সুবিমল মিশ্র লেখক হতে আসেননি। লেখা নামক ক্রিয়া–প্রক্রিয়াকে নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে এসেছিলেন। লেখক হয়ে ওঠার বদলে কীভাবে চলতে পারে আগামী শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অক্ষরের চাষাবাদ তা নিয়ে জমি প্রস্তুত করে একের পর এক ফসল ফলিয়েছেন। সেই বীজতলা তিনি পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে আয়ত্ত করেছেন। হুট করে সেই উৎপাদিত শষ্যের ভাগ নেওয়া যাবে না অর্থাৎ হুট করে সুবিমল ভুবনে ডুব দিলে মণিমুক্তার বদলে শ্যাওলা শামুকই মিলবে। লেখা যেমন প্রবাহমান প্রক্রিয়া তেমনি পাঠচর্চাও অনুশীলন নির্ভর। ফলে ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো’, ‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি’ থেকে আর কিছু আয়ত্ত করলে ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’ আখ্যানে প্রবেশ করা যাবে। এতকাল সুবিমল নিজের নামকরণ করলেও, নামকরণে ‘অথবা’ শব্দ প্রয়োগ করলেও এবার পাঠকের উপরই দায়িত্ব দিয়েছেন। অপশন হিসেবে কিছু নাম বাতলে দিয়েছেন। পাঠক এর বাইরে যদি অন্য নাম গ্রহণ করতে চায় তাও বরণীয়। পাঠক আপনি, ক্রেতা আপনি, বই আপনার তাই সুবিমলের নয়টি নামের বদলে অন্য নাম যদি মাথায় ঘুরপাক খায় তাও বরণীয়।
সুবিমল মিশ্র বাংলা সাহিত্যের একমাত্র লেখক যিনি নিজের বিরুদ্ধে কলম ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন—‘সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল এবং উস্কানিমূলক অনেক কিছুই, আপাতভাবে’। সময়ের সঙ্গে, কালের অনুপাতে পূর্বের ধ্যান ধারণা ভেঙে যায়, বহুক্ষেত্রে বদলে যায় কিন্তু একজন লেখক মোহের বশে পূর্বের বাতকর্ম নিয়েও বাজি ধরতে প্রস্তুত। চেতনার অদল-বদল ঘটলেও লেখা নামক ক্রিয়ার মোহিনী মায়ায় আচ্ছন্ন। সুবিমল সেই মোহ ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই নিজেকে বাজি ধরতে প্রস্তুত ছিলেন। এই যে সুবিমলের এতসব টেকনিক, ভাষার অন্তর্বলয় নিয়ে ঘাত-প্রতিঘাত, অক্ষরের ব্যায়াম, নিজেকে লেখকের আসনের সেভ জোন থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিষয়ের বিপ্লব, সমান্তরাল ঘটনা অপেক্ষা অসমান্তরাল ঘূর্ণিতে প্রলয় ঝড় তা বাংলা সাহিত্যের অচেনা ভুবন নির্মাণের জন্য। জটিল জীবনের বর্ণমালা, ধর্ষণের এপিসোড, সিস্টেমের বানচোদগিড়ি, প্রতিষ্ঠানের ন্যাকামিপনা ওই খুকুগদ্যে চলতে পারে না। অন্তত সুবিমল চলতে দিতে নারাজ। সুবিমলের সেইসব অ্যাটোমবোম সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক ও গভীর বীক্ষণজাত মনন কর্মের ফসল। যদিও সেই বীক্ষণকে গ্রহণ করতে, বরণ করতে বাংলা লেখক-পাঠক এখনও অক্ষম। নইলে সুবিমলকে ঘোষণা করে লিখতে হত না—‘সুবিমল মিশ্র কোনও কারণেই অর্ধমনস্ক মানসিকতা প্রার্থী নয়’। এই আত্মঘোষণা দ্বারাই স্পষ্ট হয় বঙ্গীয় পাঠকের মানসিক অবস্থান। প্রচলিত পাঠক, প্রতিষ্ঠানের পাঠক, সিলেবাসের পাঠ, নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলের পাঠকের জন্য সুবিমল নয়। সুবিমল পাঠক নির্মাণ করেন। সেই গুটিকয়েক পাঠকই সুবিমলের নন্দনকাননের মালি, সৌন্দর্য উপভোক্তা ও ফসল নিড়ানির শ্রমিক। হ্যাঁ সুবিমল বুঝতে গেলে পাঠককে শ্রমিক হতে হবে, হাড়ভাঙা মানসিক পরিশ্রম করতে হবে। সুবিমল আপনাকে কিছু খাইয়ে দেবে না, খাবার উপযুক্ত করে দেবে না, ফসলক্ষেত ঘুরে ঘুরে খাদ্যরসদ বের করে আনতে হবে। যদিও সুবিমল আত্মনির্মাণের বয়ান হিসেবে জানান দিয়ে গেছেন—
“এ এক সময়–কোলাজ, সময়–মাত্রা, কাট কাট করে, নিজস্ব পদ্ধতিতে, ‘লেখা’ থেকে ‘নির্মাণ’ কথাটা এখানে বেশি সংগত। ব্যাপকভাবে নিজের ডাইরিও কোলাজ করা হয়েছে, কাট, এই একই পদ্ধতিতে। বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন মাত্রার লেখা, সংবাদের, মন্তব্যের, ব্যাখ্যারও কোলাজ নিয়ে নিয়ে, নিজস্ব কাট–আপ এ, বের করে বের করে এ নির্মাণ, আসলে যা একটা অকেস্ট্রা তৈরির প্রচেষ্টা পেয়েছে মাত্র, এখানে লেখকের ভূমিকা সামান্য, প্রাধান্য গ্রন্থকের। তার নিজস্ব ডাইরিকে, ডাইরি লেখার পদ্ধতিকে, মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে অমসৃণ, বের করে আনার চেষ্টা হয়েছে তৃতীয় একটি মাত্রা, যেখানে লেখক গৌণ, সময় আপনাকে আপনি সৃষ্টি করে চলেছে, লেখককেও।” (ওয়ান পাইস ফাদার মাদার, বইপত্র সংগ্রহ—৮, গাঙচিল সংস্করণ ২০১৭, পৃ. ৩৮৯)
সুবিমল মিশ্র বাংলা আখ্যান ভুবনের এক সীমান্ত সৈনিক, অতন্দ্র প্রহরী। মাথায় তুলে বরণ করে নেওয়ার মতো এক অক্ষর সেনানায়ক। আজও গুটিকয় মানুষ বাদে বৃহত্তর লিটল ম্যাগাজিন সুবিমলকে নিয়ে যে নীরব তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় আমাদের অক্ষরচর্চা কেবল উৎসব ও প্রচার সর্বস্ব। সেলফ আইডেন্টিটি গড়তে প্রস্তুত সম্পাদক কোনোদিন সুবিমলকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। কেননা দল ভেঙে যাবার ভয় আছে। সম্পাদকসত্তা আউটসাইড হয়ে যাবার সংশয় আছে। এখানেই সুবিমলয়ের জয়। সমস্ত লেখা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার সফলতা।
