গান্ধর্বীরা
4.8/5 - (6 votes)

সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবি গান্ধর্বীরা ৩

বিয়ের চক্করে রাবেয়াকে পড়তেই হত না, যদি না ছ-আনির নির্জন পদ্মদিঘিটার পাড়ে গাছ-গাছালির আবডাল থেকে ষন্ডামার্কা লোকটা হঠাৎ উঁকি-ঝুঁকি মারা শুরু করত।

সেদিনও রাবেয়া সাইকেল চেপে চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ পদ্মদিঘির পাড়ে গিয়েছিল… যেমন সে সেইসব দিনে প্রায়ই যেত। কলেজের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। রেজাল্ট বেরোনো পর্যন্ত হাতে এখন অনেক সময়। ইদানিং তাই একটু বেশ ঘন ঘনই ওদিকটায় যাচ্ছিল সে। সেই কারণেই হয়ত লোকটার চোখে পড়ে গিয়ে থাকবে।

ছ-আনি তাদের বাড়ি থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে। তাদের গ্রামের বেশির ভাগ জমিই প্লট করে করে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। দেদার জঙ্গল, গাছপালা সব কাটা পড়ছে। তারই মধ্যে এই ছ-আনির দিকটা এখনও একইরকম… গাছগাছালি, পাখপাখালিতে মোড়া। ছ-আনির মধ্যে আবার তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হল এই পদ্মদিঘি এবং তৎসংলগ্ন পাড়। এখানে সে আসে…কিছুই না, একটু নিজের মত সময় কাটাতে।

পদ্মদিঘিতে পদ্ম নেই। কালো মজা তার জল। সেই জলের উপর লম্বা লম্বা ঠ্যাং মেলে জলের পোকারা হেঁটে বেড়ায়। জলের ভিতর থেকে উঁচু হয়ে থাকা পালার আগায় ফড়িং এসে বসে। ফড়ফড় করে তার ডানা কাঁপার শব্দ পাওয়া যায়। ফিরোজা নীল বিদ্যুচ্চমকের মত জলে ছোঁ মেরে চলে যায় মাছরাঙা। তবে আসল খেলা শুরু হয় পাড়ের শাল, সেগুন, বাবলা গাছের সারির ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত সূর্যের কাঁচা হলুদ রশ্মিরা যখন কাজলকালো জলের উপর এসে আছড়ে পড়তে থাকে। সময় যত গড়ায় ততই ওরা কাঁচা হলুদ থেকে আস্তে আস্তে কমলা, গাঢ় কমলা, টকটকে লাল হয়ে ওঠে। এই বিচিত্র আলোকসম্পাত জলাশয়টিকে এক অলৌকিক ব্যাকড্রপ এবং তার পাড়টিকে এক আশ্চর্য সুন্দর রঙ্গমঞ্চে পরিণত করে তোলে। রাবেয়া ওই রঙ্গমঞ্চ অধিকার করে দাঁড়ায়। এটা আসলে তার একক রিহার্সালের জায়গা।

আসলে রাবেয়া নাচের মেয়ে। চোদ্দো বছর বয়স থেকেই বাপীদার নাচের দলে সে একজন স্টার পারফর্মার। এই দলে যে নাচ শেখানো হয় তার পারিভাষিক নাম ‘ব্রেক ড্যান্স’। মূলত ফাস্ট বিটের চটুল বলিউডি, টলিউডি অথবা বাজারচলতি লোকগানের সঙ্গে এক জগাখিচুড়ি স্টাইলের আধুনিক নাচ, – বাপীদার দলের ঘরানা এটাই। এই নাচের দলের সঙ্গেই রাবেয়া হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ায় পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে। অবশ্য হিল্লি-দিল্লি বলতে কি আর সত্যি সত্যি রাজধানী দিল্লি? রাজ্যেরই বিভিন্ন জেলার গাঁ, গঞ্জ, মফস্বল… যেখানে মাচা বেঁধে ফাংশান হয়। সত্যি বলতে কি, এসব ফাংশান থেকে নাম-ডাক ছাড়াও একটু-আধটু আয়-ইনকামও হয় রাবেয়ার। গরীবের সংসারে ওই একটুই অনেক।

তবে রাবেয়ারা কিন্তু চিরকাল গরীব ছিল না। এলাকার অন্যতম বনেদি, সম্ভ্রান্ত পরিবার হিসেবে খ্যাতি ছিল তাদের। সেই পঞ্চাশের দশকে রাবেয়ার প্রপিতামহের আমলে ওই অজ পাড়া-গাঁয়ের মধ্যেও লেটেস্ট মডেলের চারচাকা গাড়ি ছিল তাদের বাড়িতে। অবস্থায় ধ্বস নামল তার বাবার হাত ধরে। বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলে। পড়াশুনো কিছুই করলেন না। বিষয় বুদ্ধিও তেমন নেই। এদিকে স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার। একের পর এক অলীক বিজনেস ফেঁদে বসতে লাগলেন তিনি। লাভ তো কিছু হলই না, উল্টে জমি-জমা, যত জমানো পুঁজি নিঃশেষ হয়ে গেল এক এক করে। শেষে একদিন কঠিন অসুখে শয্যা নিলেন। মায়ের যাবতীয় গয়না বেরিয়ে গেল চিকিৎসায়। বাবা যখন মারা গেলেন তখন তারা আক্ষরিক অর্থেই কপর্দকশূ্ন্য। বাধ্য হয়ে রাবেয়ার মাকে বারো ঘণ্টা বাচ্চা দেখার কাজ নিতে হল এক জ্ঞাতির বাড়িতে।

