জয়া মিত্রের গল্প : সমাজ প্রগতি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দলিল
অনুগ্রহ করে এই লেখাটির মূল্যায়ন করুন

জয়া মিত্রসময়ের অসমান্তরাল বিন্যাসকে বিবিধ ভঙ্গিমায় জানান দিয়েছেন জয়া মিত্র (১৯৫০)। অতীত ও ঘটমান বর্তমানের প্রবাহমান সত্যকে নিজস্ব কায়দায় জানান দেবার অভিপ্রায়ই তাঁর গল্পবলয়কে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। সময়ের নানাবিধ একক, সময়ের সঙ্গে প্রবাহিত বাস্তবের বহুমাত্রিক রূপান্তরকে কেন্দ্র করে তিনি আখ্যানভুবন সাজিয়েছেন। রূঢ় বাস্তব, প্রতিস্পর্ধী বাস্তব, স্বীকার-অস্বীকারের বাস্তব, প্রবণতা ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে চরিত্রের নিজস্ব অভিপ্রায়, জীবনচেতনা ও শুভবোধ গল্পকে সময়ের ভাষ্য করে তোলে। গত শতকের আটের দশকের শেষের দিকে আমরা পেয়েছি জয়া মিত্রকে। কারাগার জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ বয়ান ‘হন্যমান’ (১৯৮৯) লিখে তিনি সাড়া জাগিয়েছিলেন। জরাসন্ধ কারাগার জীবনের অভিজ্ঞতাকে জানান দিয়েছেন আন্তরিক গদ্যে, ও হৃদয়ানুভূতি মিশ্রণে। কিন্তু গত শতকের সাতের দশকের নকশাল বিপ্লবীদের কারাগারে অত্যাচারী জীবনের অভিজ্ঞতা যে বয়ানে, সাহসের সঙ্গে এবং নিপুণভাবে জয়া মিত্র, মীনাক্ষী সেন বর্ণনা দিয়েছেন তা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের তথ্যপূর্ণ দলিল। ‘হন্যমান’ গ্রন্থ ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হয়। সে বছরই অনুবাদের জন্য পেয়েছেন ‘সাহিত্য অকাদেমি অনুবাদ’ পুরস্কার। সাহিত্যের একাধিক শাখায় বিচরণের পাশাপাশি তিনি পরিবেশ আন্দোলনকারী, ভাবুক ও চিন্তক। ‘ভূমোধ্যসাগার’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে পরিবেশচেতনার বার্তা জাগিয়ে রেখেছেন। ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’র নিবেদন, ‘গল্পসমগ্র’র নিবেদন অংশে জয়া মিত্র নিজের গল্পবীক্ষণের কবজকুণ্ডলের মূর্তিমালা জানান দিয়েছেন। যা তাঁর গল্পবলয়ের দিগ্‌দর্শন।

‘কালপরশুর ধারাবাহিক’ (১৯৮৬) গল্প হয়ে ওঠে একটা দীর্ঘ সময় চেতনার একক। এক নারীর আত্মস্বর ও স্বাধীন সত্তার তুমুল আলোড়ন। ব্যক্তিগত পরিসরের মধ্যেও দেশকাল-সময়-সমাজের সত্যকে প্রবেশ করিয়ে ঘর-বাইরের দ্বন্দ্বে তা কীভাবে ব্যক্তির স্বাধীনসত্তাকে জানান দেয় তার নিজস্ব ছক গল্পের তীব্রতাকে বৃদ্ধি করেছে। শ্রীনন্দার সাংসারিক দায়িত্ব, পীড়ন থেকে স্বাধীনতার সত্য উন্মোচন, স্মৃতিবিজড়িত ময়াময় বাস্তবতার পুনর্পাঠ, সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ, রেলযাত্রায় নবীন প্রজন্মের নচিকেতার জীবনসত্য এবং তরুণ প্রজন্মকে নতুন সত্যে উত্তরণের মধ্য দিয়ে সময়ের ছলাকালাকে সামনে রেখে শুভবোধের যে জীবনছক এঁকে যান তার নান্দনিক ভাষ্য বড় মায়াময়। জঘন্য বাস্তবের মধ্যেও শ্বেতপদ্ম ফোটে, ব্যক্তি মানুষের কাজ সেই পদ্মকে বিকশিত সত্য-সৌন্দর্য আলোয় পৌঁছে দেওয়া। ব্যক্তিই পারে সমাজ মুক্তির জয়গান গাইতে। হ্যাঁ আমাদের সমাজে নঞর্থক, প্রবঞ্চক, মিথ্যুক, প্রতারক আছে। তেমনি আছে সত্য সুন্দরের পূজারী। ব্যক্তির কাজ তরুণকে শুভবোধ, কল্যাণচেতনায় ভাসিয়ে দেওয়া। যে বোধ পৃথিবীকে সুস্থ বসবাসের উপযোগী করে তুলবে। লেখিকা সেই শুভচেতনার আলো জ্বেলে দিতে চেয়েছেন।

সীতার অগ্নিপরীক্ষা আজও হয়, দ্রৌপদীদের ইজ্জতের পরীক্ষা আজও দিতে হয়। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল সমাজের কাছে পরাজিত হতে হয়। সমাজ প্রগতির অংশ হয়েও, শিক্ষাদীক্ষা, চিন্তাচেতনায় প্রবল অগ্রসর হয়েও কখনো সমাজের জটিল বিন্যাসের কাছে পরাজিত হতে হয়। আমাদের তৃতীয় বিশ্বে আজও মুক্ত সমাজ, মুক্ত সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। সম্পর্কের মূলে আজও আছে স্বার্থের পরম্পরা। ব্যক্তির অন্তর্বলয়ের সত্য কতরকম হতে পারে, পারিবারিক বিন্যাসের জটিলতা কত প্রখর হতে পারে, সেখানে একটি নারীকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কীভাবে বলিপ্রদত্ত হতে হয় সেই নারী স্বাধীনতাহীন সমাজের প্রতি সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ করেছেন ‘দ্রৌপদী’ (১৯৮৭) গল্পে। সম্পর্কের সত্য, পারিবারিক দায়িত্ববোধ, জীবনের চাওয়া-পাওয়া, স্নেহ-প্রেম-কর্তব্য নিয়ে এ গল্প জটিল জীবনের ভাষ্য রচনা করে। পিতা মারা যাবার পর পরিবারের দায়িত্ব হাতে তুলে নেয় জামাইবাবু রবিদা। শালীদের বড় করা, শিক্ষা, দায়িত্ব, স্নেহ সমস্তই একজন দাদার মতো সামলে এসেছেন। ইতিমধ্যেই জামাইবাবুর স্ত্রী মারা যান দুটি কন্যা সন্তানকে রেখে। স্বাভাবিকভাবে কিছুদিন চললেও পরে অস্থিরতা দেখা যায়। জামাইবাবুর আবার বিবাহ দিলে কোন পরিচয়ে তারা এই বাড়িতে থাকবেন সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বা আদৌও থাকার পরিবেশ থাকবে কি না। সবদিক থেকে বিচার করে মাতা ঝুমলাকেই বলেন রবিদাকে বিবাহ করতে। ঝুমলা আকাশ থেকে পরে। সত্যিই তো অসম্ভব। মানবিক সম্পর্কগুলো কি এভাবেই ভেঙে যাবে? আবার বিবাহ ছাড়া অন্য মেয়েকে বিবাহ করলে জীবনের জটিল জালে রবিদার কন্যাদের নিয়ে মাসি-দিদার সঙ্গে সম্পর্কেও ভেঙে যাবে। সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। রবিদা প্রথমে অস্থির হলেও পরে এই সিদ্ধান্তকেই সঠিক বলে মনে করেন। পারিবারিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক বিন্যাস ঠিক রাখতে গিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঝুমলাকে মত দিতে হচ্ছে। আজকের উত্তর আধুনিক সময়ে নারীকে যন্ত্রণার চোরাবালিতে ডুবতে হচ্ছে জটিল জালে। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, সংগঠিত সম্পর্কের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দিলে পূর্বের জামাই-শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কের পরিণতি কেমন হত তা ভাবার অবকাশ শাশুড়ি পায়নি। ভীতু বাঙালি নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে কন্যাকেই তুলে দিচ্ছেন জামাইয়ের হাতে। আর তা করছেন মা। শুধু পুরুষ নারীর ক্ষতি করে না পদে পদে মহিলারাও যে ক্ষতি করে লেখিকা তে স্পষ্ট করেন। আবার মাতার সামনে এই সত্য ছাড়া জীবনের সহজ কোনো সত্য ধরা নেই। জীবন এমনই জটিল, জীবনের বক্র চাহনি এমনই প্রখর, সেই জটিল জীবনের ভাষ্যকার জয়া মিত্র।

