রবি স্মৃতির গৌরীপুর হাউস এখনও নস্টালজিক করে
5/5 - (2 votes)
অনাদৃত রবি স্মৃতির গৌরীপুর হাউস
অনাদৃত রবি স্মৃতির গৌরীপুর হাউস

কালিম্পং শহর থেকে দক্ষিণদিকে রিং কিং পিং রোড ধরে এগোলেই গৌরীপুর হাউস। ভরা পর্যটনের মরসুমেও এখানে ভিড়ভাট্টা নেই। বরং একটা গা ছমছমে ভাব। কালিম্পং শহরে বেড়াতে এসে চিত্রভানুতে অনেকেই যান। কিন্তু রবিস্মৃতি বিজড়িত গৌরীপুর হাউসের খোঁজ অনেকেই রাখেন না। এক গ্রীষ্মের ছুটিতে এরকমই এক রবীন্দ্রপক্ষে কালিম্পংয়ে মেঘ-কুয়াশা বৃষ্টির মধ্যে দূরপিনদাড়ার অদূরে রিং কিং পং রোডে অবস্থিত নিঝুম মরগ্যান হাউস, গলফ মাঠের পাশ দিয়ে হাজির হলাম গৌরীপুর হাউসের উঠানে। ‘চিত্রভানু’ আর গৌরীপুর হাউসে বেশিক্ষণ থাকব শুনে নেপালি ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলে – ‘ক্যায়া হ্যায় ইধার বাবু? কুছ নেহি’। প্রত্যুত্তরে কিছু বলার থাকে না। কারণ বাঙালির রবীন্দ্র-প্রেম এখনও পাহাড়ের উচ্চতায় উঠতে পারেনি। দূরপিনদাঁড়া রোড মঙ্গলধাম পেরিয়ে অবশেষে রাস্তার এক প্রান্তে একটা উতরাই পেরোতেই একটা ঢালের মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল আমাদের বোলেরো। এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা। একটা সরু পায়ে চলা পথ নেমে গেছে ঢাল বেয়ে। গাড়ি থেকে নামলাম। এই সরু এবড়োখেবড়ো রাস্তাটা দিয়ে গাড়ি নামবার কোনও উপায় নেই। অথচ তখন প্রকাণ্ড মোটর নামত দিব্যি। মনে মনে হিসাব করলাম তার মানে এখন যা সরু তার চেয়ে বেশ খানিক চওড়া ছিল তখন। রাস্তার ডানদিকের অংশটা ধ্বসে গেছে বহুদিন। সাবধানে নামছি। দেখতে পাচ্ছি প্রাসাদোপম অট্টালিকাকে। ইতিহাসের ভগ্নস্তূপ। অভিমান আর অহংকার একসাথে প্রতিফলিত হচ্ছে সেখান থেকে। গৌরীপুর লজ। বিশাল এলাকা জুড়ে বাগান এবং তার গাছগাছালির মাঝে অপরূপ বাড়িটিকে দূর থেকে পুরো ভূতের বাড়ির মতো মনে হয়েছিল৷ পিচ বাঁধানো পাকা রাস্তা থেকে গৌরীপুর হাউস পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তাটিও ছিল এবড়োখেবড়ো, রাশি রাশি শুকনো পাতায় ঢাকা৷

এই ভবনে কবিগুরু বাস করতেন
এই ভবনে কবিগুরু বাস করতেন

তখন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। উদোম, অনাদৃত, তাচ্ছিল্যকর ভুতুড়ে পরিবেশ। চতুর্দিকে এমন আগাছা যে দিনের বেলাতেও সে রাস্তায় হাঁটতে গা ছমছম করে৷ আর বাড়ির সামনে পৌঁছে তার চেহারা দেখে চোখে জল আসার উপক্রম হয়েছিল৷ ভেজা জংলা ঘাস, আবর্জনা, বিষ্ঠা, প্লাস্টিক এককথায় চরমতম অবহেলা। পোড়োবাড়ি, ভূতবাংলো বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিতিকিচ্ছিরি বেহাল রবি কবির স্মৃতিবিজড়িত গৌরীপুর হাউসের দেওয়ালে, কার্নিশে, জানালার খাঁজে খাঁজে গাছপালা। আগাপাশতলা শ্যাওলার কালচে আস্তরণে ঢাকা। ইতিহাসের নির্মম রসিকতাই বলতে হবে, গৌরীপুর হাউসের গায়ে এক খণ্ড মর্মর ফলকে লেখা ছিল – ‘‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫ শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে জন্মদিন কবিতা আকাশবাণীরমাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন৷” সদর দরজা বন্ধ ছিল, কিন্তু বাড়ির প্রায় সব জানালা হয় ভাঙা, নয় দু হাট করে খোলা৷ তার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি মেরে দেখলাম একেবারে বেবাক খালি, আসবাবহীন, ধুলোয় ঢাকা ঘর৷ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কোনো সামগ্রী, কোনো আসবাবপত্র সেখানে থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। দেখেছিলাম বাড়ির অনেকাংশই ভেঙে পড়েছে। ঘরের বেশিরভাগ জানলাতেই কাচ নেই। যেগুলোতে ছিল, সেগুলোও দেখেছিলাম ভাঙা। অনায়াসে ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল। দেওয়াল এবং মেঝের কিছু অংশ খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা ছিল। বাড়ির চত্বরেই চলছিল কনস্ট্রাকশনের কাজ। জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম পলিটেকনিক কলেজ স্থাপিত হবে সামনেই। কনস্ট্রাকশনের কাজের কারণেই চারিদিকে আরও বেশি জলকাদা হয়ে জায়গাটা হাঁটার অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল। আসলে ইতিহাসের সমাধি-খনন। কতবছর আর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কে জানে!

