“কালকে তাহলে কোথায় যাচ্ছেন?”–ঘাম চপচপে জমাট ভিড় থেকে এমনই প্রশ্ন ভেসে এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নকর্তাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। আর সেটা করতে গিয়েই বিপত্তি। শরীরটাকে এমন বেঁকিয়ে ফেলেছি যে নর্মাল পজিশনে আসতে ততটাই সময় লাগবে যতটা কংগ্রেসের লাগবে ভারতের শাসক হিসেবে ফিরে আসতে। লাইন থেকে বেরনোর উপায় নেই। লাইন দিয়েছি বসার জায়গা পাবার জন্য। দাঁড়িয়ে বেগেল বা বার্গার চেবানো যায় কিন্তু লাবড়া-খিচুড়ি-টমেটর চাটনি নয়। কয়েকটি মাত্র নৈবিদ্যের মতন ছড়িয়ে রাখা চেয়ারগুলোতে লাইনে দাঁড়ানো সবার শ্যেন দৃষ্টি। খাবারের জন্যে প্রায় আধঘন্টা দাঁড়াবার পর গত পঁচিশ মিনিট চেয়ারের লাইনে।
এদিকে হাতে ধরা শোলার খোপ কাটা থালায় লাবড়া, চাটনি, ততক্ষণে প্রায় এক হয়ে গিয়েছে। গরম বলতে আমার মাথাই শুধু। থালায় সবই এতক্ষণে ঠান্ডা। ভোগে ভরা থালা কলকাতার রাস্তায় জমা জলের মতন টইটুম্বুর। কিছুটা পড়বি-পড়বি-পড় অবস্থায় আশেপাশের নতুন শাড়ি কিম্বা পাঞ্জাবি তাক করে রয়েছে। বুড়ো আর কেড়ের ওপর শোলার থালা ভেসে, কেড়ে আঙ্গুলটা নড়েছে কি ব্যাস! ভোটের আগে নেতাদের মতন দল বদল করবে। মানে শোলা থেকে দে ঝাঁপ পাঞ্জাবি কিম্বা শাড়িতে। শাড়ি পরিহিতার দলে নাম লেখালে তো কথাই নেই। গালাগালের মেনুতে কি কি থাকবে ভেবেই শিউরে উঠলাম।
“তোমাকে বললাম এতটা নিও না। অঞ্জুবউদি তোমার থালা দেখে সবার সামনে আমাকে বললে যে, এ বয়সে সুগার পেশেন্টের এত খাওয়া ভালো নয়।” বুঝতেই পারছেন কার গলা। আমার ইস্তিরি।
“দেখো হেভি খিদে পেয়েছে। লাঞ্চে তোমার ইয়া লম্বা লিস্ট নিয়ে এডিসনে না গেলে পেটটা খালি থাকতো না।”
“ওখানেই তো কিছু খেয়ে নিলে পারতে?”
“ল্যাম্ব চপ না খেয়ে নিরামিষ খাবো এডিসনে? আচ্ছা, তুমি কোনো বাঙালিকে দেখেছ এডিসনে তেল পুড়িয়ে ড্রাইভ করে পৌঁছে রুটি আর আলুকপির তরকারি চিবোচ্ছে? নেহাৎ নন-ভেজ খাবার আদেশ তাই। ওই মাটন কোরমার সাথে দুটো ধানিয়া-নান আর একপ্লেট ল্যাম্ব চপ –”
“তুমি আমিষ খেলে? আজ না অষ্টমী? পইপই করে বলেছিলাম নিরামিষ ছাড়া কিছু খাবে না”
“আরে ধ্যাৎ-সব ব্যাপারে ইয়ে করো না– খেলাম কোথায়? ভেবেছিলাম খাবো–“
“সেকি? মন্দিরে দাঁড়িয়ে তুমি এই কথা ভাবতে পারলে?”
“যাহ্! কলা, এখন কোথায় ভাবলাম? লাঞ্চের সময় ভেবেছিলাম তো”
“তাই বলে তুমি এভাবে খিচুড়ি নেবে? কাঙালি ভোজন নাকি? অঞ্জুবউদি ঠিক দেখে নিল। লজ্জা লজ্জা। আমার প্রেস্টিজের কথা ভাবলে না?”
“প্রেস্টিজ? আমিষ ছেড়ে প্লেট ভরে নিরামিষ গিললেও তোমার প্রব্লেম আবার আমিষের কথা চিন্তা করলেও প্রব্লেম? হ্যাঁ নেবো। একশোবার নেব। ফুল চাঁদা যখন দিয়েছি, তখন ফুল প্লেট নেবো। আর তোমার অঞ্জুবউদির দুহাতে যে দুটো প্লেট! সেই বেলা? আমার একপ্লেট খিচুড়িতেই এত নজর কেন?”
“কোনও আক্কেল নেই তোমার? বয়স্কদের নিয়ে এভাবে কথা বলো? ছি!-আহারে, ওর শাশুড়ির জন্য নিতে হবে না? উনি বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেন না।“
“ঢপের চপ। আমি নিজের চোখে দেখেছি ওই শাশুড়ি মাক্সি পরে হন হন করে ইভিনিং ওয়াক করছে। আসে পাশের গোরাগুলো হাঁ করে দেখছে। আমাকে বাতেলা দিও না। ভাগ্যিস দশভুজা নয় তোমার বউদি, তাহলে আরও আট্টা শাশুড়ির এক্সকিউজ দিতে হতো!”
“ধ্যাত, ওর তো একটাই বিয়ে! কি যাতা বল না! খিদের চোটে মাথাটা গেছে।”
“তাই নাকি? আমার মাথা গেছে? একটা বিয়ে বললেই হোল? একটা বিয়েতে এমন রেখা টাইপ ফিগার মেনটেইন হয় নাকি?”
“কেন? আমার কটা বিয়ে? তুমি কি আমাকে নিয়েও এই কথা বললে?”
“তোমার? তোমার তো মাথাও নেই তাই মাথা ব্যথাও নেই”
“মানে?”
“মানে, তোমার ফিগার নিয়ে কী চিন্তা!”
“ছিঃ, মন্দিরে দাঁড়িয়ে তুমি এই মেয়েদের ফিগার নিয়ে এমন নোংরা কথা বলতে পারলে?”
