“ স্যার, বিশ্বাস করুন এর কমে দেওয়া যায় না ।“
“ তা বলে পুরো পাঁচ !”
“ স্যার,আমি তো পাঁচ পঁচিশ ছাড়া মাল হাতছাড়া করি না। আপনারা নেহাত ভদ্রলোক তাই-“
“ ঠিক বুঝলাম না ! ভদ্রলোক ছাড়া কেউ আসে নাকি !”
“ কি যে বলেন স্যার,ছয় মাস রেখে গতরে মাংস সমেত হাত ছাড়া করতে পারলেই কমপক্ষে দুই বেশি পাওয়া যাবে । তাছাড়া মালটা একেবারে ফ্রেস স্যার ।কোন প্যাঁন্দা মাল নয়কো ।“
“ ফ্রেস মানে !একি মাছ-মাংস নাকি যে বাসি হবে !”
“ ফ্রেস মানে স্যার কোন গন্ডগোল নেই ।একেবারে সৎ বংশ,বুদ্ধিমানের ঔরসজাত খাঁটি সোনা । আপনি অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন বলেই আমি একেবারে বেছে রেখেছিলাম ।এখনো কতজনই তো ছোঁক-ছোঁক করছে ।আপনারা না বললেই বাকিরা একেবারে শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে ।“
“ কিন্তু একবার না দেখেই বা কীভাবে তোমাকে হ্যাঁ বলি ।তাই বলছিলাম –“
“ আপনি কী এখনই নেবেন ?”
“ এই মুহূর্তে কীভাবে সম্ভব ।আমরা তো প্রিপারেশন নিয়ে আসিনি ।আমাদের অন্তত দুটো দিন সময় দিতে হবে ।“
“ সে না হয় যেদিন নেবেন সেদিনই আগে দেখে নেবেন ।আজ পর্যন্ত কেউ আমার দেওয়া মালকে বাজে বলেনি স্যার ।তবে হ্যাঁ,কমে হয়তো আপনি পাবেন ।তাদের শারীরিক গঠন নিখুঁত নয় ।আর যদি ছেমড়ি নেন তাহলে তিনেও হয়ে যাবে ।তবে রঙের কোন গ্যারান্টি দিতে পারব না ।আর এসব কথা আগেই বলে নেওয়া ভাল ।“
“ কিন্তু তোমাকে কীভাবে জানাব ।তোমার তো আবার ফোন নেই বলেছ ।তাহলে উপায় ।“
“ আমি একটা নম্বর দিচ্ছি ।পরশুদিন ঠিক এই নম্বর থেকে একটা ফোন আসবে ।শুধু’হ্যাঁ’ বা ‘না’ বললেই চলবে ।তবে যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন তখন বলে দেওয়া হবে আপনাদের কোথায় যেতে হবে ।“
দুই
এসব ফ্যানানোর এখন আর কোন মানেই হয় না ।যা হবার তা তো হয়েই গেছে ।আসলে হঠাৎ করে ঘটনাটা মনে পড়ে গেল বলেই বললাম ।তাছাড়া আপনাদের না বললে আর কাকেই বা বলি ।এমন সাত সকালে শুনবেই বা কে !