রবীন্দ্র-গবেষক রতন বিশ্বাসের নিবন্ধ থেকে জেনেছিলাম একসময় নীচের দিকে ধাপ কেটে ৬৪টি সিঁড়ি ছিল। সেসবই বা কোথায়? ভেতরে প্রবেশ করে কারা থাকে একটু খোঁজখবর করতে একটা দরজা দেখিয়ে দিল এক নির্মাণকর্মী। দরজাতে কড়া নাড়াতে বেড়িয়ে এলেন এক বৃদ্ধা। হিন্দীতে আসার কারণ জানতে চাইলে জলপাইগুড়ি থেকে এই বাড়িটি নিয়ে লিখব বলে এসেছি শুনে একাধারে বিস্ময় এবং আনন্দের অভিব্যাক্তি ফুটে উঠল তাঁর চোখেমুখে। অত্যন্ত খাতির করে ভেতরের ভাঙাচোরা অথচ পরিপাটি করে গোছানো ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। হিন্দীতে কাকে যেন ডাকলেন। কিছুক্ষণ পড়ে এলেন মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। তিনিই এই বাংলোর কেয়ারটেকার। নাম মাণিক শর্মা। বাংলোর অস্থায়ী কেয়ারটেকার। একতলার যে অংশটা এখন মাটিতে মিশে গিয়েছে, ঠিক তারই ওপরের অংশে একটা ঘর নিয়ে থাকেন তিনি, স্ত্রী সঞ্জিতা শর্মা আর তাঁর তিনটি ফুটফুটে মেয়ে। এছাড়া কতকগুলো মোরগ-মুরগি। মাণিকের মুখে জানলাম সেখানে তাঁরা রয়েছেন চার পুরুষ ধরে। তাঁর মাতামহ এই বাড়ির চৌকিদার ছিলেন।  মানিকের মা কৃষ্ণা শর্মার এখন বয়স প্রায় নব্বই৷ তিনিই আগে বাংলোটা দেখাশোনা করতেন৷ মানিক জানালো ছোটবেলায় আলখাল্লা পরা লম্বা একজন মানুষকে কখনও কখনও বাংলোতে থাকতে দেখতেন৷ ওঁর সামনে যেতে মায়ের ভয় করত৷ তাঁর মা তখন খুব ছোট, সেসময় রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন। ছোট্ট কৃষ্ণা নাকি দাড়িওয়ালা বৃদ্ধকে রীতিমত ভয় পেতেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি এসে হাঁক দিতেন -‘বিটি, মিঠাই লে আ’। পরবর্তীকালে সঞ্জিতার বাবা পদমলালও চৌকিদারি সামলেছেন।

বাংলোর অস্থায়ী কেয়ারটেকার মানিকের সহায়তায় বাড়ির ভেতরে ঢোকার সৌভাগ্য হল। সুন্দর একটি ভারতীয় ও পাশ্চাত্য মিশ্ররীতিতে প্রস্তুত সাদা দোতলা বাংলোবাড়ি। একাধিক ব্যালকনির রেলিঙে পাথরে জাফরির কাজ। অনেকখানি জায়গা নিয়ে, পাহাড় কেটে কেটে, কখনও বড় বড় পাথর সাজিয়ে ধাপ বানানো, আবার নিচের দিকে ৬৪ টি সিঁড়ি ভেঙে প্রশস্ত জায়গাতে। বোঝাই যাচ্ছিল বাড়িটি ছিল অপূর্ব সুন্দর। ঘরে