প্রান্তিক নারীর প্রতিবাদ বর্ষিত হয়েছে ‘অন্ধকারের উৎস থেকে’ (১৯৮৮) গল্পে। প্রান্ত জীবনের সামাজিক বাস্তবতা, নারীকে কোনোরকমে বিবাহ দেবার মানসিকতার বিরুদ্ধে সরাসরি খড়গহস্ত হয়েছে শান্তবালা কুইলা। আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতা অর্ধশতকের আগের সময়ে বুঝেছিল নারীর মুক্তির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। শান্তবালাও শিক্ষাহীনতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে স্বামীকে খুন করেছে। শান্তবালারও বিবাহ হয়েছিল কম বয়সে, পারিবারিক লাঞ্ছনা, নিপীড়ন সহ্য করে সংসারের হাল ধরে রেখেছে। কিন্তু স্বামী হরিধন কুইলা কন্যাকে এগারো বছর বয়সেই বিবাহের তোড়জোড় করলে দিশাহীন শান্ত পুরুষতন্ত্রের রন্ধ্রে আঘাত আনে। শুধু আঘাত নয় থানায় গিয়ে সে অপরাধ স্বীকার করেছে। খুনের জন্য শান্তকে কিছুটা দোষ দেওয়া গেলেও কিন্তু সে মহৎ হয়ে ওঠে অপরাধ স্বীকার করে সাজাপ্রাপ্তির কথায়—“তুই রেতেতেই মোর ঘরে এলিনি কেন? দুজনে মিলে ওটাকে মাটি চাপা দিয়ে দিতুম। শান্ত ধীরভাবে মাথা নেড়েছিল না গো, তাই হয়? ভগবানের জীব একটা মানুষকে মারলে পাপ তো হয়ই। তার সাজা পেতে হবে নে?” (অন্ধকারের উৎস থেকে, গল্প সমগ্র, জয়া মিত্র, পুনশ্চ, কলকাতা-১০, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০১৮, পৃ. ৭৪) এই স্বীকারোক্তিই তাকে মহান করে তুলেছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ভিত্তিহীন সংস্কার ও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে বোবাযুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু জেল বরণ করে নিতে হয়েছে। আইন তার নিজের ভাষায় বিচার করে। অপরাধীর মনস্তত্ত্ব বিচারের রীতিকৌশল আমাদের আইনব্যবস্থায় নেই। চারুচন্দ্র চক্রবর্তী এজন্যই আইন সংস্কারের কথা ভেবেছিলেন। হ্যাঁ শান্তবালারাই আলোর উৎস, তারাই নির্মিত পথের ধ্রুবতারা।

ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা জয়া মিত্র সাহিত্যভুবনে নানা বীক্ষণে প্রয়োগ করেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মিশে গেছে সময়ের দলিলে এবং সমষ্টির প্রতিস্পর্ধী চেতনায়—“এ-বই আমার একার রচনা নয় বলেই মনে করি। যা আছে আমি শুধু তাই দেখাতে চেয়েছি, যদি এইসব, আরও অনেক সাথীরা এগিয়ে আসেন আর বইটির শেষ অধ্যায় সকলে মিলে রচনা করা যায়!” (ভূমিকা, হন্যমান, দে’জ পাবলিশিং, সপ্তম সংস্করণ, জুন ২০১৬) নকশাল জীবনের অভিজ্ঞতা, জেল বরণ, জেলে অত্যাচার নিয়ে লিখেছেন আত্মজীবনী ‘হন্যমান’ গ্রন্থ। গত শতকের সাতের দশকে সমাজ মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে জমিদার-মহাজনদের ক্ষমতার সৌধ ভেঙে দেবার শপথ নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন। কেউ কেউ চিরদিনের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। পরিবার জীবনের কমিউনিস্ট চেতনা, পিতা-মাতার কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে যোগ বাল্যকাল থেকেই মনের মধ্যে বিপ্লবী চেতনার জন্ম দিয়েছিল। সমাজ মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছেড়ে পুলিশের জালে আক্রন্ত হয়ে রাষ্ট্রের পৈশাচিক চরিত্র দেখে বিস্মিত হয়েছেন। রাষ্ট্রের সেই নারকীয় বীভৎসলীলার চিত্র আছে ‘স্বজন বিজন’ (১৯৮৭) গল্পে। আত্মজৈবনিক উপদানকে তিনি ক্ষমতার বলিপ্রদত্ত নিপীড়নের বয়ানে ভাসিয়ে দিয়েছেন। নকশাল যুবতী ধরা পড়েছে চপলার ঘর থেকে। কে এই সংবাদ দিল? এই বস্তিতে পুলিশের গুপ্তচর কে? নেই কোনো তথ্য। পুলিশের নিপীড়নের মধ্য দিয়ে লেখিকা পৌঁছে গেছেন ব্যক্তিজীবনের নিজস্ব ভাষ্যে। যে পরিবার সমাজ মুক্তির বাসনা নিয়ে পথে নেমেছে, মিছিল করেছে, আন্দোলন করেছে সেই পিতামাতা নিজের সন্তানকে সুরক্ষার কথা ভাবেনি। হঠকারী সিদ্ধান্ত ও অতিবিপ্লবী মানসিকতায় মাতা প্রথম সন্তানসম্ভব অবস্থাতেও মিছিলে গেছে। ফলস্বরূপ বিকলঙ্গ শিশুর জন্ম হয়েছে। অতিবিপ্লবী মানসিকতা কখন কোথায় ভেসে যায় কেউ জানে না—

“কিন্তু জন্মানোর আগে থেকেই যে নিজের লোকেদের অবিচারের শিকার হয়েছে? যারা পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত মানুষকে ভালোবাসার কথা বলে তারা নিজেদের স্ত্রীকে, বাচ্চাকে, কমরেডদের বাচ্চাকে ভালোবাসার তাদের যত্ন নেবার কথা চিন্তা করেনি। আর এই ঘটনাটাকে, অন্যায়কে, একজন পার্টি সদস্যের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে দেখায়।” (স্বজন বিজন, তদেব, পৃ. ৪৬)

জন্ম নেওয়া বিকলঙ্গ শিশুর প্রতি পিতামাতা মাঝেসাঝে অসিষ্ণুতা প্রকাশ করেছে। অতিবিপ্লবী মানসিকতা অনেক সময় দূরদর্শী চিন্তার জন্ম দিতে অক্ষম হয়। যা ব্যক্তিগত জীবনে দংশনক্ষত বাস্তবতার জন্ম দেয়। বিপ্লবী জীবনের এই দ্বন্দ্বকে লেখিকা ব্যক্ত করেছেন। প্রতিটি বিপ্লবের মধ্যেই কিছু ভুল সিদ্ধান্ত থেকে যায়। যা পরে মানুষকে ভুক্তভোগী করে। কখনো বিপ্লবের আশু উদ্দেশ্য সম্পর্কে নঞর্থক ধারণার জন্ম দেয়। তবে সমস্ত বিপ্লবেরই মহৎ উদ্দেশ্য থাকে। নকশাল আন্দোলনে জমিদার-মহাজনদের গুপ্তচর ও রাষ্ট্র নকশাল হত্যায় অগ্রসর হলেও শ্রেণিশত্রুর ভিত সেদিন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। আর তা সম্ভব হয়েছিল সত্তরের প্রতিস্পর্ধী কিছু যুবক-যুবতীর প্রগতিশীল মানসিকতায়। স্বপ্না দেব ‘খবর খোঁড়ার দিনলিপি’ গ্রন্থে স্মৃতি রোমন্থনে নাতিকে সময় সত্যের রহস্য জানান দিতে লিখেছেন—“বেড়ে ওঠার সময় থেকে সে দেখেছে, তার ঠাকুমা গৃহ-স্থ। আমিও যে কখনো বিশ্ব-বিজয়ের আকাঙ্ক্ষায় ডানা মেলে উড়াল দিতে চেয়েছিলাম, এইটুকু তাকে জানাতে চাই।” (খবর খোঁড়ার দিনলিপি, আমার কথা, প্রতিক্ষণ)। সেই অসম সাহসী মহিয়াসীর উত্তরাধিকারী কোথায়? জয়া মিত্রদের সেই স্বপ্নচেতনা, প্রতিবাদী মানসিকতা, সমাজ প্রগতির অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সাহসের উত্তরাধিকারী কোথায়? নাকি আজ রাষ্ট্র শুদ্ধ; প্রলেতারিয়েতদের মুক্তি ঘটে গেছে? নেই কোনো উত্তর। সেদিনের আত্মজৈবনিক উপাদান ও প্রত্যক্ষ সংগ্রামী জীবনের অভিজ্ঞতাকে তাই সাহিত্যের বাস্তবতায় রূপান্তরিত করতে হয়, যা আবহমানকালের মানুষকে প্রেরণা জোগাবে। হ্যাঁ বাস্তব জীবনের ক্ষতই লেখিকাকে দিয়ে এইসব আখ্যান লিখিয়ে নিয়েছে। সেদিনের বিপ্লবী জীবন, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ, সমাজ বদলের চিন্তা বহু পরে এসেও স্তিমিত হয়ে আছে। সমাজ বদল হয়নি বরং সমাজ আরো পিছিয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদের চক্রান্তে সমস্ত তছনছ হয়ে যাচ্ছে। সেই বাস্তবতার প্রতিবেদন ও দার্শনিক মননলব্ধ অভিজ্ঞান জন্ম দিচ্ছে একের পর এক আখ্যানের—