সব খারাপ জিনিসেরই যেমন একটা না একটা ভালো দিক থাকে… দারিদ্র্যেরও আছে। দারিদ্র্যের ভালো দিক হল মুক্তি। স্বাধীনতা। গরীব হয়ে যাবার পর রাবেয়া বা তার দিদি এমন কিছু স্বাধীনতা ভোগ করবার সুযোগ পেয়ে গেল যা ইতিপূর্বে তাদের পরিবারের আর কোনও মহিলা পায়নি। রায়চৌধুরি বাড়ির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও রাবেয়ার দিদি বিয়ে করল মাঝি পাড়ার সনাতন মাঝির ছেলে সঞ্জয়কে এবং কেউ কোনও আপত্তি করল না। রাবেয়াও এই যে সাইকেল নিয়ে যত্র তত্র টো টো করে বেড়ায়… নাচের প্রোগ্রাম করতে এখানে ওখানে যায়। তাতেও কেউ বাধা দেয় না।

রাবেয়া যখন স্টেজে ওঠে, মাইকে তার নাম ঘোষিত হয় ‘মিস রাবেয়া’। “এখন আপনাদের সামনে নৃত্য পরিবেশন করতে আসছেন মিস রাবেয়া!” আর ‘মিস রাবেয়া’ মানেই ফাংশান হিট। এর অবশ্য কিছু কারণ আছে। দলের অন্যান্য সদস্যদের মত তার নাচ কেবলমাত্র বাপীদার শেখানো ডান্স স্টেপেই যে সীমাবদ্ধ, তা কিন্তু নয়। পাড়ার মিত্তিরদের বাড়ির মোনালিসা, যে শহরে গিয়ে ভরতনাট্যম শিখে আসে, সে তো রাবেয়ার বন্ধুলোক। মোনালিসার অনুশীলনের সময় প্রায় দিন তার বাড়ি গিয়ে সে একটি কোনায় বসে থাকে। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে তার হস্ত, পদ, চক্ষু, গ্রীবা সঞ্চালন। ওই লক্ষ করতে করতেই সে বুঝতে শেখে তাণ্ডব আর লাস্যের পার্থক্য, ভাবের প্রকারভেদ… আর বুঝতে শেখে একজন নৃত্যশিল্পীর ঈশ্বরীয় গরিমাকে। তারপর ওই পদ্মদিঘির পাড়ে একলব্যের মত নির্জন সাধনায় সে নিজের মধ্যে বসিয়ে নিতে থাকে তার এইসব পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা জ্ঞান। এই দেশটারই সুদূর দক্ষিণের ভূমিখণ্ড থেকে যে গুরুপরম্পরায় এই জ্ঞান বাহিত হয়ে এসেছে… সেইসব গুরুদের রাবেয়া চেনে না। কিন্তু মোনালিসাকে দেখে শেখা গুরুপ্রণামটি দিয়ে যেই না রাবেয়া তার অনুশীলন শুরু করে… অমনি সে-ও কি জুড়ে যায় না সেইসব আদি গুরুদের সঙ্গে?

এর আগে একটু আধটু কত্থক নাচও সে শিখেছিল পাড়ার আয়েশাদির সঙ্গতে। সে-ও ওই, দেখে দেখে। তখন বছর দশেক বয়স হবে তার। বিকেলবেলায় আয়েশাদি তবলার বোলের সঙ্গে দুপায়ে বাঁধা ভারী ভারী ঘুঙুরে ঝম ঝম শব্দ তুলে নাচের অভ্যাস করত। গ্রিল খামচে জানালায় ঝুলে ঝুলে হাঁ করে তাই দেখত রাবেয়া।ওই হাঁ করা মুখ দেখে একদিন তাকে ঘরের ভিতরে ডেকে নিয়েছিল আয়েশা।

-ওরম বাঁদরের মত ঝুলছিস কেন? আয়, ভেতরে এসে বোস।

সেই আয়েশাদি বিয়ে হয়ে কলকাতা চলে যাওয়ার পর তার কত্থক শেখার পাটও চুকে যায়। তবু যে কদিন সঙ্গ পেয়েছে, তাতে কি শুধু নাচ? কী শেখেনি সে আয়েশাদির কাছে। হাব-ভাব, কথা-বার্তার ধরণ… তার সব পালটে রেখে দিয়েছিল মেয়েটা। ‘গান্ধর্বী’ কথাটা আয়েশাদির মুখেই প্রথম শোনা। যারা নাচ-গান করে তারা নাকি গান্ধর্বী।

-তুমি তো নাচ করো। তার মানে তুমিও গান্ধর্বী?

-হ্যাঁ তো!