অনেক বাক বিতন্ডা হয়েছিল কেকার সাথে । আসলে টাকাটা তো নেহাত কম ছিল না ।একজন সরকারি অফিসের মাছি মারা কেরানীর সামর্থই বা কতটুকু ।এক লপ্তে অত টাকা পাবই বা কোথায় ।আবার হাতে যে প্রচুর সময় রয়েছে তাও নয় ।তাই নিজের পি এফ ও কো-অপারেটিভ থেকে কর্জ করে এবং এর ওর থেকে ধার নিয়ে ম্যানেজ করেছিলাম ।তবু শেষ মুহূর্তে কেকাকে বলেছিলাম আর একবার ভেবে দেখতে। একেবারে নিঃস্ব হওয়াটা কী ঠিক হচ্ছে ।অথবা কম টাকায় একটা মেয়েতে অসুবিধাই বা কোথায় ।এখন তো ছেলে-মেয়ে সবই সমান ।কিন্তু কেকার সেই একই কথা-আমাদের বৃদ্ধাবস্থায় এই ছেলেই নাকি দেখবে ।তাই নির্দিষ্ট দিনে হ্যাঁ বলে দিলাম ।
স্কেচ অনুযায়ি যখন একটা বিশাল আম বাগান পেরিয়ে একটা কোঠা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম তখন চারদিকের নিস্তদ্ধতায় বুকের মধ্যে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল ।সাথে অত টাকা ছিল ।কেউ কেড়ে নিলেও আমাদের কিছুই করার ছিল না ।একজন এসে আমাদের ঐ কোঠা বাড়িতে নিয়ে গেল ।বাড়ির চৌহদ্দিতে পা দিতেই অনেক শিশুর কান্না আমাদের অভ্যর্থনা জানাল ।আমরা একটি ঘরে বসলাম । একটি লালচে রঙের শিশু আমাদের দেখান হল ।আপাতদৃষ্টিতে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব ঠিকই রয়েছে । কিন্তু আমি জানি লালচে রঙের শিশুরা বড় হয়ে কালো রঙের হয় । সে যাকগে,সোনার আংটির আবার বাঁকায় কি এসে যায় । মানুষের মতো মানুষ হলেই হল ।আমি বললাম।“ এই শিশুর বায়োডাটা দেবেন তো ? আর উনি কোথায় যার সাথে আমি আগে কথা বলেছিলাম ।”
একজন বাঊন্সার গোছের লোক বলল,”আমাদের প্রত্যেকের কাজ ভাগ করা আছে ।সে শুধু প্রাথমিক কথা বলে ।বাকিটা আমাদের দায়িত্ব ।“
আমি কিছুটা বেয়ারা গলায় বললাম,”উনি না এলে তো আমি টাকা দেব না । তাছাড়া আমি তো আপনাদের কাউকেই চিনি না ।আমি তো ওনাকে বেছে নেওয়ার কথা বলেছিলাম ।“
একজন কর্কশ গলায় বলল,”এখানে কেউ একবার ঢুকে পড়লে আর খালি হাতে যায় না ।যা দেওয়া হবে আপনাদের তাই নিতে হবে । কোন বেগরবাই করা চলবে না ।“
শিশুটিকে ভাল করে টাওয়েলে জড়িয়ে যখন রাস্তায় এলাম তখনও শিরদাঁড়া দিয়ে কুলকুল করে ঘাম বয়ে চলেছে ।এদিকে কেকার আদর যত্নে পান্তু যতই বড় হতে লাগল ততই যেন কেকার মুখে একটা প্রগাঢ় প্রশান্তি লক্ষ্য করতে লাগলাম । যা আমাকে ভরসা দিয়েছিল ।
আমি জানি সাত সকালে এমন ভ্যাজর-ভ্যাজর শুনতে কারই বা ভাল লাগে ।কিন্তু আমি আপনাদের ছাড়া আর কাকেই বা বলি বলুন । তখন পান্তু সবে ক্লাস ফোরে পড়ে ।একদিন স্কুল থেকে ফিরে মাকে বলল, ” আজ একটা ছেলেকে হেব্বি পেঁদিয়ে এলাম ।শালা আমাকে বলে কিনা গঙ্গা পার করে দেবে !এবার দেখ তোর মুখটা কেমন গ্যামাকসিন করে দিয়েছি ।“
কেকা ছেলের মুখে অমন অসংলগ্ন ভাষা শুনে কাঁদতে থাকে । বুঝতে পারে না পান্তু কাদের কাছ থেকে অমন ভাষা শিখছে । আমাকে কেকা পান্তুর ব্যাপারে সব জানালে আমি ওর স্কুলে গিয়ে ওর অমন আচরনের কথা জানিয়ে আসি । কর্তৃপক্ষ বলেন এর পরে তারা পান্তুর উপরে নজর রাখবেন ।
আমি বুঝতে পারি কেকা রোজ আমার পকেট থেকে বাড়তি টাকা স্কুলে যাবার সময় পান্তুর হাতে গুঁজে দেয় ।এটা যে ঠিক নয় তা কেকাকে বুঝিয়ে বলি ।এতে যে পান্তুর খারাপ বৈ ভাল হচ্ছে না তাও বলি । কেকা আমাকে বোঝাতে চায় যে ওর বন্ধুরা রোজ ওকে ভাল ভাল জিনিস খাওয়ালে ওকেও তো একদিন খাওয়াতে হয় । তাছাড়া সামান্য দশ টাকার বেশি তো আর দেওয়া হয় না ।