“এ তো মহা জ্বালা! দেখ আমি কিন্তু ঠিক পজিশনে দাঁড়িয়ে নেই। বার বার মন্দির দেখিও না। এমনিতেই নার্ভাস কখন আমার কেড়ে আঙুল সরে যায় ! “
হঠাৎ বাইরে থেকে তারস্বরে কেউ “গেলো রে-গেলো রে” বলে চিৎকার করে উঠলো। আর সেই আওয়াজের উত্তরে সবাই “কোথায়? কোথায়?” বলে একে অপরের পা মাড়াতে লাগলো।
“এই সবাই পা মাড়াচ্ছে। তুমি কিন্তু থালা শক্ত করে ধরো।”
“আরে কি ভেবেছো কি আমায়। আমি প্রস্তুত। আমার এই অভিজ্ঞতা আছে তাই এবারে গামবুট পরে এসেছি। আমাকে বোকা ভেবো না।”
“যাক, দুগগা, দুগগা”
হঠাৎ দেয়ালে লাগানো স্পিকার বক্সে মন্ত্রের বিরতি ঘটিয়ে কেউ অ্যানাউন্স করলো “দেরি করে এসে মন্দিরে পার্কিং না পেয়ে ফাঁক বুঝে পাশের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের মধ্যে যাঁরা পার্কিং করেছিলেন তাঁদের গাড়ি টো-ট্রাকে করে পাড়ি দিচ্ছে অন্যত্র।”
আজকাল বিরাট মন্দির হয়েছে ঠিকই তবে পার্কিং অনেকটা মরীচিকার মতন। ধরাধরিতে অযথা সময়ের অপচয়। তাই ফাঁকা জায়গা পেলেই সবাই ঢুকে যায়। এনাউন্সমেন্ট শুনে আমার দুহাত দুরে বিশজন পরে দাঁড়ানো এক পঞ্চান্ন গোছের ব্যক্তি মুচকি হেসে উঠলেন। মানে সবাই এখন লাইন ছেড়ে গাড়ি বাঁচাতে ছুটবেন আর উনি তরতর করে লাইনের সামনে এসে পড়বেন, এরকম কোনও ভাবনায় নিশ্চয়। কিন্তু আমার মটকা গেলো জ্বলে। একে ব্যাঁকা শরীর কিছুতেই সোজা হচ্ছে না। তার ওপর যাঁরা চেয়ার পেয়েছেন তাঁদের এমন ভাব যেন তত্তে এসেছেন। তাই ওই ঝাল ঝেড়ে দিলাম জ্বলন্ত মটকা থেকে।
“এই যে দাদা, কি করে আপনার এত হাসি পাচ্ছে শুনি?”
“এত কোথায় দেখলেন! এই একটুখানি হাসলাম। তাও মুখ হাঁ করিনি।”
আমার পেটের মধ্যে মুখ থেবড়ে আছে এক ছোকরা। নীচু হয়ে তাকে দেখতে পাচ্ছি না। ওই ছোঁড়া টিপ্পনী কাটলে “কারোর সব্বনাশ আর কারোর মুচকি হাস”
আমার ঠিক পিছনেই ছিল এক জেহাদি আদমি। সেও দেখি প্রতিবাদ করলো “এতগুলো মানুষের গাড়ি গেলো আর আপনার আনন্দ হোল? আপনি শালা নির্ঘাত সিপিএম!”
ওই পঞ্চান্ন গোছের ব্যক্তিটি মুখের আধা অংশ বিকৃত করে বললেন “আমারটাও গেছে ভাই। কিন্তু এখন আর কোনও অপশান নেই।”
আমি আমার সহধর্মিণীকে বললাম, “সত্যি কথা বলেছে কিন্তু, কোনও অপশান না থাকলে কাঁদা হাসা দুইই সমান। গাড়ি গেলে যাক, খিচুড়ির লাইন কিন্তু ছাড়া যাবে না।”
আমার বউ আমাকে চিমটি কেটে ফিসফিস করে বললে, “একটু আস্তে কথা বল। সবাই শুনছে। আমাদের গাড়ি ঠিক আছে তো?”
আমিও ফিস ফিস করে বললাম, “হ্যাঁ গো হ্যাঁ, আমি দেড় মাইল দুরে একটা শপিং কমপ্লেক্সে পার্কিং করেছি। আরে আমি কি প্রথম আসছি এখানে?”
এ কথা শুনে আমার বউয়ের ‘রাবণনিধনা’ প্রাণখোলা হাসি। কি যে আনন্দ পেয়েছে! হাতের তেলো দুটোকে চোঙ্গার মতন করে খুশি উদ্গার করলে, “অঞ্জুবউদি, ও অঞ্জুদি, আমাদের গাড়ি নিয়ে চিন্তা করো না, আমাদেরটা ঠিক আছে।” যেন অঞ্জুবউদি দেয়ালে মাথা ঠুকছিলেন আমাদের গাড়ির চিন্তায়।
“কি বললি রে কিছুই বুঝলাম না”। অঞ্জুবউদি কি করে বুঝবেন, উনি তো তখন কায়দা করে পা টিপেটিপে শাড়ি সামলাতে ব্যস্ত। হাত দুটি যে প্লেটের তলায়। ওর জলের গেলাস সামলাচ্ছে এক গেছো কেতাবি মাঝবয়সি। সে বলে উঠলে, “একটু খোলসা করে বলবেন, অঞ্জুদি একটু ব্যস্ত”
“ও–বুদ্ধি-করে-পার্ক-করেছে-এবারে।” বাহ! চমৎকার! আমার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় আমার পার্কিং পাওয়াতে! আর আমার বউ তা চাউর করছে।
“আরে সবাইকে শোনাতে কে বললে? অঞ্জুবউদিকে ফোন করলেই হতো।”
“কি করে? বউদির দুহাতে প্লেট। মনে আছে গতবার কত খসে ছিল গাড়ি ছাড়াতে? অঞ্জুবউদি খুব শুনিয়েছিল। বলেছিল তোমার একদম বুদ্ধি নেই। তাই আমিও এবারে শুনিয়ে দিলাম।“
পঞ্চান্ন আমার বউয়ের কথা ক্যাচ করে একটা ঢিল মারল, “কত লেগেছিল ভাই? গাড়ি ছাড়াতে? জানলে একটু সুবিধে হয়।” চিৎকার করে বলে উঠলাম, “বলবো না।” এই লোকটার নির্ঘাত কোনও অ্যাজেন্ডা আছে। আমাকে কাঠি করার মতলব।
কিন্তু আমার বউ প্রমাণ করেই ছাড়বে তার বরের থেকে বুদ্ধিমান ব্যক্তি একটিও নেই। আমার হয়ে সেই জবাব দিলে, “৩১০ হতো বুঝলেন কিন্তু ও বলেকয়ে ওটা ১৩৩-এ রফা করেছিল। দারুণ না?“
“বাহ! এতো সত্যি বুদ্ধিমান ভাই বলতে হবে। বেশ ধান্দাবাজ”
“কি বললেন? আমি ধান্দাবাজ?”
