১
শুকিয়া স্ট্রিট আর সার্কুলার রোডের মোরে স্কুল ফেরতা ঘুগনি খাচ্ছিলো পদা। ঘুগনি ওয়ালার সাথে একটা ছোটখাট বচসাও চলছিল ঝাল কম দিয়েছে বলে। এরি মধ্যে হঠাৎ কাঁধে টোকা। ঘুরে দ্যাখে বাবলু দা। বাবা বলেছে “বাবলুর সাথে তোকে যেন খবরদার না দেখি। ও ব্যাটা ছোটলোক”। কি করে যে বাবা লোক দেখেই ভদ্রলোক আর ছোটলোক বুঝে যায়, পদা সেটা অনেক চেষ্টা করেও ঠিক আয়ত্ত করতে পারে নি। কিন্তু বাবলু দা যেন চুম্বক। পদা চেষ্টা করেও এড়াতে পারে না। চেহারা টা অনেকটা মিনি মিঠুন চক্রবর্তী। বাবরি চুল। বিশাল ঘের ওয়ালা বেল বটম প্যান্ট। গায়ে স্কিন টাইট স্যান্ডো গেঞ্জির মত জামা। চোখে সানগ্লাস। গালের চামড়া পুরো মাখন। খালি হাইট টা একটু কম মিঠুনের থেকে। পদা দেখে আর ভাবে “ইশ, বাইসেপ গুলো যদি বাবলুদার অর্ধেকও হতো, স্কুলের ওই মিষ্টি দুই বেনিওয়ালা রতি বলে মেয়েটা, রতি অগ্নিহতৃর মত গলায় ঝুলতো”! “কিরে এই মাত্র ফিরলি? তোর জন্য সোয়া চারটে থেকে অপেক্ষা করছি”। দোষের মধ্যে বাবলুদার ওই একটাই। স এর দোষ। “হ্যাঁ বাস পেলাম না। হেঁটে ফিরলাম”। “যাকগে সোন, যে জন্য তোকে দরকার, তোদের পাসের বাড়ির ওই মেয়েটার নাম কি রে?” “কোন মেয়েটা?” “আরে ওই যে রে, যেই মেয়েটা রোজ বিকেল বেলা ছাদে কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়!” “কে? সোনালি?” “সোনালি? ওর নাম সোনালি?” “হ্যাঁ, কিন্তু ও তো ক্লাস নাইন এ পরে। তোমার থেকে তো অনেক ছোট!” “ভাগ সালা! ছোট তো কি আছে? ছোটই তো ভাল। বেস নিজের হাতে গড়ে নেবো”। পদা কথা ঘোরাতে চায়। আসলে সোনালি কে তার নিজেরই একটু পছন্দ, যদিও সোনালি ওর থেকে এক বছরের বড়। কথা ঘুরিয়ে বলে “আচ্ছা বাবলুদা, কাল আমাকে জিম এ নিয়ে যাবে তো?” “ধুর! তুই ওসব করে কি করবি? তোর কি এখনো বয়েস হয়েছে নাকি মেয়ে পটানোর? তার থেকে বরং চল, কাল আমার সাথে একটা ইংরিজি সিনেমা দেখতে চল”। “ইংরিজি সিনেমা?” “কেন? বাবা বকবে? আরে, তোর বাবা তো আমার সাথে তোকে দেখলেই বকবে। ইংরিজি সিনেমা দেখিস কি না দেখিস, তাতে কি কিছু এসে যাবে?” কথাটা বাবলুদা ভুল বলেনি। এই জন্যই বাবলুদাকে এত ভাল লাগে। মাথাটা ওর পরিষ্কার। রাজী হয়ে গেল পদা।
পরদিন রবিবার। দুপুরবেলা বই খাতা ব্যাগে ভরে বেরোতে বেরোতে মাকে হাঁক দিলো “মা, আমি বুম্বাদের বাড়ি যাচ্ছি। অনেক হোমওয়ার্ক”। মা উত্তর দেওয়ার আগেই পদা দরজার বাইরে। শরীরে বেশ একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে। জীবনের প্রথম ইংরিজি সিনেমা! বাবলুদা বলে রেখেছে পদা যেন জেম সিনেমার সামনে ঠিক দুটোর সময় অপেক্ষা করে। পদা এক কথায় রাজি। সে জেম সিনেমা চেনে। স্কুল কেটে একবার জেম এ শোলে দেখেছে। 30B বাসে চেপে মৌলালির মোর ছাড়ানোর পর একটা স্টপ। ম্যানেজ হয়ে যাবে ঠিকই। দুটোর একটু আগেই পৌঁছে গেল পদা। সিনেমা হলের সামনেটা লোকে লোকারণ্য। বাবলুদাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। “টিকিট কেটে রেখেছে তো! যা ভিড়!” মনে মনে ভাবে পদা। হঠাৎ নজরে পরে বাবলুদাকে। একটা জটলার মধ্যে ধস্তাধস্তি করছে। পরনে মেরুন রঙের গ্যাবারডিনের প্যান্ট আর একটা বেগুনি আর সাদা চক্কর বক্কর জামা। “বাবলুদা!” বাবলুদা ঘাড় ঘোরালো। ভিড়ের মধ্যে নিজের লাইনটা সামলে হাতের ইশারায় পদাকে কাছে ডাকল। “কিরে, এত দেরি?” “তোমাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না”। “খুঁজে পাচ্ছিলিস না মানে? এখানেই তো ছিলাম। যাকগে, চারটে টাকা দে”। “চার টাকা?” “যা সালা! বিনা পয়সায় সিনেমা দেখবি নাকি? পয়সা আনিস নি?” “হ্যাঁ কিন্তু…” “ঠিক আছে, যা আছে দে” পদা ব্যাজার মুখে তার সবেধন নিলমনি আড়াই টাকা বাড়িয়ে দেয়। হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে। অন্যমনস্কভাবে পদা এইসব ভাবছে, হঠাৎ বাবলুদার আবির্ভাব। তার হাতে গোলাপি টিকিট। “চল। ও ওইদিকটায় দাঁড়িয়ে আছে”। “কে?” বাবলুদা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে চলেছে। পদা তার পেছন পেছন। একটু পিছিয়ে পরেছে সে। অদূরে মেরুন শাড়ি পরা এক মহিলা। বাবলুদা তাকে কিছু একটা বলল। মহিলা ঘুরল। বাবলুদার কনুই ধরে এগিয়ে আসছে। পদা ভিড়ের মধ্যে তাল সামলে যখন মুখ তুলল, তার সামনে তখন সোনালি!