সুবিমল প্রবলভাবে প্রান্তজনের আত্মস্বরকে নির্মাণ করতে চেয়েছেন। প্রান্তজন কীভাবে ব্যবহৃত হয়, প্রান্তজনের ব্যবহারকারী এলিট সোসাইটির ভাবভঙ্গি, সিস্টেমসহ রাষ্ট্রের পিছনমারা জাঁতাকল নিয়ে তিনি শোষণ-শাসনের নব ভাষ্য রচনা করেন। এ ব্রিটিশ শোষণ নয়, জমিদার, রাজার শোষণ নয় এ স্বাধীন দেশের উত্তরাধুনিক শোষণ। সেই শোষণের ভাষ্য ভিক্টোরিয়ান সাহিত্যের আদলে চলতে পারে না। তার বয়ান চলবে উত্তর আধুনিক নির্মাণে। ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’ও (পাঠক আপনি যেকোন নামেই তা বরণ করতে পারেন) মধ্যবিত্ত কাল্টসহ একাধিক পরাজিত, প্রান্তজনের বয়ান। ভগবানের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার নবরূপে ফিরে এসেছে। বিজ্ঞান শিক্ষক হাতে আংটি, মাদুলি ঝুলিয়ে ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াতে যায়, চিকিৎসক অপরাশনের আগে ভগবানকে প্রণাম করে নেয়। তঞ্চকতা কোথায়? ভণ্ডামী কোথায়? সেই ভণ্ডামীতে আঘাতই সুবিমলের লক্ষ। কেন গ্রন্থের শিরোনাম হয় ‘গড অ্যান্ড নিউফিজিক্স’, ‘দ্য মাইন্ড অফ গড’। নিজেদের উত্তর আধুনিক বলে দাবি করি, পোশাক, খাদ্য সংস্কৃতিতে পশ্চিমি আধুনিকতার চূড়ান্ত পরিবর্ধিত সংস্করণ গ্রহণ করি আর ভগবান নিয়ে মেতে থাকি তা তো চলবে না। বিজ্ঞানের সঙ্গে গড মিশিয়ে আজও প্রকাশক বাণিজ্য করে। মিথ্যার বাণিজ্য, নগ্নচেতনার ভুবন থেকে তিনি মানুষকে সত্যের দিশারীতে নিয়ে যেতে চান। সুবিমলের এতসব আক্রমণ কিন্তু মানুষকে সৎ-সত্যভূমিতে দাঁড় করানোর জন্যই। শিল্প, আর্ট, ভাষা, বয়ান, প্লট, ডিসকোর্স সব ভেঙে যে বিকল্প বয়ানের নির্মাণ করে চলেন তা উজান স্রোতের নাবিক হিসেবেই গণ্য হবে। হোক তা নির্জন, তবুও তো দ্বীপ, সেই ফুলিঙ্গময় দ্বীপের দিশারী সুবমিলমিশ্র।
ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব, অন্তঃসত্তা, ভেতরের গোপন আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ চান তিনি। যা আমরা গোপনে লালন করি, মনে মনে বহন করি তার প্রকাশ হবে না কেন? প্রকাশ দ্বারা মনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করাই জীবনের শুদ্ধতা। সামাজিক নিন্দা, গ্লানি, কাঠামো সেখানে বাধা হতে পারে না। বরং মনের মধ্যে চেপে রাখাই পাপ। সুবিমল সামাজিকতার সমস্ত গণ্ডি ভাঙতে চান। সামাজিক বিধি নিষেধের যতরকম রকমফের আছে তার সমূল উৎপাটন চান। সেখানে যৌনতা অচ্ছুত হতে পারে না। মহাদেব কামযুক্ত হয়েও শিবচতুদর্শীতে পূজিত হন। মানুষের নির্মিত দেবতা যখন কামযুক্ত হয়েও পূজিত সেখানে মানুষের বাধা কোথায়? বরং যৌনতা, কাম, ইচ্ছাকে বরণ করে নেবার মধ্য দিয়ে যে আনন্দ, ঐশ্বরিক স্বর্গসুখ লাভ তাই জীবনের আধুনিকতা, উন্নতর আর্ট, সাংস্কৃতির ভদ্রলোকী সংস্করণ। জীবনে বাঁচতে, জীবনের গোলার্ধে যেমন কিছু অবচেতন ক্ষমতা থাকে তেমনি যৌনতা-ভোগাকাঙ্ক্ষা, ইন্দ্রিয়জ বাসনাও। তা অস্বীকারের প্রয়োজন নেই। অন্তত সুবিমলের বয়ান তাই বলে। জীবন প্রকোষ্ঠের বাইরের অংশ আমরা দেখি। সেখানে মানুষে সৎ ভদ্রলোক সভ্য। কিন্তু ভিতরের প্রকোষ্ঠে নানা অবদমের ক্রিয়া চলে। ভোগাকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নবাসনা যা সামাজিক গ্লানির ভয়ে প্রকাশ করা যায় না। সুবিমলের মতে সেই অন্তর্বলয়ই সত্য। তিনি প্রখরভাবে আক্রমণ করেন সিস্টেমের গোলকধাঁধা ও ঘুণধরা অংশে। তা সামাজিক, রাষ্ট্রীয় যেকোন সিস্টেম, বিধিনিষেধ হতে পারে। বিধিনিষেধ প্রদান করা হলে তা মান্য করার পরিসর নেই। জনগণতান্ত্রিক সরকার হলেও সাধারণ মানুষের জন্য কোনো সুবিধা নেই, আছে কেবল নিয়মের দাস্যতা। নিয়ম ঠিক আছে কিন্তু নিয়মের জরুরি শর্ত হিসেবে যা পালন করতে হবে তার পরিসর কোথায়? সুবিমলের আঘাত এখানেই। স্বাধীনতা, লিবারাল সোসাইটি, সমবণ্টন, সমনাধিকার আইনত পাশ হলেও মানুষ আজও সামাজিক গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। আজও বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান টিকে আছে। রাতে বাইরে নাইট পার্টি করলে মহিলাকে জবাব দিতে হয়। যতদিন সেক্স লাইফের সমনাধিকার না আসবে, সামাজিক অবগুণ্ঠনের তাবিজ গলা থেকে নারী–পুরুষ না ঝেড়ে ফেলতে পারবে ততদিন প্রকৃত আধুনিকতা আসবে না।
কী হবে ভাষা স্টাকচার তা জানতে বসতে হবে সুবিমলের মুখোমুখি। শুধু ভাষার কারিগরি বিদ্যায় আখ্যান স্বতন্ত্র না অন্য কিছু? মধ্যবিত্ত লেখকের ভাষাবাতিক, ওভার স্মার্টনেসকে সুবিমল এখানে খণ্ডন করেন—
“মধ্যবিত্ত লেখকের একটা ন্যাকামি আছে ভাষা নিয়ে। ভাষাটাই যেন সব, যার ভাষা নেই, তৈরি হয়নি—সে আদৌ লেখকই নয়। আমি প্রথমেই এর বিরোধিতা করি। মধ্যবিত্ত ঘেরাটোপ থেকে বেরবার একটা রাস্তা হল ভাষার মোহ থেকে বেরিয়ে আসা, ভাষা তৈরি করার মোহে না–পড়া।” (তদেব, পৃ. ৩১)
আগেই বলা হয়েছে সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল। নিজের যৌবনের বহু ভাবনাকেও তিনি পরিবর্তন করতে রাজি। ভাষার মতো ভাবনাও চলমান। সেই চলমানতার ফ্রেমে গ্রহণ–বর্জন নিত্য চলে। এই নিজের খোলোস ছেড়ে দ্বিধাহীন চিত্তে নতুনকে বরণ করে নেওয়াই সুবিমলের আধুনিকতা। ভাষা হবে বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মশলা যেমন ঝোলে মিশে থাকে তেমনই। আখ্যানের বয়ানের সঙ্গে ভাষা সম্পৃক্ত না হলে তা মৃত ভাষায় পরিণত হয়।