এরপরেই সেই মোক্ষম কথাটা উচ্চারিত হতে শুনেছিল রাবেয়া।

-তুইও গান্ধর্বী। যারা নাচ-গান করে শুধু কি তারাই? যাদের মনের মধ্যে নাচ-গানের কুঁড়ি রয়েছে তারাও তো গান্ধর্বী। তারা আজ হয়তো তেমন করে কিছু করতে পারছে না… কিন্তু কুঁড়ি তো একদিন ফুল হয়ে ফুটবে। ফুটবেই। সেদিন তারা নিজেদের চিনে যাবে।

আয়েশাদি চলে যাবার পর পরই সে বাপীদার হাতে পড়ে। তার খেলার মাঠের সাথী সুমন, যে কিনা বাপীদার দলে নাচত, সে-ই নিয়ে গিয়েছিল রাবেয়াকে। যে কোনও ডান্স-স্টেপ দেওয়া মাত্রই মেয়েটা তুলে নিতে পারছে, তাছাড়া তালজ্ঞানও বেশ পোক্ত। এইসব দেখে-শুনেই বাপীদা মেয়েটাকে দলে নিয়ে নিতে আর দ্বিধা করেনি।

ফাংশান করে পাওয়া টাকা জমিয়ে জমিয়ে একটা স্মার্ট ফোন কিনেছে রাবেয়া। এটা হাতে আসার পর থেকে ভারি সুবিধে হয়েছে তার। ভিডিওতে বিভিন্ন দেশের নামী-অনামী শিল্পীদের নৃত্যকলা… এবং বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধারার নৃত্যশৈলীর একটা ভাণ্ডার যেন উন্মুক্ত হয়ে গেছে তার চোখের সামনে। যেমন ঐ ভিডিও দেখতে দেখতেই সে একটি নৃত্যধারার সঙ্গে পরিচিত হয়, যার নাম ফ্লামেংকো। স্পেন এর আন্দালুসিয়া বলে একটা অঞ্চলে এর জন্ম। এই নাচটা বিশেষ ভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কারণ আয়েশাদির শেখানো কিছু হাত এবং পায়ের কাজের প্রতিফলন সে দেখতে পায় এই নাচে। যেমন তৎকার। ঠিক যেমনভাবে তৎকারে এক হাতে ঘাগরাটা একটু উঁচু করে তুলে পায়ে তোলা বোলের সঙ্গে সঙ্গে অপর হাতের কবজিটির সঞ্চালন করা হয়… ফ্লামেংকোতেও এই ধরণটার ছায়া সে লক্ষ করেছে।পার্থক্য হল কত্থকের সময় দুই পায়ের ভারী ভারী ঘুঙুরের ঝংকার কথা বলে আর ফ্লামেংকোতে কাঠ-খোট্টা ধরনের জুতো। কত্থকের ভাব-ভঙ্গী তুলনায় পেলব। ফ্লামেংকো অনেক বেশি উগ্র, তেজিয়াল। তবে রাবেয়ার, যাকে বলে ‘অলটাইম ফেভারিট’… সে হল শাকিরা। শাকিরার নাচ-গানে রাতদিন একেবারে বুঁদ হয়ে থাকে রাবেয়া। এবং বলা বাহুল্য, ভিডিও দেখে দেখে এই ভিনদেশি গান্ধর্বীর নৃত্য-বিভঙ্গগুলিকেও সে তার নিজের দেহকান্ডে যত্ন করে তুলে নেয়। এসবের সঙ্গে তার আত্মায় যোগ হয় শাল-পিয়ালের পাতার নাচ… পাখীদের কলতান… সূর্যের আলোকসম্পাতে নির্মিত আশ্চর্য সেই রঙ্গমঞ্চে তার অনুশীলনের অভিজ্ঞতা।

সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবি গান্ধর্বীরা ২

এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে রাবেয়া মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়… স্পটলাইট এসে পড়ে তার শরীরে… সেই শরীরকে আশ্রয় করে এরপর মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে এমন এক রসময় জগত, যা একইসঙ্গে চটুল এবং গভীর… ক্ষণিক এবং নিত্য… আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক। তখন, এমনকি তার সেইসব গাঁ, গঞ্জ, মফস্বলীয় মাচার অসংস্কৃত দর্শকদের সামনে পর্যন্ত খুলে যেতে থাকে এক অমরাবতীর দ্বার। ফলস্বরূপ, হয় তারা স্থাণুবৎ বসে থাকে নয়তো নেচে ওঠে, উল্লাসে ফাটিয়ে দেয় দর্শকাসন। এটা যে কেমন করে হয় তা রাবেয়া জানে না। যেমন জানে না তার প্রত্যক্ষ গুরু বাপীদাও। সে কেবল দেখতে পায় দর্শকদের উন্মাদনা। আর শো-এর শেষে তার ভর্তি পকেট।