তিন
পান্তু প্রথম বার মাধ্যমিকে ফেল করল। আর পড়বে না বলায় অনেক সাধ্য সাধনা করে ওকে আবার পরীক্ষায় বসালাম। এবার সে মাত্র একটা বিষয়ে ফেল করল। পান্তু যে সব বিষয়ে ফেল করেনি তাতেই ওর মা খুব খুশি। একদিন ভীষণ প্রত্যয় নিয়ে কেকা বলল,” দেখবে আগামী বছর পান্তু খুব ভাল রেজাল্ট করবে।“ সেদিন আমি আর কেকার বিশ্বাসে কোন আঘাত দেইনি।
পান্তু যে আর পড়বে না তা আমিও যেমন বুঝতে পেরেছিলাম, তেমনি কেকারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ইদানীং পান্তুর কানে দুল আর হাতে বালা উঠেছে। আর চুলের নব্য ছাঁটে ওকে দেখতে যে কতটা কুৎসিত লাগছে তা বলায় সেদিন ও এমন সিনক্রিয়েট করল যে ও আমার ছেলে এটা ভাবতেই আমার বেশ ঘেন্না হচ্ছিল। হঠাৎ মনে হল আমি কেন মিছে মরমে মরে যাচ্ছি! এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিল। ওতো আমাদের পালিত সন্তান ।কে ওর আসল বাবা-মা তা আমরা জানতে পারিনি। তবু দিন দিন কেকার অপত্য স্নেহ যেন ঝরে পড়তে লাগল পান্তুর উপর। আমি বুঝতে পারছিলাম পান্তু কেকার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে । রোজ সকালে বাড়ির সামনে একটা বাইক আসে। ও তাতে উঠে কোথায় যেন বেরিয়ে যায়। ও যখন রাতে ফেরে তখন আমি ঘুমিয়ে থাকি। কিন্তু কেকা ঠিক ছেলের জন্য জেগে থাকে। একদিন আমি যতটা যাওয়া যায় ওর পিছু ধাওয়া করেছিলাম। দেখেছি ও এগলি ওগলির অন্ধকারের মধ্যে ক্রমশই ঢুকে যাচ্ছে। আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। মনে হল তাহলে কী পান্তু রোজ রাতে এভাবেই ঘন অন্ধকারে তলিয়ে যায়! কিন্তু কেন যায়! কে বা কারা থাকে ওখানে! ওদের বাবারাও কী আমার মতোই সরকারি অফিসের কনিষ্ঠ কেরানী! বুঝতে পারলাম না। আসলে মাথাটাও আর কাজ করছিল না!
সংসারে ইদানীং বেশ টানাটানি চলছে । অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয় ।মাস মাইনে থেকে নিজের হাত খরচের টাকা রেখে বাকিটা সংসার চালানোর জন্য কেকাকে দিয়ে দেওয়াটা আমার অভ্যেস । কিন্তু ইদানীং কেকা মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মাঝে মাঝেই টাকা চায়। জিজ্ঞাসা করলে যে সব সময় সঠিক উত্তর পাওয়া যায়,তা নয় ।তাহলে কেকা কী আমার কাছে কিছু গোপন করছে !দিন দিন সন্দেহটা আমার মনে প্রকট হতে লাগল । একদিন দুপুরে কেকাকে কথার জালে এমন ভাবে জড়িয়ে ফেললাম যাতে সে যেন কোনমতেই বেরিয়ে যেতে না পারে। আমার সন্দেহের কারণটা ওকে বুঝিয়ে বললাম। একসময় ও ভয় পাওয়া শিশুর মতো হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলল! আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ওর চোখে কত গ্যালন পর্যাপ্ত জল ছিল যা ওর আঁচল ভিজিয়ে দিতে পারে! এ যেন হড়কা বানের মতো মুহূর্তেই কেকাকে ভাসিয়ে দিল! আমার সামনে মুহূর্তের মধ্যে একটানে ব্লাউজ খুলে নিজের উদোম পিঠটা দেখাল। আমি তার চৈত্র মাসের ক্ষত বিক্ষত মাঠের মতো পিঠ দেখে আঁৎকে উঠলাম। একবার খুব যত্নে ঐ এঁবড়ো খেবড়ো পিঠে হাত বুলিয়ে দিলাম । বুঝলাম এ ক্ষত এক দুঃখী মায়ের গভীর লজ্জার উপহার!
