চোপতা ও তুঙ্গনাথ
5/5 - (2 votes)

যাত্রা শুরু - চোপতা ও তুঙ্গনাথফেব্রুয়ারি মাস। চার বন্ধুর একটি বয়েজ ট্রিপ হঠাৎ বাতিল হওয়ায়, এক দিনের ব্যবধানে একটা অন্য যায়গা ঠিক করতে বসলাম, দুই বন্ধু যাওয়ার জন্য। আগের টায় যাওয়া ঠিক ছিল পাহাড়ে, তাই এটাও পাহাড়েই করতে হবে, এরকম ঠিক হল। অল্প মাথা ঘামিয়ে মনস্থ করা হল,চোপতায় যাওয়া যাক। গাজিয়াবাদ থেকে ৭/৮ ঘন্তায় পৌছনো যাবে। শুক্রবার গিয়ে রবিবার ফেরা। চোপতা থেকে হিমালয়ান রেঞ্জ এর দৃশ্য অনবদ্য। নন্দাদেবী, ত্রিশূল,চৌখাম্বা, বন্দরপুচ্ছ, আরও কত শৃঙ্গ! তাছাড়া চোপতায় ভালো পাখি দেখা যায় শুনেছি, তাই ক্যামেরা নিয়ে যাবো। আরও একটা ব্যপার, চোপতা থেকেই তুঙ্গনাথ চন্দ্রশিলা ট্রেক হয়। যদিও আমি খুব একটা ট্রেক ইদানিং করিনা, তার উপর এখন শীত কাল, মন্দির বন্ধ থাকবে, তাই ট্রেক এর আইডিয়া টা খুব একটা আমল পেলো না। ভাবলাম, ওখানে পৌছাই, তারপর দেখা যাবে।

ভোর সারে চারটে তে দুগ্যা দুগ্যা বলে বেরোন হল। আমি, শৌভিক আর ওর ভোক্সোয়াগেন টাইগুন। রুটঃ গাজিয়াবাদ, হরিদ্বার- হৃষীকেশ- দেবপ্রয়াগ- শ্রীনগর – রুদ্রপ্রয়াগ – অগ্যস্তমুনি – উখিমঠ – চোপতা। খবর পেয়েছিলাম যে চোপতায় আগের দিন রাত অবধি তুষারপাত হয়েছে। তাই পথে আর চোপতায় কিছুটা বরফ পাবো, সুতরাং ভ্রমন রোমাঞ্চকর হবে এমনটা ধরে নেওয়া গেলো।

ভোরের আলো ফোটার পর, হরিদ্বারের একটু আগে টি ব্রেক নেওয়া হলো; লোকাল বিস্কুট সহযোগে ভোরের এই চা টা লং ড্রাইভে যেন সঞ্জিবনীর কাজ করে। আসলে আগের রাত্রে ভালো ঘুম হয় না, সেটার আলস্য এই চা তেই কেটে যায়, তার উপর হাইওয়ের ধারে, খোলা আকাশের নিচে, প্রথম সূর্যের আলো গায়ে মেখে চা খাওয়ার আমেজ টাই আলাদা। শৌভিক পাহাড়ে ড্রাইভ করতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ নয়, তাই এবার আমি স্টিয়ারিং নিলাম। এর পরে সোজা একেবারে হৃষীকেশ; ব্রেকফাস্টের জন্য দাঁড়ানো হলো। তখনও রিভার র‍্যাফটিংওয়ালাদের দাপাদাপি শুরু হয় নি। খুব বেশি অপশন নেই, খালি আলু পরাঠা আর চা। তাই সই। রাস্তা এযাবৎ খুবই ভালো। গঙ্গার পাড় দিয়ে চওড়া রাস্তা চলে গিয়েছে। গাড়ী আরামসে ৫০/৬০ য়ে চালানো যায়। এবার দেবপ্রয়াগে পৌঁছলাম। রাস্তা থেকে অনেক নিচে দেখা যায় ভাগীরথী আর অলকানন্দার সঙ্গম। জল কম; তাও ভাগীরথী একটু উচ্ছল, আর অলকানন্দা শান্ত। দুটি নদীর মিলনে ‘গঙ্গা’ নদীর উৎপত্তি এখান থেকেই। দুটির জলই হরিদ্রাভ। শুনলাম বর্ষা কালে অলকানন্দার জল ঘোলাটে হয়ে যায়, কারন পাহাড়ের উপর থেকে মাটি বয়ে আনে। তখন সঙ্গমটি আরও সুন্দর লাগে। এগিয়ে চললাম, অলকানন্দার পাড় ধরে। দেবপ্রয়াগ থেকে ৩৬ কিমি দুরে বড় শহর শ্রীনগর। এটি ক্যান্টনমেন্ট ও বটে। শ্রীনগর থেকে ৩২ কিমি দুরে রুদ্রপ্রয়াগ। এখানে অলকানন্দা আর মন্দাকিনী নদীর সঙ্গম। রুদ্রপ্রয়াগ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল, কারন এখান থেকেই কেদারনাথ ও বদ্রিনাথের রাস্তা আলাদা হয়ে যায়। বাঁ দিকের রাস্তা মন্দাকিনীর পাড় ধরে চলে গেছে তিলওয়ারা, অগ্যস্তমুনি হয়ে গৌরিকুন্ডর দিকে, যেখান থেকে কেদারনাথ এর ট্রেক শুরু হয়। আর ডান দিকের রাস্তা চলে গেছে কর্ণপ্রয়াগের দিকে, যেখান থেকে আবার বাঁ দিকে বেঁকে রাস্তা চলে যায় গোপেশ্বর, পিপলকোঠি তারপর জোশিমঠ হয়ে বদ্রিনারায়ণের চরণে। গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছিলাম, বড় পুন্য ভাগী এই সকল স্থান। যুগ যুগ ধরে কত ঋষি মুনির চরণধূলিতে ধৌত হয়েছে এই পথগুলি। তখন পাকা রাস্তা ছিল না, তীর্থযাত্রীরা পদব্রজেই তীর্থ দর্শনে যেতেন। উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর ‘হিমালয়ের পথে পথে’ তে বর্ণনা আছে, ষাট এর দশকের শুরুর দিকে বদ্রিনারায়নের পথে এই পিপুলকোঠি অবধি বাস চলাচল ছিল, তার পরে পায়ে চলা, পুরো বদ্রিনাথ অবধি।

