সাদা কালো – ২য় পর্ব
5/5 - (1 vote)

প্রথম পর্ব


পদার দৌলতে বাবলুদা একটুর জন্য বেঁচে গেছে। সেদিন যদি আর একটু দেরি হতো তাহলে হয়ত বাঁচতো না। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর সেদিন ইমার্জেন্সির ডাক্তার মাধবীকে খুব বকুনি দিয়েছিল। “এতদিন কি করছিলেন? আগে আনতে পারলেন না?” তারপর গলা একটু নরম করে বললেন “এখন কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছি। রাতটা পার না হলে কিছুই বলতে পারছি না। কাল যদি দেখা যায় যে জ্বর কমেনি, তাহলে হয়ত কবজি থেকে হাতটা কেটে বাদ দিতে হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সেটা সফল নাও হতে পারে। ইনফেকশনটা কোনো ভাইটাল অরগানএ ছড়িয়ে পরেছে কিনা বলা খুব কঠিন”। শুনে মাধবী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবি  সাদা কালো ২-১“ওনার কোনো দোষ নেই। আমারই দোষ,” পদা এগিয়ে এসে বলেছিল। ডাক্তার কী বুঝলেন কে জানে, শুধু ভুরু কুঁচকে পদার দিকে একবার তাকিয়েছিলেন। সেদিন রাতটা পদা হাসপাতালে কাটিয়েছিল। মাধবী আর সে একই বেঞ্চের দুই প্রান্তে বসে। নিজের জন্য নয়, মাধবীর জন্য ঈশ্বরের কাছে অনেক প্রার্থনা করেছিল পদা। ভোরের দিকে ঘুমে নেতিয়ে পরেছিল। যখন চোখ খুলল, মাধবী তার পাশে নেই। নার্স বলল যে সে বাবলুদার কাছে গেছে। পদা ভয় পেয়ে দৌড় লাগালো। তাহলে কি বাবলুদা শেষ? বাবলুদার বেডের পাশে পৌঁছে দেখলো যে মাধবী বাবলুদার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে। বাবলুদা চোখ খুলে তাকিয়েছে। এখনো কথা বলার শক্তি নেই, কিন্তু পদাকে দেখামাত্র পরিচিতির হাসি দিয়ে তার চোখ দুটো যেন বলল “আমি ভাল হয়ে গেছি রে!” “তুমি ঘুমচ্ছিলে বলে আমি আর ডাকিনি,” পদার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মাধবী বলেছিল। পদা মাথা নেড়ে মৃদু হেসে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছিল। তার কাজ শেষ। হোস্টেলে ফিরে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। পদা রাতে ফেরেনি বলে থানা পুলিশ হয়েছিল। বাবাকে খবর দিয়ে আনানো হয়েছিল। মহারাজ শান্ত হয়ে পুরো ব্যাপারটা শুনলেন। “তোমার উচিত ছিল আমাদের জানিয়ে যাওয়া। কাজটা ভাল করোনি অনীক”। পদা মাথা নীচু করে শোনে। কিছু বলে না। সে খানিকটা অনুতপ্ত সকলকে এত চিন্তার মধ্যে ফেলার জন্য, তবে তার কিছু উপায় ছিল না। মহারাজও বোধহয় সেটা উপলব্ধি করেছেন। পদার বাবা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। মহারাজ তাঁকে মাঝবাক্যে থামিয়ে বললেন “আপনি রাগ করবেন না মিস্টার রায়চৌধুরী। সত্যি কথা বলতে, ওর পরিস্থিতিতে পরলে আপনিও হয়ত একি কাজ করতেন”। কথাটা শুনে বাবা চুপ করে গেল। “আজ অনীক যেটা করেছে সেটাই আমরা আমাদের ছেলেদের বরাবর শেখানোর চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু সেটা বাক্যেই থেকে যায়। অনীক আজ সেটাকে কাজে পরিণত করে দেখিয়েছে। এতে আমার খুব গর্ব বোধ হচ্ছে জানেন!” এই কথার ওপর বাবা আর কিছু বলার জোর পায়নি। চলে যাওয়ার আগে শুধু পদাকে আলিঙ্গন করেছিল। বাবার চোখে কি জলের আভাস দেখা দিয়েছিল সেদিন?

বাবলুদা এখন সেরে উঠেছে। ভাল আছে। সে এখন একটা স্টেশনারি দোকানে কাজ করে। পদার বাবাই চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছে। এ কাজে শারীরিক পরিশ্রম অনেক কম। মাধবীও এখন একজন বয়স্ক মহিলার দেখাশোনার কাজ করে। আয় বেড়ে যাওয়াতে ওরা এখন আর বস্তিতে থাকে না। নিজেদের ভাড়া বাড়িতে থাকে। বাগমারি ব্রিজের কাছে। পদা যখন বাড়িতে আসে, মাঝে সাজে দেখা করতে যায়। ওদের সাথে পদার সময় কাটাতে খুব ভাল লাগে। মনে হয় যেন নিজেরই দাদা বৌদি। একদিন বাবলুদা হঠাৎ বলল “হ্যাঁরে, সোনালি কেমন আছে?” বলে পদার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। পদা বাবলুদার চোখ এড়িয়ে গেল। “সোনালি কে?” মাধবী প্রশ্ন করলো। “বাবলুদাকে জিজ্ঞাসা করো। ওর পুরোনো প্রেমিকা” পদা জবাব দিল। “আমার পুরোনো প্রেমিকা না তোর?” বাবলুদা এবারে সোজা হয়ে উঠে বসেছে। পদা কোনো জবাব দিচ্ছে না। জবাব সে দিতে চায় না। দিতে গেলেই ধরা পরে যাবে। “তুই কি ভাবিস আমি কিছু লক্ষ্য করিনি? কিছু বুঝিনি? সেদিন জেম সিনেমা থেকে ফেরার পথে তুই যে ভাবে ওর দিকে তাকাচ্ছিলিস, সে তাকানোর একটাই মানে হয়”। পদা দেখলো যে সে কোণঠাসা হয়ে পরেছে। মরিয়া হয়ে বলল “ধ্যাত! কি যে বল!” বাবলুদাও ছাড়বার পাত্র নয়। “সে তুই মানবিনা ঠিক আছে, কিন্তু আমি অত বোকা নই বুঝলি। ওই জন্যই তো ওইদিন তোকে বললাম ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে”। বাবলুদা আবার পদাকে অবাক করলো। মাধবী এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সব শুনছিল। খুব মজা পেয়েছে সে। মিষ্টি হেসে বলল “সত্যি অনীক?” পদা আর চেপে রাখতে পারলো না। “ওই একদিনেরই ব্যাপার। তারপর আর কিছু হয়নি। যাকগে, বাদ দাও, ওসব নিয়ে আর ভাবতে চাই না”। শেষ কথাটা বলতে গিয়ে পদার গলার স্বর একটা অন্য রূপ নিলো। বাবলুদা পদাকে খানিকক্ষণ মাপলো, তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বলল “জীবনে কিছু কিছু জিনিষ চাইলেও ভোলা যায় না রে”। তারপর গলার স্বর হালকা করে বলল “চল আমরা খেয়ে নিই”। পদার সেদিন মনটা খুব হালকা লেগেছিল। এই সমস্ত ঘটনার একমাত্র সাক্ষী তো বাবলুদাই। তার কাছে এতদিন এই ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখে সে হাঁপিয়ে উঠেছিল।

পদা এখন ক্লাস টুয়েল্ভএ পড়ে। পূজোর ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। মহাষ্টমীর সন্ধ্যা নেমে আসছে। বাড়িতে সে একা। অভ্যাসবশত সে ছাদে উঠে এসেছে। আকাশের রঙটা আজ সিঁদুরে লাল। তারই মধ্যে বেগুনি রঙের শরতের কয়েকটা ছোট্ট মেঘের টুকরো। তারা যেন মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পরেছে। ছাদ থেকে বাড়ির গলি, ওপাশের রাস্তা সব পরিষ্কার দেখা যায়। এরই মধ্যে অনেকে সেজেগুজে রাস্তায় বেরিয়ে পরেছে। বাচ্চারা এন্তার ক্যাপ ফাটাচ্ছে। পাড়ার প্যান্ডেল থেকে মাইকে কিশোর কুমারের গান ভেসে আসছে “আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো, আমার স্বপ্ন হয়ে কাছে দূরে যেখানেই থাকো…”। আজ পদার মনটা খুব বিষণ্ন লাগছে। ছাদের হাওয়া আর গানটার সুর মিলেমিশে যেন এক হয়ে গেছে। পদা পায়চারি করতে থাকে। একসময় হঠাৎ তার নজরে পড়লো সোনালি নিজের বাড়ি থেকে বেরচ্ছে। দূর থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, তবে অষ্টমীর সাজ সে সাজেনি। তার পরনে সাধারণ ঘরোয়া একটা চুরিদার, হাতে একটা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। নিশ্চয়ই দোকানে যাচ্ছে। হয়ত এক্ষুনি ফিরবে আবার। যতক্ষণ না সোনালি দৃষ্টির বাইরে গেল, পদা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলো। আবার পায়চারি শুরু করলো। মিনিট খানেক পরে পায়চারি থামিয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এল। একটা সুন্দর পাজামা পাঞ্জাবী পরলো। চুলটা পরিপাটি করে আঁচড়ালো। পদাকে ঠিক রাজপুত্তুরের মত দেখাচ্ছে। মুখ না দেখলে বোঝা যায় না যে মাত্র সতেরো বছরের একটা ছেলে। চওড়া কাঁধ, বলিষ্ঠ দেহ। রাস্তায় নেমে সোনালি যেদিকে গেছে, গলির সেদিককার মুখে দাঁড়িয়ে পদা অপেক্ষা করতে লাগলো। সোনালির জন্য অপেক্ষা। কিন্তু কেন সে নিজেই জানে না। মিনিট পনেরো কেটে গেলো। পদা ছটফট করতে লাগলো। ঘনঘন ঘড়ি দেখছে। তাহলে কি সোনালি সে আসার আগেই ফিরে এসে বাড়িতে ঢুকে গেছে? কিংবা গলির অন্য দিক দিয়ে ঢুকেছে বাড়িতে? এই সব চিন্তায় যখন সে মগ্ন, দেখলো সোনালি ফিরছে। মাথাটা সামান্য এক দিকে হেলানো। চুল খোলা। হাওয়ায় উড়ছে। মুখ ঢেকে যাচ্ছে বারবার। সে বাঁহাত দিয়ে চুল ঠিক করার চেষ্টা করছে। সক্ষম হচ্ছে না। পদা গিয়ে সোনালির পথ আটকে দাঁড়ালো। প্রায় ধাক্কা লেগে যাচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে সোনালি মুখ তুলে চাইলো। পদাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গিয়ে চিনতে পেরে থমকে দাঁড়ালো। “একি অনীক! তুমি বাড়িতে কবে এলে? এখানে দাঁড়িয়ে? কারো জন্য অপেক্ষা করছো?” পদা এক মুহূর্ত সময় নিলো, তারপর সোনালির দিকে সোজা তাকিয়ে বলল “হ্যাঁ তোমার জন্য অপেক্ষা করছি”। “আমার জন্য? কি ব্যাপার বলতো? বাড়িতে কিছু হয়েছে?” সোনালি খুব স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করলো। “না তোমার সাথেই কথা ছিল”। পদার কন্ঠস্বরে হয়ত কিছু একটা ছিল। সোনালি গম্ভীর হোলো। পদার দিকে তাকিয়ে বলল “কি? বলো”। “তুমি আমার সাথে আজ ঠাকুর দেখতে যাবে?” সোনালি এক মুহূর্ত সময় নিল। যেন সে নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। তারপর মিষ্টি করে হেসে বলল “তা হয়না অনীক!” বলে পদাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পদার যতক্ষণে হুঁশ ফিরলো ততক্ষণে দেখলো সোনালি নিজের বাড়ির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। পদা চোখে অন্ধকার দেখছে। সে হয়ত ভারসাম্য হারিয়ে এক্ষুনি রাস্তায় পড়ে যাবে। তার কান ঝাঁঝাঁ করছে। এ সে কি করলো! এতদিনেও সে কি করে বুঝতে অক্ষম হোলো কেন রেঠ বাটলার সোনালিকে এত আকর্ষণ করে? রেঠ বাটলার যে নিজেকে মেয়েদের দিকে ছুঁড়ে দেয় না। দৌড়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো পদা। নিজের ঘরে ঢুকে ছিটকিনি আটকে দিল যাতে কেউ বিরক্ত না করতে পারে। বাইরে ঢাক ঢোল পিটিয়ে মহাষ্টমীর পুজো শুরু হয়েছে। পদা ঘরের আলো নিভিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে তার ছ-ফুট দেহটাকে এলিয়ে দিলো বিছানায়। তার সতেরো বছরের নরম মনটা আর সহ্য করতে পারলো না জীবনের এই নিষ্ঠুরতা। পদা কাঁদলো। অনেকক্ষণ ধরে। যে আশার ছোট্ট পাখিটাকে এতদিন সে যত্ন করে পুষে রেখেছিল, আজ তার মৃত্যু হোলো। পদা কাঁদবে না’ই বা কেন?


সেই ঘটনার পর দু বছর কেটে গেছে। এই ধরনের ঘটনা মানুষ চট করে ভুলতে পারে না, তবে সময়ের সাথে সাথে তা খানিকটা ফিকে হয়ে যায়। পদারও তাই হয়েছে। মাঝে মাঝে তার মনের গভীর থেকে প্রশ্ন আসে “আশার পাখিটাকে কেন মারলে অনীক? বেশ তো ছিল!” সে নিজেকে নিজেই উত্তর দেয় “বেশ কোথায় ছিল? যে প্রায় মৃত তাকে বেশী দিন বাঁচিয়ে রেখে কি লাভ?” কিন্তু সে জানে যে উত্তরটার মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে।
পদা এখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিক্স অনার্সের ছাত্র। বাবার খুব ইচ্ছা ছিল যে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পরে। তবে পদাকে ইঞ্জিনিয়ারিং জিনিসটা খুব একটা আকর্ষণ করে না। বড্ড কাঠখোট্টা লাগে তার। নরেন্দ্রপুরে পড়াকালীন পদার পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি একটা টান জন্মায়। মূলত সত্যেন্দ্রনাথ বসু সম্পর্কে জেনে। তখনও পদা কোয়ান্টাম ফিজিক্স বিষয়ে বিশেষ কিছুই বোঝে না বা জানে না। কেবল স্কুলের লাইব্রেরিতে ফিজিক্সের বই ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে তার হঠাৎ একদিন নজরে পরে এই ভদ্রলোকের নাম। তার নামের সাথে যুক্ত বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আল্বার্ট আইন্সটাইন এর নাম। শুধু তাই নয়, দুজনের নাম দিয়ে নামকরণ হয়েছে পদার্থ বিজ্ঞানের একটি মুখ্য প্রণালি—বোস-আইন্সটাইন স্ট্যাটিস্টিক্স। তার নামেই সৃষ্টি হয়েছে বোসোণ শব্দটি। সমস্ত তথ্য জানার পর পদার মনে এক অদ্ভুত শিহরন জাগে। কলকাতারই ছেলে। উত্তর কলকাতায় পদারই বাড়ির কাছে থাকতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা করেছেন। অথচ সমস্ত বিশ্বের লোক এক বাক্যে তার নাম জানে। মানুষটিকে কোনোদিন চেনেনি, জানেনি, কিন্তু গর্বে ভরে গেল পদার বুক। এরপরই সে মনস্থির করে নেয় যে পদার্থ বিজ্ঞানেই তার স্থান। প্রথম প্রথম পদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আপত্তি ছিল না। বিশেষত বাবা যখন চায়। মহারাজের সাথে কথা বলে জেনেছিল যে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করলেও পরবর্তীকালে পদার্থবিজ্ঞান জড়িত গবেষণার সুযোগ থাকবে। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে দুর্গাপুজোর সেই ঘটনার পর পদার আর মানসিক বল ছিল না যে ছ’মাসের মধ্যে জয়েন্ট এন্ট্রেন্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে সেই পরীক্ষায় ভাল ফল করবে। অতএব সেই পরিকল্পনাকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হয়েছিল। উচ্চমাধ্যমিকে পদার ফল ভালোই হয়েছিল। ততদিনে সে একটু সামলে উঠেছে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিক্সের এন্ট্র্যান্স পরীক্ষাতেও ভালো ফল করেছিল। পরে জেনেছিল যে সে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল। অতএব ফিজিক্স অনার্সে অ্যাডমিশন পেতে তাকে বেগ পেতে হয়নি।
সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবি  সাদা কালো ২-২প্রেসিডেন্সি কলেজ পদার খুব ভালো লাগছে। নরেন্দ্রপুরের থেকেও বেশী। এই কলেজের প্রতিটা ইট পাথরের মধ্যে একটা ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে কোয়ান্টাম ফিজিক্স ক্লাসে পদা অন্যমনস্ক হয়ে পরে। প্রফেসর আর সত্যেন্দ্রনাথের মুখটা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। সত্যেন্দ্রনাথের সে মোটে দু একটা ছবি দেখেছে বইয়ের পাতায়। তা সত্ত্বেও। প্রেসিডেন্সিতে ঢোকার পর মুশকিল তবে একটা হয়েছে। পদাকে এখন আবার বাড়িতে থাকতে হয়। সেটা পদার ভাল লাগে না। যে পাড়ায় ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে সেই পাড়াতে থাকাটা এখন একটা ভীতিতে পরিণত হয়েছে। যদি আবার সোনালির মুখোমুখি হয়ে পরে? একদিন হয়েও ছিল। পদা মুখ নীচু করে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল। এখন তার আত্মসম্মান বোধ খুব প্রখর। আবার পরে গেলে আর যে উঠতে পারবে না সে তা জানে।
কলেজে পদার অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে। সে দেখতে সুন্দর বলে অনেক মেয়েই তার বন্ধু হতে চায়। পদা সেটা বোঝে। তাদেরই মধ্যে একজনের নাম নন্দিতা। নন্দিতা পদার থেকে একেবারেই আলাদা। বড়লোক পরিবারের মেয়ে। সল্টলেকে বিরাট বাড়ি। বারো বছর বয়েস অবধি বড় হয়েছে আমেরিকায়। তার চলনবলন কথাবার্তা সবই খুব সাবলীল, খুব স্মার্ট। তার মত মেয়ে সচরাচর উত্তর কলকাতার বাঙ্গালিয়ানার মধ্যে মানুষ হওয়া বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পরা কোন ছেলের ধারে কাছে ঘেঁষবে না। কিন্তু নন্দিতা অন্যরকম। সে আমেরিকা থেকে সে দেশের ভালো কিছু শিক্ষা সঙ্গে করে বয়ে এনেছে। কাউকে ভাল করে না জেনে না বুঝে পক্ষপাতিত্ব দেখানো বা সেই মানুষটাকে বিচার করা সে একদম পছন্দ করে না। নন্দিতা ইকোনমিক্স এর ছাত্রী। পদার সাথে তার আলাপ হয় ঘটনাচক্রে। একদিন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিতে পদা কলেজ থেকে সবে বেরিয়েছে। বেরোনো মাত্র ঝড়ের ঝাপটায় তার ছাতা গেছে উল্টে। পদা যখন ছাতা সামলাতে ব্যস্ত, তখন একটা সাদা টয়োটা গাড়ি থামল তার সামনে। জানালা নামানো। জানালার ওপাশ থেকে একটি মেয়ে জোড়ালো কন্ঠে বলল “তুমি ফিজিক্স অনার্স না? কোথায় থাকো তুমি?” “গড়পার” উত্তর দিল পদা। “গড়পার? সেটা কোথায়?” প্রতিপ্রশ্ন এল গাড়ির ভেতর থেকে। “মানিকতলার কাছে”। “ও আচ্ছা। আমি তো মানিকতলা ফুলবাগান হয়েই যাব। তুমি চাও তো ছেড়ে দিতে পারি”। পদা একটু ইতস্তত করলো। মেয়েটাকে সে চেনে না। তবে আন্দাজ করা শক্ত নয় যে প্রেসিডেন্সিতেই পড়ে। গাড়ির ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলো যে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই। “ঠিক আছে,” বলে সামনের দরজা খুলে উঠতে যাচ্ছিল। “ওখানে নয়। পেছনে চলে এসো। পদা পেছনে উঠলো। উঠে কোনোরকমে ছাতাটাকে গুটিয়ে বলল “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সরি! আমার জামাটা একেবারে ভেজা। আপনার সিটে জল পরছে”। “আরে, বৃষ্টিতে তো জল পরবেই। ওতে কিছু এসে যায় না। বাই দা ওয়ে, বলতে ভুলে গেছি, আমার নাম নন্দিতা। আমি ইকো অনার্স”। পদা কোন উত্তর দিল না। কেবল একটা ধন্যবাদের হাসি। লক্ষ্য করলো যে মেয়েটার গায়ের রঙটা একটু চাপা, কিন্তু মুখটায় প্রচণ্ড বুদ্ধির ছাপ। আর হাসলে অস্বাভাবিক সুন্দর একটা টোল পরে গালে। “তুমি প্লিজ একটু ওকে বুঝিয়ে দাও তোমার বাড়িটা কোথায়”। পদার খুব আশ্চর্য লাগছে যে মেয়েটা বিনা দ্বিধায় ওকে প্রথম থেকেই তুমি বলে সম্বোধন করছে, অথচ ও আপনি থেকে বেরোতে পারছে না।

সেই প্রথম দেখা। সময়ের সাথে সাথে পদা নন্দিতার ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে। নন্দিতা মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারে। পদাকে সেটাই আকৃষ্ট করে। তার অনেক বন্ধু। পদা তাদের মধ্যেই একজন। তাদের বন্ধুত্বে কোন স্ত্রী-পুরূষের ভেদাভেদ নেই, নেই কোন ঘনিষ্ঠতা। শুধু আছে একে অপরের ওপর অগাধ বিশ্বাস। নন্দিতাকে পদা সব মনের কথাই বলতে পারে। একটা কথা বাদ দিয়ে।
একদিন কলেজের পর পদা, নন্দিতা, আর পদার নরেন্দ্রপুরের বন্ধু রাজু মিলে ঠিক করলো যে ধর্মতলা এলাকায় গিয়ে একটা সিনেমা দেখবে। হয়ত সিনেমা দেখার পর একটা রেস্তরাঁয় ঢুঁ দেবে। রাজুও ফিজিক্স অনার্স। ঘটনাচক্রে জানা গেছে যে নন্দিতা আর রাজু নাকি দুঃসম্পর্কের ভাই বোন। পদার এখনো মনে আছে রাজু কথাটা পেড়ে ঠাট্টা করে নন্দিতাকে বলেছিল “কি মাইরি! ভেবেছিলাম তোর সঙ্গে প্রেম করব! আবার নতুন করে মেয়ে পটাতে হবে!” সবাই এই কথায় খুব প্রাণ খুলে হেসেছিল। পদার নিজেকে সেদিন খুব ভাগ্যবান মনে হয়েছিল; এরকম কয়েকজন বন্ধু পাওয়াতে। কলেজ থেকে বেরিয়ে ওরা তিনজন হাঁটতে শুরু করল। জানুয়ারি মাসের হালকা শীত। হেঁটে বেশ আরামই লাগে। হাঁটতে হাঁটতে ডালহৌসি ছাড়িয়ে গেছে যখন ওরা, তখন রাজু বলল “কি সিনেমা দেখছি আমরা?” “এ পাড়ায় এসেছি যখন একটা হলিউডের সিনেমাই দেখা উচিত” মন্তব্য করলো পদা। সে হলিউড সিনেমা দেখতে ভালোবাসে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার কৌতূহল তার ইদানীং খুব বেড়েছে। এই সমস্ত সিনেমা দেখলে সেই কৌতুহল খানিকটা তৃপ্ত হয়। “কি কি চলছে?” নন্দিতার প্রশ্ন। “নিউ এম্পায়ারএ টাওয়ারিং ইনফারনো, লাইটহাউসে কি চলছে জানি না, আর গ্লোবে গন উইথ দ্যা উইন্ড” উত্তর দিল রাজু। “সবই আমার দেখা,” নন্দিতা বলল “তবে গন উইথ দ্যা উইন্ড আমি হাজার বার দেখতে পারি”। “ঠিক হ্যায়, তাহলে গ্লোবেই চলো সবাই” রাজু বলল। পদা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরলো। “টাওয়ারিং ইনফারনো দেখলে হয় না? অন্যটা আমার দেখা”। ঠিক হোলো যে যেহেতু রাজু আর নন্দিতার দুটোই দেখা, আর পদার টাওয়ারিং ইনফারনো দেখা নয়, ওটাতেই যাওয়া হবে। কিন্তু নিউ এম্পায়ারে পৌঁছে দেখা গেল যে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। পরের শো অনেক দেরিতে। উপায় নেই দেখে সবাই গ্লোবের দিকে এগোতে যাবে, হঠাৎ পদা বেঁকে বসলো। “আমি যাব না। তোরা যা”। “কেন?” প্রশ্ন করলো নন্দিতা। “বললাম তো, আমার দেখা”। “তাতে কি হয়েছে? আমার তো বহুবার দেখা। আমি তো তাও যাচ্ছি”। “আমার ভাল লাগছে না। তোরা যা”। “কেন তোর কী হয়েছে?” নন্দিতা নাছোড়বান্দা। “আমি যাব না, তোরা যা”। “তুই আগে বল তোর কি হয়েছে”। পদা হঠাৎ রেগে গেল। নন্দিতার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলো। “আমার কিচ্ছু হয়নি। বললাম তো যাব না। আমাকে একা ছেড়ে দে”। পদার গলা উঁচুতে ওঠার দরুন আশেপাশের লোকজন এখন ওদের দেখছে। নন্দিতা আর কথা বাড়ালো না। রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল “চল”। বলে পদাকে ছেড়ে এগিয়ে গেল। পদা খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের যাওয়াটা দেখলো। তারপর আস্তে আস্তে রাস্তায় পা রেখে ফুটপাথের কিনারায় উবু হয়ে বসে পরলো। চোখ বুজে মুখ ঢাকলো নিজের হাতের পাতায়।


সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবি  সাদা কালো ২-৩কলকাতায় বছর খানেক হোলো পাতাল রেল চালু হয়েছে। কিন্তু পদার এখনো চড়া হয়ে ওঠেনি। তার বাড়ি গড়পার থেকে কলেজ স্ট্রিট সে বেশির ভাগ দিন হেঁটেই চলে যায়। হাঁটতে পদার খুব ভাল লাগে। স্বাস্থ্যের পক্ষে তা ভালো তো বটেই, সব থেকে বড় কথা এই হাঁটার সময়টুকু পদার সম্পূর্ণ নিজের। এই সময় নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে সে। সত্যি কথা বলতে, পাতাল রেলে চড়ার প্রয়োজন সে কখনো বোধ করেনি। এক রবিবার ভোর বেলা উঠে পদা গেল ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে। সারাদিন সেখানে কাটানোর পর, বিকেল বেলা যখন বাড়ি ফিরছে তখন হঠাৎ তার মনে হোলো বাসে না ফিরে মেট্রোতে ফিরলে কেমন হয়? বন্ধুবান্ধবদের কাছে পদা আগেই শুনেছে যে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির সবথেকে কাছের স্টেশান হোলো রবীন্দ্র সদন। কলকাতা শহরের দক্ষিণ ভাগের রাস্তাঘাট পদা সেরকম ভালো চেনে না। রাস্তায় দু একজন ট্যাক্সি ওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে মোটামুটি একটা ধারণা করে নিয়ে পদা রবীন্দ্র সদনের দিকে হাঁটা লাগালো। দরকার হলে আবার রাস্তায় জিজ্ঞেস করে নেবে। হাঁটার তো এইটাই সুবিধা। তবে সেদিন মেট্রো স্টেশান খুঁজে পেতে পদাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। মিনিট কুড়ির মধ্যেই সে স্বচ্ছন্দে স্টেশনে পৌঁছে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে পাতালে নেমে পদার তাক লেগে গেল। এই ধূসর কলকাতা শহরে এ কী সৃষ্টি! সত্যি দেখার মত। ঝকঝক করছে স্টেশান। কোথাও এক ফোঁটা নোংড়া নেই। সব কিছু সাজানো গোছানো; মনে হচ্ছে যেন সে বিদেশি ম্যাগাজিনের পাতার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে মনে আজ সে ইঞ্জিনিয়ারদের সামনে মাথা নত করলো, তাদের মূল্যটা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করলো। মনে মনে ভাবলো যে মাকে নিয়ে এসে একদিন চড়াতেই হবে। এইসব ভাবতে ভাবতেই ট্রেন এসে পরলো। রবিবার বলে ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা। পদা সিট পেয়ে গেল। জানালার বাইরে কিছু দেখার নেই, তাই পদা কম্পার্টমেন্টেরই সামনের দিকে চেয়ে রইলো। তার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে সে ট্রেনের গতিটা মাপার চেষ্টা করছে। ময়দান স্টেশনে কয়েকজন যাত্রীর মধ্যে এক যুবক যুবতীও উঠেছে। ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। হঠাৎ একটা গলার স্বরে পদার ঘোর কাটলো। প্রথমে পদা তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। আবার মনোযোগ দিয়ে শুনলো। হ্যাঁ, সে ঠিকই শুনেছে। এ গলার স্বর সে ভুল করতে পারে না। কথোপকথনটির শব্দ আসছে তারই কম্পার্টমেন্টের অন্য প্রান্ত থেকে, কম্পার্টমেন্টের পেছন দিকটায়। যুবক যুবতীর আলাপ আলোচনা। চাপা স্বরে। কিছু কিছু শব্দ ও বাক্যের অংশ বিশেষ ইংরেজিতে। প্রেমালাপ না হলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই যুবক যুবতীর নিছক বন্ধুত্বের উর্ধেও একটা সম্পর্ক আছে। পদা ভাবছে কি করবে। কানে শুনেছে ঠিকই কিন্তু চোখে না দেখলে সে নিশ্চিত হতে পারছে না যে তার অনুমান ঠিক কিনা। আবার ঘুরে তাকাতেও তার দ্বিধা হচ্ছে। যদি চিনে ফেলে? পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে যখন ট্রেন থামল, পদা উঠে দাঁড়ালো। ভাবটা এমন করলো যেন সে নেমে যাবে, কিন্তু নামার বদলে সে সিট বদল করে অন্য একটা সিটে বসলো—এমন একটা সিট যেখান থেকে সে ঘাড় ঘুরিয়ে অনায়াসে যুবক যুবতীকে দেখতে পাবে, কিন্তু তারা তাকে চট করে চিনতে পারবে না। ট্রেন যখন আবার চলতে শুরু করলো, সুযোগ বুঝে পদা আস্তে আস্তে কায়দা করে তার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো। তার অনুমান সঠিক। সোনালি! পরনে পাশ্চাত্য কায়দার একটা নেভি ব্লু ব্লাউজ আর জিন্স। চুল খোলা। অপূর্ব দেখাচ্ছে তাকে। তার সঙ্গের যুবকটিও যথেষ্ট সুপুরুষ। হয়ত পদার মত অতটা নয়, তাও। পদার খুব ইচ্ছা করছিলো আরো কিছুক্ষণ সোনালিকে দেখতে, কিন্তু সে ঝুঁকি সে আর নিল না। যদিও তার গন্তব্য স্টেশন ছিল গিরীশ পার্ক, সে সেন্ট্রাল স্টেশনে তড়িঘড়ি করে নেমে গেলো। সোনালির সামনাসামনি হওয়ার ভীতি সে আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
এই ঘটনার পর বছরখানেক কেটে গেছে। পদা এখন ফাইনাল ইয়ারে। কর্নেল ইউনিভারসিটির পদার্থ বিজ্ঞানের এক অধ্যাপকের সাথে তার অনেকদিন যাবত চিঠি আদান-প্রদান চলছে। ভদ্রলোক এখনো কোনো কথা দেননি, তবে জানিয়েছেন যে GRE পরীক্ষায় পদার ফল যদি ভাল হয়, তাহলে তার ছাত্রবৃত্তি পাওয়ার একটা ভাল সম্ভবনা আছে। পদা শীঘ্রই GRE পরীক্ষায় বসবে। সেই পরীক্ষার জন্যই পদা এক ছুটির দিন সকালে পড়াশুনা করছিলো। মা এসে দরজায় দাঁড়ালো। “আজ সন্ধ্যেবেলায় কি তুই বাড়িতে থাকবি?” “হ্যাঁ সেরকমই তো প্ল্যান। কেন বলতো?” মা কি যেন একটু ভাবলেন। “আমাকে একটু পাশের মানুদিদের বাড়িতে নিয়ে যাবি?” পদা একটু অবাক হোলো। “সে তো তুমি একাই যেতে পারো। আমাকে কেন যেতে বলছো?” মা বেশ খানিকটা ইতস্তত করে তারপর বললেন “শুনলাম সোনালির শরীরটা খুব খারাপ। তুই গেলে ওর সাথে একটু কথা বলতে পারবি”। পদার মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তার দৌড় শুরু হোলো। সোনালির শরীর খারাপ? কিন্তু মা ব্যাপারটাকে এত সিরিয়াসলি নিচ্ছে কেন? শরীর খারাপ তো সকলেরই হয়। তাহলে কি আরো কিছু আছে এর মধ্যে যেটা মা বলতে চাইছে না? কিন্তু পদা গিয়েই বা কি করবে? তার সাথে কথা বলে সোনালির কীই বা লাভ হবে? সোনালির তো প্রেমিক আছে। সে আসে না? মা সম্ভবত এসব জানেও না। “কি হয়েছে ওর?” পদা প্রশ্ন করলো। “তা তো জানি না। মানুদি খুব কাঁদছিলেন। বললেন মেয়েটা সারাদিন বাড়িতেই থাকে। কোত্থাও যায় না। কারো সাথে কথা বলে না। খালি শুয়ে থাকে”। অদ্ভুত ব্যাপার! কি হয়েছে সোনালির? পদা ভাবতে থাকে। “ঠিক আছে আমি নিয়ে যাব তোমায়”। মা খুশী হলেন। একটু হেসে বললেন “সাতটা নাগাদ যাব তাহলে”। পদা ঘাড় নাড়লো ।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে পদার বুকের ধুকপুকানিও বাড়তে থাকলো। সে সোনালিদের বাড়িতে গিয়ে কি করবে? সোনালিকে সে কি বলবে? সোনালিই বা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে কেন, যেখানে সে কারো সাথে কথা বলেনা? অথচ সোনালির কি হয়েছে সেটা জানারও তার প্রচণ্ড কৌতূহল। একবার নিজেকে বোঝালো যে গিয়ে স্রেফ বসার ঘরে মা’র সাথে বসে থাকবে, তারপর চলে আসবে। এতে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কি আছে? কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হোলো যে ওরা যদি ওকে সোনালির ঘরে ওর সাথে একান্তে দেখা করতে পাঠিয়ে দেয় তাহলে? পদার ছটফটানি বাড়তেই থাকলো। শেষে আর না থাকতে পেরে বিকেল চারটে নাগাদ সে বেরোলো। বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। সে লক্ষ্য করেছে যে হাঁটলে তার মনটা শান্ত হয়। হাতিবাগান, শ্যামবাজা্‌র, সব ছাড়িয়ে অবশেষে সে পৌঁছালো গঙ্গার ধারে বাগবাজার ঘাটে। সন্ধে হয়ে গেছে কিন্তু গঙ্গার জলে তখনো ছোট-ছোট কিছু ছেলে-মেয়ে দাপাদাপি করছে। সেই মুহূর্তে পদার ইচ্ছা করলো ওদের মত হয়ে যেতে। পদা ঘাটের সিঁড়ির ওপর বসলো। দূরে গঙ্গার বুকে কয়েকটা বজ্রা ভেসে রয়েছে। আর কয়েকমাস পরেই পদা বিদেশে চলে যাবে। সোনালিও তার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরবে। এই সময় আবার নতুন করে মনটাকে নাড়া দাওয়ার কি প্রয়োজন? সাধারণ অসুখ করেছে হয়ত, নিশ্চয়ই শিজ্ঞির ঠিক হয়ে যাবে। মা হয়ত বিনা কারণেই ব্যাপারটার গুরুত্ব বাড়াচ্ছে। কিংবা হয়তো ওর প্রেমিকের সাথে মন কষাকষি হয়েছে। সে তো আকছার হয়েই থাকে। এই সব ভেবে পদা ঠিক করলো যে সে আর যাবে না সোনালিদের বাড়ি। গেলেই আশা। আশা মানেই আশার মৃত্যু।
রাত দশটায় পদা বাড়ি ফিরলো। খানিক পর মা’র আবির্ভাব হোলো। পদা যে মাকে নিয়ে যায়নি সোনালিদের বাড়ি সে নিয়ে মা কোন কথাই বলল না। শুধু বলল “খাবি না?” মা’র দিকে পদা তাকাতে পারলো না। অন্যদিকে তাকিয়েই বলল “একটু কাজে আটকে পরেছিলাম মা। আমি সরি। কাল তোমায় ঠিক নিয়ে যাব”। “তার আর দরকার হবে না। আমি একা একাই দেখা করে এসেছি” বলে মা ঘুরে দরজার দিকে এগুলো। পদা আর থাকতে পারলো না। “কেমন আছে ও?” “ভাল নেই”। ভাল নেই? ভাল নেই মানে? কি হয়েছে? পদার মনে আবার হাজার প্রশ্ন। “কি হয়েছে ওর?” প্রশ্ন করলো পদা। “তা তো জানিনা। সেরকম কিছু বলল না ও। খালি বলল ‘একটা খারাপ ছেলের পাল্লায় পড়েছিলাম মাসিমা। চিন্তা কোরো না। আস্তে আস্তে আমি ঠিক হয়ে যাব’। মেয়েটার জন্য মায়া লাগে। এত হাসিখুশি ছিল!” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা পদার ঘর ছেড়ে চলে গেল। পদা পাথর হয়ে বসে রইল।


মে মাস। প্রচণ্ড গরম পরেছে কলকাতায়। বিকেল চারটে নাগাদ পদা বাড়ি থেকে বেরোল। আকাশটা একটা ফ্যাট ফ্যাটে সাদা রঙ। তাতে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। পদা যাবে নন্দিতার বাড়ি। সল্ট লেকের লাবনী অঞ্চলে। নিউ এম্পায়ার সিনেমার সামনের সেই ঘটনার হপ্তা খানেকের মধ্যেই পদা আর নন্দিতার মিটমাট হয়ে গিয়েছিল। পদা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। ক্ষমার বিনিময়ে অবশ্যই সোনালি সংক্রান্ত সমস্ত ঘটনা তাকে খুলে বলতে হয়েছিল নন্দিতাকে। একদিন কলেজের সিঁড়িতে বসে অনেকটা সময় নিয়ে পদা সোনালির সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে শুরু করে দুর্গাপুজোর ঘটনা অব্ধি সব কাহিনি নন্দিতাকে খুলে বলল। নন্দিতা খুব মন দিয়ে শুনলো। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল কোনো কথা না বলে। পদা উদ্গ্রীব হয়ে রইলো নন্দিতার বক্তব্য শোনার জন্য। বেশ খানিকক্ষণ পর নন্দিতা বলল “আই ডোন্ট ব্লেম হার অ্যাট অল। আমার তো মনে হয় পুরোটাই তোর মনগড়া। প্লাটোনিক! আই থিঙ্ক ইউ নিড টু মুভ অন”। পদার এই কথাগুলো মোটেই পছন্দ হোলো না। মুভ অন বললেই করা যায় নাকি? সে অনেক চেষ্টা করেছে। আজও করে চলেছে। অবশ্য সে জানে যে সে নিজেই এক সময় ভেবেছিল যে জেম সিনেমার ওই মুহূর্তগুলো, সোনালির সেই মাউথ অরগান শোনানোর আবদার, ওগুলোর কোনোটারই কোন গূঢ় অর্থ নেই। কিন্তু অন্যের মুখে একই কথা শুনতে ওর আঁতে লাগলো। পদা অবশ্য কোন জবাব দেয়নি। চুপ করে ছিল। কাউকে চোখের সামনে দুবেলা উঠতে বসতে দেখলে ভুলে যাওয়াটা অনেক বেশি কঠিন। পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলে বোঝা যায়না সেটা কত কঠিন। তবে এবারে সে সাগর পারি দিয়ে বিদেশে চলে যাবে। মুভ অন করাটা অনেক সহজ হবে।
শেষ অব্ধি কর্নেল ইউনিভারসিটিতেই পড়তে যাচ্ছে পদা। ফিজিক্সএ পিএইচডি। তার গবেষণার বিষয় হবে কোয়ান্টাম কনফাইনমেন্ট। যে প্রফেসরের সাথে অনেকদিন ধরে যোগাযোগ পদার, সেই প্রফেসর জোন্সই পদাকে একটা ভালো ছাত্রবৃত্তি পাইয়ে দিয়েছেন। সাধারণত আগস্ট অথবা সেপ্টেম্বর মাসে নতুন ছাত্ররা শুরু করে, কিন্তু বৃত্তির চিঠিপত্র দেরিতে আসাতে পদার ওই সময় যাওয়া সম্ভব হবে না। ভিসার অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতে দেরি হয়ে গেছে। সে পরের বছর জানুয়ারি মাসে আমেরিকা যাত্রা করবে। বাবা খুব খুশী হয়েছেন। মা’র অবশ্য খুব মন খারাপ। এখন থেকেই কাঁদেন আড়ালে।
কাঠফাটা রোদে পদা এগিয়ে চলল শুকিয়া স্ট্রিট বাস স্টপের দিকে। পৌঁছে একটা আডভার্টাইজমেন্ট বোর্ডের ছায়ায় দাঁড়ালো। বিকেল হয়ে গেছে কিন্তু অস্বাভাবিক গরম বলে রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। কয়েকটা বাস ধুঁকে ধুঁকে চলেছে। বাসে গোনাগুনতি কয়েকটা লোক। পদা দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, তার বাস আসার কোন নাম গন্ধ নেই। একটু পরে বেরলেই বোধহয় ভাল হতো। কিন্তু নন্দিতা বারবার শাসিয়েছে “আমি কিন্তু ঠিক ছটায় বেরিয়ে যাব টিউশানিতে। এক মিনিট দেরি করলে আমাকে আর পাবি না”। পদা তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে। পরশু সকালে সে ভিসার জন্য আমেরিকান কন্সুলেটএ যাবে। তাই একটা জরুরি কাগজ নন্দিতার কাছ থেকে নিতে হবে। পদা ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইল বাসের জন্য। কোন উপায়ও নেই। এখান থেকে নন্দিতার বাড়ি হেঁটেও যাওয়া যায় না। একবার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশটা এখনো সেই ফ্যাটফ্যাটে সাদা। তবে দূর দক্ষিণ দিগন্তে মনে হোলো যেন একটা সামান্য কালচে আভাষ। ঘড়ি দেখলো একবার। ৪:৫০। নন্দিতার বাড়িতে কি আর ছটার মধ্যে পৌঁছানো যাবে? মনে হয় না। হঠাৎ পদার মনে পরলো যে মা’র জন্য একটা প্রেসারের ওষুধ কিনতে হবে। ফুরিয়ে গেছে। আজ রাতেই দরকার। পদা মনস্থির করলো যে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে বরং ওষুধটা এখনই কিনে নেবে। বাস যদি আসে তো আসবে। এমনিতেও দেরি হয়ে গেছে। সে সারকুলার রোডের বাঁদিক বরাবর দক্ষিণ মুখো হয়ে রাজাবাজার সাইন্স কলেজের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে পেছনে তাকিয়ে দেখছে তার বাস আসছে কিনা। দক্ষিণ দিগন্তটা এখন সত্যিই ঘন কালো রূপ নিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন একটা কালো সৈন্যবাহিনী তীব্র বেগে ধেয়ে আসছে সাদা সৈন্যবাহিনীকে আক্রমণ করতে। পদা আকাশের দিকে চোখ রেখে এগিয়ে চললো। কি অপূর্ব এই মেঘের খেলা। আর দু মিনিটের মধ্যেই পদা ওষুধের দোকানে পৌঁছে যাবে। এর মধ্যেই হাওয়ায় একটা সামান্য ভেজা ভেজা ভাব। মেঘ ডাকতে শুরু করেছে।