“আরে আপনি আবার খেপছেন। ভালো অর্থে বলেছি–ম্যানিপুলেটিভ”- বলেই সেই মুচকি হাসি।
আমি আর সামলাতে না পেরে দাঁত কিড়মিড় করে বউকে বললাম, “তোমাকে সাধে কি আর বলেছি তুমি অন্য ক্যাটেগরির”। বলেই বুঝলাম ফাঁদে পা দিয়েছি। পঞ্চান্ন লাইনে এগোনোর রাস্তা চায়। আমাদের ডিভাইড করতে চায়।
“কি বললে?” বউয়ের গলায় কর্কশ ধ্বনি। আমি মিটার ডাউন করলাম। “না, মানে, বলছিলাম তোমার অঞ্জুবউদির আমাকে নিয়ে কত্ত চিন্তা! আমি বুদ্ধিমান জেনে উনি নিশ্চয় খুব প্রফুল্ল বোধ করছেন।”
বউ ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি ব্যাপারটা কি হোল।
আমি কথা ঘোরালাম, “বাই-দা-ওয়ে, ওনার শাশুড়ির কিন্তু আজ উপোস।”
“সেকি!তাই নাকি? দেখো দিকি, বেচারি ভুল করে দুটো প্লেট ক্যারি করছে। তুমি কি করে জানলে?”
পঞ্চান্ন খ্যাঁক করে বলে উঠলো, “ভাই এর বেলায় ‘সুগার পেশেন্ট’ আর অঞ্জুবউদির বেলায় ‘বেচারি’!”
শালা সব শুনেছে। ডিভাইড চাইছে ডিভাইড। লর্ড ক্লাইভের বরাহনন্দন।
মাথা ঠান্ডা করে বললাম,“শোনো, চিন্তা করো না। স্বামীজি মাইকে বলেছেন এটা মায়ের প্রণামি-ভোগ। তাই সুগার নেই। মায়ের রান্নায় সুগার থাকে না। তুমি বাজে কথায় কান দিও না।”
আমার পেটের মধ্যে নাক ঘষে ঘষে হদ্দ সেই ছোকরা ফোঁড়ন কাটল “দাদা, ওটা মায়ের রান্না নয়, ওঙ্কারদার রান্না, জম্পেশ টেস্ট। প্রচুর সুগার আর সল্ট সাথে সবুজ লাল কাঁচা লঙ্কা। ডাল আর চালের বিরিয়ানি। ক্যালরি অনেক তবে সুগার ফুগার নিয়ে অত চাপ নেবেন না। চটপট খেয়ে বেরতে বেরতে আরও ঘণ্টা খানেক। ঘামের সাথে ক্যালরি মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।”
বাচ্ছা ছেলে। মনে হোল বল, “আমার সুগার তো তোর বাপের কি?” কিন্তু মুখ দিয়ে যেটা বেরুলো সেটা আমার বউয়ের পক্ষে গেলা কঠিন। মানে এই ঘামে ভিজে ধুতিটা এমন জড়িয়ে গেছে না!
“ভাইটি–নিচেই যখন আছো, একটু আমার পেছনেরটা সামনে আর সামনেরটা পেছনে করে দেবে?”
ব্যস, যেই না বলেছি, দেখি আমার বউয়ের কালীমার্কা জিহ্বা প্রসাদের আপেল শুদ্ধু বাইরে ঝুলছে। চারিপাশে আবালবৃদ্ধবনিতার শ্যেন দৃষ্টি আমাকে নিক্ষেপ করে বোমা মারার অপেক্ষায়।
“ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ, মন্দিরে দাঁড়িয়ে তুমি এ কথা বলতে পারলে?”
“মানে আমি বলছিলাম–এই শোনো–কি যেন বললাম–মানে“
পেছনের জেহাদি আদমির হঠাৎ আস্ফালন “দাদা কি হচ্ছে কি? কচি, খুকি, খোকা, দাদু, কাকু, কাকি, মাসি, পিসি, মামা, মামি, দিদা, দিদি আর আমাদের বউদির ইজ্জত দিতে শিখুন। নইলে আপনার ছবি তুলে ফেসবুকে লাগিয়ে তলায় ভুতজলকিয়া-টাইপ ক্যাপশান সাঁটিয়ে দেবো একেবারে। যতসব পারভারট!“
“ভুত- কি?”
অঞ্জুবউদির পাশের সেই কেতাবি মাঝবয়সি সুযোগ বুঝে কপ্পুর দিলে ঘৃতে, “মানে বলছে লঙ্কা, চিলি টাইপ ক্যাপশান। একবার ফেসবুকে লাগলে সারা জীবনের জন্য ঝাল লেগে যাবে।”
আমি সামাল দেওয়ার জন্য বলে উঠি “আরে দাদা, না না, ওসব কিছু–কি যে আপনারা মানে করছেন!”
পেটের কাছে ছোকরা ফাঁপরে পড়ে গেল, “দাদা, আপনি কি বললেন সব ট্যান গেছে। সবার সামনে এসব করলে পাবলিক ক্যালাবে। তারপর ধর্মীয়স্থান। সবাই ল্যাবড়ার লাইনে দাঁড়িয়ে এমনিতেই বমকে আছে। আর আপনি ল্যাবড়া হাতে ধরে এ সব কী আওড়াচ্ছেন মাইরি!”