রুদ্রপ্রয়াগ থেকে একটানা আসা ন্যাশনাল হাইওয়ে ১০৭ বা কেদারনাথ রোড, কুণ্ড নামে যায়গায় দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে, বাঁ দিকে মন্দাকিনির ব্রিজ পেরিয়ে চলে গেছে নারায়নকোটী- গৌরীকুন্ডের দিকে; আর ডান দিকে উঠে গেছে উখিমঠ হয়ে চোপতার দিকে। পথে অনেক যায়গায় ভারত সেবাশ্রম সংঘর আশ্রম চোখে পরলো। বাংলার বাইরে বাংলায় লেখা দেখতে খুবই ভালো লাগে। আবারও অনুভব করলাম, তীর্থ যাত্রিদের সুবিধার্থে বহু দশক আগে থেকেই এই আশ্রম গুলি কাজ করে চলেছে।

সেদিন চোপতায় পৌঁছেছিলাম প্রায় বিকেল পাঁচটা নাগাদ। একটু দেরি হলো, কারন রাস্তায় একযায়গায় কিছুক্ষন দাঁড়িয়েছিলাম, হিমালয়ান মোনাল পাখি দেখতে পেয়েছি মনে করে, ছবি তুলবার জন্য। পরে অবশ্য টের পেলাম, ওটি মোনাল নয়, কালিজ পিজান্ট, স্থানীয়রা বলে নীলা মুরগী। তবে তিনি ক্যামেরায় ধরা দেন নি। একটু দেখা দিয়েই ঘন বনে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। চোপতার প্রায় ৪ কিমি আগে থেকেই রাস্তায় বরফের দেখা মিলল। আর শিরদাঁড়ায় শিরশিরানি জাগিয়ে ব্ল্যাক আইস এর ও। যারা জানেন না, তাদের বলি, ব্ল্যাক আইস এর উপর দিয়ে গাড়ি চালানো বিস্তর ঝুঁকির ব্যাপার, কারন চাকা স্কিড করে। যাই হোক, এতক্ষন পাহাড় – জঙ্গলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হতে চলেছিলাম, এবার বরফের পালা। রাস্তার দুই ধারে বরফ জমে আছে, আর কোথাও কোথাও রাস্তাও বরফে ঢাকা। তার মধ্যে দিয়েই সাবধানে গাড়ি চলল।