২
সোনালি!একি সেই একই সোনালি? সকাল বিকেল যাকে পদা দেখেছে পিঠে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেতে, বারান্দায় জামা কাপড় শুকো দিতে, কুকুর নিয়ে ছাদে ঘুরতে? একি সেই সোনালি যাকে রাস্তার মোরে ওর ভাই এর সাথে দাঁড়িয়ে মাঝে সাজেই ফুচকা খেতে দেখা যায়? ভাল লাগতো আগে ঠিকই, কিন্তু এ তো সাক্ষাৎ পরি! কি করে পদা একে আগে দেখেনি? শারী পরলেই মেয়েদের এত ডাগর ডগর দেখায়? হাজার প্রশ্নের এই ঝর সামলাতে পদা যখন জুঝছে, তার সমস্ত সুবাস নিয়ে এগিয়ে এলো সোনালি। মিষ্টি হেসে হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে বলল “হ্যালো অনীক, তোমাকে সব সময় দেখি, কিন্তু কথা বলার সুযোগ হয় নি”। অনীক! এ নামে পদাকে সচরাচর কেউ ডাকেনা। শুনে পদার খুব ভাল লাগলো। “সত্যি? তুমি আমাকে দ্যাখো?” বলতে চাইলো পদা, কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। তার ভীষণ আক্ষেপ হতে লাগল যে সে আজ সেজে গুজে আসেনি। কি করে জানবে যে বাবলুদা এই রকম একটা কান্ড করে বসবে! কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ তুলে একটু হেসে সোনালির হাতে হাত ঠেকিয়ে বলল “হ্যালো”! ইতিমধ্যে বাবলুদা কোথায় একটা হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো। দু হাতে দুটো চকলেট আইসক্রিম। “কি ব্যাপার? মুখটা ওরকম মেনি বেড়াল মার্কা করেছিস কেন?” বলে একটা আইসক্রিম সোনালি আর অন্যটা পদার দিকে এগিয়ে দিল। “আমি খাব না” পদার গলাটা এবারে একটু পরিষ্কার হয়েছে। “কি ন্যাকা মাইরি তুই। আইসক্রিম আবার কেউ না করে নাকি?” সোনালিও না বলতে যাচ্ছিল। বাবলুদার কথা শুনে একটু থমকে গেল। তারপর তার গোলাপি জিভ বার করে ধীরে ধীরে আইসক্রিম চাটতে শুরু করলো। অতি সাবধানে, যাতে লিপ্সটিকের ক্ষতি না হয়। পদা হাঁ করে খানিকক্ষণ দেখলো। উফ! শরীরটায় একটা অদ্ভুত কিচুলি বিচুলি ভাব হচ্ছে। পদা বিভ্রান্ত! শেষে চোখ সরিয়ে নিয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল। “চলো, আমার হয়ে গেছে”। সোনালির গলার স্বরে পদার ঘোর কাটলো। তিনজনে সিনেমা হলের গেটের দিকে এগোতে শুরু করলো। বাবলুদা পকেট থেকে চিরুনি বার করে চুল ব্যাকব্রাশ করতে করতে বলল “কিরে, সিনেমায় যাচ্ছিস, সিনেমার নামই তো জানিস না?” “তুমি তো বললে না”। সোনালি একটু আগে যাচ্ছে। সোনালির গায়ে যাতে কারো ছোঁয়া না লাগে তার জন্য বাবলুদা তার দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে সোনালির ঠিক পেছন পেছন তাকে আগলে চলেছে। পাশে পদা। “গন উইথ দা উইন্ড। ঘ্যামা বই। ড্রামা আছে, ফাইটিং আছে, যুদ্ধ আছে। সব পাবি”। তারপর পদার কানের কাছে মুখটা এনে বলল “আর পোচুর ঢলানি আছে। ওই জন্যই তো ওকে নিয়ে এলাম”। বলে মুচকি হাসল। “তা আমাকে আসতে বললে কেন?” “তুই না এলে যে ও আসতো না” পদার মুহূর্তের জন্য কথাটা ভাল লাগল, কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝে নিল ব্যাপারটা। সাময়িক রাগ হলেও মনে মনে মানতে বাধ্য হল যে বাবলুদার জন্যই সোনালির সাথে তার পরিচয়টা আজ হল।
ইতিমধ্যে ওরা হলে প্রবেশ করেছে। সারে তিন টাকার টিকিটের পুরো সেকশনটাতে মাত্র একজন সিট দেখিয়ে দেবার লোক। তাকে ঘিরে ধরেছে জনা শয়েক টিকিটধারী। বাবলুদা বলল “তুই ওর কাছে কাছে থাকতো!” বলে “এইযে দাদা…” হাঁক পেড়ে ঝাঁপিয়ে পরলো ভিড়ে। মিনিট খানেকের মধ্যে ফিরে এল টিকিট চেকারকে বগলদাবা করে। ভদ্রলোক মিনমিনে কণ্ঠস্বরে কি যেন বললেন বাবলুদাকে। শোনামাত্র পদা আর সোনালির হাত ধরে বাবলুদা হুকুম করলো “চলে আয়। আমি জানি কোথায় সিট”। অন্ধকারে অন্যান্য লোকের পা মারিয়ে হোঁচট খেতে খেতে হঠাৎ পদা আবিষ্কার করলো যে সে তার সিটে বসে পরেছে। পাশে বাবলুদা। বাবলুদার ওপাশে সোনালি। ঠিক যেন ম্যাজিক! শান্ত হবার পর ভাবলো একবার বাবলুদাকে বলে “কেন? সোনালিকে মাঝে বসাতে পারো তো? ও তো আমার জন্যই এসেছে!” কিন্তু মনের কথা মনেই রয়ে গেল।