এই হয়েছে আমাদের ইয়ং জেনারেশনের জ্বালা। সব কিছুই “এ” মার্কা করে ফেলে। আতাক্যালানের দল। মনে হোল কানের গোড়ায় দি শালা সিলোন ধরিয়ে!
“আরে ধ্যাত্, আমার পা’টার কথা বলেছি ভাই–সব কথাতে সব কিছু খুঁজবে নাকি?“
পঞ্চান্ন গোছের ব্যক্তিটি আমার বউকে উদ্দেশ্য করে বললেন- “দাদা কিন্তু রসিক আছে”।
এক নম্বরের ঢ্যামনা। খালি আমার বউয়ের সাথে কথা বলার বাই। ডিভাইড চাইছে বুড়ো ভাম।
“এই যে, এই যে দাদা, আপনার গাড়িটার কি হবে খেয়াল আছে। আজকাল আবার রেট বেড়েছে। কমপক্ষে আপনার হাজার যাবে মনে হয়”। ভাবলাম টাকার অঙ্ক শুনে চুপসে যাবে কিন্তু খোঁচা নিরর্থক। পঞ্চান্ন রিটার্ন দিলো মুচকি হেসে, “আড়াইশ হাজার মাইল কভার গাড়িটার–হাজার চাইলে রেখেই আসবো। অত পুরোনো মাল আর চলে না।“
লাইনে দাঁড়ানো এক খচ্চর বললে, “সেই। সবাই কি আর অঞ্জুবউদি!”
ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে আমার বউ আমার দিকে ঘুরে কড়া ভাষায় ঝাড়ল, “ছিঃ, মন্দিরে দাঁড়িয়ে তুমি এ কথা বলতে পারলে?”
“আরে আমি কোথায় বললাম?”
“আমি স্পষ্ট শুনলাম”
এই যুক্তির উত্তর হয় না। স্পষ্ট শুনেছে মানে আমিই বলেছি! এতো আচ্ছা মুশকিল!
আমি আর্তনাদ করলাম, “আপনি কে দাদা? অঞ্জুবউদির মাইলেজ নিয়ে কে উক্তি করলেন? প্লিজ একটু হাত তুলুন!”
আবার পেনাল্টি খেলাম। কখন যে কি বলে ফেলছি। ধার্মিক বউ ধমকে দিলে, “তুমি আমাকে এই জায়গায় নামালে? আমাকে লোকের কোথা শুনে তোমায় বিশ্বাস করতে হবে!”
অঞ্জুবউদির গেলাস ধরা মাঝবয়সি টেকো কেতাবি বললে, “ অঞ্জুদির কানে ব্লুটুথ–শুনতে পায়নি”
কি গ্যাঁড়া–দুদিকেই কাটে। আমার সোডিয়াম আর পটাসিয়াম এখন আর কাজ করছে না। অঞ্জুদি কানে দাঁত লাগিয়ে সাময়িক কালা হওয়াতে এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।
“দাদা, বউদির কথায় মাইন্ড করবেন না। অঞ্জুবউদি আমাদের বউদির উইকপয়েন্ট” বলেই, পেটের কাছের ছোকরাটি পেট ঘষে নিচে নেমে গেলো।
বউ বললে, “দেখো। দেখে শেখো। সবাই আমাকে চেনে। শুধু তুমি ছাড়া!”
মনে হোল এই হারামজাদা ছোকরাকে কোলে তুলে শিশুপালের মতন বধ করি। কিন্তু সয়ে নিলাম। নেহাতই ধুতির এদিক ওদিক করতে কাজে লাগছে!
“ও কি করে তোমাকে চিনল? আমাকেই এতক্ষণে চেনেনি। ও তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। আমার পেটের কাছে ওর মাথা।“
“চেনার জন্য দেখতে হয় নাকি”
“আলবত হয়! সুকেতুদা আমাকে না দেখে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছিলো মনে নেই?”
“আবার তুমি আমার বাবাকে তোমার দাদা বলছ? ও অঞ্জুবউদি, তুমি শুনলে, আমার বাবাকে আবার দাদা বলছে!”
আবার অঞ্জুবউদির একই অজুহাত “কি বললি রে কিছুই বুঝলাম না”।
গেলাস হাতে ধরা কেতাবি টেকো গলা ছেড়ে সলিউশান দিলো, “দাদা, এই জলটা আপনি খেয়ে নিন। অনেকক্ষণ খালি পেটে তো!”
মহা ধড়িবাজ। সামনে রেখা-টাইপ অঞ্জুবউদি পেয়ে টপ গিয়ারে খেলছে! তা বাপ-এই বয়সেও তো অঞ্জুবউদির জল হাতে করে ঘুরছ। ক্ষমতা থাকলে আঁচল ধরে দেখা শালা! বললাম “আপনি থামুন তো! কুড়ি বছর ধরে পাড়ার দাদা সুকেতুদা সবে চার বছর হোল বাবা হয়েছে। এর মধ্যেই পুরোনো সম্পর্কে তালা দেবো?”
গেছো পঞ্চান্নর হাইলি মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং – চাপা গলায় আমার বউকে প্রশ্ন, “বোন, না , ভাই? মানে আপনার বাবা নাকি চার বছর আগে আবার বাবা হয়েছেন।”
গেলো! অবুঝ প্রশ্নে আমার বউয়ের বোধে তখন হ্যারিকেন! ওকে কিছু না বলে আমার ওপর গর্জন। “তুমি এই ভাবে সবার সামনে আমার বাবাকে অপমান করলে?”
এই প্রশ্নের উত্তরে যাই বলবো তাতেই মনে হবে আমি ডিফেন্স করছি। আর একবার ডিফেন্সে গেছি কি বাঁশ নিয়েছি। তাই নিশানা চেঞ্জ। বউকে উত্তর না করে পঞ্চান্নকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, “আরে ধুর মশাই। আমি ওর বাবার সাথে আমার পুরোনো সম্পর্কের কথা বলছি”। আবার মনে হল বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছি।
ব্যস! জেহাদিকে আর পায় কে, “দাদা, এই ভোগের লাইনে দাঁড়িয়ে এই সব কমপ্লেক্স রিলেশান নিয়ে কমেন্ট করবেন না বলে দিলুম। সমস্ত লেডিজ কিন্তু স্ট্যান্ডিং। পুজোর টাইম। পুন্যির টাইম। শালা গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবো। কার বাবার সাথে আপনার কি সম্পর্ক এই সব নোংরা কথা মানায়? দেবো একটা পোস্ট করে?”
মনে মনে ভাবলাম বাবা তাই দে। আর নিতে পারছি না। ভোগ খেতে এসে এই ভোগান্তি আর সয় না। চিৎকার করে বলে উঠলাম, “প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ- আমাকে আপনারা আর ভুল বুঝবেন না। আমার পা-গুলো ঠিক জায়গায় নেই। আমার বউয়ের বাবা একসময় আমার দাদা ছিল। এন্ড আই ডোন্ট কেয়ার এবাঊট অঞ্জুবউদির মাইলেজ। আমি শুধু খেতে চাই।”
পিন ড্রপ সাইলেন্স। জেহাদির ঠোঁটটা নড়ে ওঠার আগেই বুঝতে পেরেছি আমার বাক্য রচনায় মারাত্মক গাফিলতি হয়েছে। কারেক্ট করার চান্স আরও রিস্কি হতে পারে। তাই আমিও চুপ করে গেলাম। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে কানের কাছে অস্পষ্ট গলায় কেউ বললে, “টপিক বদলাও।”
মুখ কিছুটা ঘোরাতে পেরে দেখি অনেকদিনের পরিচিত অচলদা। “আহ বাঁচা গেলো। অচলদা যে। আমার খেয়ালই নেই আপনি আমার ঘাড়ের কাছে। কেমন আছেন?”
“মুখ তোমার কাঁধে, এক হাতে ভর্তি প্লেট, অন্য হাতটা ছাড়াতে পারছি না। আর জোর নেই। যেমনটি আছে তেমনটি রেখে দিয়েছি। বোতাম গুলো সব খুলে গিয়েছে।”
“মেরেছে! এর মধ্যে তো আবার লাগানোও যাবে না”
“চাপে আটকে আছে। ভয় নেই”
“আমার তো আবার ধুতি, বোতাম খোলার ভয় নেই।” বলেই মনে হল বেদম রিস্ক নিয়ে ফেলেছি।
“ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ , ছিঃ মন্দিরে দাঁড়িয়ে তুমি এ কথা বলতে পারলে?” বউয়ের আবার সেই এক কমপ্লেইন।
“কেন? ধুতি পরা পাপ নাকি? পুরোহিত কি ধুতি পরে না?”
“ধুতির কথা হচ্ছে না।”
জানি কীসের কথা হচ্ছে। কিন্তু এক্সপ্ল্যানেশানের রাস্তায় আরও বিপদ। তাই আগ বাড়ালাম না।
কিন্তু জেহাদিকে কে থামায়। “দাদা আপনার ল্যাঙ্গুয়েজটা কিন্তু ক্যাডার টাইপ হয়ে যাচ্ছে। সাবধান করে দিচ্ছি।”
আর নিতে পারলাম না। তেড়ে মেড়ে উঠলাম। “কীসের থেকে সাবধান করছেন শুনি?”। অ্যাটাক ইস দা বেস্ট ডিফেন্স।
ব্যস, আমার প্রতিবাদ আমার বউয়ের গায়ে লেগে গেল,“ও অঞ্জুবউদি! তোমার পাশে দাঁড়াবার জায়গা আছে?”
এবং যথারীতি কেতাবি মাঝবয়সির প্রাণ উথলে উঠলো, “বউদি চলে আসুন, চেপেচুপে হয়ে যাবে”
শুনলেন! চেপেচুপে হয়ে যাবে! আস্পর্ধা! গায়ে সেন্টের গন্ধ মেখে বাহারি পাঞ্জাবি পরে, হাতে দশ আঙ্গুলে বারোখানা আংটি পরে, প্লাস্টিক গেলাসে অঞ্জুবউদির জল বইছ। তাই নিয়েই থাকো না। টেকো পারভারট। আমিও শালা ডাবল মিনিং কাটলাম। “সবাই কি আপনার বউদি? দিদি বলতে পারেন না”
“আমার কাছে দিদি বউদি সব সেম”
“মানে? ঠিক পরিষ্কার করে বলুন”
বউ দলবদলের হুমকি দিলো। “এসব কি ইয়ার্কি হচ্ছে। থামবে তুমি। এবারে আমি সত্যি ওদিকে চলে যাবো কিন্তু!”
পঞ্চান্ন আবার কাঠি করলেন। মুচকি হাসিটি বজায় রেখে বললেন “দিদি বউদি সব সেম মানে দুজনেই পুজোনীয় – সে কথাই বলছে”
আমি আর পারলাম না। জ্বলে গেছি! দড়াম করে বললাম “আচ্ছা দাদা, আপনার তো হেভি জ্ঞান। তা আইএসেস আর মোদী সম্পর্কে আপনার কি বক্তব্য? মমতার দুর্নীতি নিয়ে কিছু বলুন না”
জেহাদি সুযোগ ছাড়ে না “ঠিক ধরেছি, দাদা বিজেপি!”
“নিকুচি করেছে বিজেপির”–একটু চেঁচিয়েই বলে ফেলেছি। লাউডস্পিকারে ঘোষণা হোল “কে বিজেপি বিজেপি বলছেন। মন্দিরে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করবেন না। আবার শুনলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবো।”
বোঝো। আমরা শুধু মন্দির নিয়েই রাজনীতি করতে পারি। কিন্তু মন্দিরে রাজনীতির আলোচনা মানা।
মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে, পেটে ছুঁচো ডন মারছে। আগে খাবার চাই। খাবার খেলেই অশান্ত মানুষ শান্ত হয়।
হঠাৎ নিচ থেকে সেই ছোকরা বলে উঠলো “দাদা, পেয়ে গেছি, রেডি থাকুন” –”এক, দুই, তিন -“
আমি প্রাণপণে কেড়ে আঙুল সোজা রেখে পজিশান চেঞ্জের অপেক্ষায়।
“চার, পাঁচ, ছয় –“
“আরে শালা মার টান–এত গোনার কি আছে”
“মে-রে-ছি-!
অচলদা বললেন, “এই ইয়ং জেনারেশন কিন্তু অনেক কাজের। ওরে ব্বাবা -“ বলে অচলদা ধড়াম করে পড়ে গেলেন। কাজের ছেলেটি আমার পা ভেবে অচলদার পাটা টেনেছে।
“অচলদা, ও অচলদা”
বউ ঘাবড়ে গিয়ে আমার কাছেই আমার খোঁজ খবর নিলে। “কি হোল, তুমি ঠিক আছো?”
নিচ থেকে আর্তনাদ করে একটা আওয়াজ এলো “এই ইয়ং জেনেরেশানকে দিয়ে কিস্যু হবে না।”
“ওগো তোমার কিছু হয়নি তো?”
কে কার কথা শোনে। আমি ছোকরাকে বললা, “আমার পায়ে গাম্বুট”। ছোকরা গাম্বুট দেখে পা চিনে টেনে সোজা করে দিলো। নাকের কাছে ল্যাবড়ার গন্ধ যারপরনাই তার ডিস্টার্ব করছিলো। দিলাম সুরুত করে জিব দিয়ে আলুটা মুখে পুরে। আহ! কি শান্তি। যাক বউ ওই মধ্যবয়সির দিদি হতে। কুছ পরোয়া নেহি। এতটাই আনন্দ যে তোমরা আমাকে যাই বলো – বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস। আমার তখন বুকে মাথায় মুখে খিচুড়ি আর ল্যাবড়ার স্বাদ। কি অপূর্ব এই পৃথিবী। খাবার আসলে মানুষকে বদলে দেয়।
“এ বাবা! তুমি কি গো? মুখ দিয়ে খাবার খেলে?”
“খাবার মুখ দিয়েই খাওয়াই সব থেকে হাইজেনিক। হাত ধোবার ঝামেলা নেই।”
“অঞ্জুবউদি-”
“হ্যাঁ, বল তোমার অঞ্জুদিকে। তুমি কেন? আমিই বলছি – এইযে অঞ্জুবউদি – আমি ডিরেক্ট মুখ দিয়ে আলু খেয়েছি। এরপরে খিচুড়িটাও খাবো চেটেপুটে। জিব দিয়ে। আর আপনি যখন খেতে বসবেন তখন আমি ঢেকুর তুলবো আপনার পাশে বসে! পা বেঁকে ছিল বলে এতক্ষণ আলুটা মুখে পুরতে পারিনি। এখন পেরেছি। কুছ পরোয়া নেহি।”
আমার বউ কিছুটা থতমত খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি তখন গোগ্রাসে ভোগে নিমিত্ত। হঠাৎ খেয়াল হল, মেরেছে! চাপে পড়ে একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটিয়েছি। অঞ্জুবউদির বর আমার বসের বস। মায়ের ভোগের ঠেলায় আমার চাকরি মায়ের ভোগে পাঠালাম না তো।
“এসব তুমি কি বললে? তোমার কি হয়েছে?”
“এই যাহ! কি বলতে কি বলে ফেলেছি। প্লীজ একটু ম্যানেজ করো।”
“এই জন্য বলেছি সকালে খালি পেটে প্রাণায়াম করো। স্বামীজি বলেছেন পেট ভালো থাকলে মাথা ঠিকঠাক কাজ করে।”
গেঁটে পঞ্চান্ন আবার ফুট কাটলো, “সকালে এক গেলাস চিরতার জল দারুণ কাজ করে”
কিন্তু আমি ডিফেন্সলেস। তাই মাথা নেড়ে ওদের কথা মেনে নিলাম।
নিচে তখনও অচলদা ছোকরার ক্লাস নিচ্ছে। কেন সে অচলদার পা ধরে টেনেছে।
বললাম “অচলদা ছেড়ে দিন। বাচ্ছা ছেলে। এক্সপেরিয়েন্স কম। শিখে যাবে।”
“কি শিখে যাবে? কোন পা-টা ধরে টানা উচিত? পা টানার জন্য এক্সপেরিএন্সে লাগে নাকি?”
ঠিক কথা। ওটা বাঙ্গালির জন্মগত অধিকার। মানে লেগ পুলিং আর কি।
“খেঁচে যাচ্ছেন কেন? ফিলসফিকালি বলছিলাম আরকি”
“পেটভর্তি থাকলে অনেক ফিলসফি ঝাড়া যায়। শালা এত কষ্ট করে, বেঁকেচুরে দাঁড়িয়ে, হাত অবশ করেও খিচুড়ির কিছু হতে দিইনি। আর এই হারা – “
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “আহ! মন্দিরে আবার এসব কি ভাষা !”
বউ বললে “মা দুগগা তোমাকে বাঁচিয়েছেন। ভোগ মাটিতে পড়া কিন্তু পাপ”
“না , কোনও পাপ হয়নি। ভোগ মাটিতে পড়েনি। সমস্তটাই আমার গামবুটে।”
“ইস। কি হবে এখন? আর তো ফেরত নেবে না। তখনই বললাম ধুতির তলায় গামবুট কেউ পরে? বুদ্ধি করে পাজামা বা জিন্স পরলে খিচুড়ি ঢুকতে পারতো না”
নিচ থেকে ক্ষীণ স্বরে অচলদার দাবি “আমি কিন্তু জিন্স পরেছি–তাও কি কিছু আটকাতে পারলাম। কপাল ভাই কপাল।”
“অচলদার থেকে কিছু শেখো”।
“এই যে অচলদা, এবারে প্লেট ছেড়ে দিন। ওতে কিছু নেই। বরং সাধের জিন্সটা দুহাতে কষে চেপে ধরে উঠে পড়ুন। জিন্সের বোতাম নেই খেয়াল আছে তো?”