সুবিমল বারবার মধ্যবিত্তের সংকটের সিংহমূলে পৌঁছতে চান। মধ্যবিত্ত কেন আত্মগ্লানিতে ভোগে? দেহের দাবি পূরণে যৌনতা চায়, সেক্স করে কিন্তু তা অস্বীকার করে কেন! রাষ্ট্র, যৌনতা, আইন, ঈশ্বর, মধ্যবিত্ত কাল্ট, শোষণ, ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব, রাষ্ট্রের নাটবল্টু নিয়ে যে ধন্দমূলক বস্তুবাদ (যা প্রকৃতপক্ষে ঘাপলাবাদ/ নষ্টবাদ/ অন্ধকারবাদ) তার মুখোশ খুলে দেওয়া এবং কোথায় মধ্যবিত্ত ভুল করে তার আত্মচরিতের নামাবলিই তাঁর আখ্যানভুবন। আলোচ্য ভুবনে কী লিখতে চান সুবিমল? শুনে নেওয়া যাক নিজ মুখ থেকেই—
“এ লেখার সর্বত্র, সমস্ত নির্ণয়ের পেছনে, আঠার দাগ, সর্বত্র, সব উৎস থেকে
কাট করে আনা, যদিও নিজস্বভাবে নিজস্ব ধরনে, নিজস্ব ঘরানায়
নির্মাণকর্তা শুধুই নিমিত্তমাত্র, কাঁচি, আঠা নিয়ে বসে আছে, কোলাজ করতে
করতে নিজেই কোলাজ হয়ে উঠেছেন…..” (তদেব, পৃ. ৩৭)
শুধু এ লেখা নয় সুবিমলের সমস্ত লেখা সম্পর্কেই একথা কম–বেশি সত্য। আগেই বলা হয়েছে সুবিমল লেখা নামক প্রক্রিয়ার ইঞ্জিনিয়র। বিষয় পাঠকের জানা, বিষয়ের ভিতর একাধিক সত্য অজানা। তিনি সেই অজানা পরিসরই পাঠককে দেখাতে চান।
রেফ, মধুচক্র, সেক্স, পুলিশি সন্ত্রাস, শ্লীলতাহানি, সেক্স ভায়োলেন্স, প্রান্তিকের আর্তনাদ, প্রশাসনের ফাঁকফোকর, প্রচীন শাস্ত্রের কামতত্ত্ব, মধ্যবিত্তের ভণ্ডামী, বাজার অর্থনীতি, রাজনীতির ডিসকোর্স, ভোট, মিনি সন্ত্রাস, সন্ত্রাস–প্রশাসন–শোষণের রকমফের যা জীবনকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে দেয় না সেই পঙ্কময় অন্ধকারসজ্জা সুবিমলের লক্ষ অভিমুখ। ভাষার কারিগরি বিদ্যা থেকে অক্ষরের কারিগরি বিদ্যা, দেখার সৌন্দর্য, পাঠের নতুন চলন, নব্য আখ্যান প্রবণতা, সমস্ত মিলিয়ে এ আখ্যান চলতি জীবনের রৌদ্রছায়া। যতিচিহ্ন থেকে নৈঃশব্দের খেলা, অক্ষরের মুক্ত চলন থেকে ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে নাস্তানাবুদ করা, যৌনতা–যৌন চাহিদা–তৃপ্তি–অতৃপ্তি, বাঙালি–বিদেশী যৌনতা, ভোগস্পৃহা–আকাঙ্ক্ষা থেকে সময়ের চিরুনিতল্লাসি সব হয়ে ওঠে আখ্যানের কবচকুণ্ডল।
সুবিমল এখানে কোনো কাহিনির খোঁজ দেন না। যা কাহিনি হয়ে উঠতে পারত তার আভাস দেন। টুকরো বয়ানে অমসৃণ জীবনের পটচিত্র এঁকে চলেন। বিচ্ছিন্ন বয়ান, সে সব বলাও দ্রুতগতিতে বিদ্যুৎ চমকের মতো। কিন্তু সেখান থেকেই বৃহৎ জীবনচিত্রমালা আঁকা সম্ভব। এটাই সুবিমলীয় স্টাইল।
স্বামীর সামনে সীমা ও বামদেবের স্বাধীন সেক্স উপভোগ, যার মধ্য দিয়ে দেহের উত্তেজনা ও ভিতরের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়। নারীর উত্তেজনা, চাহিদা ও সক্ষম পুরুষ পাবার মধ্য দিয়ে সামাজিক বিধি নিষেধ লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তসুলভ ট্যাবু ভেঙে ফেলেন। জীবনের শাশ্বত সত্যকে চেপে রাখাই অমানবিকতা, পাপ। প্রসারিত আলোয় ব্যক্ত করাই জীবনের সৌন্দর্য। যা কিছু গোপনীয় তাই ক্লেদময়, গ্লানিময়। তা থেকে সীমা–বামদেব মুক্ত হয়েছিল। তবে হিংস্রতা আছে। বামদেব সীমার স্বামীর উপর বল প্রয়োগ করে নিজের আধিপত্য জানান দিয়েছে। নারী হয়ে উঠেছে ভোগের সামগ্রী। যৌনতা নিয়ে সুবিমল বারবার জটিল বীক্ষণে প্রবেশ করেছেন। দেহ রাজনীতি, সেক্স ভায়োলেন্স, চাহিদা–আকাঙ্ক্ষার কত রকমফের হতে পারে, সেখানে আধিপত্যবাদ কীভাবে প্রয়োগ হয় তার রহস্য বেরিয়ে আসে।
আখ্যানের কথা বলার শিল্পকে যিনি উচ্চমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি সুবিমল মিশ্র। কীভাবে চলবে কথন ক্রিয়া। কথন ক্রিয়াই লেখককে নিয়ন্ত্রণ করবে না লেখকই হয়ে উঠবে নিয়ন্ত্রক। ‘অপর ভাষা’, সাহিত্যের ‘অপর’ ধারণা এবং ব্যক্তি মানুষের নাড়িনক্ষত্র, অলিগলি যার বড় অংশ সেক্স, এমনকি সেই মানুষ সিস্টেমের নিয়ন্ত্রক সেই দ্বিরালাপের অনুবীক্ষণিক দিক আবিষ্কারক তিনি। আর্টের সত্য, শিল্পের সত্য, চিত্রকলার মানদণ্ড ও আর্টকে বোঝার দৃষ্টি, আর্ট কতপর্যন্ত গহন প্রদেশে যেতে পারে, তার অন্তর্বলয়ের সত্য সব মিলিয়ে উত্তর আধুনিক শিল্পের পরিমণ্ডল কেমন হতে পারে তা নিয়ে নানা সমীক্ষা ও নিজস্ব বীক্ষণ সাহিত্যের জরুরি পাঠ বলেই বিবেচিত হবে। বাজার চলতি রাষ্ট্র প্রশাসনের নানা দপ্তর, তার বহুবিধ গোলমাল রহস্য, এক কথায় সঠিক সিস্টেমের অভাব, রাস্তাঘাটে উঠতি যুবকদের নোংরামি, ঘরে কামনার স্ফুরণ সব মিলিয়ে সমাজ সভ্যতার কালো অন্ধকার সুবিমল মিশ্রের নিশানা। নারী–পুরুষের স্বেচ্ছাকৃত সংগম যা পবিত্রময়, অন্যদিকে নারীর অবয়ব দেখে পুরুষের লালসা–কামনা ও আধিপত্য প্রয়োগ করে নোংরামি যা অশ্লীল দিক। সুবিমল প্রবলভাবে যৌনতার নন্দনতত্ত্ব আবিষ্কারে উদগ্রীব। কিন্তু সেই পথে অশ্লীলতা, আধিপত্য, সামাজিক মানদণ্ড, ধর্ষণ, রেপ, মধুচক্র, কিছুর জন্য দেহদানসহ অনৈতিক কার্যকলাপে দিশাহীন। তিনি চান যৌনতার ইউরোপীয় সংস্করণ। নারী পুরুষ স্বেচ্ছায় যৌনতায় মিলিত হবে শর্তহীনভাবে। কিন্তু এখানে পুরুষ নানা ইন্ধনে, গোপন ফাঁদে, আধিপত্যে নারীকে ভোগ করে। এই দ্বন্দ্বই সুবিমলের আখ্যানের অন্যতম দিক। তেমনি বিবাহিত নারী নিজের কামনার ইন্ধনে ভিন্ন পুরুষের কাছে এগিয়ে যায়। সংগমে সুখ অনুভব করে। তবুও এক পাপবোধ জেগে থাকে মনে। এই দ্বিধা দ্বন্দ্ব, সেক্স মনস্তত্ত্ব, মিলনে আনন্দ অনুভব ও পরক্ষণেই ভয় এই চেতন–অবচেতন সত্তা নিয়ে তিনি নারী–পুরুষের অন্তর্বীক্ষণে উপস্থিত হন। যা জীবনের স্বাভাবিক প্রকাশ তাই সত্য, যা উন্মুক্ত পরিমণ্ডল তাই জ্যোৎস্নার সৌরভ। তবুও মধ্যবিত্ত সংস্কারে আমাদের মনে থাকে দ্বন্দ্ব, পাপবোধ। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক ট্রিটমেন্ট। মিডিয়া কোন ভূমিকা পালন করে চলে। সত্যদ্রষ্টার নামে কিছু খুন খারাপির খবর ছেপে নিজের বাজার জানান দেয়। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নিয়মই সাধারণ মানুষের কাছে বড় দুঃশাসন। সাধারণ মানুষ প্রত্যহ সেই নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পরে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। রাষ্ট্রের নিয়মের কষাইখানা, সামাজিক বিধি, মধ্যবিত্তের মেকিপনা ও মুখোশ সেজে থাকার ভানে আঘাত সুবিমলের পরিমণ্ডল। তিনি লিখতে বাধ্য হন ‘আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি বড়ই ব্যূঢ়স্কন্ধ’। কোথায় সূক্ষ্ম সন্ত্রাস, কোথায় সূক্ষ্ম ইন্ধন, কোথায় শয়তানিবৃত্তি, সুবিধাবাদ–লোভ প্রবণতা লুকিয়ে আছে তা তিনি জানেন। সকল লেখকই কম বেশি জানেন। কিন্তু সুবিমল দ্বিধাহীন চিত্তে প্রকাশ করেন। কোনো রাজনৈতিক দর্শন, সুবিধাবাদ, প্রতিষ্ঠানের ধ্বজাধারী, প্রচলিত নীতির প্রিন্সিপাল, পুরস্কারলোভী না হওয়ায় তার প্রকাশ এত জীবন্ত। এইখানে সুবিমল স্বতন্ত্র হয়ে পড়েন।
সুবিমল টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আখ্যানের মালা গাঁথেন। হাজারও চরিত্র, হাজারও ঘটনা কিন্তু সবটাই যেন রিলেটেড। এটিই সুবিমলের ফর্ম। কনটেন্টের থেকে দর্শন এখানে বড়। সেই দর্শনটাই আখ্যানের ভিত্তিভূমি। সুবিমল তাই দেখাতে চান নানা কায়দায়, নানা চরিত্রে, নানা বীক্ষণে, নানা অছিলায়, নানা পরিস্থিতিতে। কখনও মঞ্জিমা, অমর, রমার উদোম যৌনতা, অপর পৃষ্ঠায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রিপোর্ট, ধর্ম নিরপেক্ষ বয়ান, সংসদীয় গণতন্ত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক কটুভাষ্য, নিয়মের গোঁজামিল দ্বারা সময়ের বিশেষ পাঠ উত্থাপিত হয়। মধ্যবিত্ত বাঙালির পাপ–পূণ্যবোধের রকমফের, একদিকে দেহের উত্তেজনা, অন্যদিকে পাপবোধের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, আধুনিকতা ও সংস্কারের মণ্ডামিঠাই মিলে বাঙালির যে ভণ্ডামী তার বৃহত্তর পাঠ আবিষ্কারক সুবিমল এবং তার জরুরি প্রয়োগ ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’।
জীবনের অন্ধকারমালাই সুবিমলের পাঠক্রম। খুন, জখম, সন্ত্রাস, ধর্মীয় বিভেদ, বিস্ফোরণ, পুলিশি অত্যাচার অন্যদিকে যৌনতার নন্দনকানন। যৌন মিলনের যে পরম তৃপ্তি তা নারী–পুরুষ উভয়ই ভোগ করে কিন্তু পরক্ষণেই জাগে সামাজিক গ্লানি। এই দ্বন্দ্বই সুবিমলের টার্নিং পয়েন্ট। কেন জাগে পাপবোধ? কেন দঃশিত হয় নরনারীর সামাজিক বোধ, কেন স্বীকার করে না পরকীয়া? কেন মেনে নেয় না জীবনের স্বাভাবিক দাবিকে। এই যে সেক্স করা ও তাকে সামাজিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি না দেওয়া এই আলো অন্ধকার নিয়ে তিনি আখ্যানের ভেলা ভাসান। এমনকি তিনি মারাত্মক ভাবে চেতনার গান বাজান। তা বিপ্লব হোক বা মধ্যবিত্ত বিবেক হোক। চেতনা না থাকলে নতুন জোয়ার সম্ভব নয় তা কেবল আয়োজন সর্বস্ব। অথচ আজ আয়োজন সর্বস্ব পরিমণ্ডলের রমরমা। উৎসবের ফানুস উড়িয়ে চেতনাহীনতার মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির যে ডাক তা যে যথার্থই ভিত্তিহীন তা তিনি প্রয়োগ করে দেখান। সমাজের বিবিধ স্তরের বয়সের নারীর দৈহিক চাহিদাকে সামনে রেখে নারী মনস্তত্ত্বের নিপুণ বিশ্লেষণে অবতীর্ণ হন। এত বড় সমাজ, এত বড় পরিমণ্ডল, এত শ্রেণি, বয়স বিভাজনে সকলেরই কম বেশি যৌনতা আছে। তার নানা রকমফের প্রক্রিয়া, চাহিদা, সম্পর্ক। বেশিরভাগই আড়ালে আবডালে। বিভাজনোত্তর সমাজে নারী পুরুষ পারিবারিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে আড়ালে মিলিত হয়েছে। কোথাও ক্লেদ নেই, গ্লানি নেই। আছে এক তৃপ্তির আনন্দ। তার বহুবিধ বয়ান নিয়ে এই আখ্যান। ভাষা আগ্রাসন থেকে জাতি খণ্ডীকরণ, বাঙালির হুজুকে প্রবণতা থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের শূন্য অবয়ব কোন কিছুই নজর এড়িয়ে যায় না। জগাখিচুরি হিন্দি, ইংরেজি মিডিয়াম, বাংলা ভাষা–সংস্কৃতির আদ্যশ্রাদ্ধ, পক্ষ–বিপক্ষে কোন্দল, সংস্কৃতির নষ্টচরিত্র, আধিপত্যবাদের সংস্কৃতি মিলিয়ে দিনের আলোর পরিমণ্ডলের উপর সুবিমল বুলডোজার চালান নিজস্ব ভঙ্গিতে।
বাঙালি যেমনভাবে মাতৃভাষাকে অপমান, তাচ্ছিল্য করেছে অন্যজাতি তা করেনি। মাতৃভাষাকে আয়ত্ত না করে নিজেকে ওভার স্মার্ট হিসেবে পরিচয় দিতে গিয়ে নিজের ভাষা সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়েছে। যৌনতার ডিসকোর্সের পাশে আছে খিস্তি, অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ। উঠতি যুবক, কোম্পানির বস, বহুগামী পুরুষ, রাস্তাঘাটে নিরাপত্তাহীন ইভটিজিৎ, পর্ণ, আধুনিক নুড ছবি, সংগমের প্রমাণ হিসেবে কায়দা করে নুড ছবি রেখে দিয়ে ব্ল্যাকমেল, ব্যক্তির দ্বিধা মিলে বিশেষ করে নারী মনস্তত্ত্বের চিরুনি তল্লাশি করে চলেন। অবশ্যই তা যৌনতাকেন্দ্রিক। বসপ্রবৃত্তি, বসবৃত্তি, বসের নারী লালসা যেমন আছে তেমনি কিছু ভালো মানুষও আছে। তবুও ব্যক্তির সন্দেহ জাগে। আসলে সময়টাই কীটদষ্ট, ঘুণধরা, নষ্ট বিবেকের অংশ। নেই মূল্যবোধ, আদর্শ, নৈতিকতা। কেউ সে ধার ধারলেও কুৎসা রটতে সময় লাগে না।
