পুতা বুতাম বং টি এস্টেট
5/5 - (1 vote)

অদ্রীশ সিংহের ছবি

পুতা বুতাম বং টি এস্টেট। আজ সকাল সকাল কলকাতা থেকে এসেছি, প্রপিতামহের পুরাতন এস্টেটের দেখভাল করার জন্য। আমি অনিন্দ্য নারায়ন, সঙ্গে চাকর সদানন্দ। সিঙ্গামারি গ্রাম। সমতল থেকে প্রায় ৬৫০০ ফিট উঁচুতে, সিকিমের রাস্তায়। ঘন পাইন জঙ্গলের ভীতর তিস্তা নদীর ধারে আমাদের এস্টেটের পুরাতন বাংলো। আমরা এখানেই উঠেছি। শ্রাবণ মাসের থমথমে সন্ধ্যে। ঝুমুর এসে চা দিয়ে গেল। এখানে এলে ঝুমুরই আমার দেখাশোনা করে। ঝুমুর আমাদের এস্টেটের পুরাতন কর্মচারী গদাধরের মা মরা মেয়ে।

চা চুমুক শেষ করে আমি সদানন্দ কে বললাম, ‘ চল একটু বেড়িয়ে আসি।‘

আমরা তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে দক্ষিণ দিকের সিকিমের রাস্তা ধারলাম। পুরনো আমলের মার্সিডিজ। তাই পাহাড়ি রাস্তায় ড্রাইভার এর ভরসা করি না। কিছুদুর এগিয়ে দুটো পাহাড়ের মাঝে বাঁক নেব, এমন সময় গাড়ির টায়ার গেল বিগড়ে। গাড়িটিকে একটি সমতল জায়গায় দাঁড় করিয়ে, ইমারজেন্সি ফ্লাশার জ্বালিয়ে দিলাম। পামচার হওয়া টায়ারের সামনে জ্যাক লাগিয়ে লিফটিং করে চাকা চেঞ্জ করলাম। পুরনো টায়ার টিকে গাড়িতে তুলতে যাবো, এমন সময় সদানন্দ চিৎকার করে উঠল, ‘বাবা গো ! মা গো ! মরে গেলাম গো ! বাঁচাও।‘

সহসা ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, কাত হয়ে পাহাড়ের গায়ে পড়ে আছে। ওকে গাড়িতে বসিয়ে কোনরকমে বাংলোতে ফিরলাম।

তাড়াতাড়ি ঝুমুরকে বললাম , ‘এক গ্লাস গরম দুধ দে তো ওকে। মনে হয় হাতটা ফ্র্যাকচার হয়েছে ! সদানন্দের হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে ওকে একটা কড়া ঘুমের ওষুধ দিলাম। ঝুমুর এসে আমায় রাতের খাবার দিয়ে গেল। আমি ওর দিকে চেয়ে দেখলাম, কি সুন্দর দেখতে হয়েছে !

বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন বাবার সঙ্গে আমি এখানে আসতাম নিয়মিত। বাবার মুখে শুনেছি এস্টেটটি আমার প্র-পিতামহ স্বর্গীয় অনন্ত নারায়ন মহাশয় কোন এক ইংরেজ সাহেবের কাছ থেকে কিনেছিলেন।

অদ্রীশ সিংহের ছবি

ক্যামেলিয়া সাইনেন্সিস। ছোট্ট ছোট্ট সবুজ চা চারার বন। দিনে দিনে যখন, সূর্যের আলো আর পাহাড়ের খাঁজের জল থেকে ওদের ক্লোরোফিল এবং থিয়ানাইন গাঢ় সবুজ হয়, তখন ওদের ছোট্ট পাতাগুলোকে তুলে নিয়ে চায়ের জন্য প্রসেস করা হয়। আগে বাঁশের মাচায় শুকনো করা হতো। এখন অটোমেটিক মেশিনের সাহায্য নেওয়া হয়; যেখানে টেম্পারেচার এবং হিউমিডিটি খুব সুক্ষভাবে মেনটেন করা যায়। এরপর হয় ব্রুশিং এবং অক্সিডেশন যা বিভিন্ন ধরনের চা বানানোর জন্য দরকার। ওলং টি, ব্ল্যাক টি , হোয়াইট টি, পুয়ার্ক টি ইত্যাদি। অক্সিডাইজিং এর ফলে সবুজপাতা পরিবর্তিত হয় ব্রাউন কালার এ , অনেকটা আপেলের বেকিং করার মত। সর্বশেষে এটিকে শুকনো করে নিলে, অতিরিক্ত ময়েশ্চারাইজার বের হয়ে যায়; আর পড়ে থাকে ঝকঝকে তাজা টি।