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার বউ আমার হাত ধরে বাই বাই করে দৌড় দিয়েছেন। সিট খালি পাওয়া গেছে অবশেষে। হাত চেটে ভোগ খাওয়ার সময় আগত। চারপাশ থেকে তীর বেগে সবাই নিমেষে জায়গা বদল করে ফেললেন। আমি পেয়ে গেলাম আমার চেয়ার। একেবারে অঞ্জুবউদির শাশুড়ির পাশে। হাফ ছেড়ে একগাল হেসে “কেমন আছেন” বলে বসতে গেছি অমনি জেহাদি ভড়কে দিলো “আপনি বসছেন কেন? আপনার তো খাওয়া শেষ। উঠুন এখান থেকে।”
হ্যাঁ তাই তো। আমার প্লেটে কিছুই পড়ে নেই
বউ বললে “এই জন্যই বলেছিলাম লোভ সম্বরণ করতে শেখো।”
আমি শুধু সারাজীবন শিখেই যাই। কান গরম হবার জোগাড়। “আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?”
কেতাবি ঘায়ে নুনের ছেটা দিলো “বললাম দাদা জলটা খেয়ে নিতে – পিত্তি পড়ে যেত – তাহলে এখানে বসেই খেতে পারতেন” – শালা সবজান্তা টেকো পারভারট!
হঠাৎ চোখ গেল অঞ্জুবউদির শাশুড়ির দিকে। এ কি দেখি? শাশুড়ি তার রুমালের মধ্যে থেকে কী একটা বার করে অঞ্জুবউদির হাতে দিচ্ছেন। “বউমা, তোমার হিয়ারিং এডটা ফেলে গেছিলে”।
বউমা অর্থাৎ আমাদের অঞ্জুদি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। “তাই জন্যই ব্লুটুথ লাগিয়েও একটা গানও শুনতে পারছিলাম না। সেটি কানে পরেই আমার ইস্তিরি কে জিজ্ঞেস করলেন “ কি বলছিলি রে তুই?” আমার মুখ দিয়ে পঞ্চান্নর মতন একটা হাসি বেরোল। অঞ্জুবউদি আমার সম্বন্ধে কোনও কথা শোনেননি।
আমি হাততালি দিয়ে উঠলাম। পঞ্চান্ন কিছু একটা ফুট কাটার চেষ্টা করছিল। আমি তখন ওসব তোয়াক্কা না করে একেবারে অঞ্জুবউদির সামনে। অঞ্জুবউদি সবে হিয়ারিং এডটা কানে পরেছেন। আমি চোখে চোখ রেখে বললাম “অঞ্জুবউদি আই … মানে … উই লাভ ইউ!”
অঞ্জুবউদি একটু ঘাবড়ে গিয়ে তার সফেদ রঙ করা দাঁতে লাবড়ার আলু কামড়ে বললে “সেম টু ইউ”। আর আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম আমার বউটির পাশে। নিশ্চিন্তে। চাকরিটা বেঁচে গেল এই যাত্রায়।
ইতিমধ্যে মন্ত্রের আবার বিরতি ঘটিয়ে লাউড স্পিকারে স্বামীজিদের অক্লান্ত প্রচেষ্টাকৃত গান। উল্টোদিকে বসা খোকা তার জেহাদি বাপকে জিজ্ঞেস করলে “ড্যাড, ‘যা দেবি’ বন্ধ?”। জেহাদি আদমি আমারই টেবিলে। তার ভার্যা তারই পাশে আরও দুটিকে কোলে নিয়ে। জেহাদির জেহাদ এইসব মন্ত্রের খুঁটিনাটির ঊধ্বএ। তাই দুতিনবার চেষ্টার পরেও জুতসই উত্তর না দিতে পেরে খোকাকেই এক ধমক দিয়ে দিলো। জেহাদি খোকাও বাপ কা বেটা। ধমক খেয়ে তার জেহাদি ক্রন্দন। কেতাবি টেকো মাঝবয়সি জেহাদি ব্যাটাকে বললে “’যা দেবি’ আবার হবে বাবা। এখন কমার্শিয়াল ব্রেক। স্বামীজিদের এডভারটাইজমেন্ট হচ্ছে সোনা।”
খোকা বাপের দিকে চাইল। বোধহয় কনফারমেশানের জন্যে।
“ধুর, আমি কি জানি? কাকুরা সব জানে” এর পরে শিশু সমেত ভার্যাকে আক্রমণ, “শালা এই বজ্জাতের এই সব বিটকেল কয়েশ্ছেন নিশ্চয় তোমার বাপের বাড়ি থেকে শিখে এসেছে। ওরা তো সব ব্রিগেড যায়।”
ভার্যার ডিফেন্স, “সেটা তুমিও তো করলে পারতে। বাড়িতে থাকলেই ফি বছর একটা করে কোলে ধরাচ্ছ!”
যাহ! পাব্লিক প্লেসে এই প্রথম দেখলাম জেহাদি হয়ে গেল ইঁদুর। আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল, “এ সব আমাদের চলে। সবে তিন বছর সংসার। আপনাদের কতদিন?”
আমি মুখ খোলার আগেই আমার স্ত্রী তার কনুইয়ের গুঁতায় আমাকে থামালেও অঞ্জুবউদিকে আটকানো গেলনা।
“ফোর ইয়ার্স অ্যান্ড রানিং”
“ছেলেপুলে?”
কেউ উত্তর দিলো না।
“হ্যাপিলি ম্যারেড?”
জেহাদি নিজের বউয়ের ঝাল সামলাতে না পেরে আমাকে টার্গেট করছে। তবে আমার উত্তরের আগেই দেখি এক ছোকরা আমাদের টেবিলে হাজির। সে জেহাদিকে বললে “আপনি এক নম্বরের গাম্বাট মশাই। দেখছেন না দাদা-বউদির কী প্রেম? দাদা কেমন পাশে দাঁড়িয়ে বউদির চাটনি তেলয়ে চেটে খাচ্ছে?”
“এই তুমি কে?”
“চিনতে পারলেন না? আমি আপনার ঠ্যাং ঠিক করে দিলাম মনে নেই?”