যৌনতা নিয়েও আছে অধিকারবোধের লড়াই। রিপুজ মোহ, জৈবিক বাসনা এত তীব্র, অন্তর্গূঢ় প্রবণতা এত প্রখর যা এক আকর্ষণ বোধের জন্ম দেয়। কখনও সামাজিক মাত্রাজ্ঞান লোপ করায়। এ গ্রন্থ যেন নারী–পুরুষের সংগমের সিগনাল বুক। সেক্সসহ মানব রিপুর বহুবিধ প্রকার ও মনস্তত্ত্বের নিপুণ ভাষ্য। পাতার পর পাতা জুড়ে বিচ্ছিন্ন চিত্রের মধ্য দিয়ে নারী–পুরুষের মিলন, সংগম, সেক্সের কত প্রকার তার রেড বুক হয়ে ওঠে। জীবনের কত প্রকোষ্ঠ থাকতে পারে, মানসিক অবস্থানের তারতম্য অনুসারে অন্তর্বীক্ষণের প্রবণতা কত পর্যায়ে যেতে পারে তার তত্ত্বতালাশ করেছেন। কর্পোরেট সেক্টরে যৌনতা হয়ে ওঠে অবস্থার দাস। জীবনে অর্থ জীবিকা টেকাতে প্রশ্রয়হীন যৌনতা কেউ মানতে বাধ্য হয়। দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে জীবনকে প্রশ্ন করে। কেউ মানসিক আশ্রয় খোঁজে। কেউ বিচ্ছেদ চায়। কেউ নতুন সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। কেউ অপরের সেক্স লাইফ দেখে আনন্দিত। কেউ অলস সম্পর্ককে আর টেনে নিয়ে যেতে উদগ্রীব নয়। যৌনতার পাশে আর্থ–সামাজিক, প্রশাসনিক সাম্প্রদায়িক ভাষ্যও গুরুত্বপূর্ণ। সুবিমল দেখান সমাজটা কোন অদৃশ্য জালে ঝুলে আছে। সমাজের চলনশক্তি কোথায়, পঙ্কিলতা কোথায়, দূষিত বায়ু কোথায়। দূষিত বায়ুই যখন শ্বাস নেবার প্রন্থা হয়ে দাঁড়ায় তখন কী হতে পারে সামাজিক পরিসর, সুবিমলের তীক্ষ্ন দৃষ্টি সেদিকে। পোশাক, নারী–পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি, পোশাকের উত্তেজনা, প্রদর্শন, স্মাগলিং, পরস্পর দোষারোপ দ্বারা প্রবৃত্তিসর্বস্ব মানুষের রক্তমাংস ভালোবাসাসহ জৈবিক বহুমুখী রামাবলি এই আখ্যান।
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে মিনি সন্ত্রাস, পাড়ার মস্তান, মিনি গুণ্ডা, হপ্তা তোলা, ইভটিজিং, পুলিশের সামনেই খিস্তি, তোলাবাজি, পুলিশ নিজেকে সেভ জোনে নিয়ে গিয়ে আড়াল হওয়া, তোলাবাজির শতাংশ ভাগ, বেআইনি বিশৃঙ্খল নিয়ম কাঠামো, সমাজের নানাস্তরে নানা দুর্নীতি, কখনও স্টারচিহ্ন উর্দীধারী নিচুতলার কর্মীকে শোষণ সবমিলিয়ে গ্যাঁড়াকল সিস্টেমের পঙ্কময় অস্থির চিত্র এই আখ্যানের কর্ষিত ভূমি। নারীর উত্তেজনা, কৈশোরের প্রবল ইচ্ছাপূরণে যাকেতাকে সম্বল করে চাহিদা পূরণ, অন্যদিকে ভয় দেখিয়ে পিস্তল ঠেকিয়ে, আধিপত্য বিস্তার করে কামনা পূরণ। ইচ্ছা–অনিচ্ছার তত্ত্ব বেরিয়ে আসে। যা কিছু ইচ্ছাপ্রবণ, ব্যক্তির নিজস্ব চাহিদার নিমিত্তে তাই পবিত্র। যা কিছু অনিচ্ছাপ্রবণ, ব্যক্তির চাহিদাহীন ইচ্ছার ঊর্ধ্বে তাই অপবিত্র। ভারতীয় সমাজ কাঠামোয় পরকীয়ার পাশাপাশি রেফ বর্তমান। শারীরিক নির্যাতনের নানা রকমফের বর্তমান। কোম্পানির বস একপ্রকার, খুনী একপ্রকার, বয়স্ক মানুষ একপ্রকার। সবমিলিয়ে সেক্স ভুবনের নানা অলিগলি দিয়ে তিনি পাঠককে পরিক্রমা করান।
পাতার পর পাতা জুড়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বয়ান। পুলিশের ভুল তথ্যে বছরের পর বছর জেল হয় মানুষের। বিচারের বাণী প্রহসনের ফাঁদে বন্দি। বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা মানুষ আজ বাড়ি গাড়ি বিলাসে মত্ত। কেউ জেল খেটে নেতাদের অর্থে বড়লোক। প্রান্তিক মানুষ সেই তিমিরেই। প্রান্তে বহু পূর্ব থেকেই আড়ালে আবডালে যৌনতা ছিল। একপিঠে যৌনতা অপর পিঠে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের খণ্ড চিত্র দ্বারা তিনি পৌঁছতে চান সময়ের আরোগ্য নিকেতনে। প্রান্তিক নরনারীর যৌনতার শব্দ, বয়ান, কোলাহল, কায়দা কানুন ভিন্ন। মাঠেঘাটে, নির্জনে, বাড়িতে মিলিত হয়ে উত্তেজনা প্রশমিত করে। নাগরিক মানুষ যেখানে বিজ্ঞাপন, পণ্যায়ন, পশ্চিমি যৌনতার ছলাকলা দেখে সব আয়ত্ত করেছে, প্রান্তে সেইসব রহস্য সেদিনও পৌঁছোয়নি। বাঙালি ষড়রিপু, কামকেলি, কামময়তার যে প্রবাহমান সচলচিত্র তার নিজস্ব দেশজ শব্দ ও নিজেদের মধ্যে আনন্দলাভ তার ব্যবহারিক প্রয়োগ লেখক সচেতনভাবে দেখিয়ে চলেন।
সেক্স কীভাবে পণ্যায়ন হয়, শুধু বিজ্ঞাপন বা ব্লু ফিল্ম নয় আছে হোটেল ব্যবসা, মধুচক্র। সরকার কতটা ছাড় দেবে। অর্থাৎ কতটা নগ্নতা প্রদর্শন করা যাবে। বয়স অনুপাতে নারী শরীরের মূল্য নির্ধারিত হবে। ঝকঝকে ফাইভ স্টারে বিনোদনের একপন্থা, ওয়ান স্টারে আরেক পন্থা। মানুষ অর্থের মাপকাঠিতে বিনোদন উপভোগ করবে। মহিলারা অর্থ রোজগারের বাসনায় শরীর প্রদর্শন করবে। হাসপাতাল নেই, চাকুরি নেই, ক্ষুধার সমস্যা মেটেনি, সরকার ফাইভজি লঞ্ছ করে, স্যাটেলাইট বানায়, উচ্চবিত্ত ঢালাও যৌনতায় ভেসে যায়, নিম্নবিত্ত ক্ষুধার কান্নায় অস্থির। অর্থ না থাকলেও, দারিদ্র্যের বেশভূষা গায়ে চেপে থাকলেও অবদমিত কামনা তো রেহাই দেয় না। প্রান্তিক মানুষ নিজের মতো করে যৌনতা উপভোগ করে চাঁদের আলোয় খোলা আকাশের নিচে। সভ্যতার দুই পিঠে সুবিমল টর্চ জ্বেলে নিপুণ প্রত্যক্ষে সব দেখেন।