বড় হয়ে বাবার মুখে শুনেছিলাম, আমার পিতামহের চায়ের এস্টেট ছাড়াও ওখানে আর একটা টান ছিল। অদিতি বাই। যেমন পাহাড়ি গড়ন, তেমনি গলার সুর ছিল অপূর্ব। ঠাকুরমা একবার রেগে দাদু কে বলেছিলেন, ‘তোমার যখন ওইখানে বেশিরভাগ সময় থাকতে হয়, তার থেকে ওকেই এখানে নিয়ে এসো’। উত্তরে দাদু বলেছিলেন, “বন্যেরা বনে সুন্দর! ওদের ওখানেই মানায় বেশি। ঘর এবং বাইরের মধ্যে একটা উঠোন থাকা জরুরী।‘ তারপর এক অমাবস্যার রাতে ওদের দুজনের কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বাংলো টি আমার প্রপিতামহের তৈরি করেন পাইন গাছের জঙ্গল কেটে । সেটা ১৮৩৮ সাল হবে। সবথেকে সুন্দর এর দক্ষিন বারান্দার নাচঘর টি। এখানে লাট সাহেব দের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে কত সুন্দরীর যে জীবন গেছে, তা হয়তো হাতে গুনে শেষ করা যাবে না। এর শেষ প্রান্তে একটা সুরঙ্গ আছে, মাটির নিচে যাওয়ার। তবে সুড়ঙ্গের শেষে কি আছে আমরা কেউই সে ব্যাপারে কনদিন উৎসাহ দেখাইনি। ঝুমুরের মনটা আজ ভারাক্রান্ত; কারন আমার এখানে আসার কারণটা সে জানতে পেরেছে। রাতে বাড়ি যাওয়ার আগে, দেরাজ থেকে সালটা বার করে দিয়ে আমায় বলল, ‘রাতে গায়ে দিয়ে নিস। বাহিরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়শে। ঠান্ডা আছে।‘

অদ্রীশ সিংহের ছবি

রাত তখন কটা হবে জানি না। আমার ঘুম ভাঙ্গলো ছোট্ট একটা ঝাকুনিতে। দেখলাম ঝুমুর আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। বিজলির আলো নেই। ওর হাতে একটা লন্ঠন। আমার হাত ধরে টানতে টানতে সুড়ঙ্গের মুখে নিয়ে গেল। নিজের বুকের কাছ থেকে একটা চাবি বের করে সুড়ঙ্গের কপাট খুললো। ওর হাতটা আজকে একটু বেশি মাত্রায় ঠান্ডা। তারপর আবার একটা দরজা খুললো। সে আমায় যেখানে নিয়ে গেল, আমি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

এ যেন মাটির তলায় প্রাসাদ। যক্ষের ধন। অপূর্ব কারুকার্য করা প্রাসাদ। মলিনতার কোন চিহ্নমাত্র নেই। ঘরদোর দেখে মনে হল কেউ নিয়মিত পরিষ্কার করে। ঘরের দেওয়ালে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচের মুদ্রা খচিত। আমায় সামনের একটা সোফাতে বসতে দিয়ে বললো, সে আসছে। দেখলাম সামনে বড় পোর্ট্রেট। চিনতে অসুবিধা হলো না, ইনি ই অদিতি বাই। আমি যেখানে বসে আছি তার ডান দিকে মণিমাণিক্য খচিত খাট, তাতে আতরের গন্ধ। ঝুমুর যখন ফিরে এলো আমি তাকে দেখে মুগ্ধ হলাম। তার এই রূপ আমি আগে কখনো দেখিনি। আমার হাত ধরে খাটের উপর নিয়ে গেল, তারপর বলল, ‘আমায় ভালবাস, যতখুশি ভালবাস !‘

মনে পড়ল,ওকে একদিন বলেছিলাম, ‘তোকে একদিন তিস্তা ব্রিজে বেড়াতে নিয়ে যাব, যেখানে দার্জিলিং, কালিম্পং আর সিকিমের রাস্তা এসে মিশেছে। তারপর যেদিকে যেতে চাইবি সেই দিকে !’

উত্তরে ও বলেছিল, ‘বাবু তিস্তা বাজার থেকে আমায় একটা থাঙ্কা কিনে দিস। হাতে ঝুমঝুমিয়ে পরব।‘ সেদিন বুঝিনি ওর বুকে আমার জন্য এত প্রেম জমা হয়ে আছে।

পরদিন সকালে আমার একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল। আমার চাকর সদানন্দের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, অনেক সময় দুটো পাহাড়ের মাঝে বাতাস খরস্রোতা হয়ে ওঠে; তখন নিজেরাই আনন্দে ঘূর্ণির মতো ঘুরতে-ঘুরতে পাশে যাকে পায় জোরে ঠেলা মারে; গত কালের ঘটনা কোন ব্রহ্মদৈত্যর কাজ নয়। হঠাৎ বাহিরে তাকিয়ে দেখি, গাদাধার ছুটতে ছুটতে আসছে। এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘বাবু বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে, কাল রাত্রে ঝুমুর গলায় দড়ি দিয়েছে। এস্টেট বিক্রি হয়ে যাবে তা ও মেনে নিতে পারেনি।‘

আমি অসহায় ভাবে গদাধরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। গদাধর চলে গেলে আমার চাকর সদানন্দ কে বললাম, ‘একবার সুরঙ্গ ঘরটা দেখা দরকার‘।

ছবি: অদ্রীশ সিংহ