তবে বিধাতা বোধহয় আজ পদার জন্য অন্য পরিকল্পনা করেছেন। সিনেমা শুরু হবার আগে আডভাটিস্মেন্ট চলছে। তার শব্দে ওপাশে বাবলুদা আর সোনালি ফিশফিশ করে কি খুনশুটি করছে তা কান খাড়া রেখেও পদা শুনতে পাচ্ছে না। তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। কি ভাবে ওদের আলাপে ব্যাঘাত ঘটাবে সেই চিন্তায় পদা যখন ব্যস্ত, তখন হঠাৎ বাবলুদা তিড়িং করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর সোনালিকে টপকে ঝুঁকে পরে পাশের ভদ্রলোকের কলার ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে গর্জে উঠলো “এই যে দাদু, বাড়িতে কি বাতি জ্বলে না? সিনেমা হলে এসব কি করছেন? বার করে দেবো?” তারপর কলার ছেড়ে দিয়ে সোনালিকে মৃদু কণ্ঠে বলল “তুমি মাঝখানে বসো”। “ভগবান, তুমি সত্যিই আছো!” ভাবে পদা। মুহূর্তের মধ্যে একটা মিষ্টি গন্ধে ছেয়ে গেল পরিবেশ।
সেই সুগন্ধের নেশায় তলিয়ে গেল পদা। কখন যে সিনেমা শুরু হল, কে যে সেই সিনেমার নায়ক নায়িকা, কি যে সেই সিনেমার কাহিনি, কিছুই পদাকে প্রথম দশ পনেরো মিনিট আর ছুঁলো না। কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে শুধু বুক ভরে গভীর ঘ্রাণ নেয় আর আড়চোখে চুরি করে দেখে। এমনিভাবে কতক্ষণ কাটে পদার খেয়াল নেই। এক সময় সে লক্ষ করলো যে যে ভদ্রলোক নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করছে তার প্রতি সোনালির অপলক আকর্ষণ। লোকটাকে দেখতে খারাপ নয়, তবে চেহারাটা কেমন যেন একটু ষন্ডা মার্কা। একে এত ভালো লাগার কি আছে? তবে মানতেই হবে, ভদ্রলোকের গলাখানা খাশা। সত্যিকারের ম্যানলি যাকে বলে। ইন্টারভেলে বেরিয়ে চট করে পোস্টারে দেখে নিল যে লোকটার নাম রেঠ বাটলার আর তার ভূমিকায় অভিনয় করছে ক্লার্ক গেবেল। মনে রাখতে হবে। সিনেমা চলতে থাকে। বাবলুদা ঠিকই বলেছে। প্রচুর ঢলানি। চুমুর পর চুমু। এরা এত চুমু খায় কেন? ভাবে পদা। একটা খেলেই তো বরং ভাল হতো। কে জানে? সোনালিকে আড়চোখে দেখে একবার। ওর ঠোঁট দুটো বেদানার মত। ওকে চুমু খেলে কেমন হবে? মনে মনে লজ্জা পায় পদা। কান গরম হয়ে যায় তার। শেষে যখন রেঠ বাটলার নায়িকাকে বলল “ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং ডিয়ার, আই ডোন্ট গিভ এ ড্যাম…” তখন দেখলো সোনালির চোখ দুটো চিকচিক করছে। খুব কষ্ট হয়েছিল তখন পদার। মনে হচ্ছিল ওকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
সিনেমা শেষ। ওরা বেরিয়ে এল হল থেকে। বাইরে প্রচণ্ড রোদ আর নতুন শোতে ঢোকবার জন্য লোকের ভীড়। “এই তোরা একটু দাঁড়া। আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি,” বলে বাবলুদা হাওয়া। ওরা দুজনে দাঁড়িয়ে রইল। ভিড়ে জায়গা কম। সোনালির আঁচলটা পদার বুকে ঠেকছে। আবার সেই নেশা ধরানো সুবাস। সোনালির নিঃশ্বাসের ছোঁয়া লাগছে তার গলায়। পদা চোখ বুজে শুধু অনুভব করছে। চোখ খুললেই ওর হাঁটু দুটো কেমন যেন দুর্বল লাগছে। সোনালি যে বড্ড কাছে! এইভাবে কতক্ষণ ওরা দাঁড়িয়েছিলো পদা জানে না। হঠাৎ অনুভব করলো যে তার হাতে আর একটা হাত। নরম তুলতুলে। সোনালির হাত। হয়ত ভুল করে নিজের অজান্তেই সোনালির হাত ধরে ফেলেছে সে। ছিঃ ছিঃ! কি লজ্জা! হাত সরিয়ে নেবার আগেই সোনালির হাতের মুঠো দৃঢ় হলো। পদার দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখে চোখ রেখে সে বলল “মাসিমা সেদিন মা কে বলছিলেন যে তুমি নাকি দারুণ মাউথ অরগান বাজাও। আমাকে শোনাবে একদিন অনীক?”
