমাবস্যার রাতে দেবী জাগ্রত হন এবং সবার মনোবাসনা পূর্ণ করেন।

“কাল বাদে পরশু অমাবস্যা। যাবেন নাকি মায়ের আরাধনায় ?”

পরের দিন টা আমাদের খুব ভালোই কাটলো। সবুজের মধ্যে অনু কে যেন নতুন করে পেলাম। ওর রূপের কাছে আগে তো হার মেনেছিই, এখন হার মানলাম ওর প্রাকৃতিক জ্ঞান এর কাছে। শুধু মাঝখানে ২/৩ ঘণ্টা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করতে বললো, “প্রত্নতাত্ত্বিক যুগের সঙ্গে কথা বলে এলাম।“

রাতের ডিনার এ আমরা ঠিক করলাম আগামীকাল পঞ্চ-জ্বীহা কালী মন্দিরে যাব। অখিলেশ বাবু আমাদের সঙ্গী হবেন।

-৩-

সুজন মল্লিকের ছবি কাপালিকের ধনপরদিন সকালটা কেমন যেন নেতিয়ে নেতিয়ে কাটলো। হয়তো রাতের চোরা উত্তেজনা সবাইকে ভেতরে ভেতরে জাগিয়ে রেখেছে। কোন কাজে মন লাগছে না। অনু তাঁর নিজের কাজেই ব্যস্ত। এখানে তাঁর পড়াশোনা টা যেন একটু বেড়েই গেছে। লাঞ্চের পর চোখটা একটু টিপিয়ে এসেছিল। হঠাৎ ঘুম ভাঙলো কলিং বেলের আওয়াজে। দরজা খুলে দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে অখিলেশ বাবু।

তিনি বললেন, “ কি ব্যাপার যাবেন না ? অন্ধকার তো প্রায় নেমেই এলো। আপনার মিসেস কোথায় ?”

আমি বললাম,- “ পাশাপাশি কোথাও গেছে হয়তো, এখুনি এসে পরবে। আমি বরং কফি অর্ডার করি।“

কিছুক্ষণ বাদে তিনটে কফি এলো, কিন্তু অনুরাধা ফিরলেন না। এবার মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা ভয় দানা বাঁধতে শুরু করেছে। অখিলেশ কে ও যে সন্দেহ হচ্ছে না, তা নয়।

আমি অখিলেশ কে বললাম, “ আচ্ছা অখিলেশ বাবু, অনুরাধা তো এখন ও এলো না। কোথায় গেল বলুন তো?”

“সে কি আপনাকে বলে যায়নি। এখানকার রাস্তাঘাট ভালো নয়। আদিবাসীদের উপদ্রব আছে !“

আমরা কফিটা গোগ্রাসে গিলে, টর্চ নিয়ে দুজনে অনুরাধাকে খোঁজার জন্য বের হলাম।

আজ অমাবস্যা তিথি। অন্ধকার যেন গাছগুলোকে পায়ে পায়ে জড়িয়ে রেখেছে।

আমার কেন জানি না মনে মনে অখিলেশ বাবুর উপরই রাগ হতে লাগলো। হয়তো পরশ্রী কাতরতা। আমরা পঞ্চ-জ্বীহা কালী মন্দিরের পথ ধরলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরে দেখলাম, একটা জায়গায় ঢাক ঢোল বাজছে। কাছে গিয়ে দেখি , সবাই একটা পাত্র থেকে সাদা রঙের দুধের মত কি সব পান করছে, আর আনন্দে নাচছে।

অখিলেশ বলল, “এটা সিগারু গাছের মূলের রস। এখানকার আদিবাসীরা ওদের উৎসবে দুধের সঙ্গে পান করে। কিছুটা নেশা হয়। এটা এক ধরনের টক্সিক পদার্থ। বেশি মাত্রায় পান করলে শরীরে জলের অভাব দেখা দেয়; এবং খুব বেশি সময় বাহিত হলে মৃত্যু ও হতে পারে।“

আমার বুকটা ভয়ে ঢিপঢিপ করতে লাগলো। “ কি জানি অনুরাধাকে এইসব খাইয়ে কোথাও গুম করে দেয়নি তো?”