এরমধ্যে একদিন গভীর রাতে বাইকে করে পান্তু বাড়ি ফিরে এল। সাথে একটি মেয়ে আর তার কোলে একটি কয়েক মাসের শিশু। যারা এসেছিল তারা টলতে টলতে বলে গেল,” মাসিমা একদিন কবজি ডুবিয়ে খাসি খেয়ে যাব । পান্তুর সাথে দুটো জিনিস দিয়ে গেলাম। খুব যত্নে রাখবেন ।“
সেদিন কেকার মনে আদৌ কোন আনন্দ হয়েছিল কিনা জানি না ।তবে আমি মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না ঐ শিশুটি কার !সত্যিই কী পান্তুর! নাকি সকলেরই আনন্দের ফসল !
পান্তুর কয়েকদিন ধরেই জ্বর আর কাশি। চলার শক্তি নেই। আমি ডাক্তার ডেকে আনলাম। ডাক্তার বাবু রক্ত-কাশি পরীক্ষার কথা বলে গেলেন। আমি ইচ্ছে করেই পান্তুর সোয়াব টেস্টের ব্যবস্থা করলাম ।এই ধরনের টেস্ট আবার সব ল্যাবে হয় না। একে বলে ডি এন এ পরীক্ষা ।
পান্তুর হাত থেকে যে কেকা এখনও মুক্তি পায়নি তা ওর ভেজা চোখ দেখলেই বুঝতে পারি ।ইদানীং ওকে আর মিথ্যা সান্ত্বনা দেই না ।বরং বুকের ওমে জড়িয়ে ধরি ।আমি যে ওর সাথে আছি তাই বোঝাই । এতে কেকার মনের গভীর ক্ষতের যন্ত্রণাটা অনেকটা প্রশমিত হয় বুঝতে পারি । একদিন অফিস থেকে কিছু এরিয়ারের টাকা পেয়ে কেকার হাতে দিয়ে আলমারিতে তুলে রাখতে বললাম । ভাবলাম কাল বরং ব্যাঙ্কে রেখে আসব ।
পরের দিন আর ব্যাঙ্কে যাওয়া হল না ।সাত সকালেই ছুটতে হল ডি এন এ-র রিপোর্ট আনতে । ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই লেখা রয়েছে ।পান্তুর শরীরে বইছে একজন খুনির পাপ রক্ত !এটা এখনই কেকাকে বুঝিয়ে বলতে হবে ।বরং নিজেরা অন্য কোথাও বাড়ি বিক্রি করে চলে যাব ।তবু খুনির ছেলের সাথে থাকব না । আমি যত দ্রুত সম্ভব ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম ।
দূর থেকেই দেখতে পেলাম আমার বাড়ির সামনে অনেক মানুষের জটলা !আমি তাড়াতাড়ি ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাই ।পুলিশের সাহায্যে ঘরে ঢুকে দেখি কেকা এক নদী রক্তের মধ্যে ডুবে রয়েছে !আমি রিপোর্টটা কেকাকে দেখাই ।কেকা পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে !এই প্রথম আমি পান্তুর বউয়ের নাম ধরে ডাকি ।কোন সারা নেই !পুলিশ অফিসার বলেন,” আমরা এসে এ বাড়িতে আর কাউকেই দেখতে পাইনি । দরজা হাট করে খোলা ছিল, সাথে আলমারিটাও। আর আপনার সর্বস্য চুরি হয়ে গেছে।“
কেকা পুড়ে যাচ্ছিল দাউ দাউ করে !তবু আমি ওর সারা শরীরে ছেলের মারা কালশিটে দাগগুলো যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি মেয়ে পছন্দ করতাম। অথচ কেকা চাইত ছেলে। স্বাবলম্বী হবে,বাবা-মাকে দেখবে,ওর এমনই সব কল্পনা ছিল। ও বুঝত না যে হাতের পাঁচটি আঙুল কখনই সমান হয় না। আমি ঐ লেলিহান আগুনের শিখার কাছে গিয়ে পান্তুর ডি-এন-এ রিপোর্টটি কেকাকে দেখালাম। হঠাৎ দেখলাম ওর আধ পোড়া কালো হাতটি চিতার আগুন থেকে বেরিয়ে এল আর আমি ওর হাতে রিপোর্টটি গুঁজে দিয়ে অনেকটা ভার মুক্ত হলাম। জানি একদিন না একদিন কেকা ঠিক সময় মতো রিপোর্টটি পড়ে নেবে।
ছবি : চিত্রদীপ দাশ