ভূগোল পরিচয় 
5/5 - (2 votes)

অরিন্দম বসুর ছবি

–শহরটাকে আর পরা যাচ্ছেনা।
–মানে!
–মানে,খুব আঁটোসাঁটো হয়ে গিয়েছে। বুকে চাপ, গলায় চাপ, মানে সব সময় একটা দমবন্ধ অবস্থা! এভাবে জাস্ট পারা যাচ্ছে না।
–কী আজেবাজে বকছ! শহর কি পোশাক যে পরা যাবে?
–আলবৎ পোশাক। সেটাও আবার গলাবন্ধ জামা টাইপের।
–সন্ধ্যেবেলায় ভাট বকা শুরু করলে?
–আরে, ভাট নয়। একটু ভেবে দ্যাখো,শহরের সঙ্গে তোমার প্রথম মোলাকাতটা কিভাবে হয়েছিল। প্রথমে তো মাথাটাই গলিয়েছিলে? যেহেতু সব শহরেরই গলার কাছটা ছোট হয় তাই মাথা গলানোটা বেশ কসরতের ব্যাপারই হয়েছিল নিশ্চয়ই? নতুন পোশাকের ক্ষেত্রে এমনটাই তো হয়! পাশে থাকা গার্জেনরা নিশ্চয়ই সাহায্য করেছিল তবু খানিকটা নার্ভাসনেস জাগেনি কি? মনে হয়নি, এই বুঝি সুড়ঙ্গের ভেতরে মাথাটা আটকে রইলো চিরতরে! তাই হ্যাচোর প্যাচোর করে মাথাটা কোনক্রমে বের করতে পেরে তোমার স্বস্তি হয়েছিল। তারপর খানিকটা বিশ্রাম নেয়ার পর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতেই হাত দুটো ধীরে ধীরে ভেতরে গলিয়ে নিয়েছিলে। তারপর ফের খানিকটা বিশ্রাম। তারপর পা দুটো। পুরোটা ঢুকে যাবার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছিলে। দেখে তৃপ্তি পেয়েছিলে, বাঃ, চমৎকার ফিট করেছে তো! রাতারাতি নতুন একটা পোশাক পেয়ে গিয়ে তুমি তো হেব্বি খুশী। কিন্তু তারপর? তোমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পোশাকটাও আদৌ বেড়ে উঠছে কিনা সেটা খেয়াল করেছ? যদি করতে তাহলে তোমারও অস্বস্তি হোত। দম আটকে আসতো। তুমিও চাইতে পোশাকটাকে দূরে সরিয়ে দিতে। আমার দশাটা তেমনই বনমালা।
মাথা নামিয়ে একটানা বকবক করে যাবার পর খেয়াল হলো অপর পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য আসেনি। বনমালা কি বিরক্ত হয়ে চলে গেল? আমার কষ্টটা বোঝার চেষ্টাই করলো না!
তাকিয়ে দেখলাম স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে বনমালা। চোখাচুখি হোতেই অভ্যস্ত গলায় হুকুম ছাড়লো, অ্যাই, কাছে এসো তো।
হুকুমের অর্থ বুঝতে অসুবিধে হলো না। পার্কের যে কোণটায় আমরা দুজনে বসেছি শহরের নিয়মানুযায়ী সেখানকার কয়েকটা স্তম্ভ আলো বিহীন রেখে একটা কৃত্রিম রহস্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে। বলাবাহুল্য এই রহস্যটুকুও চুরমার করার চেষ্টা হয়েছে। প্রথমে অভিযোগের মূল সুর ছিল অন্ধকার এবং অসামাজিকতার ভেতরকার যোগসূত্র নিয়ে। ধরতাই ছিল,পার্ক তো শুধু তরুণ তরুণীদের জন্য নয়, বৃদ্ধ বৃদ্ধাদেরও। সান্ধ্য ভ্রমণ কালে আলোর অভাবে কতজন হোঁচট খেয়েছে এবং তাদের ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণও এ প্রসঙ্গে উল্লেখিত হয়েছিল।
কিন্তু শহর মানেই তো নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান এবং মিলনের প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং পাল্টা যুক্তি উঠে এসেছিল এরকম যে, অসামাজিকতাকে রুখবার জন্য বেতনভোগী কেয়ারটেকার রয়েছে! শুধু বললেই তো হবে না যে কেয়ারটেকারের সঙ্গে অসামাজিকদের সাঁট রয়েছে, তার প্রমাণ কোথায়?