৩
বেশ কিছুদিন যাবত পদার একদম ঘুম হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ঘুরেফিরে ঘুমের মধ্যে সেই সিনেমার নায়িকা আর সোনালির মুখটা মিলেমিশে এক অদ্ভুত মুখ দেখা দেয়। এমন একমুখ যার চোখে কোনো ভাসা নেই, কিন্তু ঠোঁটের কোনে এক বক্র হাসি। যেন পদাকে ব্যঙ্গ করছে। সেদিনের সেই সিনেমা হলের সোনালির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেদিন সিনেমা থেকে তিনজনে ফিরেছিল ট্রামে করে। পদা আর সোনালি পাশাপাশি বসেছিল। সোনালি আর কোনো কথা বলেনি বিশেষ। হয়ত পদা কিছু বলবে সেই অপেক্ষায় ছিল। আর পদা? সে কথা বলতে চেয়েছিল। অনেক কথা। অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু তার হৃৎপিণ্ড এত জোরে দৌড়াচ্ছিল যে সে মুখ খুলতে সাহস পায়নি। পাছে বেফাঁস কিছু বলে ভাল লাগার আবেশটাকে নষ্ট করে দেয়। তাছাড়া বাবলুদার সামনে সে কিই বা বলবে? পুরো রাস্তা বাবলুদা এন্তার বকবক করে গেল। বেশির ভাগটাই সোনালিকে উদ্দেশ্য করে। পদা লক্ষ্য করেছে সোনালি ভাল করে বাবলুদার কথা শুনছিল না। তার দৃষ্টি ছিল দূরে, অন্যমনস্ক। ট্রাম থেকে শুকিয়া স্ট্রিটের মোড়ে নেমে, বাবলুদা আর রাস্তা পার হলো না। পদাকে একপাশে টেনে কানে কানে বলল “ওকে তুই একটু বাড়ি যাওয়ার পথে ছেড়ে দে তো! ওর মা আমাকে দেখলে আবার ক্যাঁচাল করবে”। পদা খুশি হয়েছিল। অন্তত কয়েকটা মিনিট সোনালির সান্নিধ্যটা একা পাওয়া যাবে। সার্কুলার রোড পার হয়ে দুজনে রামমোহন রায় রোড ধরে হাঁটতে লাগলো। ফেব্রুয়ারি মাস, কিন্তু পদার কপালে ঘাম। সে আড় চোখে একবার সোনালিকে দেখলো। সোনালি মাথা নীচু করে দ্রুতপদে হেঁটে চলেছে। পদা খুব চাইছিল যে সোনালি আরও কিছু বলুক। কিন্তু সোনালি তার ধারে কাছ দিয়ে যায়নি। কেবল নিজের বাড়ির ভেতর ঢুকে যাওয়ার আগে হাত নেড়ে পদাকে “বাই” বলেছিল।
কেন ও আর কিছু বলল না? পদা কি কিছু দোষ করে ফেলেছে? কিন্তু কই? সেরকম তো কিছু মনে পরছে না! পদা তো কোন কথাই বলে নি। তাহলে দোষই বা হবে কি ভাবে? তবে কি সেটাই পদার ভুল? তার কি নিজে থেকে কিছু বলা উচিত ছিল? সোনালিই বা এত চুপচাপ ছিল কেন? হয়ত বা চিন্তিত ছিল বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে বলে। সিনেমাটা তো বেশ লম্বা ছিল; হিন্দি সিনেমার থেকেও বড়। মাকে হয়ত বলে এসেছিল যে ছটার আগে ফিরবে। কোন বান্ধবীকে হয়ত বলে রেখেছিল যে মা জিজ্ঞেস করলে বলবি যে ছটা অব্ধি তোর বাড়িতে ছিলাম। হয়ত বা সে চায়নি যে পাড়ার লোকে দেখুক যে সে পদার সাথে সন্ধেবেলা কোথাও থেকে ফিরছে। কেন? কেন? কেন? এই সমস্ত ভেবে ভেবে পদা প্রতি রাতে খালি এপাশ ওপাশ করে। ভোরের দিকে ক্লান্ত চোখে যখন ঘুম নামে, তখন আবির্ভাব হয় সেই মুখের। কি যে করবে ভেবে কূল কিনারা পায় না পদা। জীবনটার হঠাৎ এ কি হল? দিব্বি তো ছিল!
এই ভাবে কয়েক মাস কেটে গেল। ঘুমের সেই একই দশা। না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শরীরটা সব সময় ক্লান্ত লাগে। চোখের কোলে কালি। মা বারবার জিজ্ঞেস করে “তোর কি হয়েছে?” পদা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মার চোখ এড়িয়ে যায়; বলে “কই, কিছু না তো”। এদিকে সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। পড়াশুনা তো লাটে উঠেছে। এতকাল পদা খুব ভাল রেজাল্ট করে এসেছে। পরীক্ষায় খারাপ হলে নির্ঘাত ধরা পরে যাবে মা’র কাছে। আর বাবা তো চটে তেলেবেগুনে হয়ে যাবে। রেজাল্ট ভাল করে বলে বাবা পদাকে বিশেষ ঘাঁটায় না। কিন্তু এবারে কি হবে? কারো সাথে যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করবে তারও উপায় নেই।
সোনালিকেও আজকাল আর বিশেষ দেখা যায় না। আগে মোটামুটি প্রতিদিন বিকেলবেলা দেখা যেতো সোনালি ওর কুকুর নিয়ে ছাদে খেলা করছে বা পায়চারি করছে। ঘটনার পর প্রথম প্রথম পদা ছাদে উঠে খুব মাউথ অরগান বাজাতো। ভেবেছিল কৃষ্ণের বাঁশির মত তার মাউথ অরগান রাধাকে কাছে এনে দেবে। বাঁশি অনেকদিন বাজলো, কিন্তু রাধা এলো না। এখন আর পদা মাউথ অরগান বাজায় না। কি লাভ? মাসিমা, অর্থাৎ সোনালির মা, মাঝে সাজে ওদের বাড়িতে আসে মা’র সাথে গল্প করতে। পদা আড়ি পেতে ওদের কথা শোনে, যদি সোনালি সংক্রান্ত কোন খবর পাওয়া যায়। কিন্তু কোন উল্লেখযোগ্য খবর এই ভাবে সে উদ্ধার করতে পারেনি। এরই মধ্যে এক ছুটির দিন পদা বেরিয়ে সারকুলার রোডের দিকে যাচ্ছিলো, হঠাৎ তার নজরে পরলো সোনালি উলটো দিক থেকে আসছে। তার পরনে একটা সাদা আর কালো মেশানো সালওয়ার কামিজ। আরো সুন্দরী হয়েছে। পদার হৃৎপিণ্ড যেন ধাক্কা মেরে ওকে ফেলে দেবে। কোনোরকমে সে এগিয়ে চলল। ঠিক যেই মুহূর্তে পদা আর সোনালি একে অপরকে পার হবে, সে মুহূর্তে সোনালি তার গভীর চোখ তুলে চাইলো। পদাকে হঠাৎ সামনে দেখে একটু হকচকিয়ে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বলল “ভাল আছো তো অনীক?” কতকাল পরে পদা আবার সেই কণ্ঠস্বর শুনলো! আবার অনীক! পদা কি উত্তর দেবে ভাবছে, কিন্তু উত্তর দেবার আগেই দেখলো সোনালি তাকে পার হয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। একবার ভাবল পেছন থেকে ডাকে; ডেকে বলে “সোনালি তুমি যে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছো গো, ভাল কি করে থাকবো বল?” কিন্তু এ কথা যে কাউকে বলার নয়; সোনালিকেও নয়।
এমনি করে দেখতে দেখতে দু বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। বাবলুদাকে আজকাল আর এ পাড়ায় দেখা যায় না। গত বছর পুজোর সময় একবার প্যান্ডেলে দেখা হয়েছিল। বলল যে ও নাকি এখন বজবজ লাইনে ট্রেনে হকার। ওর মা এ চত্বরে থাকে বলে পুজোতে এসেছে। সোনালির কথা ও কিছু জিজ্ঞেস করেনি। পদাও কোন উচ্চবাচ্চ্য করেনি। বাবলুদাকে দেখে পদার ওই দিন খুব ভাল লেগেছিল। বাবা যাই বলুক, ছেলেটার মনটা খুব বড়। পদা এখন ক্লাস টেন এ পরে। প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা। ছিপছিপে সুন্দর চেহারা। স্কুলের অনেক মেয়েরাই এখন পদার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু পদার তাতে কোনো উৎসাহ নেই। সে পড়াশুনা করে খুব মন দিয়ে। ক্লাস এইটের রেজাল্ট টা খারাপ হবার পর পদা খানিকটা সামলে নিয়েছে। ঘুম এখনো তার কম হয়, তবে সেই মুখ স্বপ্নে আর দেখা দেয় না। সোনালি কিন্তু এখনও মনের আনাচে কানাচে ঘোরে। মাঝে মধ্যে তার সাথে রাস্তাঘাটে দেখাও হয়ে যায়। তবে সে দেখা আর পাঁচটা মেয়ের সাথে রাস্তায় দেখা হওয়ার মতই। জেম সিনেমার সেই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তটা আজ যেন কত দূরে। মাঝে মাঝে পদা ভাবে সত্যই কি সেই ঘটনা ঘটেছিল? নাকি তার মনের ভুল? সত্যি হোক বা না হোক পদার এখন বোঝবার বয়েস হয়েছে যে সোনালি হয়ত কিছু না ভেবেই কথার কথায় তাকে একদিন মাউথ অরগান শোনাতে বলেছিল। তারপর যে ব্যাপারটা আর এগোয়নি তার জন্য সে আর সোনালিকে দায়ী করে না। আর করবেই বা কোন অধিকারে?
৪