“এক পুবালি বাতাসের জোয়ারে ভেসে যাত্রা শুরু করেছিলাম। কত নদীর পাশ দিয়ে, কত উচ্ছেদ হওয়া গ্রামের ধার দিয়ে, নিজেদের নতুন করে খুঁজে পাওয়া কত মানুষের অঙ্গন হয়ে সে রাস্তা চলে যাচ্ছে। আরও কোথায় যাবে, ম্যাজিকলণ্ঠনে চোখ রেখে আরও কী দেখাবে, সেই টানে তার সঙ্গে চলা। আর কী যে মায়া সেই মাটির, সেইসকল মানুষের জীবনযাপনের যাকে আমার নিজের ভাষায় বলে জীবনযাত্রা। সেই মানবধারা কোন করুণায় আগ্রহীজনকে দেখতে শেখাল তার পটভূমির স্থান কাল।” (গল্পসমগ্র, নিবেদন, তদেব)

জয়া মিত্র সমাজ প্রগতির ভাষ্য নানামাত্রায় বুনন করতে চেয়েছেন গল্পে। পরিবেশ, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, শোষণ, পিতৃতান্ত্রিক প্রতাপ, পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য, নারী ধর্ষণ, শিশু বিক্রি, অর্থ-শিক্ষাহীনতা, জল সংকট, ভালোবাসার বিষাক্ত নিশ্বাস থেকে সমাজ-সময়ের মানুষকে কীভাবে সুস্থ আশ্রয় দেওয়া যায় তার গূঢ়ার্থ ভাষ্য নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন। ‘হেনরি মুর ও তার শিশু’ (১৯৮৮) গল্পে শিল্পীর অবয়বের সত্যের সঙ্গে বাস্তবের সংঘাত দেখিয়ে সমাজ প্রগতির বয়ান গড়ে তুলতে চান। কিন্তু সেই বয়ান বারবার ধাক্কা খায় বাস্তবের জীর্ণতায়। আমাদের সমাজ শিশুকে, নারীকে কতটা বসবাসযোগ্য স্থান দিতে পেরেছে? আজকের নারী কি সম্পূর্ণভাবে পুরুষের উপর বিশ্বাস করতে পারে? চারিদিকে প্রতারণার ফাঁদ পাতা। আবার এই অন্ধকার থেকেই তো প্রশ্নমালার জন্ম হয়। যে প্রশ্ন নারীকে প্রতিবাদী ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। মানুষ যেহেতু ভালোবাসার দাস, নারী চায় আশ্রয়, আর পুরুষ আশ্রিত হতে চায় তাই নারী-পুরুষ আবার স্বপ্ন দেখে, আশা ভরসার জাল বোনে। সেখানেও থাকে প্রতারণার ফাঁদ। তবুও তো বাঁচতে হবে। বাঁচার একঘায়েমি থেকে বাঁচতে স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্নের চোরাবালি নিয়ে আবার অস্তিত্বের অভিজ্ঞানে ভেসে যেতে হবে। বাস্তবই যেন এক পথ। যে পথ মানুষকে অভিজ্ঞ করে। যে পথের রক্তিম আর্তনাদ মানুষকে ভীত করে। তবুও চলতে হয়। প্রমা-সুপর্ণ নামক নারী-পুরুষের সম্পর্ক, মনস্তত্ত্ব, একাকিত্ব, ভালোবাসা, ভয়-সন্দেহ-আশ্রয়-অস্তিত্ব নিয়ে লেখিকা জীবনের কাব্য রচনা করেছেন। আর তা ভেসে গেছে গদ্যের অনবদ্য মাধুর্যে—

“লোকে বলে অবশ্য যে ভালোবাসার কোনো নির্দিষ্ট ছক নেই কিন্তু আসলে মোটামুটি একটা ছক, সম্ভাব্যতার একটা সময়, ধরন মনে মনে ধরাই থাকে। সময় বা আয়ুষ্কাল হয়তো সত্যি তত বড়ো কথা নয়, আসলে এলোমেলো দিনকাল বাঁচতে বাঁচতে বাস করতে করতে, মন কেমন স্পর্শবোধহীন হয়ে ওঠে। কোনো আবেগ স্বতোৎসারিত হয় না। কোনো উচ্ছ্বাস প্লাবিত করে না আর। বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকা। বহমান মানুষজনের ভিড়ের মধ্যে, সামাজিকতার আপাতছকের মধ্যে থেকেও একা একা।” (‘হেনরি মুও ও তার শিশু’, তদেব, পৃ. ৭৬)

জননীর কোলে শিশু আশ্রয় চায়। জননীও পুরুষের কাছে আশ্রয় চায়। আবার পুরুষও নারী ছাড়া আশ্রয়হীন। আসলে আমরা প্রত্যেকে একা। সঠিকভাবে বাঁচতে অপরের আশ্রয় চাইছি। সেই জীবনসত্য লেখিকা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বড় নান্দনিকভাবে ব্যক্ত করেছেন। আবার সেই জননীই ‘লোকশিক্ষা’ (১৯৯৭) গল্পে হেরে যায় পুরুষতান্ত্রিক প্রতাপ, ক্ষমতাবান মাফিয়াদের কাছে। দুর্গা ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতা, সমস্ত ছিনিয়ে নেওয়া মাফিয়াদের বিরুদ্ধে নিজের স্বাভাবিক অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল। সামান্য মহিলার প্রতিবাদ মেনে নেয়নি দলীয় রাজনীতির ক্ষমতাপ্রাপ্ত ভেকধারী পার্টিকর্মীরা। সকলের সামনে দুর্গাকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। ব্যক্তির একক প্রতিবাদ যে বুর্জোয়া শক্তি, পার্টির বলশালী নেতাদের কাছে ঠুনকো তা ব্যক্ত হয়ে চলে। পার্টি, মাফিয়া, ঠিকাদার, বিত্তশালীদের কাজ মানুষের মধ্যে ভয়ের বীজ বুনে দেওয়া। ব্যক্তি স্বাধীন অস্তিত্বকে নাশ করে দেওয়া। সেই পথেই সমস্ত ছিনিয়ে নেওয়া যায়। দুর্গাদের একক প্রতিবাদ সমষ্টির চেতনাহীনতায় ভেসে যায়।

