স্থানান্তরিত: একটি যাপনের কবিতা
5/5 - (1 vote)

শুরু করা যাক আমার পূর্বজদের কাহিনী দিয়ে।
আমার পিতামহ, মাতামহ, পিতামহী, মাতামহীরা
পরিত্যক্ত বসতবাড়ি, ভিটে-মাটি-গাছ-ফুল
বিপদের চরম খাদের ধারে ফেলে
সাঁতরে পেরিয়ে গেলেন নদীর এ-কুল থেকে ও-কুল।
নদীর উত্তাল জোয়ারে ভেসেছিলেন যখন,
শূন্য থেকে শূন্যের যাত্রাপথে—জানা ছিল না
কি ছেড়ে যাওয়া ন্যায্য, আর কি বা সঙ্গের সাথি করে
নিতে পারা সমীচীন।

শুভাঙ্গী মুখার্জীর ছবি

ধ্বংসের সেই প্রবল ঘূর্ণিপাকে—জমি-ঘর-স্বপ্নের নকশা-আঁকা দলীল,
ভালবাসার চিঠি, পুঞ্জিভূত সম্পদ
আর হৃদয়-ভরা বিশ্বাসের মৃত শরীরের মাঝে
তারা পরবাসী হলেন, ‘উদবাস্তু’ তকমা পেলেন
সহযাত্রীদের সাথে, জড়সড়, ঠাসাঠাসি জীবনযাপনে,
ক্রোধে-ক্ষোভে, কাঁটা তারের বেড়া পেরিয়ে।

আমার দিদিমার স্ফীত, ফ্যাকাশে শরীর সন্তানের জন্মের
স্বাক্ষর বহন করেছিল ভীড়াক্রান্ত কলোনির মাথা গোঁজা আধো আঁধারে
সঙ্গী উদবাস্তুদের নিঃশ্বাসের, উপস্থিতির ওমের মাঝে।
আর তাদের সন্তান, আমার পিতা-মাতারা, নতুন অস্তিত্বের ইমারত গড়ে,
নতুন স্বপ্নের নির্মাণ-বিনির্মাণে, সাঁতরে গেলেন এক বিচিত্র ঢেউ-এর অভিমুখে।
বেগবান, অদ্ভুত সেই প্রবাহের অপর নাম ‘ইমিগ্রেশন’, অভিবাসন।

ছুঁয়ে দেখেন নি তারা, জানে্ন নি কেমন তাদের পৈত্রিক বসতবাড়ির নাক-মুখ- চোখ
জানেন নি তারা, প্রকৃতই ‘জন্মভূমি’ কি কি অনুষঙ্গ বহন করে।
পূর্ববঙ্গ, ইষ্ট বেঙ্গল তাদের নষ্ট ছেলেবেলার খেলা-র সাথে এক হল, ঘর বাঁধলো,
সমস্ত এলোমেলো, অর্থহীন বিপ্লবের যেন এক অব্যর্থ প্রতিষেধক সে।

বাঙ্গাল উপভাষার কলতানে, পদ্মা নদীর প্রতি নামহীন আকুলতায়,
দুই বাংলার বিবিধ মেজাজে, মননে, গঠনে আত্মস্থ করলেন—
যে আগুন আর জলের সহাবস্থান তাদের অমোঘ এক সত্য।
ধীরে ধীরে, তারপর ক্রমশ সতেজ শব্দে অভিবাসী জীবনের ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে…

বেজে ওঠে কালাপানি পেরনোর সঙ্কেত-ধ্বনি, সেই কালা পানি,
যাকে অতিক্রম করা ছিল পূর্বজদের চোখে মহাপাপ, আর সেই পাপের মহাপাতক আমি
বয়ে চলি নিদ্রাহীন নদীর কুহক ডাকে, সুদুর সমুদ্রের নামহীন হাতছানিতে।

আমার জন্মের নাড়ি, শেকড় ছিন্ন হল দুই দুই বার, তাই কি বিজাতীয় জমিতে খুঁটি বাঁধা আমার মন,
স্থানান্তরিত জীবনের সত্যের চাবুকের অভিঘাতে জাগিয়ে রাখে আমায় ঘোর অন্ধকারে?
মধ্যরাতের শীতল হাওয়ায় কখন দোর খুলে যায়, টালমাটাল আমি ইতি-উতি চলি।

আমার উত্তর-আধুনিক জীবনচর্যায়, ‘অভিবাসন’ এক অনুভব, এক চেতনা নিয়ে পাখা মেলে।
আমার ধূসর যন্ত্রনা এক অদ্ভুত প্লাস্টিক স্থীরতায় রুপান্তরিত হয়।
আর আমি, আমরা, শেকড়ছাড়া, নাড়িছেড়া সভ্যতার বীজ, ও আমাদের সন্তানরা,
সেই সব নামগোত্রহীন সংগ্রামের রঙের, কোলাহলের, আলোছায়ার নিঃশব্দ রূপক।

ছবি : শুভাঙ্গী মুখার্জী