সংস্কার, ধর্মান্ধতা, লোকাচার, যৌনতার ট্যাবু, পাপবোধ, সিস্টেমের গোলকধাঁধা, অসাম্প্রদায়িক ভঙ্গির মধ্যে সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতা (তা কখনও নারীপুরুষ, কখনও হিন্দু–মুসলিম) বিসর্জন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুবিমল তা বিসর্জন দিতে চাইলেও বা প্রখরভাবে আঘাত করলেও সমাজে তা প্রবলভাবে প্রচলিত। এমনকি তা কতভাবে সমাজের বুকে জীবন্ত তাই দেখিয়ে চলেন। জীবনের গভীর প্রদেশে নামতে নামতে, ব্যক্তি মানসের অন্তর্বলয়ে তল্লাসি চালাতে চালাতে একদা সত্য কথা বেরিয়ে আসে। অবস্থার দাস হয়ে, ভালোবাসার সৌরভে, উত্তেজনার মোহে নিজের জীবন যন্ত্রণার অব্যর্থ রহস্য ব্যক্ত হয়ে পরে। রিপোটার্জ ঢঙে সমাজের অন্ধকারের অতল প্রদেশের ঘটে যাওয়া ক্লেদময় জগৎ, খুন খারাপি, ধর্ষণ, পেট খসানো, দাঙ্গা, হানাহানির চিত্রমালার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রবাহমান সময়ের দৃপ্তকণ্ঠ উঁকি দিতে দেখি। অন্ধকারের চিত্রনাট্য কত ভয়ংকর, মানুষ সেখানে কত সহজভাবে বলি হয়, পুলিশ, খুনি, মস্তান, ধর্ষক সাধারণ মানুষকে মানুষের শ্রেণিতে বিবেচ্য করে না। চারিদিকে অশান্তি। মানবিকতার চূড়ান্ত অবমাননা ও পাশবিক বৃত্তির শৌর্যবীর্যের যে প্রতাপ তার অসহনীয় রণদামামার কোলাহল আখ্যানে শব্দতরঙ্গের তালে বেজে চলে।
সুবিমল রিপোটার্জ ঢঙে যেমন সময়ের পচনক্রিয়ার সংবাদ দেন তেমনি সময়ের ঘটমান অনল থেকে তত্ত্বের জন্ম দেন। বিপ্লব, শ্রেণি সংগ্রাম, রাষ্ট্র, মিডিয়া, মধ্যবিত্তসহ নানা ধারণার দুই পিঠের যে র্যাডিক্যাল পরিসর, সিভিল সোসাইটিসহ কীভাবে ধ্বংসের আয়োজন হয়েছে তা থেকে মস্তিষ্কের ভাবনা সঞ্চারী বোধ সৃষ্টি করেন। সমস্ত ভাবনার সঙ্গে যে একমত হতে হবে বা সুবিমলের ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে হবে তার কোনো মানে নেই। সুবিমল তা চাননি। বরং সেখান থেকে পাঠক বিকল্প বয়ানে যাক, সেখানেই সুবিমলের সার্থকতা। কখনও ইতিহাস–পুরাণের বলয়ে, কখনও আন্তর্জাতিক পরিসরে পাঠককে মানসভ্রমণ করিয়ে বর্তমানের কালচিত্রের নষ্ট আত্মার আর্তনাদের বিভীষিকা ব্যক্ত করেন। সর্বত্রই গদ্যের চলমান প্রবাহ বিদ্যমান। রেলগাড়ির কামড়ার মতো যা দ্রুত প্রবাহিত। ইঞ্জিন হিসেবে কিছু ইউনিট (রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, খুন, জখম, যৌনতা) বর্তমান। এসবের মধ্য দিয়ে পাঠককে কোথায় নিয়ে যেতে চান সুবিমল? সভ্য সোসাইটি, সুসভ্য নাগরিকের অন্তর্বলয়ে ও পারিপার্শ্বিক বৃত্তে কোন অন্ধকার বর্তমান।
মধ্যযুগের রাজতন্ত্রের ভোগবাদ, যৌন উদ্যাপন, রক্ষিতা, বলপূর্বক যৌনতৃপ্তি থেকে উনিশ শতকের বাবু কালচারের যৌনতা উদ্যাপন থেকে আজকের ভোগবাদনির্ভর যৌনজীবনের নিগূঢ় সংকেতমালা উপস্থাপিত হতে দেখি। আবহমান কালের চিত্র থেকে যৌনতা, যৌন নির্যাতন, সেক্স ভায়োলেন্স ও আজকের অপরিমেয় ভোগবাদের যে অবিচ্ছিন্ন পরিসর তাই আখ্যানের কেন্দ্রভূমি। সাইডরোল হিসেবে রয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নানা তালবাহানা। তোলা আদায়, পুলিশের হপ্তা আদায়, আন্তর্জাতিক পরিসরের সঙ্গে দেশের অবস্থান (শিশু শিক্ষা, শিশু শ্রম, দৈনিক মজুরিসহ নানা বিষয়)। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকেই নানা সামাজিক ক্রিয়াকর্মে যৌনতার প্রসঙ্গ ছিল, এমনকি দেবদেবী প্রসঙ্গও। সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, সময়ের নিগূঢ় সন্ধি ও সময়ের অলিগলি দিয়ে বিশ্লেষণ চালিয়ে আবহমান বাঙালির জৈবিক জীবনচিত্রের ছবি যেমন স্পষ্ট হতে দেখি তেমনি যৌনতার মিথ, ছুতমার্গ, লোকাচার, মুখে এক কর্মে আরেক সহ নানা বেলেল্লাপনার ছবি অঙ্কন করেন। দেহের ধর্ম, যৌবনের উত্তেজনা, লোকাচার, সমাজের অনুশাসন ও তা ভাঙা–গড়ার বিরোধাভাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব কোথায় সেটাই আখ্যানের মূলসূত্র।
হিস্টোরিক্যাল এপিসোড, তন্ত্রমন্ত্র, জীবনের ব্যাকগ্রাউন্ডের অন্ধকার, সময়ের নানামাত্রিক পাঠ, সময়ভেদে পাঠের নানা পরিসর মিলিয়ে সুবিমল পৌঁছে যেতে চান রুদ্ধশ্বাস সময়ের চাপানউতরে। সমস্যার অন্তমূলে গিয়ে দেখান জীবন এমন। আর আমরা জীবনকে সাজিয়েছি এমনভাবে। এই সাজানো, কৃত্রিমতার বিরুদ্ধেই সুবিমলের বিদ্রোহ। যৌনতাকে যত অবদমিত, অবরুদ্ধ করে রাখা হবে ততই তার সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে, আকর্ষণ বজায় থাকবে। সেজন্যই পর্ণ সাইট, ব্লু ফিল্মে মেয়েদের বিশেষ আগ্রহ। অবদমনের অন্ধকারে নেমে সুবিমলের প্রশ্ন যা মানুষের জীবনের অঙ্গ, যা জীবনের ক্ষেত্রে অবধারিত অনিবার্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়াই শ্রেয়। নীতির প্রিন্সিপাল দ্বারা সমাজের, সময়ের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে না অন্তত যৌনতার ক্ষেত্রে। সাংস্কৃতির গণ্ডিভাঙা বলয় থেকে সুবিমল মানুষের অবদমনকে মুক্ত করতে চান।