হয়ত দ্বিতীয় অভিযোগটা গেঁথে বসলেও বসতে পারতো কিন্তু রাতারাতি গজিয়ে ওঠা পরিবেশ প্রেমীরা যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেছিল পাখিদের ঘুম সংক্রান্ত অসুবিধে। ভিডিও আপলোড করে প্রমাণ করে দিয়েছিল পার্কের এপাশের গাছগুলো মূলতঃ পাখিদের রেস্ট হাউজ। সারাদিন ওড়াওড়ির পর দূর দূরান্ত থেকে পাখিরা এই পার্কে ঘুমুতে আসে। ঘুমের অসুবিধে হলে পাখিরা নিশ্চয়ই মেনে নেবে না, পার্ক ছেড়ে চলে যাবে দূরে কোথাও। এলাকার মানুষজন কি এই পাখিহীনতা মেনে নিতে পারবে! অন্য লাইটপোস্টগুলো তো দিব্যি ঝলমল করছে। কারো যদি হাঁটতে ইচ্ছে করে, হাঁটুক না সেদিক দিয়ে! এদিকটা থাকুক না পাখি এবং পাখিপ্রেমীদের জন্য সংরক্ষিত!
নেহাত গোটা প্রতিবাদ পর্বটাই ফেসবুক পেজে পোস্টিং, লাইক, কমেন্ট, শেয়ার ইত্যাদি প্রভৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বিষয়টাকে মাথা ঘামানোর উপযুক্ত মনে করেননি।
হুকুম শুনে কোমর ঘষটে বনমালার আরও কাছে এলাম। প্রথমে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে কিছু একটা ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করলো বনমালা। ব্যর্থ হলো। এরপর দূর থেকে যেটুকু আলো ছিটকে আসছে তার ভরসায় আমার চোখেমুখে তল্লাসী চালালো। ওকে সুবিধে করে দিতে আমি নিজের মুখটা আলোর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।
হাসলো বনমালা। অর্থাৎ দ্বিতীয় পরীক্ষাটারও নীট রেজাল্ট শূণ্য। তাতে অবশ্য বনমালার কিছুই এসে যায় না কারণ এর দ্বারা প্রমাণ হয়,আমি যা যা বলেছি সে সবই নিছকই কথার কথা। যাকে বলে দুঃখবিলাস। সব সুবিধে ভোগ করা সত্ত্বেও শহরের মানুষেরা যেমন ফাঁৎ ফাঁৎ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে,আমিও হয়তো তেমন কোনো স্মার্টনেস দেখাতে চাইছি! ফারাক বলতে শুধু কিছু উৎকট উপমার ব্যবহার।
যে কোনো উদ্ভট বাখোয়াজির উপযুক্ত দাওয়াই যেহেতু বনমালার জানা তাই এবার নিজেই আরও খানিকটা সরে এলো আমার কাছে। আমি জানি এরপর কী হোতে চলেছে কিন্তু ঠিক তখনই ফের শ্বাসকষ্ট অনুভব করলাম আমি। এবারের আক্রমণ তীব্রতর। যেন বুক ফেটে ফুসফুস বেরিয়ে আসবে। গলা দিয়ে বের হবে কালো কালো রক্ত। এক লাফে উঠে দাঁড়ালাম।
বনমালা ভাবলো হয়তো কোনো পরিবেশবিদ কিম্বা লুকিয়ে যৌনতা উপভোগ করা কোনো অতি উৎসাহী এসে দাঁড়িয়েছে। তাকালো চারদিকে। অচেনা কেউ নেই দেখে জিজ্ঞেস করলো, কী হলো!
ওপরে মুখ তুলে অক্সিজেন নিতে নিতে বললাম, খুব কষ্ট হচ্ছে। পারছি না।
বনমালা ব্যঙ্গ মাখা স্বরে বললো, এখানে কিসের কষ্ট! আমি কি শহর?
প্রশ্নটা শুনে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও হাসলাম। উত্তর দেয়াটা যেহেতু ঠিক হবে না তাই বললাম, চলি।
উত্তর না দিয়ে ঘাসের ডগা ছিঁড়তে লাগলো বনমালা।
জিজ্ঞেস করলাম,পৌঁছে দিতে হবে?