জানালা দরজার কাঁচ সব ভেঙে পড়েছে
জানালা দরজার কাঁচ সব ভেঙে পড়েছে

ঘরে ছিল প্রচুর আলো। দরজা-জানলাগুলি বড় মাপের। চারদিকে বড় বড় গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, নাথুলা পাহাড় চোখে পড়ে। সামনের নির্জন উপত্যকা ছাড়িয়ে অবাধ শূন্যতা আর পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে অনন্ত আকাশ মুগ্ধ করেছিল কবিকে। এই বাড়িরই একটি ঘরে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। কবি চুপচাপ বসে থাকতেও পারতেন না। তিনি এই পাহাড়ি শহরে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসাও করতেন। দেখলাম গৌরীপুর ভবনের সেই চাকচিক্য আর নেই। বাড়িটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ভুতুড়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছে। দিনের বেলাতেই বাংলোর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গা ছমছম করে৷ ঘরগুলো সব তালাবন্ধ৷ নানা রঙের কাচের শার্সি লাগানো কাঠের দরজার খোপে চোখ রেখে দেখা যায় ময়লা ঘরে ভাঙাচোরা ফায়ার প্লেস৷ আসবাবপত্রের নামগন্ধ নেই৷ কে কবে নিয়ে গিয়েছে কে জানে৷ মানিক জানালো মালিকেরা সব আসবাব নিয়ে গিয়েছেন৷ বাঁধানো ছবিগুলোও৷ দোতলার যে ছোট বারান্দাটায় রবীন্দ্রনাথ বিশ্রামের জন্য এসে বসতেন, একসময় সেখান থেকে দেখা যেত কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নাথুলা। এখন বসতি হয়ে গেছে। দূষণের পর্দা ভেদ করে শুভ্র হিমশিখরের দৃশ্যমানতা আর সম্ভব হয় না। তবে সামনের গাছ দুটি আজও ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকবে, আরও কতদিন। এরকম ইতিহাসের স্মৃতি-বিজড়িত জায়গায় এসে এই গাছেদের দেখে মনে হয়, যদি ওরা কথা বলতে পারত, কোনোভাবে!

জানিনা কখন মন চলে গিয়েছিল সুদূর অতীতে। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ১৯৩৮ সালের ২৫ শে বৈশাখের সেই দিনটি। পরিব্রাজক, সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল ‘দেবতাত্মা হিমালয়ে’ গৌরীপুর হাউসে কবির জন্মদিন পালনের কথা উল্লেখ করেছেন। মংপু থেকে ড: মনমোহন সেন, মৈত্রেয়ীদেবী, চিত্রিতাদেবী এলেন। সেন পরিবার ছাড়াও ২৫শে বৈশাখ উপলক্ষ্যে কবির অতিথি হয়ে এসেছিলেন ‘যুগান্তরে’র সম্পাদক পরিব্রাজক-সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল। কবির জন্য যুগান্তরের ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী সংখ্যা’র বেশ কিছু কপি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘দেবতাত্মা হিমালয়’-এ সেই যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়েছেন প্রবোধকুমার। তাঁর ভাষাতেই, “সেটা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ এবং বাংলা তারিখ ছিল ২৫ বৈশাখ। মহাকবির জন্মদিনে আমরা যাচ্ছিলুম কালিম্পং-এ। রবীন্দ্রনাথ তখন সেখানে”। সময়কাল ১৯৩৮। সেই সময় অশোককুমার সেন ছিলেন আকাশবাণী কলকাতার কেন্দ্র অধিকর্তা। কবিকণ্ঠে জন্মদিন কবিতা সম্প্রচার করার জন্য কালিম্পং ট্রাংক টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়। গৌরীপুর ভবন থেকেই ১৯৩৮ সালের ২৫ বৈশাখ  আকাশবাণীর বেতার-তরঙ্গে কবির বিখ্যাত ’জন্মদিন’ কবিতাটি পাঠ করার উদ্যোগ আয়োজন করা হল। ট্রাঙ্ক টেলিফোনে যোগাযোগ হল কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে কালিম্পঙের। অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা শাখার অধ্যক্ষ কালিম্পং এসে পৌঁছলেন। এসেছিলেন বেতার-বিশেষজ্ঞ নৃপেন্দ্র মজুমদার যিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ভারতীয় অনুষ্ঠানগুলির প্রযোজক ছিলেন। প্রবোধকুমার সান্যাল লিখছেন- “আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ঝড়ও ছিল প্রচন্ড। বৃষ্টি, পাহাড়ের ভাঙন, দূর্যোগের ফলে রাস্তায় কয়েকদিন আগে পোঁতা টেলিফোনের খুঁটিগুলি উপড়ে পড়েছিল। অনুষ্ঠানের সময় এগিয়ে এল। টেলিফোন সংযোগ কয়েকবার পরীক্ষা করা হল। সেদিনই কবির হাতে দূরভাষ কেন্দ্রের উদ্বোধন হবে। ট্রাঙ্ক টেলিফোনে জুড়বে কলকাতা আর কালিম্পং। টেলিফোন পরীক্ষা হল বারবার”।