এ হেন রাবেয়ার দিঘির পাড়ের নির্জনবাসস্থলে যখন ওই উটকো উৎপাত শুরু হল, রাবেয়া পড়ল মহা ফাঁপরে। এত বছর ধরে সে পদ্মদিঘিতে আসছে তো? জায়গাটার নির্জনতায় সে কখনও কোনও খামতি অনুভব করেনি। কিন্তু আজকাল লোকটা প্রায় প্রতিদিনই উদয় হতে এবং নজরে আসা মাত্রই গাছেদের আড়ালে সুট সুট করে লুকিয়ে পড়তে লাগল। রাবেয়া একটু ভয়ই পেল। কারণ লোকটা একা, না কি আরো সঙ্গী-সাথী আছে তার তাই বা কে জানে। এই জনহীন জায়গায় দল বেঁধে এসে তারা যদি হঠাৎ চেপে ধরে রাবেয়াকে? দল বেঁধে কেন? কোনও কুমতলব নিয়ে ওই মুশকো লোকটা একাও যদি সামনে এসে দাঁড়ায় কিছুই কি করার থাকবে তার? রাবেয়ার নির্জন সাধনায় ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। তবে লোকটা যেদিন চোখা-চোখি হওয়ামাত্রই গাছের পিছনে আর লুকিয়ে না পড়ে বরং এগিয়ে এসে অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গী শুরু করে, সেদিনই রাবেয়া মনস্থির করে ফেলে। তার একজন বডিগার্ড দরকার।

এ সম্বন্ধে যার কথা প্রথমেই রাবেয়ার মনে আসে, সে হল পাশের পাড়ার মনোতোষ, গত দু’বছর ধরে একেবারে ছিনে জোঁকের মত পিছনে পড়ে আছে। বেশ শক্ত-সামর্থ চেহারা। ভালো ফুটবল খেলে। সদ্য একটা সরকারি চাকরি পেয়েছে বলে এলাকায় রোয়াব খুব। রাবেয়া তার পাশে মনোতোষকে কল্পনা করে দেখে। হ্যাঁহ্‌! ঠিক হয়েছে।এই তো! এমন একটা ছেলে সঙ্গে থাকলে পদ্মদিঘির নির্জনতায় তাকে কেউ ঘাঁটানোর আগে দুবার ভাববে।

রাবেয়া মনোতোষকে নিয়ে দিঘির পাড়ে যাওয়া শুরু করে। শনিবার রোববার ছাড়া তো তার আর সময় হয় না। তাই রাবেয়ার অনুশীলনও সপ্তাহে ওই দুদিনেই এসে ঠেকে। মনোতোষ হাতে চাঁদ পায়। গাছপালার আড়ালে অশ্লীল ইঙ্গিত করা লোকটাকে আর দেখতে পাওয়া যায় না বটে, তবে মনোতোষকে ঠেকিয়ে রাখা দায় হয়। প্রথমটা বিয়ের কোনও তাড়া ছিল না। বিয়ে তো একদিন করতেই হবে। রাবেয়ার সময়ে তাদের গ্রামে অন্তত, বিয়ে বাদ দিয়ে কোনও ভবিষ্যত পরিকল্পনা সাধারন ভাবে একটি মেয়ের পক্ষে অসম্ভব ছিল। যদিও দিব্যি হেসে খেলে বছর তিন-চার পর কলেজে অন্তত একটা পাশ দিয়ে তবে বিয়ে করবে রাবেয়া এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু আলটপকা কিছু উটকো ফ্যাসাদ এসে হাজির হল।

মনোতোষের মা এক পাঁজা বাসন নিয়ে পিছল কলতলায় আছাড় খেয়ে পড়ে কোমরে ভারি চোট পেলেন।এই সুযোগে মনোতোষের মাকে দেখতে গিয়ে পাড়ার কেউ কেউ, বিশেষত যাদের ঘরে বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে, “এই বয়সেও তুমি এমন খেটে খেটে মরছো দিদি”, “সমর্থ ছেলে তোমার। তার তো উচিত, বৌ এনে মাকে এবার একটু বিশ্রাম দেওয়া” ইত্যাদি বলে উত্তেজিত করে তুলতে লাগল। কেউ বলল,“আমরা তো সব জানি! কীভাবে নিজেদের জান কয়লা করে তোমরা ছেলেটাকে দাঁড় করিয়েছো। ওদিকে সে ছেলে দেখো গিয়ে পড়লো কিনা এক ধিঙ্গির পাল্লায়।” কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে কে একজন বলে গেল,“নাচুনি রাবেয়া কী জাদু করেছে তোমার ছেলেকে তা কে জানে। রাতদিন কেবল ছুঁড়ির পিছন পিছন, পিছন পিছন! ওই মেয়ে কিন্তু তোমার ছেলে হাত করে কেটে পড়বে দিদি। তোমরা বুড়ো-বুড়ি পড়ে থাকবে যে কূলের সেই কূলে।” এই কথা শুনে মনোতোষের মায়ের মাথায় বাজ পড়ল। হতভম্ব তিনি কাতর প্রশ্ন করলেন, “তাহলে উপায়?” -“এখনও সময় আছে দিদি। রাশ টানো।”

ফলে মনোতোষদের বাড়িতে ঝড় উঠল।

-দেখ মনা আমি আর তোর বাবা কিন্তু অনেক কষ্ট করে তোকে মানুষ করেছি। এখন আমাদের বয়স হয়েছে। বুড়ো বাপ-মার প্রতি তোরও তো একটা দায়িত্ব-কর্তব্য আছে।

মনোতোষের মায়ের চোখ থেকে ফোঁটা দুই জল পড়ে।

-তা কী করতে হবে আমায়?