এখানে অনুরাধা আসেনি জানতে পেরে আমরা সামনের দিকে এগোতে লাগলাম।

অন্ধকার যেন পায়ে জড়িয়ে যেতে লাগলো । শুধু দুটো টর্চের আলো। আরো কিছু দূর গিয়ে দেখলাম সামনে একটা ভাঙাচোরা মন্দির। আমাদের কারোর ই বুঝতে অসুবিধা হলো না এটাই সেই পঞ্চ-জ্বীহা কালী মন্দির। পুরো মন্দির টা আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। হঠাৎ আমার চোখ গেলো সামনের একটা ঝোপের দিকে। মন্দিরের কিছু দূরে । আর সেই ঝোপ এর মধ্যে গিয়ে দেখলাম একটা পাথরের গুহা , ঢোকার পথ দুটো গোলাকার পাথর দিয়ে ঢাকা। একটার খাঁজে আরেকটা নিখুঁতভাবে বসানো। পাথরের ওপর সাংকেতিক ভাষায় কিছু লেখা।

“আরে এটা তো চিরকুটে লেখা সেই সাংকেতিক চিহ্ন যেটা কাল সান্ধ্যায় উনি আমাকে সলভ করতে দিয়েছিলেন। তার মানে উনি কাল এখানে এসেছিলেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মিসেস অনুরাধা এর মধ্যেই আছেন। “

আমি কিছু বালার আগেই ও বলতে লাগল, “খারোস্তী লিপিতে লেখা। চাইনিজ বুদ্ধিস্ট ভাষা। একটা হিল সাইফার। তখনকার দিনে রাজারা ব্যবহার করতেন নিজেদের মধ্যে সংকেত এ কথা বলার জন্য।“

অখিলেশ তাড়াতাড়ি পাতা পেন নিয়ে কি একটা হিসাব করতে বসলো। তারপর কয়েক মিনিট পরে বলল, “পেয়ে গেছি। নাও আই ব্রেক দ্য্ কোড।”

“এখানে লেখা আছে–” বলে তিনি বললেন, “ওই দূরে যে গাছের শিকড় ঝুলছে, ওটা নিয়ে এসে আমার কোমরে ভাল করে বাঁধুন। আই হাভ টু গো ইনসাইড।“

তারপরে পাথরের চাকতির উপর দাঁড়িয়ে দু পায়ের সাহায্যে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় প্রেসার দিতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে পাথর দুটো নিজেদের থেকে দূরে সরে গেল। আর একটা ছোট্ট পাথর দিয়ে ওটাকে লক করে পলকের মধ্যে ও গুহার মধ্যে প্রবেশ করলো।

আমি যখন ওদের টেনে গুহার বাহিরে বের করলাম, অনুরাধার তখন জ্ঞান নেই। মন্দিরের কুজোর জল এনে ওর চোখে মুখে ঝাপটা দিলাম। কিছুক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরলো। তারপর ওদের কাছে যা শুনলাম তাতে সারা রাত আমাদের কারোরই ঘুম হলো না।

পরদিন আমারই জানা একজন পুলিশ অফিসার কে মেঘালয় থেকে ডেকে আনালাম। পরে আমার গিন্নির কোড এবং ওদের তৎপরতায় গুহার ভেতর থেকে পাঁচ ঘোড়া সোনার মুদ্রা এবং পাঁচটি নর-কঙ্কাল বের হল। পুরানো যুগের স্বর্ণমুদ্রা। আনুমানিক বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা হবে। ভারত সরকারকে হস্তান্তর করে, তবে চিন্তা মুক্ত হলাম। এ ছাড়া আর কোনো উপায় ও তো নেই।

ফেরার সময় আমরা দুজনেই অখিলেশ এর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে গেলাম। অখিলেশ আমার গিন্নি কে বলল, “ আপনি আমার বন্ধু হবেন? আসলে আপনার মত সুন্দরীর বন্ধু হওয়ার লোভটা সামলাতে পারছি না, তাই।“ উত্তরে অনুরাধা ওর হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা সলভ করতে পারলে, তবে”।

ছবি: সুজন মল্লিক

আরো পড়ুনকাপালিকের ধন

পুতা বুতাম বং টি এস্টেট

অদ্রীশ সিংহের ছবি

অদ্রীশ সিংহের ছবি

পুতা বুতাম বং টি এস্টেট। আজ সকাল সকাল কলকাতা থেকে এসেছি, প্রপিতামহের পুরাতন এস্টেটের দেখভাল করার জন্য। আমি অনিন্দ্য নারায়ন, সঙ্গে চাকর সদানন্দ। সিঙ্গামারি গ্রাম। সমতল থেকে প্রায় ৬৫০০ ফিট উঁচুতে, সিকিমের রাস্তায়। ঘন পাইন জঙ্গলের ভীতর তিস্তা নদীর ধারে আমাদের এস্টেটের পুরাতন বাংলো। আমরা এখানেই উঠেছি। শ্রাবণ মাসের থমথমে সন্ধ্যে। ঝুমুর এসে চা দিয়ে গেল। এখানে এলে ঝুমুরই আমার দেখাশোনা করে। ঝুমুর আমাদের এস্টেটের পুরাতন কর্মচারী গদাধরের মা মরা মেয়ে।

চা চুমুক শেষ করে আমি সদানন্দ কে বললাম, ‘ চল একটু বেড়িয়ে আসি।‘

আমরা তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে দক্ষিণ দিকের সিকিমের রাস্তা ধারলাম। পুরনো আমলের মার্সিডিজ। তাই পাহাড়ি রাস্তায় ড্রাইভার এর ভরসা করি না। কিছুদুর এগিয়ে দুটো পাহাড়ের মাঝে বাঁক নেব, এমন সময় গাড়ির টায়ার গেল বিগড়ে। গাড়িটিকে একটি সমতল জায়গায় দাঁড় করিয়ে, ইমারজেন্সি ফ্লাশার জ্বালিয়ে দিলাম। পামচার হওয়া টায়ারের সামনে জ্যাক লাগিয়ে লিফটিং করে চাকা চেঞ্জ করলাম। পুরনো টায়ার টিকে গাড়িতে তুলতে যাবো, এমন সময় সদানন্দ চিৎকার করে উঠল, ‘বাবা গো ! মা গো ! মরে গেলাম গো ! বাঁচাও।‘

সহসা ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, কাত হয়ে পাহাড়ের গায়ে পড়ে আছে। ওকে গাড়িতে বসিয়ে কোনরকমে বাংলোতে ফিরলাম।

তাড়াতাড়ি ঝুমুরকে বললাম , ‘এক গ্লাস গরম দুধ দে তো ওকে। মনে হয় হাতটা ফ্র্যাকচার হয়েছে ! সদানন্দের হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে ওকে একটা কড়া ঘুমের ওষুধ দিলাম। ঝুমুর এসে আমায় রাতের খাবার দিয়ে গেল। আমি ওর দিকে চেয়ে দেখলাম, কি সুন্দর দেখতে হয়েছে !

বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন বাবার সঙ্গে আমি এখানে আসতাম নিয়মিত। বাবার মুখে শুনেছি এস্টেটটি আমার প্র-পিতামহ স্বর্গীয় অনন্ত নারায়ন মহাশয় কোন এক ইংরেজ সাহেবের কাছ থেকে কিনেছিলেন।

অদ্রীশ সিংহের ছবি

ক্যামেলিয়া সাইনেন্সিস। ছোট্ট ছোট্ট সবুজ চা চারার বন। দিনে দিনে যখন, সূর্যের আলো আর পাহাড়ের খাঁজের জল থেকে ওদের ক্লোরোফিল এবং থিয়ানাইন গাঢ় সবুজ হয়, তখন ওদের ছোট্ট পাতাগুলোকে তুলে নিয়ে চায়ের জন্য প্রসেস করা হয়। আগে বাঁশের মাচায় শুকনো করা হতো। এখন অটোমেটিক মেশিনের সাহায্য নেওয়া হয়; যেখানে টেম্পারেচার এবং হিউমিডিটি খুব সুক্ষভাবে মেনটেন করা যায়। এরপর হয় ব্রুশিং এবং অক্সিডেশন যা বিভিন্ন ধরনের চা বানানোর জন্য দরকার। ওলং টি, ব্ল্যাক টি , হোয়াইট টি, পুয়ার্ক টি ইত্যাদি। অক্সিডাইজিং এর ফলে সবুজপাতা পরিবর্তিত হয় ব্রাউন কালার এ , অনেকটা আপেলের বেকিং করার মত। সর্বশেষে এটিকে শুকনো করে নিলে, অতিরিক্ত ময়েশ্চারাইজার বের হয়ে যায়; আর পড়ে থাকে ঝকঝকে তাজা টি।

বড় হয়ে বাবার মুখে শুনেছিলাম, আমার পিতামহের চায়ের এস্টেট ছাড়াও ওখানে আর একটা টান ছিল। অদিতি বাই। যেমন পাহাড়ি গড়ন, তেমনি গলার সুর ছিল অপূর্ব। ঠাকুরমা একবার রেগে দাদু কে বলেছিলেন, ‘তোমার যখন ওইখানে বেশিরভাগ সময় থাকতে হয়, তার থেকে ওকেই এখানে নিয়ে এসো’। উত্তরে দাদু বলেছিলেন, “বন্যেরা বনে সুন্দর! ওদের ওখানেই মানায় বেশি। ঘর এবং বাইরের মধ্যে একটা উঠোন থাকা জরুরী।‘ তারপর এক অমাবস্যার রাতে ওদের দুজনের কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বাংলো টি আমার প্রপিতামহের তৈরি করেন পাইন গাছের জঙ্গল কেটে । সেটা ১৮৩৮ সাল হবে। সবথেকে সুন্দর এর দক্ষিন বারান্দার নাচঘর টি। এখানে লাট সাহেব দের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে কত সুন্দরীর যে জীবন গেছে, তা হয়তো হাতে গুনে শেষ করা যাবে না। এর শেষ প্রান্তে একটা সুরঙ্গ আছে, মাটির নিচে যাওয়ার। তবে সুড়ঙ্গের শেষে কি আছে আমরা কেউই সে ব্যাপারে কনদিন উৎসাহ দেখাইনি। ঝুমুরের মনটা আজ ভারাক্রান্ত; কারন আমার এখানে আসার কারণটা সে জানতে পেরেছে। রাতে বাড়ি যাওয়ার আগে, দেরাজ থেকে সালটা বার করে দিয়ে আমায় বলল, ‘রাতে গায়ে দিয়ে নিস। বাহিরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়শে। ঠান্ডা আছে।‘

অদ্রীশ সিংহের ছবি

রাত তখন কটা হবে জানি না। আমার ঘুম ভাঙ্গলো ছোট্ট একটা ঝাকুনিতে। দেখলাম ঝুমুর আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। বিজলির আলো নেই। ওর হাতে একটা লন্ঠন। আমার হাত ধরে টানতে টানতে সুড়ঙ্গের মুখে নিয়ে গেল। নিজের বুকের কাছ থেকে একটা চাবি বের করে সুড়ঙ্গের কপাট খুললো। ওর হাতটা আজকে একটু বেশি মাত্রায় ঠান্ডা। তারপর আবার একটা দরজা খুললো। সে আমায় যেখানে নিয়ে গেল, আমি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

এ যেন মাটির তলায় প্রাসাদ। যক্ষের ধন। অপূর্ব কারুকার্য করা প্রাসাদ। মলিনতার কোন চিহ্নমাত্র নেই। ঘরদোর দেখে মনে হল কেউ নিয়মিত পরিষ্কার করে। ঘরের দেওয়ালে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচের মুদ্রা খচিত। আমায় সামনের একটা সোফাতে বসতে দিয়ে বললো, সে আসছে। দেখলাম সামনে বড় পোর্ট্রেট। চিনতে অসুবিধা হলো না, ইনি ই অদিতি বাই। আমি যেখানে বসে আছি তার ডান দিকে মণিমাণিক্য খচিত খাট, তাতে আতরের গন্ধ। ঝুমুর যখন ফিরে এলো আমি তাকে দেখে মুগ্ধ হলাম। তার এই রূপ আমি আগে কখনো দেখিনি। আমার হাত ধরে খাটের উপর নিয়ে গেল, তারপর বলল, ‘আমায় ভালবাস, যতখুশি ভালবাস !‘

মনে পড়ল,ওকে একদিন বলেছিলাম, ‘তোকে একদিন তিস্তা ব্রিজে বেড়াতে নিয়ে যাব, যেখানে দার্জিলিং, কালিম্পং আর সিকিমের রাস্তা এসে মিশেছে। তারপর যেদিকে যেতে চাইবি সেই দিকে !’

উত্তরে ও বলেছিল, ‘বাবু তিস্তা বাজার থেকে আমায় একটা থাঙ্কা কিনে দিস। হাতে ঝুমঝুমিয়ে পরব।‘ সেদিন বুঝিনি ওর বুকে আমার জন্য এত প্রেম জমা হয়ে আছে।

পরদিন সকালে আমার একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল। আমার চাকর সদানন্দের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, অনেক সময় দুটো পাহাড়ের মাঝে বাতাস খরস্রোতা হয়ে ওঠে; তখন নিজেরাই আনন্দে ঘূর্ণির মতো ঘুরতে-ঘুরতে পাশে যাকে পায় জোরে ঠেলা মারে; গত কালের ঘটনা কোন ব্রহ্মদৈত্যর কাজ নয়। হঠাৎ বাহিরে তাকিয়ে দেখি, গাদাধার ছুটতে ছুটতে আসছে। এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘বাবু বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে, কাল রাত্রে ঝুমুর গলায় দড়ি দিয়েছে। এস্টেট বিক্রি হয়ে যাবে তা ও মেনে নিতে পারেনি।‘

আমি অসহায় ভাবে গদাধরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। গদাধর চলে গেলে আমার চাকর সদানন্দ কে বললাম, ‘একবার সুরঙ্গ ঘরটা দেখা দরকার‘।

ছবি: অদ্রীশ সিংহ

আরো পড়ুনপুতা বুতাম বং টি এস্টেট