ধীরে ধীরে সূর্য ঢলে পড়ল দুরপিন পাহাড়ের অস্তাচলে। সাড়ে সাতটা কী আটটার সময়ে বেল বাজল। কবি গিয়ে বসলেন নির্দিষ্ট আসনে। সকলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। কবি গৌরীপুর ভবনের একটা ঘরে বসে আছেন। দরজা, জানালা বন্ধ। বাইরে থেকে যেন কোনও শব্দ ভিতরে ঢুকতে না পারে। সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করে দেওয়া হল অবাঞ্ছিত শব্দের হাত থেকে মুক্তি পেতে। বাইরে রাখা আছে রেডিও সেট। কবির আবৃত্তি কলকাতা ঘুরে ব্রডকাস্ট হবে সেই যন্ত্রে। সোজা কলকাতা পৌঁছে বেতারে ছড়িয়ে পড়বে দেশ জুড়ে। সকলেই তখন প্রচন্ড কৌতূহলী। সকলের মধ্যে জন গ্রাহামও ছিলেন। বাড়ির চারিদিকে বসানো হয়েছিল টেলিফোনের তার। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, আবেগ, ইতিহাস সব একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সৌজন্যে ওই একটি মানুষ। প্রবোধ সান্যাল লিখছেন- “মহাকবি মাঝে মাঝে একবার ভীষণ শব্দে গলা ঝাড়া দেন, একথা সকলেরই মনে আছে। কিন্তু কাব্য পাঠকালে সেই আওয়াজটির দাপটে সূক্ষ্ম যন্ত্রটা বিদীর্ণ হয়ে যাবে কিনা এই আশঙ্কাটা ছিল রথীন্দ্রনাথ প্রমুখ অনেকের মনে। সেজন্য উদ্বেগও ছিল”। তখন সাড়ে সাতটা থেকে আটটা। গৌরীপুর ভবনের ঘরে বসে কবির কন্ঠ থেকে উচ্চারিত হল ‘‘আজি মম জন্মদিন / সদাই প্রাণের প্রান্তপথে / ডুব দিয়ে উঠেছে সে / বিলুপ্তির অন্ধকার হতে / মরণের ছাড়পত্র নিয়ে।…(জন্মদিন, সেঁজুতি)। টানা পনেরো মিনিটের পাঠ। একটি দীর্ঘ কবিতা। নাম ‘জন্মদিন’। পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল। আবৃত্তি শেষ। সেই পাঠ ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা, সেখান থেকে দিল্লী, বোম্বাই, লখনৌ, পেশোয়ার, লাহোর। একই সময়ে ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত মুখরিত হল বিশ্বকবির উদাত্ত কণ্ঠের মাদকতায়। সেই মায়াবী মুহুর্তের অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন প্রবোধকুমার- “আমাদের পায়ের নীচে কালিম্পং থর থর করতে লাগলো কিনা সেকথা তখন আর কারো মনে রইলো না। জ্যোৎস্না ছিল সেদিন বাইরে। একটা মায়াচ্ছন্ন স্বপ্নলোকের মধ্যে আমরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিলুম। ভুলে গিয়েছিলুম পরস্পরের অস্তিত্ব।” প্রথম লাইভ ব্রডকাস্ট। কালিম্পঙের সাথে কলকাতার দূরভাষ যোগাযোগটিও সেদিনই স্থাপিত হল, যোগ্যতম লোকের হাতেই। ধীরে ধীরে কালিম্পঙের পাহাড়ি নির্জনতাও ফিরে এল।

জরাজীর্ণ  গৌরীপুর হাউস
জরাজীর্ণ গৌরীপুর হাউস

ইহা পর কালা বিল্লি লেকে শ্যুটিং হুয়া থা…!’ এই তথ্য জানান দিল মানিকের শিশুকন্যা সফিয়া। ব্রাউন সাহেবের প্রিয় পোষ্য সাইমন নামের বিড়ালটির প্রেতাত্মা আর্বিভূত হয়েছিল গৌরীপুর হাউসের পোড়ো বাংলোতেই। সেখানেই ‘যেখানে ভূতের ভয়’ ছবির শ্যুটিং করে গিয়েছেন সন্দীপ রায়। কালিম্পংয়ের উতরাইতে দুরপীনদাড়া রোডের গৌরীপুর বাংলোর চৌকিদার মানিকের মেয়ে সফিয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে সেই শুটিং এর কথা জানাল আমাকে। কালিম্পংয়ের এই বাংলোয় বসেই ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘জন্মদিন’৷ পাহাড়ি শহরে টেলিফোন চালু হওয়া উপলক্ষে এ বাড়ি থেকেই কবির স্বকন্ঠে উচ্চারিত কবিতা দেশজুড়ে সম্প্রচার করেছিল আকাশবাণী৷ সেই বাড়িতে কিনা বেড়ালের প্রেতাত্মার আগমন! হজম করতে কষ্ট হয় বৈকি। এক সময় এ বাড়িতে বসেই বিশ্বকবি লিখে গিয়েছেন একটার পর একটা কবিতা৷ সে সময়কার রঙিন কাচের শার্সি লাগানো দরজা, ফায়ারপ্লেস, বড় বড় জানালা – সবই রয়েছে এখনও৷ শুধু মলিন থেকে মলিনতর হয়েছে অবস্থা৷ জীর্ণ হয়েছে দেওয়াল-দরজা-জানালা৷ খসে পড়েছে চাঙড়৷ রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা এতই খারাপ যে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত গৌরীপুর হাউস এখন কিনা এলাকায় পরিচিত ভূত বাংলো বলে! গা ছমছমে ভূতের ছবির শ্যুটিং স্পট হিসাবে হালে বেশ কদর হয়েছে জরাজীর্ণ গৌরীপুর বাংলোটির৷ সন্দীপবাবু গোটা উত্তরবঙ্গ চষে বেরিয়েছিলেন সত্যাজিতের ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’-র জন্য উপযুক্ত পুরনো বাংলোর সন্ধানে৷ শেষপর্যন্ত কালিম্পংয়ের গৌরীপুর হাউসের খোঁজ পান৷ একনজরেই পছন্দ হয়ে যায় তাঁর৷ সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় ফোন করে ইউনিটকে জানিয়ে দেন, ঠিকঠাক বাড়ির সন্ধান মিলেছে৷ পরে গৌরীপুরের বিখ্যাত জমিদার পরিবারের সদস্য সীমা রায়চৌধুরীর সহায়তায় বাড়িটি ব্যবহার করার সুযোগ পান সন্দীপবাবু৷

