[মহাকাব্য ‘রামায়ণ’এর ট্র্যাজিক মহানায়িকা সীতার জবানিতে একটি কাল্পনিক চিঠি বা একটি দীর্ঘ মোনোলগ, তার পুত্রবধূ দের উদ্দেশ্য করে রচিত।
সময়কালঃ সীতার পাতাল প্রবেশের বহুকাল পরে।]
পৃথিবী জননীর গোপন গর্ভগৃহ হতে জেগে উঠেছি, এই আমি, বৈদেহী।
চোখের ঘন কালো কাজলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল বিন্দু বিন্দু অশ্রু—
চকিতে, নীরবে, সন্তর্পণে তারা আমায় টেনে নিয়ে যায়
আর কোন সর্বনাশা জীবন নাটিকার দিকে—ভয়, প্রবল ভয় পেয়ে বসে!
এ কোন নতুন মহাকাব্যের জাগরণ,
নাকি সেই সব অতীত স্মৃতি-ইতিহাস-দৃশ্যকল্পের মধ্যে নিমজ্জমান আমি,
যার সাথে প্রতি নিয়ত লড়ছি আজও?
সেই ছায়ান্ধকার জগতের প্রতিবিম্ব, যাকে তোমরা পুরাণের গৌরব দান করেছো?
তোমরা—আমার দুই স্নেহের পুত্রবধূ, আমার যমজ পুত্র
লব কুশের সাথে আজ আবদ্ধ হবে বিবাহবন্ধনে।
দুটি পুত্র যেন আমার হৃদয়ের অমূল্য দুটি টুকরো
তাদের স্নান করিয়েছি আমার অপাপবিদ্ধ যন্ত্রণার জলে
পান করিয়েছি মাতৃদুগ্ধ শোণিতের প্রবাহের সাথে
তারা দিনের পর দিন কঠিন পাথরের শয্যায় নিদ্রিত হয়েছে,
ঋষি বাল্মিকীর আশ্রমে আশ্রমবালক।
কান পেতে শোনো, ওই শোনা যায়—আমার নির্বাসনের বুক চেরা আর্তনাদ।
আর তোমরাও বুঝি বিবাহের মঙ্গলসূত্রে বাঁধা পড়ছো আর এক দয়াহীন,
ক্ষমাহীন, গৌরবময় মহাকাব্যের গানে?
আজও যেন অযোধ্যার পূণ্যভূমির শিকড়ে, আমার সতীত্বের পরীক্ষার গনগনে আগুন
পোড়া অঙ্গার হয়ে ঝলসে ওঠে বাঁধনহীন, শাসনহীন হাসিতে।
বীরপুঙ্গব রাজার বীর-রস, স্ত্রী-নির্বাসনের আদর্শ গাথা
হিমবাহের শীতলতায় বিরাজমান, হৃদয় গলে না, অবিচলিত তাঁর।
রাবন-রাজের দুর্বিনীত দশটি মাথা পুড়তে থাকে দশেরার পুণ্য উৎসবে
মহাসমারোহের সাথে—পতিত রাজা সে, যে আমায় একদা হরণ করেছিল
পরাক্রমী পৌরুষের অহংকারে, আর তার অহংকার ছিন্নভিন্ন করেছিলেন
আমার-ই বীরযোদ্ধা স্বামী, মহাকাব্যের অমোঘ এক যুদ্ধে।
আর আজ—কালের চক্রের অমোঘ আবর্তনে সেই একই রাজবংশে
তোমাদের অভিষেক হবে বধূবেশে, নীরব বশ্যতায় করবে মাল্যদান
অঙ্গীকারবদ্ধ হবে—নিজ সত্তায় শুষে নেবে সব কটি স্ত্রী-আচার, বিবাহের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে।
নিশ্চুপ এক শান্ত কোনে মুখ লুকাই আমি—অর্বাচীনের মতো
বিশালাকায় প্রাসাদের কোন এক প্রাচীন, পরিত্যক্ত প্রান্তে।
পৃথিবী মায়ের আবরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে— দীর্ঘ দিন মৃত আমার এই হিমশীতল মুখ, শরীরী অবয়ব।
বেরিয়ে এসেছি সেই মাতৃগর্ভের আচ্ছাদন থেকে, যা এতদিন ছিল
আমার কাঙ্ক্ষিত স্বেচ্ছা- নির্বাসন, আমার পৃথিবী মায়ের না-ছেঁড়া নাড়ি।
সেই নাড়ির টানেই দৃষ্টির অগোচরে সরেছিলাম, সরেছিলাম প্রবল ঘৃণা, যন্ত্রণার ভারে।
মহাকাব্য আমার ভাগ্যনিয়ন্তা—জানি, আর এও জানি
তার শুরু থেকে শেষে, আমি এক নারীর চেয়েও অনেক বেশি
ছিলাম গুটি, দাবার বড়ে।
শূন্য থেকে শূন্যে ভেসেছে সীতার কুসুম-সুরভিত বিবাহের উপাখ্যান,
রুপকথাময় আনুগত্য, সীতাহরণ, নির্বাসন, সীতার মাতৃত্বের গরিমা, সীতার সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষা—
নির্মাণ করেছ, বিনির্মাণ করেছ বহু বার।
প্রিয়তম রাজা রাম, আমার রাজাধিরাজ, আর তাঁরই সভাসদরা
তাঁর চতুর্পাশে মৌমাছির মত ভিন ভিন করা অনুচর-রা
আমার সতীত্বের ফুল-এর সত্যতা, কুঁড়িতেই বিনষ্ট করেছেন।
আহ! জানো না, এখনো কি জানো না?
‘সতীত্ব’-ই সেই একটি শব্দ, আজ যা এক বাসি, দগদগে ঘা-এর স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে—
সেদিন, অগ্নিপরীক্ষার সেই জ্বলন্ত দিনে, ভীষণ কোলাহলের মাঝে
যার অসহ তাপ বোঝে নি কেউ-ই।
আর আজ, এতকাল পরে, তোমাদের দুটি উদ্ভিন্ন যৌবনা শরীরের,
তোমাদের কুমারী, স্বপ্নালু চোখের অগোচরে দাঁড়িয়ে আমি,
একাকী, আনমনা হয়ে দেখি, বিবাহের আগুনে দাউ দাউ জ্বলছে চিতা!
সতীত্বের সেই ভীষণ অঙ্গীকারের রক্ত-মাংস পুড়ছে, পুড়ছে আনুগত্যের দৃপ্ত শিখা
নাছোড়বান্দা আনুগত্য, অপ্রাসঙ্গিকও বটে!
পাথর-চোখে চেয়ে দেখি তোমাদের সিঁথিতে সিঁদুরের বর্ষণ উৎসব—
চেয়ে দেখি—দ্বার খুলল বুঝি আর এক প্রবঞ্চনাময় মহাকাব্যের।
সহস্র-লক্ষবার শিখেছি, ভুলেছি, আমার নারীত্বের পরিভাষা,
সহস্র-লক্ষবার ভুলেছি সতীত্বের নষ্ট সত্যের অন্বেষণ।
লব-কুশ আমার আত্মজ, কিন্তু তারাও আমার রাজাধিরাজ রামের আদলেই সৃষ্ট—
তারা যে আজ প্রস্তুত, জন্ম নেবে আর একটি অগ্নি-স্নাত উপাখ্যান, ত্যাগ, তিতিক্ষা আর সহিষ্ণুতার।
প্রতারণা ও দীর্ঘ অপমানের পরে, বহু কষ্টার্জিত আর একটি অধ্যায়ের সূচনা।
কিন্তু তার আগে—একটি বার, শুধু একটি বার, হে কন্যারত্নরা, আমার আত্মজা নও জানি
তবু একটি বার হেঁটে দেখ আমার কণ্টকাকীর্ণ পথে, নিশ্বাস নাও একটি বার এই তপ্ত অঙ্গারে।
আর তারপর—নিমজ্জিত হবেই সেই পূতিগন্ধময় আখ্যানে।
ছবি: অঞ্জন চক্রবর্তী