জয়া মিত্র সময়ের বড় সত্যকে ধরতে চেয়েছেন। প্রবাহমান সত্যের আড়াল দিয়ে, ফেলে আসা জীবনের স্বরকে স্পর্শ করে তিনি বাস্তবকে নির্মাণ করেছেন। সেখানে নারীর ভাঙন, আত্মচেতনা, যন্ত্রণা, নিপীড়ন সমস্ত মিলিয়ে আখ্যানকে জীবনসমুদ্রের উপকণ্ঠে নিয়ে এসেছেন। বৃহত্তর সময়কে ধরে সময়ের বহুবিধ মাত্রকে স্পর্শ করে, মহাকালের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একককে টেনে এনে বর্তমান ও অতীতের তুলনামূলক আলোচনা করে বর্তমানের ক্ষত-অন্ধকার কত প্রবল তা নির্মাণ করেন। তবে আশা, আলোর পথও থাকে। সেই অন্ধকারের তিমির থেকে তাঁর চরিত্ররা জীবনবীক্ষণে নিজেই বাঁচার পথ করে নেয়। সমাজ-সভ্যতার বুকে আশার আলো জ্বালিয়ে যায়। ‘স্বাধীনতার যমজ’ (১৯৯০) গল্প এক শিখ নারীর জীবনযন্ত্রণা থেকে উত্তরণের পথ পরিক্রমা। ১৯৪৭ সালের পনেরোই আগস্ট জন্ম হয়েছিল বলে তার নাম পিতা রাখতে চেয়েছিল আজাদ কাউর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠাকুমা নাম রেখেছে সুখবিন্দার। অত্যন্ত মেধাবী, প্রতিবাদী, প্রগতিশীল নারী। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতাপ, আধিপত্যের কাছে পরাজিত হল। আবার পরাজয়ের মুখে ছাই দিয়ে নতুন করে বাঁচার সত্যে ভেসে গেছে। দেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের দিন জন্ম নেওয়া নারীও জীবনে স্বাধীনতা পায়নি। আবার যাঁর নাম সুখবিন্দার সে জীবনে সুখের মুখই দেখল না। লেখিকা তীব্র শ্লেষে সময়-সমাজ-আধিপত্যের সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করেছেন। যে মেয়ে প্রবল প্রতিবাদী, প্রগতিশীল সেই বিবাহের সময় পরিবারের কথা মেনে নিল। দ্বন্দ্বটা কোথায়? ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা, সম্ভ্রম, পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা ও নিজস্ব স্বাধীনতাকে বলি দেওয়া। বয়ানে ভেসে আসে—“পরিবারের বড়োদের অবাধ্য হওয়া নাকি একেবারে অসম্ভব ওদের মধ্যে। ওদের সমাজে কিছু নির্দিষ্ট রীতিনীতি আছে, সেগুলো না মানলে সমাজের মধ্যে থাকা যায় না, আর একজন শিখের কাছে তার সমাজ আর তার পরিবার সমার্থক।” (স্বাধীনতার যমজ, তদেব, পৃ. ১১২) এই সামাজিক সত্য, সামাজিক রীতি ডুবিয়ে দিল প্রগতিশীল সুখবিন্দাকে। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া, চিরদিনের জন্য সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হওয়া, স্বামীর ডিভোর্স চাওয়া, শাশুড়ি কর্তৃক আত্মহত্যা করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে এক নারীর ক্ষতবিক্ষত জীবনচিত্রের আড়াল দিয়ে সমাজ-সভ্যতার অন্ধকার দিক উদ্‌ঘাটিত হয়ে চলে। তবে সুখবিন্দার পরাজিত হয়নি। জীবনে বেঁচেছে, ছোটবউদির কন্যাকে নিজের মতো করে মানুষ করে তার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে চেয়েছে। জয়া মিত্র বড় পরিসরে সময়-সমাজের নথিনামা, চিরকালের সংস্কার, আধিপত্যকে ব্যক্ত করে দেখান একজন নারী আজও কতটা বঞ্চিত। অথচ নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য তারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক প্রতাপ, কখনো মেয়েরাই তাদের বড় শত্রু হয়ে উঠছে। মেয়েরা নারী থেকে মা, শাশুড়ি হয়ে গেলে কখন যেন পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের দোসর হয়ে যায়। সেই সত্য বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন রকমভাবে স্পষ্ট হয়ে চলে। আবার ‘চক্রবৎ’ (১৯৯৩) গল্পে তিন প্রজন্মের নারী জীবনের ভাষ্যের মধ্য দিয়ে দেখান একইভাবে সংসারের চাকা ঘুরছে। নারী কর্তৃক নারীকে শোষণের জাঁতাকাল সেই চলমান গতিতেই অব্যাহত রয়েছে। বিরাট পরিসরে নারীর আর্তনাদ, শোষণ, আধিপত্য সব মিলিয়ে জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা ক্ষত থেকে রক্ত ঝরান। মধ্যবিত্ত জীবনের গ্লানি, সংস্কার, সংসার সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণা, বধূকে ক্রমেই শাশুড়ির নাগালে রাখার কায়দা, প্রয়োজন বক্র মন্তব্য—সমস্ত মিলিয়ে বিংশ শতকের শেষ দশকেও সমাজের ভিতরের অন্তর্বাস্তবের যে আমূল পরিবর্তন ঘটেনি তা লেখিকা নির্মাণ করে চলেন। আবার ‘খেয়া’ (১৯৯৪) গল্পের নারীজীবনের ভাষ্য অনেকটাই পুরাতন সমাজ। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে লিখিত গল্পে শাশুড়ি ও পুত্রবধূ একসঙ্গে সন্তান জন্ম দিচ্ছে, সমাজের অগ্রগতি কি কিছুই হয়নি? সেই সত্যকে সামনে রেখেও তিনি একটা বহমান জীবনছাঁচ গড়ে তুলেছেন। আন্তরিক গদ্যে নারী জীবনের হৃদয়স্পর্শী বয়ান নির্মাণ করেছেন। ভালোবাসা, সংসার সাজানো, সন্তান মানুষ, রান্নাবান্না ও স্নেহ-প্রীতির মধ্য দিয়ে পারিবারিক জীবনচেতনার সুগভীর সত্য গল্পকে স্বাদুময় করে তুলেছে। কন্যা থেকে বধূ, শাশুড়ি ও বৃদ্ধা হয়ে সাগরময়ী আজও সংসারকে নন্দনকানন বানানোর ভাবনায় মশগুল, সন্তান-নাতিনাতনিদের মঙ্গলকামনা ও দায়িত্ব পালনে ক্রিয়াশীল। একজন নারী কীভাবে তিলতিল করে আত্মদংশনে, নিজেকে বিসর্জন দিয়ে সংসার সাজিয়ে তোলে সেই ভুবন লেখিকা হৃদয়স্পর্শী ভাষায় গড়ে তোলেন। মান-অভিমান, যন্ত্রণা নয় সংসারকে সাজিয়ে তোলাই নারীর আকাঙ্ক্ষা। পুরষতান্ত্রিক আধিপত্য, ক্ষমতা প্রয়োগের বাইরেও আরেক জীবন আছে। যে জীবনের জন্য পৃথিবী সুন্দর, মানুষ আজও পরিবারনীতিতে বিশ্বাসী। সেই জীবনচেতনার কারিগর সাগরময়ীরা।

‘চক্রবৎ’ ‘খেয়া’ গল্পের গৃহস্থ, সংসারী নারীর কল্যাণময়ী মূর্তি বদলে যাবে ‘শেলটার’ (১৯৯৫) গল্পে। এখানে নারীর গৃহিণী ও বিপ্লবী সত্তা দুইই আছে। দুই নারীকে (সরস্বতী, নন্দিনী) সঙ্গী করে জীবনের বহুমুখী বয়ান স্পষ্ট করেছেন। নারীর মধ্যে যেমন বিবিধ প্রবৃত্তি আছে তেমনি আছে পুরুষের মধ্যেও। একেক জন এক রকম করে জীবনকে দেখতে চেয়েছে। জীবনের সৌন্দর্য, উদ্দেশ্য একরকমভাবে ভেবেছে। সরস্বতীর গৃহিণীসত্তা, নন্দিনীর বিপ্লবীসত্তার মধ্যবিন্দুতে দুই স্বামী দুইরকম ভূমিকা পালন করেছে। ঘরের নারী কখন বাইরে এসে উত্তাল করে দিল, গৃহিণী সচিব রান্নাবান্নার নারী কখন বিপ্লবের মুখ্য মুখ হয়ে উঠল কেউ জানে না। কোনো শাশুড়ি যেমন পুরুষতন্ত্রের দোসর হয়ে পুত্রবধূকে নির্যাতন করেছে তেমনি কোনো শাশুড়ি নববধূকে এগিয়ে দিয়েছে, কোনো নারী চেয়েছে জীবনের মুক্তি ঘটুক বিপ্লবের পথে। সমাজ বদলের আকাঙ্ক্ষায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী নন্দিনীর উদ্দেশে সরস্বতীর বয়ানে ভেসে আসে নারীর স্বাধীন সত্তার কথা—“আমার বড্ডো ভালো লাগবে যে আমি যেমন হতে পারিনি একজন তেমনটি হয়েছে। এই শাড়িটা তোমার কাছে থাকলে মনে হবে আমিও একটু একটু তোমার কাছে আছি।” (শেলটার, তদেব, পৃ. ২৩১) । নকশাল হয়ে যাওয়া নন্দিনীদের উদ্দেশ্য সফল হোক তা চেয়েছে সরস্বতী। অথচ সে নিজে গৃহে পুরুষতন্ত্রের বক্র চাহনির স্বীকার। তা অস্বীকার করে গৃহকে সুন্দর করে তুলেছে সরস্বতী, নন্দিনী চেয়েছে রাষ্ট্রের শুদ্ধিকরণ। ঘরে-বাইরে নারীর চক্রবৎ আলোড়ন কীভাবে সমাজকে এগিয়ে দিতে সক্ষম তার নিপুণ বয়ান গল্পগুলিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।