মুখ না তুলেই বনমালা বললো, নিজেকে কেমন বেশ্যা মনে হচ্ছে!
এটা যেহেতু আমার প্রশ্নের উত্তর নয়, সর্বোপরি কোনো প্রশ্নও নয় তাই একাই হাঁটতে শুরু করলাম। খানিকটা এগিয়ে যাবার পর ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম ছুটকো ছাটকা আলোর ভেতরে এক থুপ অন্ধকার হয়ে বসে আছে বনমালা। থাকুক। কিছু করার নেই। সমস্যাটা একান্তই আমার। বনমালা কোনো সমাধান দিতে পারবে না। যদি এটা কোনো অসুখের লক্ষণও হয়ে থাকে তাহলেও বনমালার কাছে এর কোনো প্রতিষেধক নেই, যেরকম ভাবে ছিল না আমার প্রপিতামহী, পিতামহী কিম্বা আমার মায়ের কাছে। হয়ত আমার পূর্ব পুরুষেরা পোশাকের তত্ত্বটা জানতেন না তবু অসুখটা তো ছিলই।
শুরুটা হয়েছিল আমার ঠাকুর্দার বাবা অর্থাৎ প্রপিতামহের থেকে। কিংবা তার আগেও হয়ে থাকতে পারে, অতটা পুরোন ইতিহাস আমার জানা নেই। আমি শুধু চার পুরুষের কথা জানি।
চলে যাবার কথা শুনে ঠাকুর্দার মা অর্থাৎ আমার প্রপিতামহী ভেবেছিল হয়ত নিছক কাজের প্রয়োজনে যাওয়া। জাতিতে সুপুরী কাটতে কাটতে জানতে চেয়েছিল,কবে ফিরবা?
ঝোলা গোছাতে গোছাতে ঠাকুর্দার বাবা বলেছিল,কইবার পারি না।
–কী কও এইগুলা!
–সত্যি কথাই তো বলতেসি। ফিরেই যদি আসবো তাইলে যাবো ক্যান!
পূর্ব পুরুষের ভিটে,জমাট গেরস্থালী, আত্মীয় স্বজন ছেড়ে যেহেতু কেউ চিরতরে চলে যেতে পারে না তাই  গোটা ব্যাপারটা স্বামীর রসিকতা ভেবে নিয়ে প্রপিতামহীও হালকা চালে বলেছিল,বুঝছি। কাউরে মনে ধরসে? তার কাছে যাবা?
প্রপিতামহ কষ্টমাখা স্বরে বলেছিল, আলফাল কথা বাদ্দাও। এইখানে আর থাকা যাইতেসে না। চাইর পাশের সবকিছু য্যান গলা টিপা ধরতেসে!
প্রপিতামহীর রসিকতা সংক্রান্ত ধারণাটা এরপর মজবুত হয়েছিল। হওয়ার কথাও। চারপাশ বলতে নিশ্চয়ই মাঠ ঘাট জমি জিরেত জল বাতাসের কথা উঠছে না। তাদের তো হাতই নেই যে গলা টিপে ধরতে যাবে! মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে বটে কিন্তু সেসব কোথায় ঘটে না? বরং বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতেই তো মানুষ ভালোবাসে!
যাদের হাত আছে তারাও তো জ্ঞাতিগুষ্টি, আত্মীয়, কুটুম্বের দল। স্বজন মানেই যে সব সময় গলাগলি প্রেম পীরিত, তা নয় বটে কিন্তু শরিকি বিবাদ বাঁধে যেমন, তেমন মিটেও তো যায়। তার জন্য বিবাগী হয় কে?
–যাবা কই?
–যেইখানে এই রকম গলাচিপা ভাব লাগবে না, সেই খানে।
–পাবা সেই রকম জায়গা?
–খুইজে তো দেখি পাওয়া যায় কিনা!