-বিয়ে করে সংসারে বৌ আনতে হবে। বেশ একটা লক্ষ্মীমন্ত বৌ। চোখ বোঁজার আগে আমরা তোমার বিয়েটা অন্তত দেখে যেতে চাই।

মনোতোষের বিয়েওলা বোনও বাচ্চাকোলে এসে হাজির। নীচু গলায় সে-ও যোগ করে,

-ফুত্তি যদি করতেই হয় বিয়ে করে কর। মা কেন একা খেটে মরে? সে-ও এসে হাত লাগাক। সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করুক।

মনোতোষ আমতা আমতা করে বলে,- রাবেয়ার তো সবে ফার্স্ট ইয়ার। দু-তিন বছরের আগে সে বিয়ে করবে না।

-রাবেয়া না করে না করুক, অন্য মেয়ে দেখি।

এই বলে মনোতোষের মা মনোতোষের জন্য মেয়ে দেখতে উঠে-পড়ে লাগে।

এতে অবশ্য রাবেয়ার কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু বেঁকে বসল রাবেয়ার মা আর দিদি।

-ওই ছেলের সঙ্গে টই টই করে ঘুরে বেড়ানোর সময় মনে ছিল না?

-পাড়ার কারুর কি আর কিছু জানতে বাকি আছে?

-এই ছেলের সঙ্গে বিয়ে ভেস্তে গেলে সমাজে আমরা মুখ দেখাবো কী করে?

তাছাড়া হাজার হোক সরকারি চাকরি করা ছেলে! আজকাল কটা মেয়ের কপালে অমন জোটে? বিশেষ করে রাবেয়ার মত একজন ধিঙ্গি, নাচুনি মেয়ের কপালে?

রাবেয়া টের পায় স্বাধীনতা কখনই এমনি এমনি আসে না। তার জন্য সব সময় একটা মূল্য ধার্য থাকে। সে তুমি ধনী হও বা দরিদ্র।

মোটের উপর রাবেয়া আর মনোতোষের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর প্রথমেই বাপীদার নাচের ঠেক-এ যাওয়া রদ হয় রাবেয়ার। কলেজটা কিছুদিন চালু থাকে বটে… তবে এন্তার কামাই হতে থাকে। এরপর অন্য জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে মনোতোষের পোস্টিং হলে রাবেয়াকেও সঙ্গে যেতে হয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই তার কলেজের পাট উঠে যায়। মনোতোষের বাবা-মা বায়না ধরেছিলেন মরার আগে তাঁরা ছেলের বিয়েটা অন্তত দেখে যেতে চান। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাঁরা নতুন বায়না ধরেন, মরার আগে নাতির মুখ দেখে যাবেন। মনোতোষের বাবা-মা যেহেতু অনেক কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেছেন তাই ছেলের বৌ অর্থাৎ রাবেয়ার অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় স্বামীর বাবা-মায়ের শখ-আহ্লাদ পূরণে মনোযোগী হওয়া। এভাবেই রাবেয়া, যে আসলে পদ্মদিঘির জলে সূর্যের আলোকসম্পাত সঙ্গে নিয়ে নাচের অনুশীলনে মগ্ন থাকত আর সেই প্রক্রিয়াকে নির্বিঘ্ন করার জন্যই মনোতোষের মত একজনের সঙ্গ করেছিল, সে পদ্মদিঘির কথা ভুলে যেতে থাকে। এতদিন যার উপর শয়ে শয়ে মানুষের মনোরঞ্জনের ভার ছিল, আজ তার সেই দায়ীত্বভার কমে শুধু দুইটি মানুষের মনোরঞ্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাঁরা মনোতোষের বাবা আর মা। মনোতোষের মনোরঞ্জনের দায়ীত্ব তাকে খুব একটা নিতে হয় না। কারণ ইতোমধ্যেই সে আবিষ্কার করে ফেলে, ইন্দ্রিয়তাড়নার বাইরে মনোতোষের আলাদা করে তেমন কোনও মনোভূমি  নেই। থাকলেও সেখানে তার বাবা-মায়েরই একাধিপত্য। তাছাড়া মনোতোষ সর্বদাই এক অদ্ভুত ঋণবোধ অথবা অপরাধবোধে ভোগে। অপরাধবোধ, কারণ কথায় কথায় তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় “আমরা তোমাকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছি… এখন তোমার দায়ীত্ব আমাদের জন্য…”। যেন জন্মানোটাই মনোতোষের অপরাধ। তার বাবা-মা তাকে জন্ম দিয়েছে, খাইয়ে পরিয়ে বড় করেছে… এতে যে ঋণ তৈরি হয়েছে মনোতোষের সেই ঋণ সে যেন আর কিছুতেই শোধ করে উঠতে পারছে না। আর সেই অপরাধে তাকে বলি দিয়ে দিতে হচ্ছে তার যাবতীয় স্বাধীন ইচ্ছা। শুধু কি তার? আঁচ তো এসে লাগছে রাবেয়ার গায়েও।

সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবি গান্ধর্বীরা ৪

এইভাবেই বছর গড়াতে থাকে। রাবেয়ার ছোট ছেলের বয়স এখন পাঁচ। আর বড়োটার দশ। রাবেয়া আর নাচে না। সাইকেল চালায় না। বাচ্চার জন্ম দেবার পর থেকে অবসাদে শুয়ে বসে তার দিন কাটে। পদ্মদিঘির কথা সে একরকম প্রায় ভুলেই গেছিল। এমন সময় হঠাৎ মনোতোষের ট্রান্সফার হল। নতুন জায়গায় এসে মনোতোষ হাত পা ছুঁড়তে লাগলো। বড্ড রিমোট! পলিটিক্যাল প্রেশার… ইত্যাদি, প্রভৃতি। তবে ছোট্টর উপর সুন্দর একটা দোতলা বাড়ি তারা ভাড়ায় পেয়েছে। তার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাবেয়া অবাক হয়ে গেল। কে যেন তাদের গ্রামের পদ্মদিঘিটাকে এনে হাজির করেছে তার জানালার পাশে। একেবারে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে শাল পিয়ালের জঙ্গলে ঘেরা একটা আস্ত জলাশয়। বেশ টলটলে জল তার। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলোয় রঙ ধরা শুরু হয় আর গাছপালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে সেইসব আলোকরশ্মিরা ঠিকরে এসে পড়তে থাকে ময়ূরকণ্ঠী জলতলে। এ যেন ঠিক সেই তাদের গ্রামের পদ্মদিঘিটার যমজ বোন।

রাবেয়ার খুব ইচ্ছে করে এক ছুটে সে চলে যায় ঐখানে। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠে না। বর এবং বাচ্চাদের তদারকি আছে। শ্বশুর-শাশুড়ি এখন আরো বুড়ো। গ্রামের বাড়ির পাট চুকিয়ে তারা পাকাপাকি ভাবে ছেলের কাছে এসে উঠেছে। তাদেরও ঠ্যাকনা হাজার। এইসব সামলে সুমলে উঠে জলের কাছে তার আর যাওয়া হয় না। তবে অবসর পেলেই শোবার ঘরের জানালা দিয়ে ঐ জলাশয়ের দিকে সে তাকিয়ে থাকে।

ওই ভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ একদিন জলাশয়ের অপর পারে রাবেয়ার চোখে পড়ে একটি মেয়ে। সে কী করে? রাবেয়া ভালো করে ব্যাপারটা দেখবে বলে তাড়াহুড়ো করে ছাতে উঠে যায়। ছাতের উপর থেকে দৃশ্যটা একদম স্পষ্ট।

-সাইকেল করে মেয়েটা আসে। তারপর সাইকেলটা দূরে দাঁড় করিয়ে একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসায় একটা ক্যামেরা। মোবাইল ফোনে মিউজিক চালিয়ে ঐ পুকুরের ব্যাকগ্রাউন্ডে পড়ন্ত সূর্যরশ্মি শরীরে মেখে মগ্ন হয়ে ক্যামেরার সামনে সে নাচতে থাকে। রাবেয়ার বুঝতে অসুবিধে হয় না যে মেয়েটা আসলে নাচের রিল বানায়। আজকাল এই এক চল হয়েছে। তবে জিনিসটা তেমন মন্দ নয়। হিল্লি-দিল্লি না করেও মানুষ কেমন তার চাহনেওয়ালেদের সঙ্গে জুড়ে যেতে পারে। সে মেয়েটাকে দেখে আর মনে মনে তারিফ করে। এই মেয়েটাও যে স্টাইলে নাচে সে-ও ঐ। বাপীদার দলে যাকে বলা হত ‘ব্রেক-ড্যান্স’। মূলত ফাস্ট বিটের বলিউডি গানের সঙ্গে নাচ। তবে মেয়েটার মধ্যে লাস্যের নামগন্ধ নেই। তার অঙ্গসঞ্চালন একটু যেন বেশি কাঠ কাঠ। যদিও বডি খুব ফ্লেক্সিবল। আর বিট এর সেন্সও দারুণ।

লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েটার নাচ দেখা রাবেয়াকে নেশার মত পেয়ে বসে। বিকেল হলেই তড়িঘড়ি সে ছাতে উঠে আসে। বিকেলের ঐন্দ্রজালিক আলোয় মেয়েটি নাচে। আর সে হাঘরের মত তার সমস্ত সত্তা দিয়ে শুষে নিতে থাকে ঐ দৃশ্যটির সমস্ত রস… ঠিক যেমনভাবে তার ছোট ছেলেটা লেবু লজেন্স চোষে।

হঠাৎ একদিন রাবেয়া লক্ষ করে মেয়েটির দর্শকসংখ্যা বেড়েছে। একে তো জলাশয়ের পাড়ে ঘন গাছ-গাছালির ভীড়। তার উপর মেয়েটা থাকে নাচের ঘোরে। ফলে সে কিছুই টের পায়না। কিন্তু ছাতের উচ্চতায় রাবেয়ার তো পাখীর নজর। তাই কোনও কিছুই তার চোখ এড়ায় না।