“অনেক রাত হয়েছে বাবা, এবারে শুয়ে পর,” ঘরে এসে উঁকি দিল মা। রাত এখন একটা। সামনের মাস থেকে পদার মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু। সে অনেক রাত জেগে পড়ে। রাত জাগার যে খুব প্রয়োজন তা নয়। আসলে পদার রাত জাগতে ভাল লাগে। গোটা শহরটা যখন ঘুমিয়ে পরে, তখন রাতের আকাশটাকে কেমন যেন মায়াবী লাগে। তারাগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যেন ওরা কিছু বলতে চায়। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পদা মাঝে মাঝে ছাদে চলে যায়। খোলা আকাশের নিচে পায়চারি করতে করতে তার সদ্যঃপ্রাপ্ত ভরাট গলায় গায় “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে…” পদার গানের গলা খুব সুন্দর, যদিও সে কারো সামনে কখনো গান গায় না। মাঝেমাঝে পায়চারি থামিয়ে সোনালিদের বাড়ির দিকের ছাদের কোনটায় দাঁড়ায়। অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সোনালি কি এখন…? নিজেকে জোর করে থামায়। অবশ্য রাত জাগার আরো একটা কারণ আছে পদার। ইদানীং পদা মাঝেমধ্যে এক আধটা সিগারেট খায়। মা শুয়ে পরার আগে খাওয়া যায় না। কেন যে খায় সে নিজেই জানে না, তবে লক্ষ্য করেছে যে খেলে মন্দ লাগে না। “তুমি শুয়ে পরো মা, আমি আর আধ ঘণ্টায় শুয়ে পরবো”। মা চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকলো। পদার কাঁধে হাত রেখে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর যেন হঠাৎ মনে পরেছে সেইভাবে বলল “হ্যাঁরে, পাশের বাড়ির মানুদি বলছিলেন যে সোনালি নাকি সামনের বছর থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স এ কমার্স পরবে”। পদা অবাক হলো। মা হঠাৎ এই কথাটা কেন এত রাতে বলতে এলো? তাহলে কি মা কিছু আঁচ করেছে? কিন্তু আঁচ করবেই বা কি করে? পুরোটাই তো পদার মনের কল্পনা। কে জানে? হয়ত বা মায়েরা নিজেদের সন্তানের কল্পনাটারও হদিস পেয়ে যায়। পদা অবিশ্যি জানে যে সোনালি এক বছর ড্রপ দিয়েছে। কেন তা জানেনা। খবরটা শুনে সে খুশিই হলো। যদিও তার বয়স মোটে ষোলো, তবু এই গত দু বছরে পদা খুব ভালো করেই বুঝে গেছে যে মস্তিষ্কটাকে কাজে ব্যস্ত রাখাটা খুব জরুরি। তাতে মনের কষ্ট কমে। মাকে সে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো “তুমি খুব ভালো, মা। যাও শুয়ে পরো। আমি এক্ষুনি শুয়ে পরবো”।
মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল। পদা স্টার পেলো। সে যে পরিমাণ খেটেছিল, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদিও তার স্কুলে সে প্রথম স্থান পায়নি, তবুও তার রেজাল্ট উল্লেখযোগ্যই বলা চলে। অঙ্কে সে স্কুলের সকলের চেয়ে বেশী নম্বর পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সে সায়েন্স নিয়েই পড়াশোনা করবে। ইলেভেন টুয়েলভ কোন স্কুলে পরবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। পদার ইচ্ছা কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ঢোকার। ইংরিজি সে ভালোই জানে, তবে বলতে গেলে একটু জড়তা। সে জানে যে আজকাল ইংরিজি ভাল করে জানাটা চাকরি বাকরির ক্ষেত্রে আবশ্যক। পদা ঠিক করলো যে বাবার কাছে কথাটা পাড়বে। রেজাল্ট ভালো হওয়াতে বাবার মেজাজ এখন ফুরফুরে। একদিন সুযোগ বুঝে বলল “বাবা, আমি ভাবছি স্কুল চেঞ্জ করবো”। বাবা রাগ করলেন না। ভাল লক্ষণ। “কেন রে?” “না মানে আমাদের স্কুলের সব স্ট্যান্ড করা ছেলেমেয়েরা তো অন্যান্য আরো ভালো স্কুলে চলে যাচ্ছে, তাই”। “তা, কোথায় পড়বি ভাবছিস?” “সেন্ট জেভিয়ার্স”। বাবা এবারে গম্ভীর। “না না, ওটা তো স্কুল নয়, ওটা কলেজ। ওখানে ছেলেপিলেরা খুব তাড়াতাড়ি বখে যায়। যত ট্যাঁশ দের আড্ডা ওখানে”। “কিন্তু বাবা, পাশের বাড়ির…” বলতে গিয়েও পদা থেমে গেলো। এ কি বলতে যাচ্ছিলো সে! “তাহলে আমি কি করবো?” “কেন? ভাল স্কুলে পরতে চাস, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হয়ে যা। হোস্টেলে থাকলে স্বাবলম্বী হওয়াটাও শিখবি”। “কিন্তু আমি যে ভেবেছিলাম ইংলিশ মিডিয়ামে…” “আরে ধুর! ইংরিজি শেখার বয়েস কি পেরিয়ে যাচ্ছে নাকি? কলেজে যখন পড়বি এমনিতেই ইংরিজি শিখে যাবি”। পদা আর কিছু বলল না। বাবার সাথে তর্ক করে লাভ নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলো। সঙ্গে তার একরাশ চিন্তা। অনেকটা হাঁটলো। অবশেষে হেদুয়ার পাশে একটা বেঞ্চে শান্ত হয়ে বসলো। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াটা মন্দ হবে না। আর কথাটা বাবা ভুল বলেনি। ইংরিজি সে ঠিকই শিখে যাবে। নিজেকে বোঝালো যে যে কারণে সে সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়তে চাইছিল সেই কারণটা তো পুরোপুরিই তার মনগড়া, কল্পনার শিশিরে মোড়া। রোদ উঠলেই সব উবে যাবে। সময় এসেছে হয়ত সেই কল্পনার বাঁধন থেকে মুক্তি পাওয়ার। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে—এই পাড়া থেকে দূরে সরে যাওয়াটাই এখন কাম্য। মা অবিশ্যি মন খারাপ করবে। পদারও মা’র জন্য মন খারাপ লাগবে। তবে বাড়িতে তো মাঝেমাঝেই আসবে। এ তো দিল্লি বোম্বাই নয়। অনেকদিন পরে পদার নিজেকে কেমন যেন হঠাৎ স্বাধীন লাগছে। হেদুয়ার জলে ভেসে বেরানো হাঁসগুলোকে সে অনেকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখলো। “আমি তোদের মত হতে চাই; সম্পূর্ণ বাঁধনছাড়া”। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেঞ্চ থেকে উঠলো। বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালো। “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…” মনে মনে গুনগুন করছে সে। আকাশের রংটা আজ গাঢ় নীল। মেঘের লেশমাত্র নেই তাতে।