‘দেশভ্রমণ’ (২০০৪) গল্প যেন বৃত্ত ভাঙার গল্প। বড় বৃত্ত থেকে ছোট বৃত্তে, আবার ছোট বৃত্ত থেকে বড় বৃত্তে পরিক্রমার মধ্য দিয়ে নারীর জীবনযন্ত্রণার ভাষ্য গড়ে উঠেছে। বালিকা মেয়েটির কাছে দেশভ্রমণ মানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করা। একবার সে দিল্লিতেও গিয়েছিল কাজ করতে, ফিরে এসে জন্ডিস রোগ বাঁধিয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে কত লোক, কত অভিজ্ঞতা, কত চালচিত্র। নিম্নবিত্ত পরিবারের গৃহে ভাতের জন্য জীবনযুদ্ধ, বাইরে কাজ করতে গিয়ে লাঞ্ছনা, নিপীড়ন সহ্য করা। দেশের চালচিত্র মানুষের কাছে কতভাবে ধরা দেয় তার এক দৃষ্টান্ত এই গল্প। রাষ্ট্রীয় বৃত্তান্ত, পুঁজিবাদ, উন্নয়ন, কর্পোরেটরাজ, ক্ষমতাতন্ত্র, অর্থনীতির বৈষম্য যারা কিছুই বোঝে না তারাও বেঁচেবর্তে থাকার স্বপ্নে মশগুল থাকে। তাদের স্বপ্ন কেবল ভাতের স্বপ্ন। সঠিক মাত্রায় জীবন অতিক্রমের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন প্রায়সই ভেঙে যায়। নতুন লড়াইয়ে নামতে হয়। মেয়েটি বাড়ি বাড়ি কাজের বদলে পিতার ব্যান্ডপার্টিতে বাঁশি বাজানোর কাজ করতে চেয়েছে। শুধু শ্রমের রূপান্তর নয় স্বপ্নেরও রূপান্তর। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের জন্য মানুষকে যে কত রূপান্তরে যেতে হয় তার সত্য ব্যক্তি মানুষ নিজেও জানে না। সেই অজানা কাহিনি জয়া মিত্র আমাদের শুনিয়েছেন সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

জয়া মিত্র নারীজীবনের বিচিত্র অবস্থা, বহুবিধ সমস্যা নিয়ে আখ্যানে বিচরণ করেছেন। প্রান্তিক নারীর জীবনযুদ্ধ থেকে কর্পোরেট নারীর খতিয়ান, মধ্যবিত্ত নারীর প্রেম-সেক্স-রোমান্স-বিদ্রোহ নিয়ে অর্ধেক আকাশের সম্পূর্ণ চালচিত্র নির্মাণ করেছেন। শ্রমিক নারী, গৃহিণী নারী, বিপ্লবী নারী, কর্পোরেট নারী, মধ্যবিত্ত নারীর বিবিধ ছলাকলা, পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন, স্বাধীনতাহীনতা, দোলাচলতা নিয়ে নারী মননের অন্তর্বাস্তব ও বহির্বাস্তবের নথিনামা যে বয়ানে নির্মাণ করেছেন তা সময়ের আনুষঙ্গিক পাঠ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ‘নিয়ন্ত্রণের অধিকার’ (১৯৯৭) গল্পে প্রেম-সেক্স-মিলন-স্বাধীনতা নিয়ে নারীর স্বাধীন জীবনের যে ভাষ্য গড়ে তোলেন তা উত্তর আধুনিক সময়ের চাবিকাঠি হয়ে ওঠে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আজকের নারী স্বাধীন সত্তায় ভেসে গেছে, তবে জীবনের নিয়ন্ত্রণ জানে শৈলজারা। জীবনের দুই পিঠে নারীকে আজ বিভিন্ন পরিসরে বিভিন্নভাবে দৈহিক নির্যাতিত হতে হচ্ছে। কেউ স্বাধীন, লিবারাল সোসাইটির অঙ্গ হিসেবে, যৌনতার স্বাধীন সত্তা হিসেবে মেনে নিয়েছে। আবার কেউ সেই নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ নিজের হাতে রেখেছে। কাকে ভালোবাসবে, কাকে দেহ দান করবে এবং কতটুকু ঘনিষ্ঠ হবে সব নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে। নারীর প্রগতিশীল ভাষ্য হিসেবে, সমাজ অগ্রগতির বয়ান হিসেবে গল্পটি গুরুত্বপূর্ণ।

(২)

জয়া মিত্র‘ঘৃণার সমস্যা’ (১৯৮৯) গল্প যেন মহাকালের ধারাপাত হয়ে উঠেছে। সময়ের প্রবাহিত বড় সত্যকে ধরে তিনি অন্তর্মননের গোপন দরজা উদ্‌ঘাটন করেছেন। কালিক সত্যকে ধরে, সময়ের উপর দিয়ে ঘটে যাওয়া হিংসার সত্যকে কেন্দ্র করে প্রবৃত্তিসর্বস্ব মানুষের কুচেতনার সিংহদ্বারে গিয়ে দেখান সমস্যা কোথায়? পরাধীন দেশ থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী দাঙ্গা, সন্ত্রাস, উচ্ছেদসহ সমস্ত সমস্যার মূলে আছে ঘৃণার সত্য। একদল অন্যদলকে ঘৃণা করেছে, একদল অন্যদলের ভিত্তিহীন প্রথা, মানা-না মানার সত্যকে বক্র চোখে দেখেছে। একদিকে আধুনিকতা আছে, প্রগতিশীল ভাবনা আছে কিন্তু সেই ভাবনাও ভিন্ন মানুষকে দেখেছে ক্ষোভের দৃষ্টিতে। ধর্ম, লোভ, লালসা, হিংসা, ঘৃণার সত্য গোটা দেশের মানচিত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সংস্কার-প্রথা নিয়ে দ্বন্দ্ব, অফিসে জাতি বিদ্বেষ, জাতি বিদ্বেষ থেকে দেশভাগ, রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থসিদ্ধি, লাভের অঙ্ক থেকে মানচিত্র ভাগ, দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে দেশপ্রেম-জাতি বিদ্বেষ, পণপ্রথা, সামাজিক ভিত্তিহীন সংস্কার, শিক্ষিত লোকের সেই সংস্কার মানা, যার পিছনে আছে বৃহত্তর লোভ, অন্যকে সর্বশ্রান্ত করার অভিপ্রায়, অন্য জাতিকে আক্রমণ, পরিবেশ নাশ সমস্ত মিলিয়ে সময়ের সত্যের সঙ্গে ব্যক্তির অন্তর্মননের দ্বন্দ্বময় বিন্যাসকে প্রস্ফুটিত করেছেন। পাঁচালি, ধর্মগ্রন্থে সর্বত্রই ছিল নিজের, সংসারের মঙ্গলকামনা। সেখানে অন্যকে নাশ, অন্যকে আক্রমণ, অন্য ধর্মকে ঘৃণার কোনো সত্য ছিল না। আবার কেউ কেউ নিজে সুখে থাকতে, নিজে আত্মতৃপ্তিতে থাকতে অন্যকে ঘৃণা করার ভুলভুলাইয়াতে ভেসে গেছে। কিন্তু গল্পকথক সেই ঘৃণার পাত্র না পেয়ে আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন হয়েছেন। জয়া মিত্র শুভবোধ মঙ্গলচেতনার শিল্পী। কালের ভাষ্কর্যে যতরকম ক্ষত আছে সেগুলিকে তিনি চিহ্নিত করে, ঘটনার অভ্যন্তরের সত্যকে স্পর্শ করে তিনি মানবিক সত্যের উন্মোচন ঘটিয়েছেন। যে সত্য মানুষকে মহৎ-মানবিক করে, যে সত্য মানুষকে মুক্ত করে, যে সত্য পরধর্ম-মানুষকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখতে শেখায় জয়া মিত্র সেই মানব মহামন্ত্রের দীক্ষিত শিল্পী। শুধু গল্প উপন্যাসে নয় গল্পজীবনের বীক্ষণেও সেই সত্যকে তিনি জানান দিয়ে যান—