সৌরভ রায়চৌধুরীর ছবি  সাদা কালো ২-৪ঠিক যেই মুহূর্তে পদা ওষুধের দোকানে ঢুকলো, ঠিক সেই মুহূর্তে বিকট শব্দে বাজ পরলো আর মুশলধারে বৃষ্টি শুরু হোলো। পদা ওষুধের দোকানের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ সেই বৃষ্টি উপলব্ধি করলো। পদার গায়ে ছাঁট লাগছে, কিন্তু তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কি আরাম! মাটি থেকে একটা সোঁদা সোঁদা মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে। খানিক বাদে যখন বৃষ্টির প্রবলতা কমলো, তখন পদা দোকানের ভেতর ঢুকল। এ দোকান তার জানাশোনা। নিয়মিত ওষুধ কেনে এখানে। দোকানের মালিক মিত্রবাবু খালি বললেন “খুব বাঁচলাম জানো। আর পারা যাচ্ছিল না। এক সপ্তাহ না দু সপ্তাহের দেবো?” পদা আঙ্গুলের ইঙ্গিতে এক দেখালো। ওষুধ নিয়ে যখন সে দোকান থেকে বেরোলো, তখন সাদা কালো মিলে মিশে আকাশের রঙ ধূসর হয়ে গেছে। অদূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এখনো মেঘ ডাকছে মাঝে সাজে। বৃষ্টি অনেক কমে গেছে। তবে এখনো টিপিটিপি করে পরছে। আজ আর নন্দিতার বাড়ি গিয়ে লাভ নেই। পদা গড়পার রোডের দিকে অগ্রসর হোলো। সে সবে কয়েক পা এগিয়েছে, হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এলো “অনীক!” পদা গলার স্বর চিনতে পেরেছে। সে ভাব করলো যেন ডাকটা শোনেনি। এগিয়ে চলল। আবার ডাক “অনীক! দাঁড়াও”। পদা এবারে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। পেছন ফিরলো না। কয়েক মুহূর্ত পর হাঁপাতে হাঁপাতে এল সোনালি। সে বোধহয় পদাকে ধরার জন্য দৌড়াচ্ছিল। এসে পদার একেবারে মুখোমুখি দাঁড়ালো। “কি ব্যাপার? তোমাকে কতবার ডাকছি। শুনতে পাও নি?” পদা দেখলো যে সোনালি আজ একটা কালোর ওপর সাদা ফুল কাটা স্কার্ট পরেছে, আর ওপরে একটা ধবধবে সাদা জামা। বৃষ্টির জলে জামাটা কয়েক জায়গায় ভিজে গেছে। “শুনতে পেয়েছি, কিন্তু…” “কিন্তু কি?” পদা এক মুহূর্ত সময় নিল। নন্দিতার কথাটা মনে পড়ে গেল। আই নিড টু মুভ অন। “ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং,…” পদা তার বাক্য শেষ করতে পারলো না। সোনালি তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো “কি?” পদা লক্ষ্য করলো যে বৃষ্টিতে সোনালির চোখের পাতাগুলোও সামান্য ভেজা। তার মসৃণ গালে মুক্তোর মত কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা। “দ্যাট ইউ ডোন্ট গিভ আ ড্যাম? বলেই ফেলো। আমি কিচ্ছু মাইন্ড করবো না”। বলে মুখ নিচু করলো সোনালি। পদা কি বলবে? সে কি করে বোঝাবে যে এই ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং আর রেঠ বাটলারের ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং এক নয়। সে বলতে চেয়েছিল ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, তুমি কাছে এলেই যে আমার সমস্ত কিছু ওলোট পালোট হয়ে যায়। নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তাই তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তা আর বলতে পারলো না। সোনালির দিকে তাকিয়ে শেষে বলল “না, তা নয়”। সোনালি কি বুঝলো পদা তা কোনোদিন জানতেও পারবে না। হয়ত পদার ভেতরের আবেগ তার গলার স্বরে ধরা পরেছিল। সোনালি মুখ তুলে সরাসরি পদার চোখের দিকে তাকালো। পদা দেখলো যে এই সোনালি আর সেই চতুর্দশ বয়েসি জেম সিনেমার সোনালি এক নয়। এই সোনালি পরিপূর্ণ যুবতী। এর চাহনিতে একটা মায়া আছে, এর গলার স্বরে একটা আত্মবিশ্বাস আছে। এত বছরে পদার অজান্তে তারও হয়ত খানিকটা আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। এবার সে আর চোখ সরালো না। সোনালি মিষ্টি করে হাসল। তারপর পদার হাতটা নিজের নরম হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল “চলো। আমরা একটু হাঁটি”। দক্ষিণ আকাশে তখন তুলোর মত ধবধবে সাদা কয়েকটা নতুন মেঘ এসে হাজির হয়েছে। পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম আলো ঠিকরে পরছে তাদের গায়ে।
।সমাপ্ত।

ছবির সংরচনা ড্যাল-ই-এর মাধ্যমে এবং প্রোক্রিয়েট দিয়ে স্কেচ করেছেন সৌরভ রায়চৌধুরী