–আমি বলতাছি, এইরকম সোনার দ্যাশ আর পাবা না।
ঠাকুর্দার বাবা উত্তর দিয়েছিলেন,না পাইলেও ফিরবো না। থাকো তুমি। দেইখে শুইনে রাখো সব।
খেয়ালী স্বামীর নতুন খেয়াল ভেবে বলাবাহুল্য আমার প্রপিতামহী এরপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভেঙে দেখেছিলেন স্বামী নিরুদ্দেশ। খুব একটা উদ্বিগ্ন হননি এই ভেবে যে, যাবেটা কোথায়? মাটির টান ঠিক ধরেবেঁধে নিয়ে আসবে। মাঝখান থেকে জোরাজুরি করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে।
ফেরেন নি প্রপিতামহ। চুয়োডাঙা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন অনেক দূরে,পীরগাছায়। ফের নতুন ঘর, নতুন জমি, নতুন স্ত্রী,নতুন স্ত্রীর গর্ভে নতুন নতুন সন্তানও ফের উপহার দিয়েছিলেন।
আমার ঠাকুর্দার যেদিন পীরগাছায় অস্বস্তি শুরু হয়েছিল সেদিন ঠাকুমাও নিয়ম মেনে যথারীতি অবাক হয়েছিল এবং একই রায় দিয়েছিল,আমি কইতাছি, এইরকম সোনার দ্যাশ আর পাইবা না।
ঠাকুর্দাও একই কথা বলেছিল, থাকো তুমি। দেইখা শুইনা রাখো সব।
তবে এরপরের অংশটুকু আগের সঙ্গে মেলেনি। পুরুষ মানুষকে আঁচল ছাড়া করার পরিণতি কি হয় সে উদাহরণ মজুত থাকায় ভুল করেনি ঠাকুমা, তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে ঝোলা গোছাতে গোছাতে বলেছিল,পুড়া কপাল আমার,আমি কি সেই কথা কইসি! শুদু জানতে চাইসি আমরা কোথায় যামু?
নিমিষে বহু বচনের ব্যবহার দেখে আমার স্বভাব গম্ভীর পিতামহর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠেছিল।
ঠাকুর্দার পছন্দ হয়েছিল বেলকুচি, যা কিনা পরবর্তিতে বাবার শরীরে চেপে বসে রীতিমত টুঁটি চেপেধরে। তবে এক্ষেত্রে টুঁটিচাপা ভাবটা শুধু বাবা নয়, পরিবারের সবাই,আরও বিস্তৃত ভাবে বলতে গেলে বলতে হয় চারপাশের আত্মীয় স্বজনেরাও অনুভব করতে পেরেছিল। কারণ ততদিনে দেশভাগের হুজুগ, জাতিগত সমস্যা এবং বাস্তুত্যাগের হিড়িক ভালো রকম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।
যেহেতু বাবা তখন নাবালক এবং নিয়ম যেহেতু নিয়মই তাই পুত্রবধুর পরিবর্তে ঠাকুমাকেই জিজ্ঞেস করতে হয়েছিল,যাবি কই?
–আমাগো দ্যাশে।
–এইডা আমাগো দ্যাশ না?
–না, এইডা অগো দ্যাশ। আমাগো দ্যাশ হিন্দুস্থান।
কানাঘুষোয় শোনা কথাটা নিজের সন্তানের মুখেও প্রতিধ্বনিত হোতে দেখে বিভ্রান্ত হয়েছিল ঠাকুমা।
তাকিয়েছিল ঠাকুর্দার দিকে। ঠাকুর্দা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
সংবিধানের কাঁচিতে দেশটা দু টুকরো হওয়ার আগেই চলে আসায় আলিপুরদুয়ারে জমি জিরেত কিনে নতুন বসতি গড়তে অসুবিধে হয়নি ওদের। কিন্তু সেই বসতিই বা সইলো কোথায় বাবার! ফের উড়তে হয়েছিল। তবে এবারের উড়ালের কারণ ছিল সরকারি চাকরির বদলি সংত্রান্ত নিয়ম। যদিও আমি অজুহাতে বিশ্বাসী নই কারণ সেটাই যদি হবে তাহলে এ শহর সে শহর ঘোরার পর শিলিগুড়িতে  থিতু হওয়া কেন? ফিরে যাওয়াই যেত আলিপুরদুয়ারে !