“অসংখ্য ছোটো ছোটো টুকরোয় ভেঙে ছড়িয়ে যাওয়া মুখের মলিন কাগজের মতো কোঁচকানো ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে, উড়ে বেড়াচ্ছে প্রতিদিনের শহুরে বাতাসে। এই খণ্ড পরিচয়ের পেছনে যে বৃহত্তর সমকাল—যেখানে আজকে দেখতে পাওয়া অনেক উত্তরের শুরুর প্রশ্নমালা নিহিত, তার কথা আরও যত্ন নিয়ে খুঁজে বার করা, আর একমনে, পরম যত্নে আমার কালকে তার নিজের গল্প, আমাদের গল্প বলে যেতে থাকা—মনে হয়, এই যেন আমার কাজ। অন্ধকারের আলোর প্রদোষের গল্প বলে যাওয়া।” (গল্পসমগ্র, নিবেদন, তদেব)

মানবিক বোধ, সুস্থচেতনায় ভেসে গেছে ‘অভাগীর নিজের স্বর্গ’ (২০১২) গল্পের অভাগী। সতীনকে সে মেনে নিয়েছে। ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে অভাগীর স্বামী রসিককে ফিরিয়ে দিতে এসেছিল টুনি। অভাবের সংসারে অভাগী টুনিকেও রেখে দিয়েছে। জীবনযন্ত্রণার সংগ্রামময় চিত্র থেকে মূল্যবোধের সত্যে উত্তরণের মধ্য দিয়ে আর্দশের উচ্চ নিকেতনে পৌঁছে গেছেন লেখিকা। ভাঙন, দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য থেকেও ব্যক্তি যে মানব মহিমায় অটল থাকে তার দৃষ্টান্ত অভাগী। মৃত্যুর পর মুখে আগুন নয় যৌথ সংসারের আটপৌর আনন্দ বিতরণেই তাঁর সুখ। মানবিক বোধের জাগরণ, জীবনের জটিল যন্ত্রণাব্যাধি থেকে সহজ সত্যে উত্তরণ ও যৌথ জীবনের সংগ্রামময় ভাষ্যই যে জীবনের স্বাভাবিক বিকাশ সেই চেতনা গল্পকে উচ্চ সুরে বেঁধে দিয়েছে।

সময়ের কবজকুণ্ডল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা, জটিল সময়ের বহুমুখী বয়ান ও ঘটনার পশ্চাতে ঘটে থাকা সত্য অনুসন্ধানের প্রয়াস জয়া মিত্রের গল্পগুলিকে পৃথক মূল্য দান করেছে। একজন লেখক তো শুধু ডিটেলিং বা কাহিনি লিখবেন না তিনি সত্যদ্রষ্টা, তিনি নিয়ন্ত্রক ও কারিগর। ঘটনাকে রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া একভাবে সাজায়। যেখানে লাভ বেশি সেই কায়দায় ফেলে ধর্মের আবেগ প্রয়োগ করে, ভোটের অঙ্ক গুনে তার বিচার করে। মাঝ থেকে শোষিত হয় মানুষ। ‘আগুন লাগার আগে’ (১৯৯২) গল্পের প্রেক্ষাপট আসানসোল সন্নিহিত অঞ্চল। সময় পর্ব বাবরি মসজিদ ধ্বংসকালীন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দাঙ্গকালীন প্রেক্ষাপট। সময়কাল রামনবমী ও ইদের মাঝামাঝি। সমস্ত মানুষকে আজ বিচার করা হচ্ছে রাজনীতির রঙে। সমস্ত মানুষকে বিচার করা হচ্ছে জাতিতত্ত্ব ও ভোটের সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে। হিন্দু অঞ্চলে কর্মরত দীর্ঘদিনের দর্জি সাদিক আলি খুন হয়েছে। চারপাশ থেকে ধেয়ে আসছে ঘৃণা, অবিশ্বাস ও আক্রমণের বিষ। দাঙ্গার সত্যকে সামনে রেখে চারিদিকে ঘৃণার বিষ উগড়ে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ মাথা চাড়া দিয়েছে। সাদিক আলি নাকি শিউপূজনজীর কন্যাকে বিরক্ত করেছিল। ইহাই কি সত্য? না বানিয়ে তোলা মিথ্যা বয়ান? তবে সত্য কোনটি? কেন খুন করা হল? লেখক সত্য উন্মোচনে অগ্রসর হয়েছেন। সেই সত্য উন্মোচনে তিনি কতগুলি ডিসকোর্স গড়ে দিয়েছেন। জনপদের জীবন পাঁচালি থেকেই তা উঠে এসেছে। ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক দলের দাঙ্গা সৃষ্টিকারী মনোভাব এই বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে। সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুকে শোষণ করে। সমস্ত ক্ষেত্রেই ধর্মীয় নিষ্পেষণে রাজনৈতিক দলের ভণ্ডামিতে মানুষকে ধ্বংস করা হয়। সংখ্যালঘুও বিদ্বেষের বিষ ছড়াতে চায় কিন্তু প্রশাসন তখন সরব হয়। ক্ষমতার রাজনীতি, জাতি বিদ্বেষের কূটনীতি মানুষকে কীভাবে নিমিষেই নস্যাৎ করে দেয়, সেই প্রক্রিয়াকে ঘুলিয়ে দেবার কত বয়ান হতে পারে, পুলিশ প্রকৃত সত্যের বদলে ঘুলিয়ে দেওয়া সত্যকে কেন্দ্র করে কীভাবে অত্যাচারীকে চিহ্নিত করার বদলে সমস্ত ধামাচাপা দেয় তার তাৎপর্যপূর্ণ বীক্ষণ গল্পগুলির তাত্ত্বিকমূল্যকে প্রখর করে তুলেছে। আবার জল সংকটকে সামনে রেখে মেঘদূত কাব্যের সত্যকে কেন্দ্র করে এক নব্য মেঘদূত রচনা করেন। ‘মেঘদূত’ (২০১৩) গল্পে পুরাণের সত্যকে বিনির্মাণ করে আজকের সমস্যা প্রধান পৃথিবীর যে ভাষ্য নির্মাণ করেন তা সময়চেতনার পাঠ। জলস্তর নেমে যাচ্ছে। স্বাদু জলের অধিকাংশ ব্যয় করা হচ্ছে শিল্প, কৃষিতে। এই ধরাভূমি ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। মেঘ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রবল গ্রীষ্মে মেদিনী তপ্ত হয়ে উঠছে। সেদিনের মেঘ আর নেই। হারিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় মাঠের পর মাঠ পুড়ে যাচ্ছে। পুরাণের সত্যকে তিনি বিনির্মাণ করে আজকের সমস্যায় পৌঁছে যেতে চেয়েছেন।