গাছপালার আড়ালে খালি গা, ভুঁড়িওয়ালা, ষন্ডামার্কা এক লোক বেশ কিছুদিন যাবৎ নজরে রাখছে মেয়েটিকে। পাতা-নাতার আবডালে লোকটির মুখ ঠিক দেখা যায় না বটে তবে তার হাব-ভাব অঙ্গ-ভঙ্গী খুব একটা সুবিধের ঠেকে না রাবেয়ার। সম্ভবত লোকটির উপস্থিতি মেয়েটিও ইদানিং টের পেয়েছে। কারণ আজকাল তার মধ্যে কেমন যেন বন্য হরিণীর মত একটা সদা-সতর্ক ভাব। পিঠের পিছনে কারো একজোড়া অবাঞ্ছিত চোখ অনুভব করেই হয়ত বা সে আজকাল অসময়ে ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়, এদিক ওদিক তাকায়।

রাবেয়া ত্রাতা হয়ে উঠতে চায়। রক্ষাকর্ত্রী মনোতোষকে বলে ঐ লোকটাকে টাইট দিতে তার এক মিনিট লাগবে। শুধু ওই মেয়েটা যেন আসা বন্ধ না করে। তার চেয়েও বড় কথা দেহরক্ষী হিসেবে যেন কোনও পুরুষসঙ্গী সে আবার জুটিয়ে না ফেলে। রাবেয়া মনে মনে দিঘির দেবতার কাছে এইসব প্রার্থনা জানায়।

সেদিন রবিবার। খাসির মাংস আর ভাত খেয়ে মনোতোষ পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। মেয়েটি যথারীতি তার রিল বানাবার সরঞ্জাম নিয়ে জলাশয়ের পাড়ে হাজির। রাবেয়া ছাত থেকে সেই সবকিছু লক্ষ করছে। দেখতে দেখতে দিঘির জলে গোধূলি ঘনিয়ে আসে। রাঙা আলোয় মোহময় হয়ে ওঠে পৃথিবী। গাছেদের কচি সবুজ পাতা, তাদের ধূসর কান্ড, কালচে লাল মাটি আর জংলা ঘাসের বন… এই সমস্তকিছুর উপর একটা উষম উষম রাঙা আলোর আস্তরণ পড়ে যায়। এই আলোতেই মেয়েটি তার রিল বানায়। মেয়েটির নাম জানা হয়নি আজ অবধি… নইলে সে মোবাইলে ঠিক তার রিল খুঁজে দেখত। সন্ধে হয় হয়, কিন্তু দিনের আলো তখনও নিভে যায়নি, এমন সময় হঠাৎ ঝোপ জঙ্গল, পাতা-নাতা ভেদ করে বেরিয়ে আসে সেই মুশকো লোকটা। কালো-কালো মোটাসোটা চেহারা। প্রথমে মেয়েটাকে সে কিছু একটা বলে। মেয়েটা তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। কী কথোপকথন হয় তা রাবেয়া এত দূর থেকে শুনতে পায় না। কিন্তু লোকটাকে হঠাৎ খপ করে মেয়েটার হাতদুটো চেপে ধরতে দেখে সে। এক ঝটকায় মেয়েটা হাত ছাড়িয়ে নেয় এবং পিছন ফিরে চলে যাবার উপক্রম করে। লোকটা কিন্তু নাছোড়বান্দা।সর্বশক্তি প্রয়োগ ক’রে মেয়েটাকে সে পিছন থেকে জাপটে ধরে। নাচিয়ে মেয়েটি এইবার অভাবনীয় এক কাজ করে। কনুই দিয়ে পিছনের লোকটার পাঁজরে মারে এক গুঁতো। লোকটা ককিয়ে করে ওঠে। এবার সে পিছন ফিরে কি এক আশ্চর্য কায়দায় এক লাথিতে ধরাশায়ী করে ফেলে লোকটাকে। লোকটার সম্ভবত খুব লেগেছে। সে যাহোক তাহোক করে লুঙ্গির কষি বেঁধে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়। ছাতের কার্নিশে দৃষ্টিপথ বাধা পাওয়ায় রাবেয়া আর তাকে দেখতে পায় না। মেয়েটা সাইকেল নিয়ে কেটে পড়ার উপক্রম করতেই ছাদ থেকে রাবেয়া চেঁচিয়ে ওঠে। “এই! দাঁড়াও, দাঁড়াও!” মেয়েটা থমকে দাঁড়ায়।

রাবেয়া হুড়মুড় দুদ্দুড় করে ছাত থেকে নেমে আসে। দরজা দিয়ে বেরোনোর পথে সে দেখতে পায় লোকটা তাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। একতলার রোয়াকে বসে ব্যথায় মুখ বিকৃত করে সে পায়ে মলম লাগাচ্ছে। পরনে সেই লাল লুঙ্গি। লুঙ্গিটা সিল্কের। ঠিক এই রকম একটা লুঙ্গি মনোতোষেরও আছে না! এবং অবাক হয়ে সে লক্ষ করে শুধু লুঙ্গি নয়। গোটা শরীরটাই মনোতোষের। ওটা মনোতোষই। হায় রে! যে উৎপাতের হাত থেকে বাঁচতে সে একদিন পদ্মদিঘির পাড় ছেড়ে ঘরে ঢুকেছিল, সেই উৎপাত আজ তার ঘরেই বিদ্যমান।

রাবেয়া পাশ কাটিয়ে দ্রুত দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। মেয়েটা তখনও দাঁড়িয়ে।

-হ্যাঁ রে! ওটা কী করলি?

রাবেয়া ছুটে আসার দরুন হাঁফাতে থাকে।

-কোনটা?

-ঐ যে এক লাথি মেরে লোকটাকে ফেলে দিলি!

-ও! ও তো মার্শাল আর্ট। পাড়ার ক্লাবে মন্টুদার কাছে শিখেছি।

-নাচ শিখলি কোথায়?

-টিভি আর রিল দেখে।

-হ্যাঁ রে, রিল বানাস বুঝি?

-হ্যাঁ গো। তিন হাজার ফলোয়ার আছে আমার।

-আমায় নিবি!

-তুমি কে? তুমি কি ঐ লোকটার বৌ নাকি? দেখো আমায় ফাঁদে ফেলতে এস না। পুরোটাই ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে আছে কিন্তু। উনি আগে আমাকে অ্যাটাক করেছেন। তারপরেই আমি ওনার গায়ে হাত তুলেছি। ভাইরাল করে দিলে তোমরাই বিপদে পড়বে।

-দূর! হাত কোথায়! তুই তো পা তুললি।

মেয়েটা এবার ফিক করে হেসে ফেলে।

-শোন্‌না। এক কালে আমারও ফলোয়ার ছিল। কাতারে কাতারে ফলোয়ার। রিলের ফলোয়ার নয়। রিয়েল লাইফ ফলোয়ার। তবে তারাও নিশ্চয় আজকাল রিলের দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছে। তাই না রে?

-রিলে কে নেই তাই বলো না।

রাবেয়া পড়ে থাকা মোটা কাঠের গুঁড়িটার ওপর জাঁকিয়ে বসে।

-আয়। আমার পাশে এসে বোস।

মেয়েটা রাবেয়ার পাশে এসে বসে।

সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবি গান্ধর্বীরা ৫

-শীতকাল বলে তাই রক্ষে। তেনারা সব শীতঘুম দিচ্ছেন। নইলে এই অঞ্চলে সাপ-খোপের উৎপাত খুব।

-ঘরের মধ্যেই সাপ-খোপ নিয়ে যাদের বাস, তাদের কি আর বাইরের সাপ-খোপে ভয় করলে চলে রে? ওসব কথা রাখ। আসল কথায় আয়। আমাকে তোর রিলে নে না? নিবি?

দেখ আমার সেইসব ফলোয়ারগুলো… তারা নিশ্চয় এখনও আমাকে খোঁজে। তাহলে তোর আর আমার দুজনের ফলোয়ার একসাথে মিলে গেলে সংখ্যাটা কতোতে দাঁড়াবে ভাবতে পারিস?

-তুমি নাচতে পারবে?

-আরে আমার নাম মিস রাবেয়া রে! নাম শুনিসনি কখনও?

-কই না! আচ্ছা! মোবাইলে একটা মিউজিক চালাই কই নেচে দেখাও তো দেখি।

সন্ধে গড়িয়ে গেছে কখন। কিন্তু রাত আর সেভাবে নেমে উঠতে পারে নি। পূর্ণিমা জ্যোৎস্না তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কোথায়। সেই জ্যোৎস্না গায়ে মেখে মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে রাবেয়া নাচ শুরু করে।

ছেলেটা কেঁদে উঠলো কি? শাশুড়ি কি গালাগাল করছে তার বাপ-মা তুলে? স্বামীর ব্যাথার উপশম হয়েছে কি? এসব তার আর মাথায় আসে না। সে নৃত্যস্থ হয়ে যায়। ঠিক যেমন ভাবে মাচার দর্শককুল রাবেয়ার নাচে আবিষ্ট হয়ে গিয়ে নিজেরাও নাচতে লেগে যেত… ঠিক সেই ভাবে মেয়েটার শরীরেও নাচের হিল্লোল ওঠে।

মিউজিক থামলে, নাচ থামলে, ঘোর কাটলে… মেয়েটা বলে -তুমি তো গোলা গো! গোলা! চলো! আজ থেকে তুমি আমার পার্টনার। কিন্তু তোমার বর আবার তোমায় অ্যালাউ করবে তো!

-করবে না মানে! রেকর্ড করা আছে না তোর ক্যামেরায়? ওটা দেখলেই তো দুধ কা দুধ, পানি কা পানি সব পষ্ট হয়ে যাবে! ভাইরাল হবার ভয় নেই নাকি মানুষের?

মাথার উপর দিয়ে রাতচরা পাখি উড়ে যায়। দুই গান্ধর্বীর হাসির কলতান ঘুঙুরের শব্দের মত ছড়িয়ে পড়তে থাকে জ্যোৎস্নাধৌত চরাচরে।

ছবির সংরচনা ড্যাল-ই-এর মাধ্যমে এবং প্রোক্রিয়েট দিয়ে স্কেচ করেছেন সৌরভ রায়চৌধুরী