শিলিগুড়ি আমার জন্মস্থান নয় বটে তবু শৈশব, কৈশোরের পুরোটা এবং যৌবনের শুরুটুকু তো এখানেই। দিব্যি ছিলাম। সময়ের দাবীকে মান্যতা দিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছিল শিলিগুড়ি, আর শহরের সঙ্গে  তাল মিলিয়ে আমিও আড়ে বহরে বেড়ে চলছিলাম। ছুটে বেড়াচ্ছিলাম এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। নতুন নতুন পথ ঘাট মানুষ আবিষ্কার করছিলাম।
অস্বস্তিটা সেদিন শুরু হলো যেদিন দেখলাম শহরের বাড়বাড়ন্তু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কোনো কোণেই আর কোনো রহস্য নেই। কোনো রাস্তা এমন কোথাও আমাকে পৌঁছে দিতে পারছে না যেখান থেকে ফেরার সময় আমার বুক দুরুদুরু করে। যে পথেই যাই সে পথেই কেউ না কেউ পথ আটকে নাম ধরে ডেকে ওঠে। গন্তব্য জানতে চায়। নেই জেনে বিস্মিত হয়। কুশল জানতে চায়। সঙ্গে সঙ্গে পথ বদলাই বটে কিন্তু যাব কোথায়? সবচে সমস্যা হলো যেদিন আমার প্রিয় নদীটাও গতি হারিয়ে পচা ডোবায় পরিণত হলো। এরপর কার কাছে উৎসের খোঁজ করবো?
হয়তো তখনই এই শারীরিক অস্বস্তিটা জেগে উঠত যদি না আচমকা বনমালার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটতো। নারী মানেই তো অপার রহস্যে ভরা নদী। সত্যি বলতে কী, বনলতা নামটার মধ্যেই প্রগাঢ় রহস্য খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু বনমালার সঙ্গে দেখা করার জন্য তো শেষ বিকেল অবধি অপেক্ষা করতে হয়! বাদবাকি সময়টুকু?
একদিন হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম আদালত চত্বরে। তারপর থেকে প্রতিদিন। ‌কেন যাই, নিজেও জানি না। এমন নয় যে আইন কিম্বা বে-আইন বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র কৌতুহল আছে। তবে এটুকু তো জানতামই যে নিতান্ত দায়ে না পড়লে কেউ আদালতে আসে না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষগুলোকে। দেখতাম, বিষাদ ক্লান্ত চিন্তিত মুখগুলো। অথচ যাদের কারণে ওদের কোর্টে ছুটে আসা, সেসব ভ্যান বোঝাই অপরাধীরা দিব্যি আনন্দে মসগুল। জামিন বাতিল হয়ে ফের জেলখানায় ফেরত যাবার পথেও আনন্দের কোনো খামতি থাকে না। বুঝি না, কে জোগায় এই আনন্দ! এই বন্দীত্ব কী তবে কোনো মুক্তির সন্ধান? কিসের থেকে মুক্তি!
এরকম একটা সময়ই পোশাক সংক্রান্ত তত্ত্বটা জানতে পারি। জানায় একজন ম্যাজিশিয়ান, যদিও নিজেকে সে ভেল্কিওলাই বলেছিল। আব্দুল ভেল্কিওলা। প্রতিদিন কোর্ট চত্বরের মাঝখানে থাকা কদম গাছটার নীচে শতরঞ্জি বিছিয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে সুর করে বলতো, আব্দুল ভেল্কিওলার সালাম নেন বাবুরা। আসেন। ভেল্কি দেইখে যান।
ভিড় জমলে শুরু হোত আব্দুলের ম্যাজিক। মানুষের জিভ কেটে নেয়া, ঘুমন্তু মানুষকে আকাশে উড়িয়ে দেয়া, জমায়েতের নাক কান মুখ থেকে টাকা আধুলি বের করার ম্যাজিক। যদিও আব্দুল সে সবকে ম্যাজিক নয়, ভেল্কিই বলতো এবং আমিও জানতাম সে সব ভেল্কিই। তবু ম্যাজিকই ভাবতাম, কারণ ভেল্কি শব্দটা ভীষন উলঙ্গ। সেই নগ্নতা এতটাই ছোঁয়াচে যে, মুগ্ধ দর্শককেও নিমিষে উলঙ্গ করে নির্বোধে রূপান্তরিত করে। বরং ম্যাজিক শব্দটায় আছে রহস্যময়তার ছোঁয়া, এক অধরা মাধুরী যেন যার শুরুটা হয় অর্থহীন কিছু মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে।
প্রথম প্রথম ভিড়ের মধ্যে ভিড় হয়েই আব্দুলের ম্যাজিক দেখতাম। ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করলাম। পরবর্তীতে ভিড়ের ছুঁড়ে দেয়া যে পয়সাগুলো শতরঞ্জির নাগাল পেত না সেগুলো কুড়িয়ে জড়ো করতাম। যদিও সে কাজ বাবদে আব্দুলের কাছ থেকে কোনো সাবাসি কিম্বা বাধা পেতাম না।
একদিন সাহস করে বলে ফেললাম, নতুন নতুন খেলা দেখাও না কেন আব্দুল ভাই?