গৌরীপুর লজের চৌহদ্দিতে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কেন জীবন সায়াহ্নে উপনীত হয়ে চিরনবীন কবি ছুটি কাটাতে মংপু আর কালিম্পং এই দুটি জায়গাতেই কেবল আসতেন পালা করে। অথচ পাহাড় তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল না বলে মৈত্রেয়ী দেবী কিন্তু উল্লেখ করেছেন। কবি নিজেকে বলেছিলেন ‘পৃথিবীর কবি’। দেশ-বিদেশের নানান কোণায় মাটির সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল তাঁর পায়ের ছাপ। তাহলে শেষ বয়সে কিসের টানে বারবার ছুটে এসেছিলেন এই গিরিরাজির কোলে? কেবলই মৈত্রেয়ী দেবীর প্রতি ভালবাসার টানে নাকি বাংলার পাহাড়ের অপার্থিব সৌন্দর্য্যের কাছে ধরা দিতে? গৌরীপুর লজ ‘আসবাবশূন্য নিরলঙ্কার। এখানে কেউ কোনো দিন বাস করেছে বলে মনে হয় না। এখন মানুষ বাস করে। রবীন্দ্রনাথ এখানে এলে বেশ অনেকগুলো ঘর ব্যবহার করতেন। সুবিশাল অট্টালিকায় ঘরের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। কিন্তু কোন ঘরগুলো ব্যবহার করতেন তিনি? প্রতিমা দেবীই বা কোন ঘরে থাকতেন? কবির একটি আলাদা বসবার ঘর ছিল। মৈত্রেয়ী দেবীরা এলে সেই ঘরের পাশের ঘরে থাকতেন। সেগুলোই বা কোনগুলো? সঞ্জিতা দেখাতে পারেননি। এজন্য তাঁকে দোষ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এত খুঁটিনাটি কথা তাঁর জানার কথা নয়। যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়েরই ভেঙে পড়বার উপক্রম, সেখানে একসময়ে রবীন্দ্রনাথ এসে কোন ঘরে থাকতেন এসব জেনে তাঁর লাভ কী! কবির সম্বন্ধে যতটুকু পড়েছি তাতে জেনেছি, তাঁর দৃষ্টি চলে যেত বহুদূর। সুদূরের পিয়াসী মানুষটি যে সুদূরকেও অতিক্রম করে গেছেন। শুধু সাদা চোখের দৃষ্টিতে নয়, অন্তর্দৃষ্টিতেও। সামনের গাছ থেকে শুকনো পাতা ঝরে এসে পড়েছে বারান্দায়। আমার জুতোর চাপে মর্মরধ্বনি উঠছে তাদের। যেন একটা দীর্ঘশ্বাসকে চাপা দিয়ে মারতে চাইছে কেউ। সঞ্জিতার কথা আর কানে ঢুকছে না তখন। আমি যেন ফিরে গিয়েছি সেই অদেখা সময়ে। সময়টা যে বড় প্রিয় আমার।

মনে হয়, কবিগুরুর ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’-র শিশিরবিন্দুটিকে খুঁজতেই বুঝি এই স্বেচ্ছা-প্রত্যাবর্তন। ছোট পাহাড়ি শহর কালিম্পং। এখানে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। যাতায়াতের পথও ছিল সমস্যাসঙ্কুল। শিলিগুড়ি থেকে দূরত্ব ৫০ মাইল। তিস্তার পাশ দিয়ে রাস্তা, দুই পাহাড়ের মাঝখানে তিস্তা, জঙ্গল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া সে এক অপূর্ব ভয়চকিত আনন্দ। রঙ্গিত ও তিস্তার মিলন আর হিমালয়ের দীর্ঘ বিস্তার। কবিকে এই পরিবেশ খুব কাছে টেনেছিল। রবি ঠাকুর বড্ড ভালোবাসতেন এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরটিকে। তাঁর পাহাড় ভ্রমণ প্রসঙ্গে দুই শৈলশহর কালিম্পং ও মংপুর নাম উঠে আসে। দুটি শহরেই তিনি চারবার করে থেকেছেন। কালিম্পংয়ের প্রতি কবিগুরুর এক বিশেষ টান এবং ভালোবাসা, কালিম্পংয়ের মৌন ধ্বনিহীন প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কবি সেঁজুতি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন কালিম্পংয়ের এই গৌরীপুর হাউসে৷ শুধু কবিতা নয়, চিঠিপত্র, গদ্যরচনা যা অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। কালিম্পংকে ভীষণ ভালোবাসতেন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর সীমান্তে কালিম্পংয়ের কথা উঠলেই অমিয় চক্রবর্তীকে কবির লেখা চিঠিতে কবিতাটির কথা মনে আসে। কবিতার লাইনগুলো- ‘‘পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে, / শূন্যে আর ধরাতলে, মন বাঁধে ছন্দে আর মিলে / বনেরে করায় স্নান শরতের সোনালী / মাঝখানে আমি আছি, চৌদিকে আকাশ তাই / নিঃশব্দে দিতেছে করতালি / আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ, / জানে তাকে এ কালিম্পং।’’ পরিব্রাজক, সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল ‘দেবতাত্মা হিমালয়ে’ গৌরীপুর হাউসে কবির জন্মদিন পালনের কথা উল্লেখ করেছেন “মনে পড়ে সেই ২৫শে বৈশাখের অপরাহ্ন। কবি রয়েছেন গৌরীপুর প্রাসাদে। বৈদান্তিক অ্যাটর্নি হীরেন দত্ত আছেন, আছেন রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, অনিল চন্দ, মৈত্রেয়ী আর চিত্রিতা৷ শ্ৰীযুক্ত অমল হোমের কলম এবং রজনীগন্ধার গুচ্ছ কবির হাতে তুলে দিয়ে প্রণাম করলুম”।

কথা প্রসঙ্গে দেখলাম বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে সঞ্জিতার গলায় যথেষ্ট উৎকণ্ঠা। সন্দীপ রায়ের ‘যেখানে ভূতের ভয়’-এর ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’-র শুটিং এ বাড়িতেই হয়েছিল। সঞ্জিতা তখন সন্দীপকে অনুরোধ করেছিলেন, যদি বাড়িটার কিছু ব্যবস্থা করা যায়। ফল হয়নি। তাই বাড়ির সাথে সাথে সঞ্জিতাও কেবল দিনই গোনেন। এই বুঝি বিপজ্জনক নোটিশ পড়ল বাড়িতে। বেশ কসরত করে নেমে একতলার দিকটায় যেতে হল। সব ঘরে তালা ঝুলছে। একটা ফলক। ‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫ শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে “জন্মদিন” কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন’। কে ফলকটি করিয়েছিলেন সেসব কিছু লেখা নেই। তবে যিনিই করিয়েছিলেন ভারতীয় গণমাধ্যমের ইতিহাসে যে প্রথম লাইভ টেলিকাস্টের ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল এই বাড়ি অন্তত সেই স্বীকৃতিটুকুর লিখিত খোদাইটি করিয়েছিলেন। কালিম্পংয়ে রায়চৌধুরি পরিবারের গ্রীষ্মকালীন আবাস গৌরীপুর হাউস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য৷ অথচ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই স্মৃতি আজ ধূলাচ্ছন্ন৷ আত্মবিস্মৃত বাঙালি নিজের ইতিহাস, নিজের ঐতিহ্য আর গর্বকে যথাযোগ্য মর্যাদায় রক্ষণাবেক্ষণ করতে জানে না৷ নয়ত কালিম্পংয়ের ঐতিহাসিক গৌরীপুর হাউস আজ পোড়ো বাড়ির চেহারা নিত না। সে নিয়ে কারও কোনো দায় নেই, দায়িত্বও নেই৷ গৌরীপুর হাউসের যাঁরা মালিক, কলকাতার সেই রায়চৌধুরী পরিবার কিন্তু বহুবার জানিয়েছিলেন কালিম্পংয়ের মতো জায়গায় প্রায় প্রাসাদতুল্য ওই দোতলা বাংলো বাড়ির সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে তাঁরা অপারগ৷ সরকার যদি চায়, অথবা অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যদি আগ্রহী থাকে গৌরীপুর হাউসকে একটি রবীন্দ্র সংগ্রহশালায় পরিণত করতে তা হলে তাঁরা সাগ্রহে রাজি আছেন৷ অথবা বাড়িটি একটি হেরিটেজ হোটেলেও রূপান্তরিত করা যায়৷ তা হলেও অন্তত রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত ইমারতটি রক্ষা পায়। কিন্তু তখনও পর্যন্ত কিছুই হয়নি৷

কবিগুরু বই পড়ছেন
কবিগুরু বই পড়ছেন

আসলে আমাদের নিত্যদিন, প্রতিমুহূর্তে, অস্থিমজ্জায়, চিন্তায়-মননে যিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন তিনি আর কেউ নন। পরমপ্রিয় অতি আপনজন গর্বের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালিকে দিয়ে গিয়েছেন পরম সম্পদ যা আমরা ফিক্সড ডিপোজিটের মতো ভাঙিয়ে তাঁর নাম জপ করে চলেছি। দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, মংপু, রংপো, রিয়াং, পেদং এগুলো বেশিরভাগই স্থানীয় তিব্বতি বা লেপচা নাম থেকে উদ্ভূত। কিন্তু কালিম্পং এর মত জায়গাতে গৌরীপুর লজ এই নামটা কেন সেই বিষয়ে কৌতূহল ছিল। আসলে কালিম্পং পাহাড়ে এসে চিরসখা রবি ঠাকুরকে নিয়ে ভাবতে গেলে গৌরীপুর হাউস এবং মংপু আমাকে খুব ভাবায়। তাই পাহাড়ি মেঘের মত এই ভাবনাগুলোও উড়ে উড়ে আসে আমার অলস মস্তিস্কে। এরকম বিশুদ্ধ বাংলা নাম তো চট করে এই অঞ্চলের কোনও জায়গার হতে পারে না। জবাবটা পেলাম কালিম্পং এর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মিলনী সঙ্ঘের সভাপতি তথা কর্ণধার দুলাল রায়ের সঙ্গে। দুলালদার কাছ থেকে জানলাম এখানকার জায়গাগুলোর নাম স্থানীয় তিব্বতি বা লেপচা নাম থেকে উদ্ভূত যেখানে ‘ঙ’ বা ং এর উপস্থিতি চোখে পড়ে। আবার নেপাল সীমান্তের কাছাকাছি সুখিয়াপোখরি, জোড়পোখরি, মানেভঞ্জং এই নামগুলো আবার নেপালি। সেক্ষেত্রে গৌরীপুর বলে কালিম্পঙে কোনও জায়গার নামকরণ রীতিমত বেমানান। দুলালদার গ্রন্থসম্ভার থেকে মৈত্রেয়ীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিতে প্রশ্নের উত্তর পেলাম।

“কল্যাণীয়েসু (য়াসু)

বীরেন্দ্রকিশোরের কাছ থেকে তাদের কালিম্পঙের বাড়ি চাবা মাত্র তারা উৎসাহপূর্ব্বক দিয়েছে ………. বউমাকে ডাক্তার দীর্ঘকাল পাহাড়ের হাওয়ায় রাখতে চায়, তাঁর সঙ্গে পরিচারিকা ও অনুচরবর্গ থাকে, এই উপলক্ষ্যে আমার ভগ্ন শরীরের ভার তার উপর দিতে চাই- আমার এখন দরকার মাতৃশুশ্রূষার……………

আসলে গৌরীপুরের বাড়ির সঙ্গে জড়িত আছে এক অন্য ইতিহাস। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বড়মাপের পৃষ্ঠপোষক ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরিরা ছিলেন এখনকার বাংলাদেশের অদূরে ময়মনসিংহের গৌরীপুর এস্টেটের জমিদার। তাঁদের সুবিশাল প্রাসাদোপম বাড়িটির নাম ছিল গৌরীপুর হাউস। সেই অনুকরণেই কালিম্পঙের বাড়িটিরও এই নাম। এখানে ব্রজেন্দ্রের পরিবার গ্রীষ্মাবকাশ যাপনে আসতেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯২৬ সালে ময়মনসিংহের মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরির নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে সেখানে গিয়েছিলেন তখন রায়চৌধুরি পরিবারের সাথে তাঁর আত্মীয়তা হয়। তবে কালিম্পঙে রায়চৌধুরিদের বাড়িটি কবে তৈরি হয়েছিল সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। এই পরিবারের স্বদেশী আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক জগতে ব্যাপক অবদান আছে। বীরেন্দ্রকিশোরের বাবা ব্রজেন্দ্রকিশোর ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক। স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসাবে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনের পত্তন যখন হয়, সেই কাজেও অর্থসাহায্য করেছিলেন ব্রজেন্দ্রকিশোর। এই সংস্থাই বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট ও বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে এই দুটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান একত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দিয়েছে। প্রবাদপ্রতিম সেতারবাদক পণ্ডিত বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির হাত ধরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের প্রতিষ্ঠা। দুলালদার সঙ্গে হাটতে হাটতে চলে এলাম গৌরীপুরের ঐতিহাসিক বাড়িটির কাছে। হেরিটেজ কমিশন নিয়ে নিলেও তখনও সেভাবে কাজ শুরু হয়নি। সেই বাড়ির সামনে পলিটেকনিক কলেজের কাজ হচ্ছিল বলে বালি, পাথর এবং নির্মাণের সামগ্রী ফেলে রাখা হয়েছিল ওই বাড়ির সামনে। মিলনী ক্লাব সেখানে কবি প্রণাম আয়োজন করে প্রতিবছর।

দুলালদার সঙ্গেই এলাম এই গৌরীপুর হাউসের কাছেই অতিশা রোডে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত চিত্রভানুতে। কবির খুব ভালো লাগত কালিম্পং। তাই কালিম্পং-এ স্থায়ী একটি আবাস তৈরি করতে চান কবি। সে বাড়িটির জমি কেনা হবে বলে কবিই স্থান নির্বাচন করে দিয়ে যান। ১৯৪১ সালে কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবীর নামে লিজে নেওয়া হয় জমি। সেখানে নির্মাণের সময় রথীন্দ্রনাথ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নির্মাণ করিয়েছিলেন। পরে বিশ্বভারতীর উপাচার্য হিসাবে রথীন্দ্রনাথ কাজে ব্যস্ত থাকলে প্রতিমাদেবী দীর্ঘদিন সেই চিত্রভানুতে ছিলেন। আর তিনি থাকার সময় চিত্রভানুর লনে তিনি কয়েকবার রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালন করেছিলেন। সেই সময় কালিম্পং টাউন হলে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালিত হলে তাতে উপস্থিত ছিলেন প্রতিমা দেবী। চিত্রভানু তৈরি হয়েছিল কবির মৃত্যুর ঠিক দু’বছরের মাথায়। তাঁর প্রয়াণের পর চিত্রভানুর দেওয়ালে