স্মৃতিসরণিতে গত শতকের সাতের দশকের বিভীষিকা, আত্মমন্থনে ফেলে আসা দিনের রক্তিম আর্তনাদ, সমাজ বদলের ভাবনায় ঘর ছাড়া, হঠকারী সিদ্ধান্ত, শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আখের গুছিয়ে নেওয়া, আজকের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সন্তানদের নব্য চিন্তাস্রোতের মধ্য দিয়ে অতীতের আত্মবীক্ষণ নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘সূর্য ও সাদাপাখিটি’ (২০০৫) গল্প। এও এক নারীর সংগ্রামী জীবনের ভাষ্য। জয়া মিত্র আত্মজৈবনিক উপাদানকে নানামাত্রায়, নানা কৌণিক বিন্দু থেকে আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধরতে চেয়েছেন। কারাগার জীবনের অত্যাচার, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, বন্ধন মুক্তির অভিপ্রায়, পিতামাতার আর্তচিন্তার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহ-বিপ্লব ভেসে গেছে। সেদিন তারা নিজেদের জীবনের সাফল্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সমাজ মুক্তির বাসনায় ঘর ছেড়েছিলেন। আজ শ্রীলতার সন্তান পূর্ব, বল্লী নিজস্ব ভাবনায়, নিজস্ব উদ্যোগে, প্রচলিত পথ ছেড়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা পেতে চাইছে। সেখানে প্রথাগত শিক্ষার সার্টিফিকেট জরুরি নয়। গল্পে আছে মে দিন, বিদেশী মেরীর বিপ্লবে যোগদান, নভেম্বর বিপ্লবের প্রসঙ্গ। ব্যক্তির মুক্তি বা স্বাধীন আত্মপ্রতিষ্ঠা দিতে পারে একমাত্র চেতনা। চেতনাই ব্যক্তিকে নিয়ে যেতে পারে স্বতন্ত্র সত্যে। যে সত্যের সঙ্গে প্রচলিত সিস্টেমের কোনো মিল নেই। সেদিনের যোদ্ধরা আজ এসে দেখে সমস্তটাই লোকসানের খাতায়। কিন্তু যে অভিজ্ঞতা ও আত্মদর্শনের স্নায়ুতন্ত্র তারা লাভ করেছিল তাই জীবনকে স্বয়ম্ভু সত্যে চালনা করতে সাহায্য করেছে। সেই জীবনচেতনাকে লেখিকা এমনভাবে জানান দিয়েছেন—“আগুন কখনো শিখা তুলে জ্বলে, কখনো ছাই চাপা, কিন্তু আগুন থাকে। আগুন তো মাটিতে জমে থাকা সূর্যতাপ, সে কি হারায়?” (সূর্য ও সাদাপাখিটি, তদেব, পৃ. ৩৯২)

(৩)

শ্রেণির রূপান্তর, ভিটেমাটি হারা মানুষের আর্তনাদ, শোষকের রক্তচক্ষু শাসন, রাষ্ট্রের বিভীষিকা, কর্পোরেট পুঁজি, উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস সাধনের নানা ইতিবৃত্ত জয়া মিত্র নির্ভিক চিত্রে নির্মাণ করেছেন। সমস্ত ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হতে হয়েছে প্রান্তিক মানবকে। রাষ্ট-পুঁজিবাদ-কর্পোরেট-উন্নয়ন যজ্ঞের সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে প্রান্ত-প্রান্তিক মানবের উপর দিয়ে। আসানসোল সন্নিহিত অঞ্চলের ভূগর্ভ থেকে কয়লা তুলে, পাহাড় কেটে পাথর ভেঙে পরিবেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে। রাষ্ট্র, পুঁজিবাদ দিনের পর দিন বস্তি উচ্ছেদ করে, জঙ্গল নাশ করে ক্ষমতার মিনার চূড়ায় বসে সাধারণ মানুষকে মুছে দিতে চাইছে। ‘পাথরজন্ম’ (২০০৮) গল্পে রূপলালের যে শ্রেণি রূপান্তর, বাসভূমিচ্যুত, নতুন কর্ম সন্ধানের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক মানবের লেলিহান শিখার অন্তিম আর্তনাদ ও পরিবেশ ধ্বংসের যে নথিনক্ষত্র চিহ্নিত করে চলেন তা সময় ও রাষ্ট্রকে যেন আক্রমণ করে। ধানবাদের রূপলালদের পূর্বপুরুষের জমি ছিল। সম্পূর্ণ কৃষক। কিন্তু নদী বাঁধ বিপর্যস্ত করে দিল গ্রামের পর গ্রাম। জমি লবণাক্ত হতেই সকলেই কর্মহীন হয়ে, ক্ষুধার্ত হয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। কর্মের সন্ধানে সে আসানসোলে এসে দেখে এখানেও বস্তি উচ্ছেদ হয়েছে। বাড়ি ফিরেও শুনতে পায় যন্ত্র দ্বারা ঘরবাড়ি সব গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্র ও উন্নয়ন প্রান্তিক মানবকে ছিবড়ে করে দিচ্ছে। বেঁচেবর্তে থাকা মানুষকে ভিখারিতে পরিণত করছে। শ্রেণিচ্যুত থেকে বাসভূমিহারা সমস্তের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র তার সর্বগ্রাসী ধ্বংসপ্রবণ উন্নয়ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে। পরিবেশ, মানব সম্পদ, প্রান্তজনকে নানা প্রকরণে ধ্বংস করা হচ্ছে। সেই চক্রান্তের আগাপাশতলা সংবাদ ও ধ্বংসের রকমফেরের আবিষ্কারক জয়া মিত্র। কোনো রোমান্টিক কাহিনি বা কল্পিত বাস্তব নয় ঘটমান বর্তমানের সিঁড়ি দিয়ে প্রত্যক্ষ বাস্তবতার অলিন্দ দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতাসহ পুঁজিবাদের রক্তচক্ষু শোষণ ও উন্নয়ন যজ্ঞের পৃষ্ঠদেশের সর্বশ্রান্ত শ্রেণি রূপান্তর তাঁর গল্পকে ভিন্ন পরিমণ্ডল দান করেছে। ক্ষমতাশালীদের দুর্বৃত্তায়ন, প্রান্তিক মানুষকে ছলছুতোয় শোষণ ও প্রান্তের জেগে ওঠা, সমস্ত গ্রাস করে নেবার ইতিবৃত্ত গড়ে উঠেছে ‘কাঁকর-মাটি’ (২০০৮) গল্পে। মাটি চালান, পাথর ভাঙা, কয়লা খাদান, গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদ চলতে থাকে আবহমানকাল ধরে। কখনো কখনো কেউ গর্জে ওঠে, সুযোগ বুঝে পার্টি এগিয়ে যায়, পিছিয়ে আসে। লেখিকা দীর্ঘ প্রেক্ষাপটে ক্ষমতান্ত্রিক দুর্বৃত্তায়নের প্রতাপ, সাধারণ মানুষের নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ও প্রতিবাদের ইস্তেহার রচনা করেছেন। তবুও প্রান্ত জাগে না। দুর্বৃত্তায়ন, পুঁজিবাদ, পার্টি, রাষ্ট্র শোষণের ভিন্ন পথ খুঁজে নেয়। হারিয়ে যায় পরিচিত প্রান্ত। আসানসোল সন্নিহিত জনপদ জীবনের চোরাবলি কত ভয়ানক, ভূমিহারা মানুষের আর্তনাদ কত করুণ, দুর্বৃত্তায়নদের লালসায় পরিচিত ভূগোল কীভাবে বদলে যাচ্ছে, শ্রেণির রূপান্তর সহ পরিবেশ বদলের পর্ব থেকে পর্বান্তর জয়া মিত্র আখ্যানের ভিতর দিয়ে নানামাত্রায় বুনে দেন। যা হয়ে ওঠে তৃতীয় বিশ্বের প্রলেতারিয়েত শ্রেণির জীবনচক্র। পুঁজিবাদ নির্ভর সমাজ কাঠামোয়, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশের ধারার বিপরীতে মরতে মরতে বেঁচে থাকা মানুষের চিরকালীন ভাষ্য।