পাহাড়ি রাস্তার বাঁক - চোপতা ও তুঙ্গনাথচোপতা একটি ছোট্ট জনপদ। থাকার মধ্যে আছে কিছু বেসিক লেভেলের হোমস্টে – ট্রেকার দের থাকার জন্য,আর কিছু চা-জলখাবারের দোকান, যেখানে আবার ট্রেকের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও পাওয়া যায়। একটা ঘর নেওয়া হলো। বাথরুমে কলে জল নেই, কারন পুরো চোপতা তেই জলের লাইনে বরফ জমে আছে। ঘরের বাইরে ইয়াব্বড় প্লাস্টিকের ট্যাঙ্ক রাখা আছে, সেখানে বরফ গলা জল জমে, তাই বালতি করে নিয়ে ব্যবহার করতে হবে। কারেন্টের অবস্থাও তথৈবচ। মূলত সোলার পাওয়ারে সব চলে। ফোন বা ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ হবে, কিন্তু তার বেশি কিছু চলবে না।

হাত মুখ ধুয়ে চায়ের দোকানে ঢুঁ মারলাম। পরপর দু কাপ চা খাওয়া হল। সাথে পাহাড়ের জাতীয় খাবার ম্যাগি! ক্ষিদেও পেয়েছিল, কারন পথে ভালো করে আমরা লাঞ্চ করি ই নি। খেতে খেতে তুঙ্গনাথ ট্রেক এর ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করলাম। জানা গেল, এখান থেকে তুঙ্গনাথ মন্দির প্রায় ৫ কিমি ট্রেক, প্রায় পুরোটাই খাড়া। রাস্তা বাঁধানো, কিন্তু এখন বরফে ঢাকা, তাই স্থানে স্থানে পিছল। সাবধানে যেতে হবে। মন্দির এখন বন্ধ (শীতকালে অন্য কেদার মন্দিরের প্রথামতোই, মন্দির বন্ধ করে, ডোলি নিয়ে পুরোহিতরা নেমে আসেন। সেই সময়টা নিচে মাক্কুনাথ মন্দিরে দেবাদিদেবের ভোগ ও পূজা হয়। ট্রেক করে ফিরে আসা কয়েকজনে সাথে আলাপ হলো। তাদের মতে, প্রায় ৫ কিমি রাস্তা যেতে ৪/৫ ঘন্টা মত লাগে, আর ফিরতে ৩ ঘন্টা, মানে সব মিলিয়ে ৮ ঘন্টায় ট্রেক শেষ করা সম্ভব। চন্দ্রশিলা যেতে (তুঙ্গনাথ থেকে আরও ১০০০ ফিট চড়াই, যেতে আরও ২ ঘন্টা, কিন্তু সে রাস্তা দুর্গম। এমনকি অনেক যায়গায় রাস্তাই নেই ভালো করে)। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তুঙ্গনাথ অবধি ট্রেক করবো; পরের দিন সকাল ৯/৯.৩০ নাগাদ যাত্রা শুরু করবো।

তুঙ্গনাথ বিখ্যাত পঞ্চ কেদারের অন্যতম প্রধান, আর দুনিয়ায় সবচেয়ে উঁচু শিবমন্দির ও বটে (১২০০০ ফিট), কেদারনাথের থেকেও উঁচু। কথিত আছে, কুরুক্ষেত্রে ভ্রাত্রি হত্যার পাপের স্খলনের জন্য পাণ্ডবেরা দেবাদিদেব শিবের চরণে প্রার্থনা করবার অভিলাষে তাঁকে খুজে বেরাচ্ছিলেন, কিন্তু ভগবান শিব তাদের দেখা দিচ্ছিলেন না, কারন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে হওয়া ছল-কপটতা ও স্বজন হত্যায় তিনি পাণ্ডবদের উপর ভীষণ ভাবে অপ্রসন্ন ছিলেন। পাণ্ডবরা দেবাদিদেব কে প্রথমে কাশি তে খুঁজলেন, কিন্তু পেলেন না। শিব হিমালয়ের কোলে একটি ষাঁড়ের রূপ ধরে আত্মগোপন করে রইলেন। শেষে পান্ডবরা তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে এই অঞ্চলে উপস্থিত হন, ও ভীম দুই পাহাড়ে পা দিয়ে অনুসন্ধান করতে করতে এক জায়গায় ষাঁড় রুপী মহাদেব কে চারণ করতে দেখতে পান, ও তৎক্ষণাৎ চিনতে পারেন। এই যায়গার নাম ই গুপ্তকাশি, কারন মহাদেব এখানে আত্মগোপন করেছিলেন। ভীম সেই মহিষ এর লেজ ও পেছনের পা ধরতে গেলে ষাঁড় অদৃশ্য হয়ে যায় ও পরে তার ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ হিমালয়ের পাঁচ যায়গায় প্রকট হয়, সেই যায়গা গুলিই পঞ্চ কেদার নামে পরিচিত ও মহাদেব পূজিত হন। পূরান অনুযায়ী, কেদারনাথে ষাঁড়ের কুজ, তুঙ্গনাথে বাহু, রুদ্রনাথে মুখ, পেট ও নাভি মধ্য মহেশ্বরে,আর কেশদাম কল্পেশ্বরে প্রকট হয়েছিল।

পরের দিন সকাল প্রায় ৯.৩০ নাগাদ যাত্রা শুরু হল। জলখাবারে ম্যাগি আর চা খেলাম। শৌভিক সাথে প্রচুর চকলেট নিয়ে নিল। হাঁটাপথে এনার্জি দেবে। পথ বরফে ঢাকা বলে আমরা আমাদের জুতো চেঞ্জ করে ভাড়া করা রবারের মোটা সোল ওয়ালা জুতো পরে নিলাম; বেটার গ্রিপ থাকবে। আর সাথে লাঠি; ব্যালান্স ঠিক রাখার জন্য। গায়ে ডাউন ফিলড জ্যাকেট, মাথায় টুপি, গলায় বালাক্লাভা। প্রস্তুতির কোনও খামতি নেই। শৌভিক বিশেষ উত্তেজিত; ও কোনোদিন ট্রেক করেনি। বরফের মধ্যে তো দুরের কথা। আর ফিটনেস নিয়ে একটু পিছিয়ে আছে বলে নানাজনের সু-পরামর্শ মাঝেমাঝেই শুনতে হয়। তাই, এই ট্রেক যদি করে ফেলতে পারে, তাহলে অনেক কিছু একসাথে হাসিল হয়ে যাবে! দুজনের সাথেই একটা করে সাইড ব্যাগ। আমার সাথে ক্যামেরা, আমার চির-সফরসঙ্গী।

যাত্রা শুরু, আর শুরুতেই আমরা বোল্ড আউট! যেদিকে তাকাই, প্রকৃতি তার অপার সৌন্দর্যের ভান্ডার ঢেলে দিয়েছেন। পাহাড়ের ঢালে বরফ জমে আছে, আর তারই মধ্যে ঘন সবুজ রডোডেন্ড্রনের বন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। এখন সবে ফুল ফুটতে শুরু করার সময়, তাই চারিদিকে ইতস্তত লাল, গোলাপি রঙের সমাহার। আর কোথাও কোথাও ফুল ঝরে নিচের বরফের চাদরে পরে যেন এক নৈস্বর্গীক দৃশ্য তৈরী করেছে। দুচোখ ভরে দেখলেও যেন আশ মেটে না। চারিদিক নিশ্তব্ধ, খালি মাঝে মাঝে দু একজন যাত্রির কথা কানে আসছে। মনে হচ্ছিল যেন চুপ করে বসে এই সৌন্দর্য উপভোগ করি। কিন্তু থামলে চলবে না, অনেকটা পথ বাকি। তাই আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম। পথ শুরুতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রী মত খাড়াই (পরে সেটা আরও বেড়েছিলো)। খাদের দিকে অনেক যায়গায় রেলিং দেওয়া আছে। পাথরে বাঁধানো রাস্তা অনেক যায়গায় সিড়ির মত করা আছে, আর কিছু দুরে দুরে বিশ্রাম নেওয়ার যায়গা করা আছে। যা দেখলাম, যাত্রীদের গড় বয়স আমাদের দুজনের বয়সের কম। শৌভিক একটা বসার জায়গা থেকে আরও একটা বসার যায়গা; এই স্ট্র্যাটেজি নিয়ে চলতে লাগলো। প্রায় ২ কিমি যাওয়ার পর চারিদিকের বরফ আরও ঘন আর পুরু হয়ে এলো। এক জায়গায় এসে পৌঁছলাম, যেখানে প্রশস্ত বুগিয়াল রয়েছে, আর যেদিকে চোখ যায় খালি সাদা হয়ে রয়েছে। মনে হলো, ছবিতে সুইজারল্যান্ড বা অন্যান্য শীতের দেশের যে ছবি গুলি দেখি, তার থেকে এ কিছু কম নয়। এরকম প্রশস্ত তুষারাবৃত প্রান্তর, আর দুরে প্রকান্ড দেওয়ালের মত রজতশুভ্র মুকুট পরে হিমালয়ের শিখরগুলি। দেবাদিদেব মহাদেবের বাসস্থানই বটে! চলতে চলতে দেখলাম, বড় বড় রডোডেন্ড্রন গাছ গুলি অরধেকের বেশি বরফে ঢুকে রয়েছে। ক্রমশ অক্সিজেন কমে আসছে সেটা মালুম হলো। রাস্তায় দেড় থেকে ২ ইঞ্চি বরফ। কিছু কিছু যায়গায় ধুলোবালি মিশে আর লোকের পায়ে পায়ে প্রচন্ড পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে, সাবধানে চলতে হচ্ছে। কমবয়েসি যাত্রী দের অনেকে আমাদের ভরসা দিয়ে গেলঃ “আরামসে আইয়ে, কোই জলদবাজি নেহি হ্যায়”, বোধ হয় আমাদের বয়স দেখে উৎসাহ দেওয়ার কথা ভেবেছিলো। প্রায় ৩ কিমি যাওয়ার পরে শুরু হলো প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোণে চড়াই। আমরা ঘন ঘন বসতে বসতে এগোতে লাগলাম। এক যায়গায় রডোডেন্ড্রন ফুলের জ্যুস বিক্রি হচ্ছিলো। পাহাড়িরা এই ফুলকে বলে ‘বুরাংশ’। দারুন উপাদেয় খেতে; খেয়ে শরীরে এনার্জি ও একটু বাড়লো মনে হয়। আবার চলা। অনেকে দেখলাম নিজেদের জুতো পরেই এসেছে, আর খালি পিছলোচ্ছে। আমরা মনে মনে নিজেদের জন্য রবারের জুতো ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্তকে তারীফ করলাম, না হলে কপালে দুঃখ ছিল, এমন বলাবলি করলাম। অনেকে অবশ্য দেখলাম বেশি সচেতন, তাঁরা রবারের জুতোর উপরে স্নো চেন পরে এসেছে। স্নো চেন অবশ্য আমাদের লাগে নি, তবে এক এক যায়গায় রাস্তা প্রচন্ড পিছল ছিল, তখন মনে হচ্ছিল ওটা হলে ভালো হত।

তুঙ্গনাথ মহাদেব মন্দির - চোপতা ও তুঙ্গনাথথামতে থামতে অবশেষে মন্দিরের ফটকে গিয়ে পৌঁছলাম প্রায় আড়াইটে নাগাদ, ঠিক পাঁচ ঘন্টা লাগলো। পৌঁছে অবিভূত হলাম বললেও কম বলা হবে। পাহাড়ের ঠিক কাঁধের উপর বহু প্রাচীন, পাথরে তৈরি মন্দির, আদলে কেদারনাথের মতই। আর পাহাড় চুড়া যেন সাপের ফনার মতন মন্দিরের উপরে, একটু পেছনের দিকে মন্দিরকে কভার করে আছে। দুরে, চারিদিকে হিমালয়ের সুউচ্চ গিরিবর্ত্ম, লাইন দিয়ে যেন দেওয়ালের মত, ধ্যান গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যে তুষার শুভ্র উপত্যকা। মন্দিরের গায়ে প্রাচীনতার ছাপ স্পষ্ট। দুর্গম হওয়ার জন্য হয়তো এখানে আধুনিকতার ছাপ সেভাবে পরে নি। একটা মোটামুটি হোমস্টে, আর কিছু বাড়ি আর দোকান। সবই পুরু বরফে ঢাকা। ভাব গম্ভীর পরিবেশ। মনে হল, যোগীবর দেবাদিদেবের ধ্যানমগ্ন হওয়ার এই তো আদর্শ যায়গা! নিশ্চুপ, নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রকৃতির সাথে দেবমহীমার নিশ্চয় কোন সুগভীর সম্পর্ক আছে, নইলে এমন যায়গায় এসে, মন কেন জগদীশ্বরের কাছে, প্রশ্নহীন ভাবে, নিঃসংশয়ে সমর্পণ করে, কেন এমন অনাবিল ভক্তিভাবে আর অদ্ভুত আনন্দে ভরে যায় ? মনে হয়, বিশ্বচরাচরের কতটুকুই বা আমরা জানি ? যুগ যুগ ধরে মুনি ঋষি রা যে পথে প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করে যে বিশ্বপিতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে এসেছেন, তা নিশ্চয়ই মিথ্যা নয়! নাহলে সংসারের পাঁকে পরে থাকা আমার মতো মানুষেরও এরকম দৈব অনুভূতি হবে কেন ?

বেলা হয়ে আসছিল। বন্ধ ফটকের সামনেই সাষ্টাঙ্গ হয়ে শুয়ে বাবা তুঙ্গনাথের চরণে মনে মনে প্রণাম করে, ফেরার পথ ধরলাম। চন্দ্রশীলা আর গেলাম না। পরের বারের জন্য থাক। কারন, এ পথে আমাকে যে আবার আসতে হবে, বাবার চরণে প্রনিপাত না হলে পরিতৃপ্তি হবে না।

আলোকচিত্র: কৌশিক গুহ