৫
নরেন্দ্রপুর পদার ভীষণ ভালো লাগছে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ করতো। সব কিছুর অভাব বোধ করতো, বিশেষত মায়ের গন্ধ আর মায়ের হাতের রান্না। এখন তা সয়ে গেছে। এখানকার খাবার দাবার ভালোই বলতে হবে। বাড়ির মত না, তবে বেশ ভাল। কিছু কিছু রান্না—যেমন খিচুড়ি—বাড়ির থেকেও বেশী মুখরোচক লাগে পদার। আস্তে আস্তে অনেকের সাথে বেশ বন্ধুত্বও হচ্ছে। সবাই খুব মেধাবী। তবে সবাই যে বন্ধুত্ব পাতাবার উপযোগী তা নয়। জনা তিনেক খুব ভালো বন্ধু হয়েছে পদার এই আট মাসে। ক্যাম্পাসের পরিবেশটা ভারী ভালো লাগে পদার। এক ফোঁটা নোংরা নেই। রোজ খুব ভোরে ওঠে সে। উঠে ঘণ্টাখানেক ব্যাম করে। বিকেল বেলা ফুটবলও খেলে। তার শরীর এখনও খুব মজবুত। চেহারা আগেই ভাল ছিল, এখন মাথা ঘুরিয়ে দেখার মত। তবে গলার স্বরটা এখনো ক্লার্ক গেবেলের মত হয়নি। মনে হয়না কোনোদিন আর হবে। আজকাল সে আবার মাউথ অরগান বাজাতে শুরু করেছে। নরেন্দ্রপুরের সব থেকে ভালো যেটা পদার লাগে সেটা হলো পড়াশুনার আবহাওয়াটা। শিক্ষকরা খুব যত্ন নিয়ে পড়ান। আর কত কিছু শেখান; জীবন সম্পর্কে, এই জগৎ সম্পর্কে। পদা মাঝেমাঝেই বাবাকে এই জন্য মনেমনে ধন্যবাদ জানায়।
রবিবার দুপুরবেলা পদা নিজের ঘরে দিবানিদ্রা দিচ্ছিল। এই সপ্তাহে সে বাড়ি যায়নি। সামনের সপ্তাহে স্কুলে বড় একটা অনুষ্ঠান আছে বলে। এর মধ্যে তার বন্ধু রাজু এসে ঘুম ভাঙালো “এই অনীক, ওঠ, মহারাজ তোকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তোর খোঁজ করছেন একজন”। “কে?” “একজন অল্প বয়সী মহিলা”। “কি নাম বললেন মহারাজ?” পদা জিজ্ঞেস করলো। রাজু নাম জানে না। পদার ভুরু কুঁচকে গেল। “অল্প বয়েসি মহিলা। কে হতে পারে? তবে কি…”। পরমুহূর্তেই সে নিজেকে থামায়। নিজেকে বোঝালো “তা কেন হতে যাবে?” আর তাছাড়া লিগাল গার্জেন ছাড়া কারো যখন খুশি দেখা করার নিয়ম নেই। যাইহোক, রহস্যটা রয়েই গেল। হৃৎপিণ্ডটা কি বেশি ধুকপুক করছে? তাড়াহুড়ো করে একটা জামা চড়িয়ে নিচে নেমে এলো সে। ভিজিটর রুমের দিকে হাঁটা লাগালো। ঘরে ঢুকে দেখলো সত্যি সত্যিই একজন মহিলা তার জন্য অপেক্ষা করছে। পদার পায়ের শব্দে সে ঘুরলো। অচেনা। পদা তাকে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। বয়স অল্পই। সিঁথিতে সিঁদুর। পদা কিছু বলার আগেই ভদ্রমহিলা গলা অত্যন্ত নামিয়ে বললেন “আপনি কি অনীক রায়চৌধুরী?” “হ্যাঁ”। “গড়পাড়ের পদা?” “হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে…”। “আমাকে আপনি চিনবেন না। আমার নাম মাধবী। কিছু মনে করবেন না, ওনাদের আমি বলেছি যে আমি আপনার জ্যাঠতুতো দিদি আর আপনার জ্যাঠার শরীর খুব খারাপ”। পদা হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলতে পারলো না। তার একমাত্র জ্যাঠা বহুকাল আগে পরলোকগত। মহিলা আবার বলল “আপনি বাবলুদাকে চেনেন তো?” “বাবলুদা?” “হ্যাঁ বাবলুদা। আপনাদের পাড়ায় আগে থাকতো”। “আমাকে প্লিস আপনি বলবেন না। হ্যাঁ চিনি বইকি। কিন্তু বাবলুদার কথা আপনি বলছেন কেন?” “ওঁ আমার স্বামী”। পদা আবার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। সেই সিনেমা দেখতে যাওয়ার দিনটার কথা মনে পরে গেল। বাবলুদার বিয়ে হয়ে গেছে? কই, জানতে পারেনি তো? চিন্তার ঘোর ভাঙলে বলল “বাবলুদা কোথায়? আপনি কেন এখানে এসেছেন?” মহিলার চোখ ছলছল করে ওঠে। কোনরকমে কান্না চেপে বললেন “বাবলুদা তোমাকে একটু দেখতে চেয়েছে”। “দেখতে চেয়েছে মানে? ওর কি হয়েছে?” পদার গলার স্বরে সামান্য উদ্বেগ। মহিলা আর কান্না থামাতে পারলেন না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে যে কাহিনি উনি বললেন, তা শুনে পদা ভীষণ বিচলিত হয়ে পরলো। বাবলুদা বজবজ লাইনের ট্রেনে সেন্ট, আতর এই সব বিক্রি করে সংসার চালাতো। একদিন চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েছিল। তাতে তার বাঁহাতের দুটো আঙুল কাটা গেছে। হয়ত তা সত্ত্বেও সে চালিয়ে যেত, কিন্তু মুশকিল হয়েছে যে হাসপাতাল