জঙ্গল আর আগাছায় ঢাকা জরাজীর্ণ স্মৃতিবিজড়িত গৌরীপুর হাউস
জঙ্গল আর আগাছায় ঢাকা জরাজীর্ণ স্মৃতিবিজড়িত গৌরীপুর হাউস

মার্বেল পাথরে কবিতার কয়েকটি লাইন খোদাইও করা হয়। কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথের স্টুডিওর নামে এই বাড়ির নামকরণ হয় চিত্রভানু। এখন যেখানে পাইন ভিউ ক্যাকটাস নার্সারি, ঠিক তার পাশেই চিত্রভানুর গেট। এ জায়গাটার নাম ছিবো বস্তি। গেটের দুদিকে লেখা তারিখ। ২২ শ্রাবণ, ১৩৫০। ৮ অগাস্ট, ১৯৪৩। ২০১১ সালের ভূমিকম্পে সেই বাড়ির অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে প্রতিমা দেবীর ব্যবহার করা টেবিল, চেয়ার, খাট সবই আছে। তাছাড়া কবিগুরুর অনেক হাতের কাজ এখানে আছে। শেষজীবনে রথীন্দ্রনাথের সাথে যখন তাঁর চির-দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে সেসময় প্রতিমা দেবী এখানে এসে দিন কাটিয়ে যেতেন। ছবি আঁকতেন। দুই শিল্পীর স্মৃতিতে ভরপুর গৌরীপুর হাউস এবং চিত্রভানু। এখন রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনস্থ নারী শিক্ষা কেন্দ্র এখানে। এখন রাজ্য সরকারের তরফে মহিলাদের হাতের কাজের কিছু প্রশিক্ষণ হয়। পাহাড়ি মহিলারা হাতের কাজ শেখেন। উপযুক্ত পথেই ব্যবহৃত হচ্ছে চিত্রভানু। গৌরীপুর ভবনটাও যদি কোনোভাবে ব্যবহৃত হতো।

আসলে মংপু হয়ে কালিম্পঙে একরাশ অভিমান আর দায়িত্ববোধ নিয়ে ইতিহাসের ভগ্নস্তূপে এসে পৌঁছেছিলাম একটা হেরিটেজ সফর এবং ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। রবীন্দ্র অনুরাগী হিসাবে আমার দুঃখ, অভিমান আর জেদ নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ক্ষেত্রসমীক্ষা করে মংপু, গৌরীপুর হাউসের হতশ্রী অবস্থা সংক্রান্ত আমার লেখাগুলি এবং ভিডিওগ্রাফির ক্লিপিংস রাজ্য হেরিটেজ কমিটি সহ উত্তরবঙ্গের নির্বাচিত মন্ত্রী, সাংসদ এবং বিধায়কদের কাছে পাঠাবো। কারণ আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ যদি সততার সঙ্গে আঁকড়ে থাকা যায় তাহলে অসীর চেয়ে এখনো মসী বড়ো। সেই বছরেই পুজোর সময়ে কালিম্পং এসে মংপু, গৌরীপুর হাউস, গ্রাহামস হোমকে বেছে নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করি প্রচুর মানুষের ইন্টারভিউ নিয়ে। তৎকালীন মাননীয় পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেব সহ হেরিটেজ কমিটিকে ফাইল পাঠাই এবং অবশেষে মংপু বাংলো, গৌরীপুর হাউসের সংস্কারের কাজ শুরু করে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রখ্যাত ভ্রামণিক প্রাবন্ধিক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের প্রাক্তন সদস্য আনন্দগোপাল ঘোষ সহ আরো অনেক রবীন্দ্র অনুরাগীর সাহায্য সহযোগিতাই সরকারের ঘুম ভাঙাতে হয়তো সাহায্য করেছিল। সেই বিশেষ দিনটায় ফিরতে ইচ্ছা করছিল বারবার। মানসচক্ষে ভেসে উঠছিল ছবিটা- অট্টালিকা চত্বর লোকে লোকারণ্য। পাশে রাখা রেডিও সেট। বিশ্বকবির কণ্ঠ বেজে উঠবে তাতে। একখানা যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী থাকা। আসলে ওই মেলাতে না পারা আর মেলাতে যাবার চেষ্টা করার অসহায়ত্ব, এই দুইয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যা ভাবছি, তা যেন সবই গল্পকথা। ইতিহাস নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তোলা বাঙালির বুঝি এতটা ইতিহাস-বিস্মৃত হওয়া সাজে না।

সামনে থেকে গৌরীপুর হাউস
সামনে থেকে গৌরীপুর হাউস

তথ্যসূত্রঃ পাহাড়ে পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ – রতন বিশ্বাস, পেপার কাটিং (আনন্দবাজার, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, বিভিন্ন ব্লগ, গুগল সার্চ, বঙ্গদর্শন ওয়েব, দুলাল রায় – সম্পাদক, মিলনী ক্লাব, কালিম্পং, শিশির রাউত – মংপু, জলপাইগুড়ি জেলা গ্রন্থাগার, পরিব্রাজক, সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল – ‘দেবতাত্মা হিমালয়’,

বি:দ্র: আলোকচিত্র গুলি প্রদান করেছেন লেখক নিজে।