কাজী রুনালায়লা খানমের কবিতাগুচ্ছ
5/5 - (1 vote)
আমার প্রার্থনা শোনো, প্রিয় বর্ণমালা

শ্রীহরি দত্তের ছবি

আমার প্রার্থনা শোনো,প্রিয় বর্ণমালা
জ্বলে ওঠো আরো একবার
ইতিহাসের পাতা থেকে নয়
আরো একবার সময়ের বৃন্ত থেকে
তুলে আনো একুশের ফুটন্ত সকাল
আরো একটা উনিশে মে র জন্ম দাও তুমি
প্রিয় বর্ণমালা আমার, তুমি তো শুধু কয়েকটি
স্বরবর্ণ কিংবা ব্যঞ্জনবর্ণের সমাহার নও
আমাদের বুকের গভীরে মিশে থাকা
অনন্ত লাবডুব
জীবনের নিবিড় স্পন্দন।
আমাদের হাসি কান্নায়,আমাদের ঘরকন্নায়
লেগে থাকা অলৌকিক জ্যোৎস্নার চন্দন
তুমি সেই অভীষ্ট আগুন
পৃথিবীর সব রঙ, সব আলো নিভে গেলেও
পাঁজরে জ্বেলে রাখো অনন্ত পিদিম।
একুশের ভোর তো শুধু প্রভাতফেরি
কিংবা কোনো স্মরণসভা নয়
একুশের ভোর মানে শিশিরের শব্দের মতোন
মায়ের গলার মিহি সুর
একুশের ভোর মানে প্রপিতামহীর বিশুদ্ধ স্বর
তোমাকে পাঁজরে বহন করার বলিষ্ঠ আত্মম্ভরিতা

শ্রীহরি দত্তের ছবি

তোমাকে বুকে করে তুলে নিতে
সেদিন যারা বন্দুক আর বেয়নেটের সামনে
পেতে দিয়েছিলো অনশ্বর বুক
আরেকবার জন্ম দাও
সেইসব ‘কমলা’ রঙা অগ্নিবলয়
আরেকটা রফিক- সালাম – বরকত
আরো আরো কানাইলাল- চন্ডীচরণ -হিতেন বিশ্বাস।

প্রতিটি মঞ্চে মঞ্চে স্মরণসভায়
আমরা যেই হাতে তাঁদের মাল্যদান করেছি
সেই হাতেই বিক্ষত করেছি
তোমার চেতনাতীত শরীর।
আজ তাই জানু পেতে বসেছি বিজনে

আমার প্রার্থনা শোনো, প্রিয় বর্ণমালা
আমাদের ক্ষয়িষ্ণু আঙুল থেকে
আমাদের মেধাহীন মগজ হতে
আমাদের আলোহীন চোখ হতে
উপড়ে নাও অক্ষম আড়ম্বর
শুদ্ধি দাও,ঋদ্ধি দাও
দাও অক্ষরের অক্ষয় প্রসাদ

ছবি: শ্রীহরি দত্ত 

পয়গাম

আমাকে থাকতে দাও
আরো কিছুকাল
এইখানে
পৃথিবীর বয়সিনী ঘাসেদের কাছে

চৌদিকে ছড়ানো কলার মোচায় টলমলে পা

সুপারি পাতার খোলে দুরন্ত শৈশব

চিত্রদীপ দাশের ছবি

পড়শিনী নারীর ঢেঁকির পাড়ের ছন্দে
দুলে দুলে গাওয়া গান
নতুন চালের গন্ধে ম ম ঢেঁকিঘর
আফাজুদ্দিনের ছাপিজালে
ভেসে ওঠা অজস্র সরপুঁটি মৌরলা
লাঙলের ফলায় মাঠজুড়ে চাষি লেখে ঘাম-গন্ধ ফসলের গান
মানুষ মানুষীর ঘরকন্নার বারোমাস্যা

কনে দেখা আলোর নিচে প্রেমিক পুরুষ
ছুঁয়ে গেছে চিবুকের তিল প্রিয় নারীটির

এইখানে বিন্নি ধানের পাশে
জাতিস্মর পাখিদের ডানা অবিরল
ভোরের গায়ে লেগে আছে
শতাব্দীপ্রাচীন আলো ও আঁধার
নাবিকনীল জলের সুঘ্রাণ

এই বাঙ্ময় নৈঃশব্দ্যের পাশে
থেকে যাবো আরো কিছুকাল

পয়গাম পাঠিয়েছে সাড়ে তিন হাত ভূমি

ছবি: চিত্রদীপ দাশ

হত্যে দিয়ে পড়ে আছি

মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছো
সেই থেকে হত্যে দিয়ে পড়ে আছি তোমার দুয়ারে
আমার তো আর কোথাও যাওয়ার নেই!
দেখবার মতো কিছু নেই! বলবার মতো নেই কিছু
আমার যা কিছু বলার সব তোমাকেই
যা দেখবার শুনবার সব তোমাকে ঘিরেই।

চিত্রদীপ দাশের ছবি

রাজপথে শুয়ে থাকা ছেলেটির
কথা বলবো বলে উসখুস করছি সেই সকাল থেকে
অথচ গলা দিয়ে একটি শব্দও ঠিকরোচ্ছে না
একখণ্ড কাপড় মাথায় জড়ায়নি বলে
এক কোপে মেয়েটার শরীর থেকে খসে গেলো মাথা
আমি নির্বাক রইলাম
ছেলেটা দৌড়োচ্ছে !ছেলেটা সিঁড়ি ভাঙছে!
পেছন পেছন তাড়া করছে একদল হায়েনা
জলজ্যান্ত ছেলেটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো
উলঙ্গ ছাদ থেকে
দেখতে দেখতে সে নিজেই হয়ে উঠলো দীর্ঘ এক মিছিল
অথচ আমি কিছুই দেখছি না!
আমার চোখ বাঁধা অন্য কোনোখানে
ঠোঁট খুবলে নিয়েছে অন্য কেউ
হিমশীতল পাঁজরের নিচে জমে আছে
থিকথিকে গাঢ় খয়েরি অন্ধকার
কার্তিকের মাঠ হয়ে আছে এই করতল
লিভ-ইন পার্টনারের রেফ্রিজারেটরে রাখা
দেহখন্ডের মতোই
জমে গেছে আমার-ঠোঁট-গলা-চোখ- আঙুল
এমনকি ফুসফুসও

এই আমি চোখ থেকে খুলে রাখছি দৃষ্টি
বুক থেকে উপড়ে এনেছি লাবডুব
এই নাও সাড়হীন অক্ষম আঙুল …
শুধু তোমার আলোয় চোখ ধোবো বলে
হত্যে দিয়ে পড়ে আছি আজন্মকাল!
দু চোখের নিচে পোষ মানিয়ে রেখেছি
দুটো দাউ দাউ নদী।

ছবি: চিত্রদীপ দাশ