প্রাথমিক চিকিৎসা করে ছেড়ে দাওয়ার পর কাটা জায়গাটা সারছে না। বোধহয় ইনফেকশন হয়ে গেছে। গত দু-দিন ধরে প্রচণ্ড জ্বর আসছে আরে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। তারই মধ্যে সে বারবার পদাকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। মাধবী প্রথমে পদার বাড়ি গিয়েছিল। সেখান থেকে এখানে ছুটে এসেছে। সব ঘটনা শুনে পদা কি বলবে বুঝতে পারছে না। বাবলুদার আজ এই দশা? তাকে যেতেই হবে। কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলল “আপনি আমাকে কয়েক মিনিট সময় দিন। আমি আসছি এক্ষুনি”। বলে নিজের ঘরের দিকে দৌড় লাগালো। স্যুটকেস তন্নতন্ন করে খুঁজে মাত্র বাহান্ন টাকা পাওয়া গেল। আসলে পদার কাছে টাকা পয়সা বিশেষ থাকে না। টিউশন ফি, খাবার খরচ ইত্যাদি সোজাসুজি স্কুলে জমা পরে যায়। এই কটা টাকা পদার জমানো টাকা। টাকা কটা পকেটে গুঁজে, জুতো মোজা পরে সে আবার দৌড় লাগালো। সে জানে যে ক্যাম্পাস ছেড়ে এই সময় যাওয়া নিয়মভঙ্গ করা হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে বেপরোয়া। যা হবার হবে। পরে দেখা যাবে। “চলুন”। “তুমি না বলেই চলে যাবে? কিছু হবে না?” “ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। চলুন”।
দুজনে রাস্তায় বেরোল। রবিবার দুপুরে রাস্তায় বাস কম। পদা একবার ভাবলো একটা ট্যাক্সি ডাকবে। কিন্তু পরে ভাবলো যে টাকা কটা বাঁচানো দরকার। যদি বাবলুদাকে ট্যাক্সি করে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হয়! নারকোলডাঙ্গার বস্তিতে পৌঁছতে ঘণ্টা দুয়েক লেগে গেল শেষ অব্ধি। কিন্তু কিছু করার ছিল না। বাস থেকে নেমে মাধবী অলিগলির ভেতর দিয়ে পদাকে নিয়ে গিয়ে শেষে এক অন্ধকার ঘরে ঢোকালো। ঘরের দরজার বাইরেই একটা কর্পোরেশনের জলের কল। সেখানে অনেক ভিড়, অনেক কলরব। মাধবী ঘরে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিল। আলো থেকে অন্ধকারে ঢুকে অভ্যস্ত হতে পদার একটু সময় লাগলো। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হওয়ার পর দেখলো যে ঘরের এক কোনে কিছু বাসন কোসন, জলের বালতি ইত্যাদি ছড়ানো। অন্য কোনে একটা বিছানা। সেই বিছানার এক পাশে শুয়ে আছে একটা লোক। ইতিমধ্যে মাধবী পদাকে একটা টিনের চেয়ার টেনে দিয়েছে। নিজে দাঁড়িয়ে। আগে থেকে না জানলে পদা কিছুতেই বাবলুদাকে চিনতে পারতো না। বাবলুদার কপালে হাত রাখলো পদা। কপাল পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। বাবলুদার চোখ বোজা। পদা ডাক্তার নয়, কিন্তু তার অনুভূতি তাকে জানালো যে পরিস্থিতি খুব সঙ্গিন। “একে এক্ষুনি হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া দরকার”। মাধবী এগিয়ে এসে পদার হাত ধরে ফেলল। “তুমি এসেছো এই যথেষ্ট। ওসব করার দরকার নেই। আমি বরং জলপট্টি দিই একটু। জ্বরটা নেমে গেলেই ও চোখ খুলবে। তারপর তুমি চলে যেও। রাতে না ফিরলে তোমার হস্টেলে অনেক ঝামেলা হবে”। এই দ্বিতীয়বার কোনো মেয়ে পদার হাত ধরলো। প্রথমবার সে লজ্জা পেয়েছিল। হাত ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছিল। আজও সেই মুহূর্তটা ভুলে উঠতে পারে নি। কিন্তু এইবার সে হাত ছাড়ালো না। উল্টে মাধবীর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল “তা হয় না। বাবলুদা আমার দাদা। আপনি ওকে রেডি করুন। আমি ট্যাক্সি ডাকতে যাচ্ছি”।
ট্যাক্সি নীলরতন সরকার হসপিটাল এর দিকে ছুটে চলেছে। পদা ড্রাইভারের পাশে। পেছনে মাধবীর কোলে মাথা রেখে বাবলুদা শুয়ে আছে। তার এখনো হুঁশ নেই। পাড়ার লোক ডেকে কোলে করে তাকে ট্যাক্সিতে তুলতে হয়েছে। পদার মন বারবার চলে যাচ্ছে পুরনো দিনগুলোতে। এই সেই বাবলুদা যে ওকে সাইকেল চড়া শিখিয়েছিল। ঘুরি ওড়ানো শিখিয়েছিল। কি চেহারা ছিল আর এখন কি হয়েছে। মাধবীর সাথে ওর আলাপ, বিয়ে এসবই বা কবে হলো? কীভাবে হলো? এইসব নানা চিন্তা ওর মস্তিষ্কের মধ্যে পাক খেতে থাকলো। একবার পেছনে তাকালো। দেখলো মাধবী বাবলুদার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে জানালার বাইরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো চিকচিক করছে। কান্না চেপে আছে নিশ্চয়ই। বহুদিন আগে আর একজনের চোখ এরকম চিকচিক করতে দেখেছিল। সাদা কালো এই জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়! ভাবে পদা। কোথায় সেই সিনেমা আর কোথায় এই বাস্তব জীবন। বাবা ঠিকই বলেছিল। পদা যেন হঠাৎই আজ বড় হয়ে উঠলো!
ছবির সংরচনা ড্যাল-ই-এর মাধ্যমে এবং প্রোক্রিয়েট দিয়ে স্কেচ করেছেন সৌরভ রায়চৌধুরী