আমার দিকে তাকিয়ে আব্দুল হেসে বলেছিল, এইখানে যারা আসে তারা অন্য খ্যালা দ্যাখপে না। অরা এইসব ভেল্কিই জিন্দেগি ভর দ্যাখপার চায়।
কথাটার মধ্যে সত্যতা কতটা ছিল বলতে পারবো না,তবে দিনকে দিন আব্দুলের উপার্জন বেড়েই চলছিল।
একদিন শো শেষে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসেছিল আব্দুল। কাছে গিয়ে পিঠে হাত রেখেছিলাম।
–কী হয়েছে আব্দুল ভাই?
মুখটা তুলে আব্দুল বলেছিল, খোব কষ্ট।
আব্দুলের মুখটা যেহেতু যন্ত্রণায় মাখামাখি ছিল তাই অবিশ্বাস করতে পারিনি।
–কী হয়েছে? কোথায় কষ্ট?
আব্দুল ইশারায় গোটা শরীরটা দেখিয়েছিল।
–ডাক্তার দেখাও।
আমার উপদেশে হেসে ফেলেছিল আব্দুল।
–এইসব ব্যাদনা সারানোর মতোন কুনো ডাক্তার নাই।
–তাহলে?
— পোশাকটা আর পরা যাইতেসে না। বদলায়া ফেইল্লেই ঠিক হয়া যাবে।
কথাটা শুনে আমি তো অবাক। লোকটা বলে কী! পরণে যে আলখাল্লাটা আছে সেটা তে অনায়াসে আরও দুটো মানুষ এঁটে যাবে। তাহলে?
এরপর আব্দুল শহর এবং পোশাকের গূঢ় সম্পর্ক বিষয়ে আমাকে জানকারি দেয়। বনমালার মতো আমিও সেদিন অবাক হয়েছিলাম। পরদিন ফের গিয়েছিলাম আব্দুলের খোঁজে। পাইনি। পরদিনও নয়। কিম্বা তার পরের দিনও। বুঝিছিলাম, আব্দুল এবার নিজেকে নিয়ে ভেল্কি করেছে। পাগলের কান্ড ভেবে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
এরপরও কোর্ট চত্বরে যাওয়ার অভ্যেসটা বজায় রেখেছিলাম। যথারীতি গিয়ে বসে থাকতাম কদম গাছটার নীচে। যথারীতি লোক জমতো এবং আব্দুলের বদলে আমাকে দেখে ভাবতো এখন থেকে আমিই বুঝি ভেল্কি দেখাবো। কিন্তু আমি তো ভেল্কি জানি না! তাহলে? এরপরই আমার শ্বাসকষ্টটা জেগে ওঠে এবং আব্দুলের তত্ত্বটা আমার মনঃপূত হয়। আপশোস হয়, কেন আব্দুলের সঙ্গে চলে গেলাম না।
কে জানে, হয়ত তখুনি নতুন পোশাকের খোঁজে বেরিয়ে পড়তাম, যদি না আচমকা বনমালার কথা মনে পড়ত। বুঝেছিলাম, পোশাকটা আঁটো হলেও এখনও খানিকটা ফুরসত রয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় সেই ফাঁকটুকুও বুজে গেল।

(দুই) 

ভাতের টেবিলেই বাবাকে বললাম, আমি চলে যাচ্ছি।
বাবা দুধের বাটিতে ভাত মাখতে ব্যস্ত থাকলো। কিছু বললো না। জানতেও চাইলো না কেন যাচ্ছি। বংশের নিয়মানুযায়ী যা কিনা স্বাভাবিক। বাবার জানতে চাওয়ার কোনো অধিকার নেই। বরং আমিই জানতে চাইলাম, যাবে তুমি?