গাদিয়ালির স্পেকট্রোক্রম থিয়োরি, সফদার হাসমির প্রগতিবাদী চেতনা, প্রতিবাদী চেতনাকে সহজেই ভুলে যাওয়া, ইতিহাসের কুশিক্ষা আয়ত্ত, নিয়ম নির্ধারকরাই নিয়মভাঙার পাণ্ডা, ভিত্তিহীন পাবলিক ধোলাই, মন্ত্রীর মিথ্যা মগজ ধোলাইসহ প্রবাহিত সময়ের পচনক্রিয়ার খতরনাক অমাবস্যাকে আখ্যানে স্পষ্ট হতে দেখি। গল্প উপন্যাসের বানানো কাহিনি গড়ার মুখে মুতে দিয়ে সুবিমল সময়সরণি ধরে হাঁটেন। সময়ের বুকে ঘটে চলা অন্ধকারকে উপপাদ্য করেই দেখান শতাব্দীর আর্তনাদ কত প্রখর। সংস্কৃতির পরিমণ্ডল দিন দিন দূষিত হচ্ছে। লিটল ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করতে করতে নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছে। মার্কসবাদের শুদ্ধিকরণের নামে বুর্জোয়া ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষা, প্রকাশক, বিশ্ববিদ্যালয়, পাঠ্যসূচি সমস্ত দুর্নীতি ও ভুল লোক দিয়ে ভরা। চলে তন্ত্রমন্ত্রের রমরমা বাজার। কেউ তন্ত্রমন্ত্রকে সাহিত্য বলে চালায়। প্রকাশক তন্ত্রমন্ত্রকে প্রমোট করে। একজন লেখক হিসেবে সুবিমল কী করবেন? সময়ের বিরোধাভাস বুনে চলেন। মধ্যবিত্ত সিভিল সোসাইটি কর্ম, আদর্শ, বিশ্বাস, মূল্যবোধের থেকে ভঙ্গি, ফাঁপা প্রদর্শনকে বিশেষ মূল্য দিয়েছে। সুবিমলের আঘাত এখানেই। বিজ্ঞানের পাশে সমান্তরাল গতিতে কুসংস্কার বর্তমান। বিজ্ঞানের মানুষ, বামপন্থী ভাবাপন্ন মানুষ ধর্মেকর্মে লিপিবদ্ধ হচ্ছে। বিজ্ঞান না সংস্কার কোনটা বরণ করবে মানুষ বোঝে না। মধ্যপথে থাকতে গিয়ে কোনো আদর্শ মূল্যবোধ গড়ে ওঠে না। সেই ফাঁপা পরিসরকে ধাক্কা মারে সুবিমল মিশ্র। ৩০৭ নং পৃষ্ঠায় শুনিয়ে যান—“মূলশব্দ প্রতিফলিত হওয়ার পর পৃথকভাবে শ্রোতার কানে প্রবেশ করলে তবেই প্রতিধ্বনি শোনা যাবে। আর প্রতিধ্বনি এ লেখার প্রাণ।” বিবিধ বয়ান, বিবিধ চরিত্রের মধ্য দিয়ে একই ঘটনা/দৃশ্য/বৃত্তের পুনরাবৃত্তি দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি প্রবলভাবে যৌনতার স্বাধীনসত্তায় জোর দিতে চান। দুই মহাদেশে দুই সংরূপ হতে পারে না। ইউরোপে যা পুণ্য তা আমাদের সমাজে পাপ হতে পারে না। লিবারাল সোসাইটির সন্ধানের মধ্য দিয়ে বাঙালির ইউরোপীয় মানসভ্রমণসহ বাংলা আখ্যানকে তিনি আন্তর্জাতিক পরিসরে নিয়ে চলেন।
শিক্ষা, রাজনীতি, চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা। দায়িত্বজ্ঞানহীন, ফাঁকিবাজ, কর্মজ্ঞানহীন মানুষ দ্বারা সিস্টেম চলছে। সিস্টেমের ইঞ্জিনিয়র হয়ে কর্তব্যরত প্রশাসক নাকে নাকে নস্যি টিপে সাংবাদিক সম্মেলনে ব্যস্ত। কেননা সমস্ত ক্ষেত্রে ইউনিয়ন আছে। ইউনিয়ন সরকারের পাশে। মাঝখান থেকে ভেঙে যায় সমস্ত পরিষেবা। সাধারণ মানুষের ত্রাহিত্রাহি রব। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে বিধ্বংসী বয়ানে সিস্টেমের জাঙিয়া খুলে সব স্পষ্ট করাই সুবিমলের স্বধর্ম। তৃতীয় বিশ্বের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের সমস্যা না মিটিয়ে আন্তর্জাতিক যুক্তি, যুদ্ধকামান, শক্তি প্রদর্শনে অস্ত্র মজুত, মহাকাশজানের মধ্য দিয়ে দেশের যে গরিমা, অথচ বাইরের রাষ্ট্রদূত এলে প্রাচীর তুলে দারিদ্র্যতা ঢাকার ধান্দাবাজির মুখে আগুন ধরিয়ে দিতেই সুবিমল কলম তুলে নেন। সেক্স অনেকটা পরিস্থিতি, দৃশ্য, উত্তেজনার উপর নির্ভরশীল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আনেক সময় উত্তেজনা পেয়ে বসে। তখন মহিলারা মাত্রাজ্ঞান হারায়। যেকোন অবলম্বনকে সামনে নিয়েই চাহিদা মেটাতে চায়। আখ্যানের জয়া ভুলে যায় মাত্রাজ্ঞান। মাতার সংগম দেখে পাশে নিদ্রারত কন্যা পমিও নিজস্ব কায়দায় যৌনসুখ অনুভব করে। কোনো ঘৃণা নয় বরং ঐশ্বরিক আনন্দে মত্ত হয়। পরে জয়া মাসি কথা দিয়েও উদ্দালকের কাছে ধরা দেয় না। আসলে সবটাই পরিবেশ ও দৃশ্য নির্ভর। কখন সেক্স ব্যক্তিকে পেয়ে বসে ব্যক্তি নিজেই জানে না।
চারিদিকে সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্রীয় শোষণ, পুলিশি মিনি অত্যাচার, আন্তর্জাতিক দখলদারি, বসের চোখরাঙানি, অভাবী মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে নানা শারীরিক নির্যাতন সব মিলিয়ে অন্ধকারে ডুবে গেছে শতাব্দীর আর্তনাদ। এই ভয়গ্রস্ত–ভয়বৃত্তকে সামনে নিয়েই একুশ শতকে পা রাখছে মানুষ। চারিদিকে সংকটের মাত্রা ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। এক শ্রেণি সম্পদ লুণ্ঠন করে ধনীত্বের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে অপর বৃহৎ শ্রেণি অভূক্ত। কোথাও আলোর দিশা নেই। মানুষ নামক স্বগোষ্ঠী, স্বশ্রেণিকে বাঁচাতে মানুষ হাত বারিয়ে দেয়নি। প্রত্যক্ষ–পরোক্ষ নানামাত্রিক শোষণে বিধ্বস্ত একটা বড় মনুষ্য সমাজ। আবার সুবিমল ৩৪৪ পৃষ্ঠায় গিয়ে গড়ে ওঠা ডিসকোর্সকে ভেঙে ফেলতে চান। বিকল্প ডিসকোর্সের মধ্য দিয়ে নব চিন্তা অনুশীলনের সম্ভাবনা আছে। যা তৃতীয় বিশ্বের ক্ষেত্রে অধিক প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করতে গিয়ে দেখেন লিটল ম্যাগাজিন কখন নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। সুবিমলের আক্রমণ সেখানেও। ফলত লিখতে হয়—“আমি এখন ব্যবহার করি ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতারও বিরোধিতা।” সমস্ত আক্রমণের বিরুদ্ধে সুবিমল প্রস্তুত। আক্রমণের ভিতর থেকেই তিনি নতুন তত্ত্ব উঠিয়ে আনতে চান। এক্ষেত্রে সুবিমল নিজেকেও অবিশ্বাস করেন। ধ্রুবসত্য বলে কিছু নেই। নিজের উপলব্ধি জ্ঞান যখন নিজের কাছেই ভেঙে যাবে তখনই আসতে পারে প্রকৃত আধুনিকতা। সেক্ষেত্রে বি–নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চত্যে এক দার্শনিকের মতবাদ পরবর্তী সময়ের মানুষ এসে নতুন করে বি–নির্মাণ করেছে। মার্কসবাদের বিনির্মাণের তাত্ত্বিক দিকটি যদি না খোঁজা সম্ভব হয় তবে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি ঘটবে না। কেননা বাচন কখনও স্থির হতে পারে না।
নতুন শতাব্দী নিয়ে প্রত্যাশা–প্রাপ্তি যে সেগুড়ে বালি তা সুবিমল নির্মাণ করে চলেন। ওধুষ চোরাবাজারি থেকে কর্তব্যজ্ঞানহীন চিকিৎসক, ফাঁকিবাজ চিকিৎসক, শতাব্দীকে উচ্ছ্বল নৃত্যে বরণ সমস্তের মধ্য দিয়ে শতাব্দীর আর্তনাদ করুণ সুরে বাজে। সুবিমল অস্তিত্বের অংশ হিসেবে চরিত্রকে নির্মাণ করেন। প্রহেলিকার অমাবস্যার ব্যক্তি অস্তিত্বের দ্বিরালাপ কত সংকটপূর্ণ, প্রকাশ–অপ্রকাশের দ্বিধা কত জটিলতায় আবদ্ধ, তঞ্চকতা, অবিশ্বাস, স্তাবকতা–মিথ্যার দাসত্ব দ্বারা সিভিল সোসাইটি কীভাবে মুখোশ এঁটে থাকে তা জরুরি বয়ানে উপস্থিত হতে দেখি। সুবিমল যখন লেখেন—“যে বৃত্তির উপর যত বেশি নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা, তা তত বেশি দুর্নীতির আকর” (পৃ. ৩৫৫) বা “বেশ্যাবৃত্তি পিতৃতন্ত্রের অনিবার্য পরিণাম বলে আমি মনে করি, এই তন্ত্র নির্মূল না হলে বৃত্তিটিও যাবে না।” (পৃ. ৩৫৫) বুঝতে অসুবিধা হয় না তিনি কোন সমাজ গঠন করতে চান। জাতি–ধর্ম–বর্ণ–শ্রেণি–গোত্র–অর্থ কাঠামোকে উড়িয়ে দিয়ে একটি লিবারাল সোসাইটি গঠন। যা তৃতীয় বিশ্বের সমাজ কাঠামোয় অসম্ভব। ফলস্বরূপ সুবিমলকে দিনের পর দিন লিখে যেতে হয়। সমান্তরাল সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে লিটল ম্যাগাজিন চলতে পারে না। লিটল যদি বিকল্প বয়ান, বিকল্প চিন্তার জন্ম দিতে না পারে তবে তা বন্ধ করে দেওয়াই সমীচীন। দীর্ঘদিন ধরে একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়ে কোনো নির্দিষ্টি ঘরানার লেখক যদি তৈরি করতে না পারে, কিছু পাঠক যদি গড়ে তুলতে না পারে তবে কেন গড়হাজিরা উপস্থিতি। সাহিত্যের পণ্য উৎপাদনে আজ বিগ হাউসের সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনও সমান দায়ী।
ভোগবাদের ঢালাও আয়োজনে ভেসে গেছে সভ্যতা। হাজার বছরের সভ্যতা নতুন রসদ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে একুশ শতকে। মানুষকে মজা, বিনোদনের চূড়ান্ত স্বর্গে ভাসিয়ে দিতে সমস্ত ইন্ধন জাগিয়েছে। নাইট ক্লাব, বার, ডিসকো ড্যান্স, আউটিং, সমুদ্রে হোটেল, উদোম ভোগ, নারী সাপ্লাইয়ের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত সোসাইটির মস্তিষ্কে ভোগবাদ স্থায়ীস্তম্ভ হয়ে বসেছে। মধ্যবিত্তের নিজস্ব পরিসর ভেঙে দিয়ে, নিজস্ব স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষার বারোটা বাজিয়ে এক নতুন পরিসর নিয়ে যেতে ব্যস্ত। বিজ্ঞাপন, কোলাহল, উত্তেজনা, শপিংমল, মস্তিষ্কে ধোলাই, দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে পকেট ফতুড় করতে। ইহাই নতুন শতাব্দী। সেই শতাব্দীর নাড়িনক্ষত্র অমাবস্যা, ধান্দাবাজি, বিবেক দূষণ, সিস্টেমের নজরানা নিয়ে সুবিমল সর্বদা প্রস্তুত থাকেন।
নতুন শতাব্দীর শুভসূচনা হচ্ছে। অর্থবান এলিট সোসাইটি, যুবক সম্প্রদায় হইহুল্লোর, মদ্যপান, নাইট পার্টি করে শতাব্দীকে স্বাগত জানাচ্ছে। নতুন সূর্যদয় দর্শন নিয়ে রীতিমত ব্যবসা চলছে। ইন্টারনেট স্যাটেলাইট, টেলিকমিউনিকেশন, জিন–থেরাপি নিয়ে শতাব্দী নতুন দিশা দেখাবে। মানুষ উত্তেজিত। কিন্তু দেশের মানুষ আজও সামান্য রেডিও না থাকায় আগাম সংবাদের অভাবে সমুদ্রে ডুবে যায়, ম্যালেরিয়া হলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বদলে শীতলা মন্দিরে ভিড় জমায় তারা কীভাবে উপকৃত হবেন। প্রদীপের নিচের অন্ধকার বা দৃশ্য সৌন্দর্যের আড়ালেই যে ভয়ংকর বিভীষিকা বিরাজমান তাই সুবিমলের টার্গেট। হতাশাগ্রস্ত, বিষাদগ্রস্ত, স্বপ্নপ্রতারিত শ্রেণির কাছে এ শতাব্দীর নতুন সূর্যদয় অর্থহীন। সিভিল সোসাইটির কাছে যারা মানুষ হিসেবেই পদবাচ্য হতে পারেনি, সেইসব বাতিল প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি হয়ে সুবিমল সময়কে ট্রিটমেন্ট করে চলেন।
কূপমণ্ডূকতা, ছদ্মবাস্তব, মধ্যবিত্ত মুখোশধারী ছেনালিপনা, স্নায়ুতন্ত্রের মেকিবাদ বিসর্জন দিয়ে সুবিমল নতুন শতাব্দীতে মানুষকে সুস্থ জীবনচেতনায় ফিরিয়ে আনতে চান। যৌনতার কৃত্রিম বন্ধন উড়িয়ে দিয়ে মধ্যবিত্ত মননের ভেকধারী পচনক্রিয়ার সমূল উৎপাটন ঘটিয়ে নতুন শতাব্দীতে সুবিমল নতুন জীবনচেতনা গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিংশ শতক ছিল অসাম্য দূরীকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কতটা সক্ষম হয়েছে সময় জানে। অপরদিকে নতুন শতাব্দীর দুয়ারে কড়া নাড়চ্ছে ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদ। এখানেই সুবিমলের সংশয়। আর তা দাঁড়িয়ে থাকে কথন ক্রিয়া, চরিত্রের মুহূর্তসত্তা ও সুবিমলের নির্মাণ কৌশলের নির্ভরযোগ্য বুননে। ইহা শুধু ঘোষিত অ্যান্টি নভেল নয়। রীতিমত পরীক্ষাযোগ্য ও সময়ের ধারাপাতে সফল অ্যান্টি নভেল। সময়ের বিনির্মাণে আখ্যানও বিনির্মাণ দাবি করে, তার সফল প্রয়োগকর্তা সুবিমল মিশ্র।
ছবি : ফেসবুক থেকে নেয়া