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, উন্নয়ন, কর্পোরেট বাণিজ্য সর্বত্রই বলি হতে হয়েছে প্রান্তিক মানুষকে। ভোটযুদ্ধের সংখ্যামাত্র প্রান্তিক মানুষকে নিয়ে কেউ ভাবেনি। ভাবার অবকাশ পায়নি। একমাত্র ভোটের অঙ্ক ভেবে যখন প্রয়োজন ব্যবহার করেছে। দিনের পর দিন সাধারণ মানুষ নিপীড়িত, বাস্তুহারা হয়ে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ‘উন্নয়ন ও ঘরের লক্ষ্মী’ (২০০২) গল্পে লেখিকা একমুখী উন্নয়নকে ব্যঙ্গ করেন। যে উন্নয়ন সর্বস্বহারা প্রান্তিক মানুষের কথা ভাবে না, যে উন্নয়ন মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে, ফসলহারা করে, ক্ষুধার অন্নকে কেড়ে নেয় তা কেমন উন্নয়ন? বুর্জোয়াতন্ত্র, রাষ্ট্র বণিককুলের হাত মজবুত করতে, বিত্তবানদের আরো সুবিধা দিতে প্রান্তিক মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পথে বসিয়ে দিয়েছে। আছে পার্টি রাজনীতির শোষণের বহুমুখী ইতিবৃত্ত। উষালতা, সুবলরা কোনো পথই খুঁজে পায় না। রাস্তা বড় হবে বলে বস্তি উচ্ছেদ হলে উষালতারা বাস্তুচ্যুত হয়ে শ্রেণির রূপান্তর ঘটে ভৃত্যে পরিণত হয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধানকে অর্থ দিয়ে রাস্তার জন্য নেওয়া সরকারের জমিতে কিছু ধান ফলিয়েছিল। কিন্তু ধান ঘরে তোলার আগেই নির্মিত রাস্তার জন্য পাথর এসে সব ধান পিষে দিয়েছে। একমুখী উন্নয়ন ক্ষুধার লক্ষ্মীকে ছিনিয়ে নিয়েছে। রাষ্ট্রের উর্দিধারী পুলিশ একদিনও সময় দিতে পারেনি। মানবতার লাঞ্ছনা, রাষ্ট্রযজ্ঞের ক্ষুদ্র নাটবল্টুদের দুর্বৃত্তায়ন, একপেশে উন্নয়নের ডমরু বাজনা উষালতাদের সামান্য ভাতের স্বপ্নটুকুও কেড়ে নিয়েছে। অথচ সরকারি জমিতে ধান চাষের জন্য পঞ্চায়েতকে ঘুষ দিতে টাকা জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয়েছে। বোকা, ক্ষুধার্ত উষালতারা সামান্য ভাতের স্বপ্ন দেখে, তাদের পক্ষে বোঝে সম্ভব নয় রাষ্ট্রের নিচুতলার নাটবল্টুদের চক্রান্ত। স্বপ্নের ভাত স্বপ্নেই থেকে গেছে।

জয়া মিত্রসভ্যতার উন্নয়ন যে কেবল বিত্তবানদের জন্য, পুঁজির গোলাঘরকে আরো মজুত করার জন্য তা জয়া মিত্র মেনে নিতে পারেননি। পুঁজিবাদি ও ধনতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর উন্নয়ন প্রান্তিক মানুষকে শুধু নাশ করেনি, প্রান্তিক মানুষের কোনো উপকারেই লাগেনি। গণতন্ত্রের মেকি ধ্বজা উড়িয়ে দিয়ে প্রান্তের সর্বস্ব নাশ করে একপেশে উন্নয়ন সভ্যতাকে, প্রান্তকে ধ্বংস করে দিল। সাধারণ মানুষের যে সহজ সরল সত্যে বাঁচার জীবনচক্র ছিল তা ক্রমেই জটিল করে দিল। ‘সাধন ও তার পথঘাট’ (২০১৪) গল্পে একপেশে উন্নয়ন প্রান্তিক মানুষকে কীভাবে ধ্বংস করে দিল তার বয়ান। বৃক্ষ নাশ থেকে প্রান্তিক মানুষের সহজ সরল বিশ্বাস ও জীবনচর্চায় আঘাত এনেছে বড় রাস্তা। গ্রামজীবনের শ্রেণিচিত্র বদলে গেছে, গ্রামের মানুষের স্বভাব, রুচিবোধ বদলে গেছে। যে সাধন রাস্তা অতিক্রম করতে ভয় পায়, যে সাধনরা স্তিমিত গতিতে রাস্তা অতিক্রম করত রাষ্ট্রের উন্নয়ন তা কেড়ে নিয়েছে। তাদের স্বাভাবিক বাঁচার উপর আঘাত এনেছে। কাঠ মিস্ত্রি সাধন উন্নয়নের চক্রান্তে শুধু স্ত্রীকেই হারায়নি, নিজেও মরেছে। পুঁজিবাদনির্ভর উন্নয়নে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির বাঁচার অধিকার কেড়ে দেওয়া হবে। হারিয়ে যাবে সাধনরা। হারিয়ে যাবে গাছ, ফসলের জমি। হারিয়ে যাবে প্রান্তিক জীবনের সাধারণ সত্য। সব হয়ে উঠবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত বয়ান। রাষ্ট্র যেমন চালাবে তেমন চলতে হবে। ব্যক্তির স্বাধীন সত্তাকে ধ্বংসের নানামাত্রিক বিশ্লেষণ নিয়ে জয়া মিত্র সময়ের ভাষ্য গড়ে তুলেছেন। যে বয়ান রাষ্ট্রবিরোধী, ভিত্তিহীন উন্নয়ন বিরোধী। সংগতভাবেই ‘গল্পসমগ্র’র নিবেদন অংশে তিনি জানিয়েছেন—

“মানুষ যেখানে সবচেয়ে সুন্দর—তার সহজ স্বাভাবিক জীবনযাপনে, সেখান থেকে উপড়ে তুলে কোটি কোটি মানুষকে ছুঁড়ে ছিটিয়ে ফেলা হচ্ছে পরিত্যক্ত বস্তুর মতো। যেখানে মানুষের বাস, হাজার হাজার বছর ধরে যেখানে মানুষ গড়ে তুলেছিল তার সভ্যতা-সংস্কৃতি, সেই প্রকৃতি আর তার ধাত্রী পৃথিবীকে কিছু লোকের উচ্ছিন্ন খেয়ালখুশিতে চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত করার নাম দেওয়া হল—অগ্রগতি। এই সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে কী করবে একজন লেখক?”

সেই দায়িত্ববোধ, জীবনচেতনা, প্রান্তিকের অস্তিত্ব অমাবস্যাই লেখিকাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় সমাজ প্রগতির ভাষ্য। সমাজের প্রত্যক্ষ বাস্তবতার সঙ্গে মানবিক দর্শন ও জীবনচেতনার নিগূঢ় পাঠ জন্ম দেয় বয়ানের। যে বয়ান প্রতিমুহূর্তে বাতিল করে দিচ্ছে পুঁজিবাদনির্ভর ভিত্তিহীন অপরিকল্পিত উন্নয়নকে।

ব্যক্তি মানুষের বহুমুখী সমস্যা থেকে জয়া মিত্র মানবিক আখ্যান গড়ে তুলেছেন। সমাজ প্রগতির অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের ভিত্তিহীন সিদ্ধান্তের চোরবালির মুখোশ খুলে দিয়েছেন। দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের বদলে অপরিকল্পিত পুঁজিবাদের স্বার্থে উন্নয়নের শ্রেণিচক্রকে তিনি আক্রমণ করেছেন। পার্টি থেকে বিপ্লব, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে গার্হস্থ্য সন্ত্রাস, লোকাল পার্টি থেকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বৃহত্তর পুঁজিবাদে বিধ্বস্ত মানুষের নিয়তিকে তিনি নির্মাণ করেছেন আন্তরিক গদ্যে। কোথাও মরবিড কোথাও চরিত্র ফিরে গেছে শুদ্ধচেতনায়। আসানসোল সন্নিহিত প্রান্তভূমির দলিলিকরণ, ক্রমে বদলে যাওয়া মানচিত্র, পরিবেশের অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক মানবের আর্তনাদ তিনি শুনেছেন প্রত্যক্ষ বাস্তবতায়। কল্পিত ভূমি ও আর্টের সত্যের বদলে বাস্তবের ভূখণ্ডকে তিনি ব্যক্ত করেছেন নিজস্ব অভিপ্রায়ে ও সমাজতাত্ত্বিকের দার্শনিক বীণায়। এই দেশ, এই সমাজ, এই মানুষের মৃত্যু উপত্যাকায় দাঁড়িয়ে আগামী পৃথিবীর জন্য তিনি কিছু বার্তা রেখে যেতে চান। যা বহন করে চলে তাঁর চরিত্র ও গল্পভূমি।

ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত