বাঁশিওয়ালা ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
অনুগ্রহ করে এই লেখাটির মূল্যায়ন করুন

লোকটা বাঁশি বাজায়। আর বাঁশি বাজালেই কী আশ্চর্য গলা চিরে রক্ত উঠে আসে। না বাজালে ওঠে না। তবু বাজায়। এই তার নিয়তি। তার বাঁচা। ভুল বললাম। বাঁশি নয়, আসলে সে জীবনকে বাজায়। বাজায় মৃত্যুকেও। বলে, “বাঁশি বাজাব না? বল কী ভাগনে? তাহলে বাঁচব কী করে?” কিন্তু জীবনের এই নিধি, জীবনমৃত্যু একাকার হয়ে যাওয়া এই মরমি শিল্পকেও একদিন বিদায় জানাতে হয়। হয়তো স্বেচ্ছায় নয়। অনেকটাই বাধ্য হয়ে। অভাবেও। আবার কখনো ভালোবাসার মানুষটিকে খুশি করার অমোঘ তাগিদে। অথবা মৃত্যুতে। তখন সেই রক্তখেকো বাঁশি বহির্ভুবন থেকে একেবারে অন্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আর সেখানেই অনবরত একটা রিনরিনে ব্যথার মতো বাজতে থাকে চিরকাল। এই নেশা, এই সুরসুধা একজনের কাছ থেকে অন্যজনের মধ্যে সঞ্চারিত ও সংক্রমিত হয় কালে কালে।
কবে পড়েছিলাম আজ আর মনে নেই। আর আট দশজন স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া বাঙালির মতো ‘পাশেফেল’ দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। তার অনেক আগেই মানিকের সঙ্গে আমার সত্যিকারের পরিচয় ঘটিয়ে দেয় ‘অতসীমামী’। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে তাঁকে, তাঁর রচনাকে বুঝতে চেয়েছি। চিনতে চেষ্টা করেছি। মানিককে নিয়ে সম্পাদকীয় লিখতে বসে কিছুতেই তাঁকে আমি ‘অতসীমামী’র যতীনের থেকে পৃথক করে ভাবতে পারছি না। ফিরে পড়তে বসে আজও আমার স্মৃতিতে জমে থাকা সেই বাঁশি বাজানো মানুষটা ফুঁ দিয়ে চলেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর যতীন্দ্রনাথ রায় আজও আমার দৃষ্টিতে এক ও অবিচ্ছেদ্য দু’টি জ্যান্ত চরিত্র। আসলে মানিকের জীবনের সঙ্গে তাঁর শিল্পের এতটাই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যে আলাদা করে ভাবাই যায় না। অথচ অতসীমামী লেখা হয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে তর্কে বাজি জেতার জন্য : “এ গল্প সাহিত্য করার জন্য লিখিনি-লিখেছিলাম বিখ্যাত মাসিকে গল্প ছাপানো নিয়ে তর্ক জিতবার জন্য।”-তর্কে স্থিরিকৃত বাজি তো জিতেছিলেন। কিন্তু তারপর আত্মমর্যাদায় আসীন হয়ে জীবনব্যাপী সামাজিক দায়বদ্ধতার যে বাজি তিনি লড়ে গেছেন তার কত কিছুই আমরা জানি না বা জেনেও মুখ ফিরিয়ে থাকি। ২০ বছর বয়সে লেখা অতসীমামীকে মানিক নিজেই ‘রোমান্সে ঠাসা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এই ‘অবাস্তব কাহিনি’র মধ্যেই মানিকের ভাবীকালের জীবন ও সাহিত্যের শেকড়টি যে প্রথিত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মেধাবী ছাত্র। অঙ্কে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়ছেন অথচ ঘর ভর্তি বিদেশি, বিশেষত রুশ সাহিত্যের বই! ফলে পরীক্ষা না দেওয়া এবং দেওয়া। এবং অনুত্তীর্ণ হওয়া। বলা যায় তথাকথিত প্রতিষ্ঠান তাঁকে গ্রহণ করতে পারেনি অথবা তিনি প্রতিষ্ঠানের যোগ্য হননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বিদায় জানিয়ে মহত্তর বাজির জন্য তিনি ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়েছেন। বিস্মিত পরিজন। দেশ থেকে দাদার চিঠি-আর টাকা আসবে না। দাদার ইচ্ছে-মানিক আগে পাঠ্যপুস্তক পড়ে পরীক্ষায় পাশ দিক তারপর যত খুশি সাহিত্য করুক। মানিক দাদাকে লিখেছিলেন, “গল্প উপন্যাস লেখা ও পড়া আমি ছাড়তে পারব না। কাজেই কলেজের পড়াই আমাকে ছাড়তে হবে। তবে আপনি দেখে নেবেন, কালে এই লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমারও নাম ঘোষিত হবে।” কী দৃঢ় এই আত্মবিশ্বাস!আত্মবিশ্বাস নাকি গোঁয়ার্তুমি? এই একগুঁয়েমি, সুনিপুণ বিজ্ঞানমনস্কতা আর ‘অন্তর্গত রক্তের ভেতরে’ গিয়ে ময়নাতদন্ত চালিয়ে বিশ্লেষণ করার চমকপ্রদ ক্ষমতা নিয়ে উপনিবেশের প্রসব করা উলঙ্গবাহার বাঙালি ‘ব্যক্তি’ চরিত্রকে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে ‘হোলবডি স্ক্যান’ করে পরিবেশন করতে শুরু করলেন। চরিত্রটি—”নিজের অনেক ভেতরে চোখ ফেলতে বাধ্য হয়ে সে দেখে তার মধ্যে কী শোচনীয়, কী ভয়াবহ রকমের ধস নেমেছে। প্যাথলজির রিপোর্ট হাতে নিয়ে ল্যাবরেটরির দরজায় সে দাঁড়িয়ে থাকে, চলার শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে, তার নাদুসনুদুস গতরটা তাকে এতদিন কী প্রতারণাই না করে এসেছে। অণুবীক্ষণযন্ত্র তার যে রোগ শনাক্ত করেছে তার চিকিৎসা কেউ জানে না।” শশী ডাক্তার হয়েও নিজের রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা করতে অক্ষম। ফলে কুসুমও যে কখন অজান্তেই ঝরে শুকিয়ে গেছে সে বুঝতেই পারেনি। বাংলা কথাসাহিত্যে এই আকস্মিকতার আমদানি রবীন্দ্রশরৎ পরবর্তী পর্যায়ে মানিকের নিখুঁত ও নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ফসল। সূচনাপর্ব থেকেই জীবনকে খুঁটিয়ে দেখার এই প্রবণতা যা তাঁকে ব্যক্তিমানুষের ক্ষত বা ব্যক্তিনিয়তি আবিষ্কার করতে সাহায্য করল সেটি তাঁর জীবনব্যাপী ক্রিয়াশীল ছিল। ফলে এমন একটা সিদ্ধান্তে আসা মনে হয় অসঙ্গত নয় যে, সূচনাপর্বে মানিক ফ্রয়েডের পাশাপাশি অসচেতন মার্ক্সবাদের দ্বারা চালিত ছিলেন। পরবর্তীতে যা তাঁরই আবিষ্কৃত ব্যক্তিগত ক্ষতের প্রতিষেধকরূপে সচেতন মার্ক্সবাদে রূপান্তরিত হয়। এ প্রসঙ্গে গোপাল চরিত্রের কথা উল্লেখ করা যায়। ফলে মানিক সংক্রান্ত আলোচনায় পর্ববিভাজন ঘটিত যে বিষয়টি এতকাল ধরে এতবেশি মান্যতা পেয়েছে সেখানে আপাত বিরোধ থাকলেও প্রকৃত বিরোধ নেই এটা মেনে নেওয়া স্বাস্থ্যকর। তবে মার্ক্সবাদে আস্থা আমৃত্যু টিকে থাকলেও প্রতিবাদের স্বতঃস্ফূর্ততাকে চাপা দিয়ে সমকালীন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বারফাট্টাই ও আনুষ্ঠানিকতাতে তাঁর কোনো আস্থা ছিল বলে মনে হয় না।
মানিক তাঁর সাহিত্যিক দায়বদ্ধতা তথা সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে বরাবর সচেতন ছিলেন। নিজের শরীর ও মনের উপর যারপরনাই অত্যাচার করেছেন। প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। প্রবল দারিদ্রের মধ্যে সপরিবারে অশেষ যন্ত্রণা সহ্য করেছেন।তাঁর দারিদ্রপীড়িত জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ছবিটি তুলে ধরতে গিয়ে কলম কেঁপে ওঠে। দম বন্ধ হয়ে আসে। অভাবের চূড়ান্ত চলছে সংসারে। সেই সময় তিনি বরানগরের ভাড়াবাড়িতে থাকেন। তাঁর স্ত্রী একটি মৃত সন্তান প্রসব করেন। মানিক লিখেছেন, “বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল যে, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।” এই মর্মান্তিকতার দিনেও তিনি তাঁর অসাধারণ দায়িত্ববোধ থেকে সরে দাঁড়াননি। পয়সাওয়ালা ভাইদের উপরে নির্ভরশীল না থেকে বৃদ্ধ বাবাকে রেখেছেন নিজের কাছে। কমিউনিস্ট দল ছেড়ে বেরিয়ে না আসাটাও তাঁর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার আরও একটি বড় প্রমাণ। এই দায়বদ্ধতাই তাঁর সাহিত্যের প্রাণ। সেজন্য কোনো ভেজাল বা ফাঁকি তিনি তাঁর সাহিত্যে আমদানি করেননি। বরং উত্তরকালে বারেবারেই নিজের লেখার ফাঁকিগুলিকে শনাক্ত করেছেন নির্মোহ বস্তুবাদীর দৃষ্টিতে। ভাববাদ বা অধ্যাত্মবাদের মোহ থেকে তিনি নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত রেখেছেন আজীবন। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির দায়বদ্ধতার সবচেয়ে বড় নমুনা হতে পারে ‘কুমুদ ও মতি’ উপকাহিনিটি। “গৃহবিমুখ যাযাবর স্বামীর সঙ্গে মতিও আজ এলোমেলো পথের জীবনকে বরণ করিল-আমাদের গেঁয়ো মেয়ে মতি। হয়ত একদিন ওদের প্রেম নীড়ের আশ্রয় খুঁজিবে, হয়ত একদিন ওদের শিশুর প্রয়োজনে নীড় না বাঁধিয়া ওদের চলিবে না-জীবনযাপনের প্রচলিত নিয়মকানুন ওদের পক্ষেও অপরিহার্য হইয়া উঠিবে। আজ সে কথা কিছুই বলা যায় না। পুতুলনাচের ইতিকথায় সে কাহিনি প্রক্ষিপ্ত—ওদের কথা এইখানেই শেষ হইল। যদি বলিতে হয় ভিন্ন বই লিখিয়া বলিব।” কিন্তু পরে আর কখনই তিনি এই প্রয়োজন অনুভব করেননি। কেন করেননি? কারণ এই ধরনের বাউন্ডুলে চরিত্রদের তিনি সবে দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু পরিণতি সম্বন্ধে সন্দিহান। একটা আন্দাজ করতে পারছেন বটে কিন্তু আন্দাজের উপর ভর করে কাল্পনিক পরিণতির ধাপ্পাবাজিতে তাঁর কোনো সায় ছিল না। তিনি ঠকতে ও ঠকাতে চাননি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘এলিজি : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ শীর্ষক শোকগাথায় মানিকের সামাজিক দায়বদ্ধতার অভিপ্রায় চমৎকার ফুটেছে—
“আমি যেন টের পাই
আমি যেন দেখে যেতে পারি
তোমাদের কঠিন অসুখে
তোমরা ঔষধপত্র পেয়েছিলে কিনা ঠিকঠাক
অনন্ত নক্ষত্র দূরে খেলা করে-করে হতবাক।”
দারুন ব্যথা পেলে আমরা প্রচলিত ছকে হাউমাউ করে কাঁদি। মানিক সুর বেঁধে গান ধরেন। ব্যথা বাড়লে সুরও বাড়ে। এই ব্যথা তো কেবল ব্যক্তির নয়, সমাজেরও, সুরও তাই উপশম হয়ে ওঠে। মানিক চেনা ছকে তাঁর জীবন ও সাহিত্যকে বাঁধেননি। বাঁধেননি বলেই আমরা তাঁকে নিয়ে বড্ড বিপাকে পড়ে যাই। আমরা বুঝে উঠতে পারি না বলে ছকের বাইরে এসে হাঁসফাঁস করি। তিনি প্রথমপর্বে ফ্রয়েড, পরের পর্বে মার্ক্স, তিনি মার্ক্সবাদ ছেড়ে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন—ইত্যকার আলোচনায় পন্ডশ্রম করি। একটি আলোচনাচক্রে একজন বিশিষ্ট অধ্যাপককে মানিকের যে আসল নাম ‘প্রবোধ’, এই প্রবোধ দেওয়াতেই অধিকতর আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখে আর অবাক হই না। কারণ মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মে, ফাঁকফোকর গলিয়ে মানিক তো সেই কবেই ছকভেঙে বেরিয়ে গেছেন। প্রত্যাখ্যান করেছেন যাবতীয় মধ্যবিত্ত ছকের ধাস্টামো। মানিক চাইলে লেখালেখি সমেত হয়ত কোনো বড় পুরস্কারসহ একটা ভদ্রস্থ মধ্যবিত্তের জীবন কাটিয়ে যেতে পারতেন। “কিন্তু কোনোদিকেই মাঝারি হওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে তিনি আসেননি। চূড়া যেমন তাঁর মেঘলোক ছাড়ানো খাদও তেমন অতল গভীর। তাই মানিয়ে নেবার মানুষ তিনি নন।” যত ক্ষতিই হোক চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া তাঁর যে কিছুতেই চলে না। এমন একজন সৎ ও মহৎ শিল্পী মৃত্যুর ঠিক একমাস আগেও তাঁর শ্রেষ্ঠগল্পের বই বিক্রি করছেন নিজহাতে। দোকানমালিকের কাছে তাঁর সকরুণ আর্তি যেন পাঁচকপি বই নগদ পেমেন্টে রাখা হয়। কেননা তখন যে তাঁর বড়ই অভাব। মদ খাওয়ার পয়সাও জোটে না। মদ খাওয়া তিনি ছাড়তেও পারেন না। এই তাঁর নিয়তি। তাঁর বাঁচা।
প্রথম রচনার নিজস্ব সাহিত্যসৃষ্টির সেই রেখাভাস জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ক্রিয়াশীল ছিল। “কেবলই মনে হয়, নেশাকে মানুষ এতবড় দাম দেয় কেন। লাভ কী? এই যে যতীনমামা পলে পলে জীবন উৎসর্গ করে সুরের জাল বুনবার নেশায় মেতে যান, মানি তাতে আনন্দ আছে। যে সৃষ্টি করে তারও যে শোনে তারও।” কিন্তু প্রশ্ন জাগে যদি কেউ না শুনতে চায়, না শোনে তখনও কজন অমন করে বলতে পারে, “রক্ত পড়বে তো হয়েছে কী? তুমি শুনলেও আমি বাজাব, না শুনলেও আমি বাজাব।”…
তাই যতীন্দ্রনাথ রায় বাঁশি বজায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাঁশি বাজান। আর বাঁশি বাজালেই কী আশ্চর্য গলা চিরে রক্ত উঠে আসে। রক্ত তো রক্তই। কিন্তু তার ভেতর থেকে উঠে আসা জীবনের সুর, জীবনের নির্যাস—
তা কি অমৃত নয়?
“যে-বাঁশি বাজাও তুমি
তাকে আরো মূল্যবান করা
হবে কি আমার?
প্রিয় অর্ফিয়ুস, আমার স্তবেই হলো হার।”

[২০ মে, ২০০৮ ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’এ প্রকাশিত আমার ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও একজন বাঁশিওয়ালার গল্প’ নিবন্ধের সহযোগিতা গ্রহণ করেছি।]