সড়াৎ করে আমার হাত আমার বউয়ের প্লেট থেকে সরিয়ে ফেললাম। চাটনিটা আমার ফেভারিট। তাই ওরটাও জমিয়ে চাটছিলাম।
“এদিকে চলে এসো। এখানে একটা সিট খালি আছে।” দূরের একটা টেবিল থেকে অচলদা আমাকে ডাকছে। আমি বসার জন্য খালি সিটের দিকে দৌড়তেই মনে হোল আমার হাত ধরে কে টানছে। তারপর অঞ্জুবউদি, জেহাদি, ছোকরা আর পঞ্চান্নর মিলিত স্বর। “আরে কি হোল আপনার , অগ্যান হয়ে গেলেন নাকি।” আমি নিথর দাঁড়িয়ে, আমার বউ মাটিতে পড়ে। কেতাবি জলের গ্লাস থেকে ওর মুখে জল ছেটাচ্ছে। জেহাদি ভার্যা হাওয়া করছে। পঞ্চান্ন যেন বাবার মতন মাথায় হাত বোলাচ্ছে। জেহাদি ছোট শিশুর মতন আমার বউয়ের দিকে চেয়ে। ছোকরা ছুটেছে ফার্স্ট এইড বক্সের জন্য। আমার সম্বিত ফিরতে কিছু সময় লাগলো। ছোকরা ফার্স্ট এইড বক্সের থেকে কিছু একটা ওর নাকে শোঁকালো। আমার বউ চোখ মেলে তাকাল। আমাকে কিছুই করতে হোল না। জুটে গেলে সং জুটে যায় এই পৃথিবীতে। কেমন যেন বুকটা ছ্যাঁক করে উঠলো। এবারে দত্তকের ব্যাপারটা বউয়ের সাথে ফাইনাল করে ফেলতে হবে।
“কি হয়েছিলো আমার?”
আমি বললাম “চলো এবারে বেরোই। কথা আছে। মাসিমা, অঞ্জুবউদি আসি। আর আপনাদেরও বলছি। আবার দেখা হবে বন্ধু। “
মাসিমা বলে উঠলেন “কাল তাড়াতাড়ি চলে এসো কিন্তু”
জেহাদি বলে উঠল “শুভ অষ্টমী”
অঞ্জুবউদি জিজ্ঞেস করলো “গাড়ি কোথায় পার্ক করলে এবার”
আমার বউ আবার আমার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে গেছিলো। আমি ওকে থামিয়ে দিলাম।
“বেশি দুর নয় – “
ছোকরা বলে উঠল “জানি – শপিং কমপ্লেক্সটায়”
আমি সবাইকে বললাম “চলি”
বউ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে। প্রশ্ন করলো “কি ব্যাপার? কি হয়েছে? তোমাকে অন্যরকম লাগছে কেন?”
ওর কাছে গিয়ে বললাম “কথায় কথায় আমাদের এই সারাদিনের উপোসের ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। দত্তক নিলে ক্ষতি কি?”
বউ কিছু বলতে গিয়েও বললে না।
মাসিমা বললেন “চলি বলতে নেই, বল আসি”
ছোকরা জোর করলো “দাদা, আপনি মাইরি বউদির এই ব্যাপারটা সেন্টুতে নিয়ে নিয়েছেন মনে হচ্ছে। আরে, চাবিটা দিননা, গাড়ি এনে দিচ্ছি। অতটা হাঁটতে হবে না। আপনি বরং কয়েকটা পাঁপড় মেরে দিন ততক্ষণে।”
“আরে না না – “
“ধুর দিন তো – “ বলে পিঠে-নাক-ঘষা ছোকরা আমার হাত থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে নিমেষে উধাও।
পঞ্চান্ন গলা নামিয়ে আবদার করলে “আচ্ছা, প্রিন্সটন দিয়ে ফিরবেন কি? তাহলে আমাকে একটু ৫১৮ আর ২০৬ এর ক্রসিং এ ছেড়ে দেবেন প্লিজ?”
আমি পঞ্চান্নর হাত ধরে বললাম “কি যাতা বলছেন? আরে আমি জানি ওরা গাড়ি কোথায় নিয়ে যায়। চলুন গিয়ে নিয়ে আসি। এখনও খোলা আছে। হতে পারে এবারেও বলে কয়ে – “
বউয়ের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম এক তৃপ্তির হাসি। আমরা সবাই হেসে উঠলাম।
অঞ্জুবউদি বললে “তুমি ওনাকে নিয়ে যাও। তোমাদের ফিরতে রাত হবে। আমি তোমার এই মিষ্টি বউকে নামিয়ে দিচ্ছি”
কেতাবি খেজুর করলো “আমার গাড়ি কিন্তু দাদা – “
আমি আর রাগতে পারলাম না। আমাকে আর আকেলা দেড় মেইল হাঁটতে হোল না। আবার মনে হোল জুটে গেলেই সব জুটে যায়। মন্দিরে ভিড় তখন অনেকটাই হালকা। ভেতর থেকে ওঙ্কারদা জিজ্ঞেস করলো “একটু বোঁদে চলবে নাকি?”
“চলবে মানে, শালা, দৌড়বে”
“আবার মন্দিরে তুমি শালা বললে?”
“অনলি লাভিং অয়াইফ। নো শালা বিজনেস। আই এম কামিং ইউ বোঁদে”
জেহাদি খোকা হঠাৎ চিৎকার করলে “ড্যাডি ‘যা দেবি’ হচ্ছে”
আমার বউ গলা নামিয়ে আমাকে বললে “এবারে হয়নি যেটা হবার। দত্তক হয়ত নাও নিতে হতে পারে”
“হ্যাঁ সেকি? আমি ঠিক শুনছি? আরে বল না , ঠিক শুনছি”
“হ্যাঁ তুমি ঠিকই শুনছো – দত্তক নেবার দরকার নেই – উপোসে কাজ হয়েছে”
সে উপোসে হোক আর না হোক। আমি চিৎকার করে ফেললাম।
“যা দেবি – যা দেবি ”
কেউ কিছু সেরকম বুঝতে না পেরেও বলে উঠলো “যা দেবি – যা দেবি”
মাটিতে বসে পড়লাম কখন কেন জানি না। আমার বউকে তখন মা দুর্গার মতন লাগছে। আমি ওর পা জড়িয়ে ধরলাম।
ঠিক তখনই কমার্শিয়াল ব্রেকের পর স্পিকারে ভেসে এলো –
“যা দেবী সর্বভুতেষূ শক্তি রুপেনা সংস্থিতা …. নমস্ততসই নমস্ততসই নমস্ততসই নম নমহা”
ছবি: অদ্রীশ সিংহ