বাবা দুধে চুমুক দেয়ার ছলে বাটি দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো।
নিয়ম মেনে মা জানতে চাইলো, কোথায় যাবি?
আমি হাসলাম। উত্তর দিলাম না।
মা ফের জিজ্ঞেস করলো, কবে ফিরবি?
–ফিরবই যদি তাহলে যাব কেন!
মা মুখে আঁচল দিলো। ফের জিজ্ঞেস করলাম, য়াবে তুমি আমার সঙ্গে?
ততক্ষণে বাবার খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ায় মা আমার কথার উত্তর না দিয়ে এঁটো থালা বাসনগুলো গুছিয়ে নিয়ে কলতলায় চলে গেল।
এরপর বনমালার কাছে না গেলেও চলতো কারণ সে তো আমার স্ত্রী নয়। সুতরাং প্রস্তাব কিম্বা অনুমতি আদায়, কোনোটারই সে যোগ্য নয়। তাছাড়াও আমার এই কষ্টটা তো ওর কাছে বিশ্বাসযোগ্যই হয়নি। ভেবেছে সরে যাবার ছুতো খুঁজছি। তবু গেলাম।
বনমালা জানতে চাইলো,কোথায় যাবে?
আমি বললাম, যেখানে এরকম দমবন্ধ ভাব লাগবে না সেখানে।
–পাবে সেরকম জায়গা?
হাসলাম আমি।
–খুঁজে তো দেখি।
–না পেলে ফিরে আসবে?
যেহেতু এই প্রশ্নের উত্তর হয় না তাই চুপ করে থাকি।
বনমালা ফের জিজ্ঞেস করে, আমার কী হবে?
আমি উৎসাহে টগবগিয়ে ফুটি, আমার সঙ্গে যাবে? চলো। দুজনে মিলে আরেকটা নতুন জামা খুঁজি।
আমার উৎসাহকে এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিয়ে চলে যায় বনমালা। যেতে যেতে এমত ঘোষনা করে যায় যে সে পাগল নয়।
এরপর হাঁটতে হাঁটতে শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। শুরু করি খোঁজপর্ব। কোনো জায়গা পছন্দ হলে দাঁড়াই, মুখটা ওপরে তুলে দীর্ঘ শ্বাস টানি কিন্তু তাজা অক্সিজেনের পরিবর্তে শ্বাসকষ্টটা নিমিষে হাজির হয়। ফের খুঁজি। খুঁজে চলি। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রাম নেই। ফের হাঁটি। পেরিয়ে যাই মাঠ ঘাট নদী নালা বন্দর।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেও জানিনা। ঘুম ভাঙলে দেখি চমৎকার এক সকালের ভেতর ঝকঝক করছে এক ভুখন্ড। বাতাসে নির্মল প্রশান্তি। দিগন্ত ছুঁয়ে সবুজ অর্ধচক্র।
এটাই কি তবে সেই গন্তব্য? জেনে নিতে এগিয়ে যাই। রাস্তার কলে মুখ ধুয়ে নিতেই চায়ের জন্য প্রাণটা ছটফটিয়ে ওঠে। এগিয়ে যাই চায়ের দোকানের খোঁজে। মেঠো পথ আমার পায়ে ধরে টেনে নিয়ে যায় চায়ের দোকানে। আমাকে দেখা মাত্র উটকো খরিদ্দারেরা সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দেয়। ধোঁয়া ওঠা চায়ে পরম তৃপ্তিতে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করি, এই জায়গাটার নাম কি?
প্রশ্ন শুনে প্রথমে অবাক চোখে তাকায় খরিদ্দারেরা, তারপর হো হো করে হেসে ওঠে। হাসির কারণ খুঁজতে তাকাই দোকান মালিকের দিকে। মালিকও হাসিতে ফেটে পড়তে পড়তে বলে, ভালোই তো চেল্কোমি শিখছিস রে অলোক! নাকি সাত সকালেই এমন ন্যাশা করছিস যে নিজের চুয়োডাঙারেও চিনতে পারতেছিস না!

ছবি : অরিন্দম বসু